ضعيف এর আভিধানিক অর্থ দুর্বল। ইমাম নববী [রহ:]বলেন, যে হাদীছে সহীহ ও হাসান হাদিসের শর্তসমূহ পাওয়া যায় না, তাকেই যঈফ হাদিস বলে।[ইমাম নববী, মুক্বাদ্দামাহ মুসলিম পৃঃ ১৭]
মোটকথা যয়ীফ ওই সকল হাদিসকে বলা হয়, যার মধ্যে সহীহ এবং হাসানের শর্তগুলো পরিপূর্ণরূপে বিদ্যমান থাকবে না। অর্থাৎ, রাবীর বিশ্বস্ততার ঘাটতি, বা তাঁর বিশুদ্ধ হাদীস বর্ণনা বা স্মৃতির ঘাটতি, বা সনদের মধ্যে কোন একজন রাবী তাঁর ঊর্ধ্বতন রাবী থেকে সরাসরি ও স্বকর্ণে শোনেননি বলে প্রমানিত হওয়া বা দৃঢ় সন্দেহ হওয়া, বা অন্যান্য প্রমানিত হাদীসের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়া, অথবা সূক্ষ্ম কোন সনদগত বা অর্থগত ত্রুটি থাকা ইত্যাদি যে কোন একটি বিষয় কোন হাদীসের মধ্যে বিদ্যমান থাকলে ঐ হাদিসটি যঈফ বলে গণ্য।
◼️জয়ীফ/দুর্বল হাদীস কি আমলযোগ্য?
কিছু মুহাদ্দিস বা আলেম ইবাদতের প্রতি আগ্রহ ও জাহান্নাম থেকে সতর্ক করার নিমিত্তে কতিপয় শর্তসাপেক্ষে দ্বা‘ঈফ হাদিস বর্ননা ও এর উপর আমল করা বৈধ বলেছেন যেমন:
▪️১. দ্বা‘ঈফ হাদিস ইবাদতের প্রতি আগ্রহ ও পাপ থেকে সতর্ককারী সম্পর্কিত হওয়া।
▪️২. কঠিন দ্বা‘ঈফ না হওয়া। অর্থাৎ শরীয়তের মূলনীতির সাথে সাংঘর্ষিক না হওয়া
▪️৩. দ্বা‘ঈফ হাদিসের মূল বিষয় কুরআন বা সুন্নায় মওজুদ থাকা।
▪️৪. হালাল-হারাম সংক্রান্ত না হওয়া।
▪️৫. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন দ্বা‘ঈফ হাদিসের ক্ষেত্রে বিশ্বাস না করা। এ চারটি শর্তে দ্বা‘ঈফ হাদিসের উপর আমল করা বৈধ।
.
তবে জমহুর ওলামাদের বিশুদ্ধ মতে যঈফ বা দুর্বল হাদিস কখনোই আমালযোগ্য বা গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং যঈফ বা দুর্বল প্রমাণিত হয়ে যাওয়ার পরও তার উপর আমল করা নিঃসন্দেহে গর্হিত কাজ। এ মতের পক্ষে ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম, ইয়াহইয়া ইবনু মাঈন, ইবনুল ‘আরাবী, ইবনু হাযম, ইবনু তায়মিয়াহ প্রমুখ শীর্ষস্থানীয় মুহাদ্দিছগণ সকল ক্ষেত্রে যঈফ হাদিস বর্জনযোগ্য বলেছেন[দ্রঃ জামালুদ্দীন ক্বাসেমী, ক্বাওয়াইদুত তাহদীছ; আশরাফ বিন সাঈদ, হুকমুল ‘আমাল বিল হাদীসিয যঈফ]
◼️দ্বা‘ঈফ হাদিসের উপর কোনো অবস্থাতেই আমল করা বৈধ নয়,কয়েকটি কারণ:
▪️১. দ্বা‘ঈফ হাদিসের উপর আমল করার অর্থ সন্দেহ বা ধারণার উপর আমল করা, রাসূল সাঃ বলেছেন যে লোক এই সন্দেহজনক বিষয়গুলো নিজের দ্বীন এবং মান-ইজ্জাতের হিফাযাতের উদ্দেশ্যে ছেড়ে দেবে সে নিরাপদ হল। যে লোক এর কিছুতে লিপ্ত হল তার হারাম কাজে লিপ্ত হওয়ারও সংশয় থেকে গেল[আত-তিরমিজি ১২০৫]
▪️২. দ্বা‘ঈফ হাদিস দ্বারা মোস্তাহাব বা মাকরুহ প্রমাণিত হয় না, অতএব তার দ্বারা কিভাবে ফযিলত প্রমাণিত হয়।
▪️৩. সমাজে দ্বা‘ঈফ হাদিসের কু-প্রভাব বন্ধের নিমিত্তে তার উপর আমল নিষিদ্ধ করা জরুরি। ফযিলত অধ্যায়ে দুর্বল হাদিস বলার অজুহাতে অনেক খতিব ও বক্তা ওয়াজে,মসজিদে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে নিজেদের স্বার্থে জাল হাদিস পর্যন্ত বর্ণনা করেন, যা পরিহার করা জরুরি।
▪️৪. দ্বা‘ঈফ হাদিসের উপর আমল করা হলে সহীহ হাদিস সুরক্ষায় মুহাদ্দিসদের প্রচেষ্টাকে অবজ্ঞা করা হয়,যা মোটেও কাম্য নয়।
▪️৫. একমাত্র জাল জয়ীফ হাদিস বর্ননা, প্রচার এবং এগুলোর উপর আমল করার কারনে সমাজ আজ মানুষের মধ্যে বিদআত চর্চা এবং নানা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে সাধারণ মানুষ বলে একেক আলেম একটা বলে আমরা যাবো কোন দিকে।
▪️৬. আমরা যেহেতু প্রত্যেক প্রকার সহীহ ও হাসান হাদিসের উপর আমল করতে পারিনি, তবু কেন দুর্বল হাদিসের উপর আমল করব।
অতএব দ্বা‘ঈফ প্রচার করা, শিক্ষা দেওয়া ও তার উপর আমল করা দুরস্ত নয়। তবে প্রয়োজন হলে দুর্বলতা প্রকাশ করে দ্বা‘ঈফ বলা বৈধ, কারণ দুর্বলতা প্রকাশ করা ব্যতীত দ্বা‘ঈফ বলা নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর মিথ্যারোপ করার শামিল।
মুগীরাহ ইবনু শু‘বা [রাযিয়াল্লাহু আনহু] বলেন, নবী (ﷺ)বলেছেন,আমার পক্ষ হতে যে লোক কোন হাদীছ বর্ণনা করে অথচ সে জানে যে, তা মিথ্যা, তাহলে সে মিথ্যুকদের একজন’[তিরমিযী, হা/২৬৬২; মুসলিম মুক্বাদামাহ্, ইবনু মাজাহ, হা/৪১]
সালামাহ ইবনু আক্ওয়া‘[রাযিয়াল্লাহু আনহু] বলেন, আমি নবী (ﷺ)-কে বলতে শুনেছি, ‘যে ব্যক্তি আমার উপর এমন কথা আরোপ করে যা আমি বলিনি, সে যেন তার ঠিকানা জাহান্নামে বানিয়ে নেয়’ [ছহীহ বুখারী, হা/১০৯, ১০৬]
আবূ হুরায়রাহ্ [রাঃ] বলেন রসূলুল্লাহ [সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম] বলেছেন: কোন লোকের মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে যা শুনে [সত্যতা যাচাই না করে] তা-ই বলে বেড়ায়।[সহীহ মুসলিম ৫, ইবনু আবী শায়বাহ্ ২৫৬১৭,মিশকাতুল
মাসাবিহ, হাদিস নং ১৫৬]
◼️জয়ীফ হাদিস বর্জনীয় মর্মে সালফে সালেহীনের মানহাজের যুগ শ্রেষ্ঠ কয়েকজন ইমামের মন্তব্যঃ
1️⃣মুহাদ্দিছ যায়েদ বিন আসলাম বলেন, ﻣَﻦْ ﻋَﻤِﻞَ ﺑِﺨَﺒْﺮٍ ﺻَﺢَّ ﺃَﻧَّﻪُ ﻛِﺬْﺏٌ ﻓَﻬُﻮَ ﻣِﻦْ ﺧَﺪَﻡِ ﺍﻟﺸَّﻴْﻄَﺎﻥِ . ‘হাদীছ মিথ্যা প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও যে তার উপর আমল করে সে শয়তানের খাদেম’[মুহাম্মাদ তাহের পাট্টানী, তাযকিরাতুল মাওযূ‘আত [বৈরুত : দারুল এহইয়াইত তুরাছ আল-আরাবী, ১৯৯৫/১৪১৫ পৃঃ ৭; ড. ওমর ইবনু হাসান ফালাতাহ, আল-ওয়ায‘উ ফিল হাদীছ [দিমাষ্ক : মাকতাবাতুল গাযালী, ১৯৮১/১৪০১ ১ম খন্ড, পৃঃ ৩৩৩]
2️⃣শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ [রাহিমাহুল্লাহ] বলেন, ‘শরী‘আতের কোন বিষয়ে ছহীহ ও হাসান হাদীছ ব্যতীত যঈফ বা দুর্বল হাদিসের উপর নির্ভর করা জায়েয নয়’[মাজমূঊল ফাতাওয়া, ১/২৫০ পৃ.]
3️⃣ইবনুল ‘আরাবী [রাহিমাহুল্লাহ] বলেন, ‘যঈফ হাদিসের উপর আমল করা সম্পূর্ণরূপে নাজায়েয’[তাদরীবুর রাবী, ১/২৫২ পৃ.] আর এই মতটিকেই ইমাম মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী [রাহিমাহুল্লাহ]গ্রহণ করেছেন [সহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, ১/৪৭-৬৭; তামামুল মিন্না, পৃ. ৩৬]
4️⃣শায়খ ইবনে উছাইমীন [রাহিমাহুল্লাহ] বলেন, যঈফ হাদিসকে দলীল হিসাবে গ্রহণ করা যাবে না এবং তাকে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নামের সঙ্গে সম্পৃক্তও করা যাবে না…[উসাইমীন, ফাতাওয়া নূরুন ‘আলাদ দারব, টেপ নং ২৭৬]
5️⃣শায়খ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) বলেন, ‘যঈফ হাদিস অতিরিক্ত ধারণার ফায়েদা দেয় মাত্র। তবে এ বিষয়ে সকল বিদ্বান একমত যে, আহকাম ও ফাযায়েল কোন বিষয়েই যঈফ হাদিসের উপর আমল করা বৈধ নয়’ [তামামুল মিন্নাহ ৩৪ পৃঃ]
.
অবশেষে আমাদের আহ্বান, রাসূল [সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম] এবং তার সাহাবীদের থেকে বিশুদ্ধ সনদে অনুসরণীয় অনুকরণীয় আমল ও ফযীলতে যত সহীহ হাদীস মুহাদ্দিসগনের কিতাবে বিদ্যামান রয়েছে একজন মুসলিম যদি জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সেগুলোর প্রতি আমল করে তারপরও সব হাদিস শেষ করতে পারবে না। তাহলে সন্দেহপ্রবণ যঈফ বা দুর্বল হাদীসের দিকে যাওয়ার দরকারটা কি?প্রশ্ন রইল পাঠকদের কাছে।মহান আল্লাহ আমাদেরকে জাল যঈফ হাদিস বর্জন করে কুরআন ও সহীহ হাদিস অনুযায়ী আমল করার তৌফিক দান করুক আমীন। আল্লাহু আলাম।
_______________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।