মুসলিমদের মধ্যে আক্বীদা ও মানহাজের ক্ষেত্রে মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তাদের মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব কি

সারসংক্ষেপ: এই আলোচনার সারসংক্ষেপ এই যে বিশুদ্ধ আকিদা ও সহীহ তাওহীদের ভিত্তি ছাড়া মুসলিমদের মাঝে প্রকৃত ঐক্য সম্ভব নয়।

বিস্তারিত দলিলসহ: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। আমাদের নবী মুহাম্মদের প্রতি, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাহাবীগণের প্রতি আল্লাহর রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক। অতঃপর বিশুদ্ধ আকীদা ও তাওহীদের ভিত্তি ছাড়া মুসলিমদের মাঝে প্রকৃত ঐক্য কখনোই প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। ইসলামে বাহ্যিক কিছু বিষয়ে যেমন: এক কিবলা, এক কুরআন, হজ্জের জন্য এক স্থান নির্ধারিত। এসবের মধ্যে ঐকমত্য থাকলেও, যদি আক্বীদা ও মানহাজে ঐক্য না থাকে, তবে সত্যিকার অর্থে ঐক্যবদ্ধ হওয়া সম্ভব নয়। ঐক্য তখনই স্থায়ী ও ফলপ্রসূ হয়, যখন তা তাওহীদ, নবুওয়তের পথে অনুসরণ এবং কুরআন সুন্নাহ’র সহীহ বুঝের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। আক্বীদাগত বিভ্রান্তি ও মানহাজগত বিচ্যুতি নিয়ে গঠিত সমাজে বাহ্যিক ঐক্য যতই প্রচার করা হোক না কেন, তা এক প্রতারণা ছাড়া কিছুই না। মূলত আক্বীদাগত ভ্রান্ত মতাদর্শের লোকদের সাথে ঐক্য নয়, বরং বিশেষ প্রয়োজনে চুক্তি বা সমঝোতা হয়…। আমরা যদি এই বিষয়ে বিস্তারিত বলতে চাই তাহলে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট উল্লেখ করতে হবে আর হা হচ্ছে:
.
প্রথমত: আক্বীদা ও মানহাজের বিষয়ে মানুষের মধ্যে মতভেদ হওয়া একটি স্বাভাবিক বিষয়। আল্লাহ তাআলা স্বয়ং তাঁর সৃষ্টির মাঝে এই মতবিরোধ সংঘটিত হওয়ার কথা জানিয়েছেন। একইসাথে তিনি এটাও বলেছেন, চাইলে তিনি সকল মানুষকে একই দ্বীনের ওপর একত্রিত করতে পারতেন। তবে তিনি তা করেননি, কেননা এর পেছনে রয়েছে তাঁর পরিপূর্ণ হিকমত। এই হিকমতের অন্তর্গত উদ্দেশ্য হলো তিনি যাতে তাওহীদে অটল, আনুগত্যশীল বান্দাদেরকে তার কর্মের উত্তম প্রতিদান দিতে পারেন এবং অপরাধী, কা-ফের ও মুশ-রিকদের মুনাফিকদেরকে শাস্তি দিতে পারেন। যদি তিনি সবাইকে এক পথের ওপর একত্রিত করতে চাইতেন, তাহলে তিনি তাওহীদবাদীদের শ্রেষ্ঠত্ব বর্ণনা করতেন না, এবং পাপ ও পাপীদের শাস্তির কথাও বলতেন না।আল্লাহ তাআলার সুন্দর নামসমূহ ও গুণাবলির একটি বাস্তব দাবি হলো তিনি সৃষ্টির মাঝে ইখতিলাফ সৃষ্টি করেছেন, যাতে তাঁর হিকমত পরিপূর্ণতা লাভ করে।আল্লাহ তাআলা বলেন:وَ لَوۡ شَآءَ رَبُّكَ لَجَعَلَ النَّاسَ اُمَّۃً وَّاحِدَۃً وَّ لَا یَزَالُوۡنَ مُخۡتَلِفِیۡنَ، اِلَّا مَنۡ رَّحِمَ رَبُّكَ ؕ وَ لِذٰلِكَ خَلَقَهُمۡ ؕ وَ تَمَّتۡ كَلِمَۃُ رَبِّكَ لَاَمۡلَـَٔنَّ جَهَنَّمَ مِنَ الۡجِنَّۃِ وَ النَّاسِ اَجۡمَعِیۡنَ”আর আপনার রব ইচ্ছা করলে সব মানুষকে একটি জাতি বানাতে পারতেন; কিন্তু তারা সদা মতভেদে লিপ্তই থাকবে তাদের ব্যতীত, যাদের প্রতি আপনার রব দয়া করেছেন। আর এজন্যই তিনি তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। আপনার প্রভুর বাণী পূর্ণ হয়েছে যে, ‘আমি অবশ্যই জাহান্নাম পূর্ণ করব জিন ও মানুষ উভয় প্রকারের (অপরাধী) দ্বারা।”(সূরা হুদ, আয়াত: ১১৮-১১৯)
.
সূরা হুদের ১১৮-১১৯ নং আয়াতের তাফসিরে ইবনে জারির আত-তাবারী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত:৩১০ হি.] বলেন:يقول تعالى ذِكره : ولو شاء ربك ، يا محمد ، لجعل الناس كلها جماعة واحدة ، على ملة واحدة ، ودين واحد “আল্লাহ তাআলা তাঁর বানী কুরআনে বলেন: হে মুহাম্মদ! যদি আপনার প্রতিপালক ইচ্ছা করতেন, তাহলে তিনি সকল মানুষকে একই জামাআতে, একই জাতিতে এবং একই দ্বীনের ওপরে একত্রিত করতেন”।(তাফসীরে ত্ববারী; খন্ড: ১৫; পৃষ্ঠা: ৫৩১) ইমাম ইবনু কাসীর (রাহিমাহুল্লাহ) [জন্ম:৭০১ মৃত: ৭৭৪ হি.] বলেন:يخبر تعالى أنه قادر على جعل الناس كُلِّهم أمَّةً واحدة ، من إيمان أو كفران ، كما قال تعالى : ( وَلَوْ شَاءَ رَبُّكَ لآمَنَ مَنْ فِي الأرْضِ كُلُّهُمْ جَمِيعًا ) يونس / 99 ، وقوله : ( وَلا يَزَالُونَ مُخْتَلِفِينَ إِلا مَنْ رَحِمَ رَبُّكَ ) أي : ولا يزال الخُلْفُ بين الناس في أديانهم ، واعتقادات مللهم ، ونِحلهم ، ومذاهبهم ، وآرائهم.”আল্লাহ তাআলা জানিয়ে দিচ্ছেন যে, তিনি চান তো সমস্ত মানুষকে হোক তারা মু’মিন কিংবা কাফির একটিমাত্র উম্মত বানিয়ে দিতে সক্ষম। যেমন তিনি বলেছেন: “আর যদি আপনার রব ইচ্ছা করতেন, তাহলে যমীনের সকলেই একসাথে ঈমান আনত” (সূরা ইউনুস: ৯৯)। আর তিনি বলেন: “তারা সদা পরস্পর ভিন্নমতাবলম্বীই থেকে যাবে, তবে তারা নয় যাদের প্রতি আপনার রব রহম করেছেন” (সূরা হূদ: ১১৮-১১৯)। অর্থাৎ, মানুষের মধ্যে তাদের দ্বীন, আকীদা, ধর্মমত, মাজহাব এবং মতামতের ক্ষেত্রে মতভেদ ও বিরোধ লেগেই থাকবে।”(তাফসির ইবনে কাসীর; খন্ড: ৪; পৃষ্ঠা:৩৬১)
.
সৌদি আরবের প্রথিতযশা মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ ইমাম ‘আব্দুর রহমান বিন নাসির আস-সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৩৭৬ হি./১৯৫৬ খ্রি.] বলেছেন,” يخبر تعالى أنه لو شاء لجعل الناس كلهم أمة واحدة على الدين الإسلامي ، فإن مشيئته غير قاصرة ، ولا يمتنع عليه شيء ، ولكنه اقتضت حكمته أن لا يزالوا مختلفين ، مخالفين للصراط المستقيم ، متبعين للسبل الموصلة إلى النار ، كل يرى الحق فيما قاله ، والضلال في قول غيره .( إِلا مَنْ رَحِمَ رَبُّكَ ) فهداهم إلى العلم بالحق والعمل به ، والاتفاق عليه ، فهؤلاء سبقت لهم سابقة السعادة ، وتداركتهم العناية الربانية والتوفيق الإلهي .
وأما من عداهم : فهم مخذولون ، موكولون إلى أنفسهم .
وقوله : ( وَلِذَلِكَ خَلَقَهُمْ ) أي : اقتضت حكمته أنه خلقهم ، ليكون منهم السعداء والأشقياء ، والمتفقون والمختلفون ، والفريق الذين هدى الله ، والفريق الذين حقت عليهم الضلالة ، ليتبين للعباد عدلُه ، وحكمتُه ، وليظهر ما كمن في الطباع البشرية من الخير والشر ، ولتقوم سوق الجهاد والعبادات التي لا تتم ولا تستقيم إلا بالامتحان والابتلاء .

“আল্লাহ তাআলা জানাচ্ছেন যে, যদি তিনি ইচ্ছা করতেন, তাহলে সকল মানুষকে একটিমাত্র উম্মত একই ইসলামের ওপর প্রতিষ্ঠিত করে দিতেন। কেননা তাঁর ইচ্ছাশক্তি সীমাবদ্ধ নয় এবং তাঁর পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়। কিন্তু তাঁর হিকমতের দাবিই হলো এই যে, মানুষ সবসময়ই মতভেদে লিপ্ত থাকবে, সোজা পথে না চলে বিভিন্ন বিভ্রান্তিকর পথে চলবে, যা মানুষকে জাহান্নামের দিকে নিয়ে যায়।প্রত্যেকে মনে করবে, সে যা বলছে সেটাই সঠিক এবং অন্যরা যা বলছে তা ভ্রষ্টতা।(আয়াতের পরের অংশে) “তবে যাদের প্রতি তোমার প্রতিপালকের রহমত হয়েছে” অর্থাৎ তিনি তাদেরকে সত্যকে জানা, সে অনুযায়ী আমল করা এবং তাতে ঐক্যমত প্রতিষ্ঠার তাওফিক দিয়েছেন। এরা সেইসব সৌভাগ্যবান, যাদের জন্য সৌভাগ্যের ঘোষণা পূর্বেই নির্ধারিত হয়েছে, এবং যারা প্রভুর বিশেষ তত্ত্বাবধান ও ইলাহী সাহায্য দ্বারা কৃতার্থ হয়েছেন। আর তাদের বাইরে যারা রয়েছে, তারা হলো পরিত্যক্ত, যাদেরকে তাদের নিজ নিজ প্রবৃত্তির ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আর তাঁর বাণী: “এবং এজন্যই তিনি তাদের সৃষ্টি করেছেন” এর অর্থ হলো, আল্লাহর হিকমত এটাই নির্দেশ করেছে যে, তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তাদের মধ্য থেকে কেউ হবে সৌভাগ্যবান, কেউ হবে হতভাগা; কেউ হবে একমত, আবার কেউ মতবিরোধ করবে; কেউ থাকবে হেদায়াতপ্রাপ্ত, আবার কেউ থাকবে বিভ্রান্ত। এর দ্বারা আল্লাহ বান্দাদের জন্য তাঁর ন্যায়বিচার ও হিকমত প্রকাশ করেন। মানব প্রকৃতির ভেতরে লুকিয়ে থাকা ভালো ও মন্দ প্রকাশিত হয়। আর জিহাদ ও ইবাদতের ক্ষেত্র তৈরি হয়, যেগুলো পরীক্ষার ও বিপদের মাধ্যমে ছাড়া পূর্ণতা লাভ করে না।”।(তাফসির আস সাদী; পৃষ্ঠা: ৩৯২)
.
দ্বিতীয়ত: যখন তাওহিদ ও সঠিক আক্বীদা (বিশ্বাস) ইসলামী ঐক্যের মূল ভিত্তি, তখন এ দুটির বাইরে অন্য কোনো বিষয়ে মুসলিমদের একত্রিত করার চিন্তা কিভাবে গ্রহণযোগ্য হতে পারে?
.
মুসলিমদের বর্তমান অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলেই স্পষ্ট হয় প্রত্যেক ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠান, হোক তা মাদ্রাসা, স্কুল কিংবা কলেজ, ইসলামি বিধি বিধান পালনে ও শিক্ষাদানে নিজস্ব পদ্ধতি অনুসরণ করে চলে। ফলে মুসলিম সমাজে দেখা দিয়েছে মতভেদ, দলাদলি ও বিভক্তির প্রাচীর। অথচ যদি সবাই একটি পদ্ধতিতে, একটি সুনির্দিষ্ট মানদণ্ড অনুযায়ী ইসলামি বিধান মেনে চলত, তবে তারা একই আকীদার উপর ঐক্যবদ্ধ হতে পারত, গড়ে উঠত একটি একক জাতি হিসেবে। তারা যদি দল বা সংগঠনের নেতৃত্বের পরিবর্তে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেখানো তাওহীদের পথের প্রতি মনোযোগী হতো, তাহলে বিভাজনের পরিবর্তে হতো ঐক্য। কিন্তু তারা বরং মনোযোগ দিয়েছে ফিরকা ও মতবিরোধের দিকে। এক দল বলে, “ওদের কথা সঠিক নয়”, আরেক দল বলে, “এদের কথা ভুল” এইভাবে একে অপরকে অস্বীকার করতে করতে তারা মুসলিম সমাজকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছে।রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো নির্দিষ্ট জাতি, গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ের জন্য প্রেরিত হননি; বরং তিনি ছিলেন সমগ্র মানবজাতির জন্য। তিনি এসেছেন সাদা-কালো, ধনী-গরিব, নারী-পুরুষ, দাস-স্বাধীন সকল শ্রেণির মানুষের জন্য হিদায়াত নিয়ে। তিনি মানুষকে একত্রিত করেছিলেন কোরআন ও তাওহীদের ভিত্তিতে এক এমন পথ যা বিভেদ সৃষ্টি করে না, ভাষা, বর্ণ কিংবা জাতির ভিন্নতা এতে বাধা নয়। রাসূলের এই পদ্ধতি ছাড়া আর কোনো পথে সত্যিকারের কল্যাণ ও ঐক্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। কেউ যদি রাজনৈতিক ভিত্তিতে মুসলিমদের একত্রিত করার চেষ্টা করে, তবে তা হবে ক্ষণস্থায়ী ও মতবিরোধপূর্ণ, কারণ মতপার্থক্য সেখানে অনিবার্য। কিন্তু তাওহীদের ভিত্তিতে একত্রিত হলে যেখানে মূল হচ্ছে বিশুদ্ধ আক্বীদা তবেই সম্ভব প্রকৃত ঐক্য, আর তবেই সম্ভব ঈমানকে দৃঢ় ও অটল ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করা। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, মুসলিম উম্মাহ আগেও তখনই শক্তিশালী হয়েছিল, যখন তারা তাওহীদের উপর ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। সেই পথেই রয়েছে মুক্তি, অন্য কোনো স্বতন্ত্র পদ্ধতিতে নয়।
.
তৃতীয়ত: মুসলিম উম্মাহর বিভক্তির অন্যতম প্রধান একটি কারণ হলো নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য না দেখিয়ে ব্যক্তি মতকে প্রাধান্য দেওয়া, যার ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন ফেরকা ও বিভাজনের সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে আলেমগণ বিভিন্ন দিক থেকে বিশদ ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন।” ইমাম শাতিবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: উপর্যুক্ত বর্ণনার পর যে সকল মতভেদ দেখা দিয়েছে, তার তিনটি কারণ রয়েছে এগুলো কখনো কোন ব্যক্তির মাঝে একত্রে হতে পারে, আবার কখনো আলাদা-আলাদাও হতে পারে।”
.
:أحدها : أن يعتقد الإنسان في نفسه ، أو يُعتقد فيه أنه من أهل العلم ، والاجتهاد في الدين ، ولم يبلغ تلك الدرجة ، فيعمل على ذلك ، ويعد رأيَه رأياً ، وخلافَه خلافاً ، ولكن تارة يكون ذلك في جزئيٍّ ، وفرعٍ من الفروع ، وتارة يكون في كلِّي وأصلٍ من أصول الدين ، كان من الأصول الاعتقادية ، أو من الأصول العملية ، فتارة آخذاً ببعض جزئيات الشريعة في هدم كلياتها حتى يصير منها ما ظهر له بادىء رأيه من غير إحاطة بمعانيها ولا رسوخ في فهم مقاصدها ، وهذا هو المبتدع ، وعليه نبه الحديث الصحيح أنه صلى الله عليه وسلم قال : ( لا يقبض الله العلم انتزاعاً ينتزعه من الناس ، ولكن يقبض العلم بقبض العلماء ، حتى إذا لم يَبقَ عالمٌ اتخذ الناس رؤساء جهالاً فسئلوا فأفتوا بغير علم فضلوا وأضلوا ) .

والثاني من أسباب الخلاف : اتباع الهوى ، ولذلك سمِّي أهلُ البدع أهل الأهواء ؛ لأنهم اتبعوا أهواءهم ، فلم يأخذوا الأدلة الشرعية مأخذ الافتقار إليها ، والتعويل عليها حتى يصدروا عنها ، بل قدموا أهوءاهم ، واعتمدوا على آرائهم ، ثم جعلوا الأدلة الشرعية منظوراً فيها من وراء ذلك ، وأكثر هؤلاء هم أهل التحسين والتقبيح ، ومن مال إلى الفلاسفة ، وغيرهم ، ويدخل في غمارهم من كان منهم يخشى السلاطين لنيل ما عندهم ، أو طلباً للرياسة ، فلا بد أن يميل مع الناس بهواهم ، ويتأول عليهم فيما أرادوا حسبما ذكره العلماء ونقله من مصاحبي السلاطين ، فالأولون ردُّوا كثيراً من الأحاديث الصحيحة بعقولهم ، وأساؤوا الظن بما صح عن النبي صلى الله عليه وسلم ، وحسَّنوا ظنَّهم بآرائهم الفاسدة ، حتى ردوا كثيراً من أمور الآخرة وأحوالها ، من الصراط ، والميزان ، وحشر الأجساد ، والنعيم ، والعذاب الجسمي ، وأنكروا رؤية الباري ، وأشباه ذلك ، بل صيَّروا العقل شارعاً جاء الشرع أو لا ، بل إن جاء فهو كاشف لمقتضى ما حكم به العقل إلى غير ذلك من الشناعات .

والثالث من أسباب الخلاف : التصميم على اتباع العوائد وإن فسدت ، أو كانت مخالفة للحق ،وهو اتباع ما كان عليه الآباء ، والأشياخ ، وأشباه ذلك ، وهو التقليد المذموم ؛ فإن الله ذم ذلك في كتابه بقوله : ( إنا وجدنا آباءنا على أمة ) الآية ، ثم قال : ( قال أو لو جئتكم بأهدى مما وجدتم عليه آباءكم قالوا إنا بما أرسلتم به كافرون ) ، وقوله : هل يسمعونكم إذ تدعون . أو ينفعونكم أو يضرون ) فنبههم على وجه الدليل الواضح فاستمسكوا بمجرد تقليد الآباء ، فقالوا : ( بل وجدنا آباءنا كذلك يفعلون ) وهو مقتضى الحديث المتقدم أيضا في قوله : ( اتخذ الناس رؤساء جهالاً ) إلى آخره ، فإنه يشير إلى الاستنان بالرجال كيف كان .

প্রথম কারণ হলো: কেউ নিজের সম্পর্কে অথবা অন্যরা তার সম্পর্কে মনে করে যে, সে দ্বীন সম্পর্কে জ্ঞান রাখে বা ইজতিহাদের মর্যাদায় পৌঁছে গেছে, অথচ প্রকৃতপক্ষে সে ঐ স্তরে পৌঁছেনি। এরপর সে এই ভুল ধারণার ভিত্তিতে আমল করতে থাকে, নিজের মতামতকে বিশুদ্ধ মনে করে এবং অন্যদের মতামতকে নিজের মতবিরোধ মনে করে। কখনো এটি কোনো আংশিক বা শাখাগত বিষয়ে ঘটে, আবার কখনো তা দ্বীনের মৌলিক বিষয়, যেমন আকীদা বা আমলের মূলনীতিসমূহে ঘটে। সে যখন শারিয়তের কোনো একটি আংশিক বিষয়ে আঁকড়ে ধরে, তখন সে তার খণ্ডিত ধারণা দিয়ে শারিয়তের মৌলিক বিষয়সমূহ ধ্বংস করে ফেলে, কারণ সে তার অর্থ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান না রেখেই তা গ্রহণ করে থাকে। এধরনের ব্যক্তিই বিদআতী। এই ব্যাপারে সহীহ হাদীসে ইঙ্গিত করা হয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: “আল্লাহ ইলমকে মানুষের অন্তর থেকে উঠিয়ে নেবেন না; বরং তিনি আলেমদের মৃত্যু ঘটিয়ে ইলম উঠিয়ে নেবেন। যখন কোনো আলেম অবশিষ্ট থাকবে না, তখন মানুষ অজ্ঞ ব্যক্তিদেরকে নেতা বানাবে। তাদেরকে প্রশ্ন করা হবে, তারা না জেনেই ফতোয়া দেবে; ফলে তারা নিজেরাও পথভ্রষ্ট হবে এবং অন্যদেরও বিভ্রান্ত করবে।”(সহীহ বুখারী: ১০০, ৭৩০৭; মুসলিম: ২৬৭৩; তিরমিযী: ২৬৫২; আহমাদ: ৬৪৭৫, ৬৭৪৮; দারিমী: ২৩৯)।
.
দ্বিতীয় কারণ হলো: নিজের প্রবৃত্তির (খেয়াল-খুশির) অনুসরণ করা। এ কারণেই বিদআতের অনুসারীদেরকে “আহলুল আহওয়া” (কুপ্রবৃত্তির অনুসারী) বলা হয়। কেননা তারা তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে; তারা শরীয়তের দলিলের প্রতি সেই রকম প্রয়োজনশীলতার দৃষ্টিতে তাকায় না, কিংবা সেগুলোর ওপর নির্ভর করেও চলে না যে, সেগুলোর আলোকে নিজেদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। বরং তারা তাদের মনগড়া ধারণাকেই অগ্রাধিকার দেয় এবং নিজের মতের ওপর নির্ভর করে, তারপর শরয়ি দলিলসমূহকে তাদের মতের আলোকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করে।এদের অধিকাংশই হচ্ছে সেইসব লোক যারা “ভালো-মন্দ বিচার” (তাহসীন ও তাকবীহ)-কে নিজস্ব বুদ্ধিমত্তার ভিত্তিতে নির্ধারণ করে, কিংবা যাদের মনোভাব গিয়েছে গ্রিক দার্শনিকদের ধ্যান-ধারণার দিকে, অথবা যারা শাসকদের কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আশায় কিংবা নেতৃত্ব ও মর্যাদা লাভের আকাঙ্ক্ষায় তাদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট হয়ে পড়েছে।এর ফলে তারা মানুষের স্রোতের সঙ্গে ভেসে চলে এবং তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণে নিমগ্ন থাকে।এদের সম্পর্কে আলেমগণ উল্লেখ করেছেন, বিশেষত যারা শাসকদের সান্নিধ্যে থাকেন।এই শ্রেণির প্রথম দলের মানুষ বহু সহীহ হাদীস তাদের বুদ্ধির মানদণ্ডে অগ্রহণযোগ্য মনে করে প্রত্যাখ্যান করেছে, তারা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) থেকে যা সহীহ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে, তাতে তারা সন্দেহ ও কটাক্ষ করেছে এবং তাদের বিকৃত মতকে উত্তম মনে করেছে। এমনকি তারা আখিরাত সম্পর্কিত বহু বিষয়ও অস্বীকার করেছে যেমন: পুলসিরাত, মীযান, দেহসহ পুনরুত্থান, জান্নাত-জাহান্নামের শারীরিক নেয়ামত ও শাস্তি, আল্লাহর দর্শন ইত্যাদি। তারা এসব অস্বীকার করেছে এই ধারণা থেকে যে, তাদের বুদ্ধিই হলো আসল শরীয়ত। এমনকি তারা এমনটিও বলে যে, যদি শরিয়ত এসেও থাকে, তবে সেটি কেবল তাদের বুদ্ধির নির্দেশক সিদ্ধান্তেরই প্রকাশ। অথচ এসবই ভয়াবহ বিভ্রান্তি।
.
তৃতীয় কারণ হলো: পূর্বপুরুষদের রীতি-নীতি, সমাজের প্রচলিত অভ্যাস বা পীর-মুরশিদের পথ অন্ধভাবে অনুসরণ করা, যদিও তা সত্য ও হক পরিপন্থী হয়। এটি হলো নিন্দনীয় (নিকৃষ্ট) তাকলীদ। অথচ আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনুল কারিমের মাঝে এ সম্পর্কে নিন্দাজনীয় বাক্য ব্যবহার করেছেন তিনি বলেছেন;”বরং তারা বলে, নিশ্চয় আমরা আমাদের পিতৃপুরুষদেরকে এক মতাদর্শের উপর পেয়েছি এবং নিশ্চয় আমরা তাদের পদাঙ্ক অনুসরণে হেদায়াতপ্ৰাপ্ত হব।”(সূরা যুখরুফ: ২২) এরপর মহান আল্লাহ বলেন: তাদের প্রতি নবী ﷺ বলেন;”তোমরা তোমাদের পিতৃপুরুষদেরকে যে পথে পেয়েছ, আমি যদি তোমাদের জন্য তার চেয়ে উৎকৃষ্ট পথ নিয়ে আসি তবুও কি (তোমরা তাদের অনুসরণ করবে)? প্রত্যুত্তরে) তারা বলত,নিশ্চয় তোমরা যা সহ প্রেরিত হয়েছ আমরা তা প্রত্যাখ্যান করি।”(সূরা যুখরুক আয়াত: ২৪) অন্য সূরায় আল্লাহ আরো বলেন,”তিনি বললেন, তোমরা যখন আহ্বান কর তখন তারা তোমাদের শোনে কি? অথবা তারা কি তোমাদের উপকার কিংবা অপকার করতে পারে?। (সুরা শুয়ারা: ৭২-৭৩) আল্লাহ তাদেরকে সুস্পষ্ট প্রমাণের মাধ্যমে যুক্তি উপস্থাপন করেছিলেন, কিন্তু তারা কেবল নিজেদের বাপ-দাদার ঐতিহ্যের পেছনেই ছুটে চলে। তারা বলত: “আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে এ কাজ করতে দেখেছি।”এই বিষয়টি পূর্বের হাদীসের সাথেও সম্পর্কযুক্ত, যেখানে বলা হয়েছে: “মানুষ অজ্ঞ ব্যক্তিদের নেতা হিসেবে গ্রহণ করবে; ফলে তারা তাদেরকেই অনুসরণ করবে, সে ব্যক্তি সত্যের ওপর থাকুক বা না থাকুক।”(ইমাম শাতীবি; আল ই’তিসাম খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৪২১-৪২৩)।
.
বিশুদ্ধ আক্বীদা মানহাজের ভিত্তি ছাড়া ঐক্য সম্পর্ক নয় এই বিষয়ে সৌদি ফতোয়া বোর্ড এবং সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের প্রবীণ সদস্য, যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫৪ হি./১৯৩৫ খ্রি.]-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল কোন বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে মতনৈক্য করা যাবে আর কোন বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে মতনৈক্য করা যাবে না? মুসলিমদের দ্বীনের ব্যাপারে এগুলো কি আবশ্যক?

উত্তরে শাইখ বলেন :
الاختلاف على قسمين :القسم الأول : الاختلاف في مسائل العقيدة ، وهذا لا يجوز ؛ لأنّ الواجب على المسلمين اعتقاد ما دلَّ عليه الكتاب والسُّنَّة ، وعدم التّدخُّل في ذلك بعقولهم واجتهاداتهم ؛ لأنّ العقيدة توقيفيّة ، ولا مجال للاجتهاد والاختلاف فيها .القسم الثاني : اختلاف في المسائل الفقهيَّة المستنبطة من النُّصوص ، وهذا لابدّ منه ؛ لأنّ مدارك الناس تختلف ، ولكن يجب الأخذ بما ترجّح بالدّليل من أقوالهم ، وهذا هو سبيل الخروج من هذا الخلاف .ويجب على المسلم أن يهتمَّ بأمور دينه ، ويحافظ على أداء ما أوجب الله عليه ، ويترك ما حرَّمَ الله عليه ، وأن يتحلَّى بالأخلاق الفاضلة مع إخوانه ، وأن يصدُقَ في معاملته ، ويحفظ أمانته ، ويكون قدوةً صالحةً لغيره .ويجب أن يتربَّوا على التّمسّك بالدّين والأخلاق الفاضلة ، وأن يبتعدوا عن الأخلاق الرّذيلة وقرناء السُّوء ، وأن يهتمُّوا بما ينفعهم في دينهم ودُنياه ، وأن يكونوا قوَّة للإسلام والمسلمين .

মতানৈক্য দুইভাবে হয়ে থাকে:

প্রথম প্রকার: আক্বীদার মাসআলা মাসায়েলের ক্ষেত্রে মতানৈক্য করা, আর এটা জায়েজ নেই; কেননা মুসলিমদের জন্য আবশ্যক হলো তারা কিতাব (কুরআন) ও সুন্নাহর (হাদিসের) নির্দেশনার উপর ঈমান স্থাপন করা,ওই বিষয়ে তাদের ইজতিহাদ ও গবেষণায় হস্তক্ষেপ না করা। কেননা আক্বীদা হচ্ছে তাওকিফি বিষয় (বিলকুল কুরআন-হাদীসের দলিলনির্ভর) যার মধ্যে মতানৈক্য ও ইজতিহাদের কোন সুযোগ নেই।
.
দ্বিতীয় প্রকার: ফিকহি মাসআয়েলের ক্ষেত্রে মতভেদ যেগুলো বিভিন্ন নস (কুরআন, হাদীস ইত্যাদি) থেকে ইস্তিবাত বা নির্যাস গ্রহণ। এ ধরনের মতপার্থক্য এক অর্থে অনিবার্য, কেননা মানুষের বোধশক্তি, উপলব্ধি এবং বিশ্লেষণক্ষমতা একে অপরের থেকে ভিন্ন। তবে এ ক্ষেত্রে করণীয় হলো যে মতটি দলীল প্রমাণের দিক থেকে অধিকতর দৃঢ় ও গ্রহণযোগ্য সেটিকে গ্রহণ করা। এটিই এমন মতভেদ থেকে মুক্তি পাওয়ার সঠিক ও সংগত পথ।একজন মুসলিমের কর্তব্য হলো:সে যেন তার দ্বীনের বিষয়ে যত্নবান হয়, আল্লাহ তাকে যা ফরজ করেছেন তা যথাযথভাবে পালন করে, আল্লাহ যেসব কাজ হারাম করেছেন তা থেকে বিরত থাকে। তার মুসলিম ভাইয়ের সাথে উত্তম আচরণের মাধ্যমে সজ্জিত হওয়া, তার কাজ কর্মের মাধ্যমে বিশ্বস্ততা অর্জন করা, আমানত রক্ষা করা অন্যের জন্য সৎ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকা। তাদের (তরুণ প্রজন্মের) আবশ্যক হলো, দ্বীন এবং উত্তম চরিত্র ধারণ করা, খারাপ চরিত্র ও খারাপ সঙ্গীদের থেকে দূরে থাকা, যা তাদের জন্য দ্বীন ও দুনিয়ার দিক থেকে উপকারী, সেসব বিষয়ের প্রতি মনোযোগী হওয়া এবং তারা যেন ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর জন্য এক শক্তি হিসেবে পরিণত হয়।”(সূত্র: আল-মুনতাক্বা মিন ফাতাওয়া আশ-শাইখ সালেহ আল-ফাওযান, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ৪০৭-৪০৮, প্রশ্ন নং: ২৪১)।
.
প্রিয় পাঠক! কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের সমাজে এমন কিছু বিপদজনক বিদআতি মূলনীতি চালু রয়েছে, যার মূল উদ্ভাবক মনুষ্যরূপী শয়তানেরা। এই মূলনীতির নাম “আমরা দল মত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ থাকব” আরো আপডেট করে বলা হয়: “আমরা যে ব্যাপারে একমত, সে ব্যাপারে আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকব, আর যে ব্যাপারে আমরা একমত নই, সে ব্যাপারে আমরা একে অপরকে মার্জনা (ক্ষমা) করব। এই নীতি দেখতে যতই উদার মনে হোক না কেন, প্রকৃতপক্ষে এটি দ্বীনের মৌলিক ভিত্তিকে ধ্বংস করার এক সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। একজন সচেতন সালাফি মুসলিম কখনোই এই প্রলোভনে পা দিতে পারে না। কারণ, ইসলাম আমাদের সত্যের ওপর একতাবদ্ধ হতে শিখিয়েছে, সত্যের পরিপন্থী বাতিল ও বিদআতের সাথে আপস নয় বরং তার প্রতিবাদ করতে শিখিয়েছে। ভ্রষ্টতার প্রতি নম্রতা নয়, বরং সুন্নাহর প্রতি আনুগত্যই মুসলিমের বৈশিষ্ট্য। এই বিদআতি মূলনীতির ব্যাপারে বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন:أما عذر بعضنا لبعض فيما اختلفنا فيه فليس على إطلاقه، فما كان من مسائل الإجتهاد التي يخفى دليلها فالواجب عدم الإنكار فيها من بعضنا على بعض، أما ما خالف النص من الكتاب والسنة فالواجب الإنكار على من خالف النص بالحكمة والموعظة الحسنة“আমাদের পরস্পরের মধ্যে যে বিষয়গুলোতে মতভেদ রয়েছে, সে বিষয়ে একে অপরকে ক্ষমা করার নীতি নিঃশর্ত ভাবে প্রযোজ্য নয়। যদি মতভেদটি এমন ইজতিহাদী মাসআলাহ’য় সংঘটিত হয়, যার দলিল অস্পষ্ট ও গোপন থাকে,সেক্ষেত্রে আবশ্যক হল পরস্পরের বিরোধিতা না করা। পক্ষান্তরে যদি কোনো মত কিতাব (কুরআন) ও সুন্নাহর (হাদিসের) স্পষ্ট দলিলের বিরোধী হয়, তাহলে হিকমাহ ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে দলিল বিরোধী ব্যক্তির বিরোধিতা করা আবশ্যক।”(ইবনু বায; মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৫৮; দারুল ক্বাসিম, রিয়াদ কর্তৃক প্রকাশিত; সন: ১৪২০ হিজরী (১ম প্রকাশ)।
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে প্রশ্ন করা হয়েছে,সম্মানিত শাইখ, এটা তো সুবিদিত যে শী‘আ ও মুরজিয়া এরা সবাই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের সঙ্গে মারাত্মকভাবে দ্বিমত পোষণ করে থাকে। অথচ কিছু আলেম এমন একটি নীতিমালা বর্ণনা করেন, যেটিকে তাঁরা ‘সোনালী নীতি’ বলে থাকেন। নীতিটি হলো “যেসব বিষয়ে আমরা একমত, সেসব বিষয়ে একে অপরকে সহযোগিতা করব, আর যেসব বিষয়ে মতভেদ আছে, সেসব বিষয়ে একে অপরকে মার্জনা (ক্ষমা) করব।” তাহলে প্রশ্ন হলো, আমরা কীভাবে ঐই শী‘আদের মার্জনা করব?
.
তিনি (রাহিমাহুল্লাহ) উত্তরে বলেছেন,

هذه القاعدة الذهبية ليست قاعدة ذهبية ولا تستحق أن تكون قاعدة، بل ما اتفقنا فيه فهو من نعمة الله عز وجل، والإتفاق خير من الإختلاف، وما اختلفنا فيه فقد يعذر فيه المخالف وقد لا يعذر، فإذا كان الاختلاف في أمر يسوغ فيه الاختلاف فهذا لا بأس به، وما زال الأئمة يختلفون، فالإمام أحمد والشافعي ومالك وأبو حنيفة كلهم يختلفون، وأما إذا كان الخلاف لا يعذر فيه كالخلاف في العقائد، فإنه لا يعذر بعضنا بعضاً، بل الواجب الرجوع إلى ما دل عليه الكتاب والسنة، فعلى المرجئة وعلى الشيعة وعلى كل مبتدع أن يرجع إلى الكتاب والسنة ولا يعذر، فهذه القاعدة ليست قاعدة ذهبية، ولعلك تسميها قاعدة خشبية. عرفت الآن الذي يسوغ فيه الاجتهاد، هذا لا بأس أن نسمح للمخالف، والذي لا يسوغ فيه الاجتهاد كمسائل العقائد التي يخالف فيها الإنسان السلف لا يمكن أن يعذروا.

“এই (তথাকথিত) সোনালী মূলনীতি আসলে সোনালী মূলনীতি নয়। আর এটি মূলনীতি হওয়ারই যোগ্য (হকদার) নয়।বরং আমরা যে বিষয়ে একমত হয়েছি, তা আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ থেকে এক বিশাল নিয়ামত। আর মতৈক্য মতদ্বৈধতার চেয়ে উত্তম। পক্ষান্তরে আমরা যে ব্যাপারে একমত নই, সে ব্যাপারে ভিন্নমত পোষণকারী ব্যক্তিকে মার্জনা (ক্ষমা) করা হতে পারে, আবার মার্জনা (ক্ষমা) করা নাও হতে পারে। মতানৈক্য যখন এমন বিষয়ে সংঘটিত হয়,যে বিষয়ে মতানৈক্যের অবকাশ আছে, তাহলে এতে কোনো অসুবিধা নেই। ইমামগণ সবসময়ই এমন বিষয়ে মতানৈক্য করে এসেছেন ইমাম আহমাদ, ইমাম শাফি‘ঈ, ইমাম মালিক এবং ইমাম আবূ হানীফাহ (রাহিমাহুমুল্লাহ) তাঁরা সবাই মতানৈক্য করেছেন। তবে যদি মতানৈক্য এমন ক্ষেত্রে সংঘটিত হয়, যেক্ষেত্রে মতানৈক্য (মার্জনা) ক্ষমার্হ নয়। যেমন ‘আক্বীদা বা বিশ্বাসগত বিষয়ে মতানৈক্য সেক্ষেত্রে পরস্পরকে মার্জনা করা হবে না। বরং ওই বিষয়ের দিকে ফিরে যাওয়া ওয়াজিব, যা কিতাব ও সুন্নাহ দ্বারা সাব্যস্ত (প্রমাণিত)। সুতরাং মুরজিয়া, শী‘আ এবং প্রত্যেক বিদআতীকে কুরআন ও সুন্নাহর দিকে ফিরে আসতে হবে; এ ব্যাপারে তাদের কোনো উযর গ্রহণযোগ্য হবে না। তাই, এই (তথাকথিত) সোনালী মূলনীতি আসলে সোনালী নয় তুমি একে কাষ্ঠবৎ মূলনীতি (অর্থাৎ মূল্যহীন) বললেই অধিকতর যথার্থ হবে। তুমি এখন বুঝে গেছ যে, যেসব বিষয়ে ইজতিহাদের অবকাশ রয়েছে, সেখানে ভিন্নমত পোষণকারীদের প্রতি (মার্জনা) বা নমনীয়তা দেখানো যেতে পারে। কিন্তু যেসব বিষয়ে ইজতিহাদের সুযোগ নেই বিশেষ করে আকীদাগত বিষয়ে কেউ যদি সালাফদের বিরোধিতা করে, সেক্ষেত্রে তাদেরকে মার্জনা করা সম্ভব নয়।”(ইবনু ‘উসাইমীন, লিক্বাআতুল বাবিল মাফতূহ; লিক্বা নং: ৭৫)।
.
একই প্রশ্ন সৌদি ফতোয়া বোর্ড এবং সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের প্রবীণ সদস্য, যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫৪ হি./১৯৩৫ খ্রি.] করা হলে জবাবে তিনি বলেছেন,إذا كان الاتفاق في العقيدة نعم، قد يحصل اختلاف في مسائل الفروع، والمجتهد يؤخذ بما أصاب فيه، ويترك ما خالف فيه، فإذا كان الاتفاق على العقيدة، والاختلاف إنما هو في مسائل الفقه والفروع، فهذا له وجه، أما إذا كان الاختلاف في العقيدة، فعلى أي شيء اتفقنا إذن؟! ما اتفقنا على شيء، وهذا هو الظاهر اللي يريدون، هذا ما يجوز. نعم.“যদি ‘আক্বীদাহর (বিশ্বাসগত মূলনীতির) ক্ষেত্রে ঐক্য হয় হ্যাঁ,তাহলে বিষয়টি গ্রহণযোগ্য। কারণ, শাখাগত মাসআলাগুলোর ক্ষেত্রে মতভেদ ঘটতেই পারে। এ ক্ষেত্রে একজন মুজতাহিদ (ইজতিহাদকারী আলিম)
সঠিক সিদ্ধান্তটি গ্রহণ করবেন, আর বিপরীত সিদ্ধান্তটি পরিত্যাগ করবেন। সুতরাং, যদি ‘আক্বীদাহর ক্ষেত্রে ঐক্য থাকে এবং মতভেদ থাকে শুধু ফিকহি ও শাখাগত বিষয়ে, তাহলে এটির একটি ভিত্তি ও গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে।কিন্তু যদি ‘আক্বীদাহর ক্ষেত্রেই মতানৈক্য হয়,তাহলে আমরা কিসের ওপর ঐক্যবদ্ধ হব? আমরা তো আদৌ কোনো কিছুর ওপর ঐক্যবদ্ধ হলাম না! আর বাহ্যিকভাবে এটাই তারা (বিভ্রান্ত গোষ্ঠী) চায় এটা বৈধ নয়।না‘আম।”(শাইখের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ফাতওয়া নং-১৪১৯১)।
.
পরিশেষে প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত আলোচনার মূল কথা এই যে বিশুদ্ধ আকিদা ও সহীহ তাওহীদের ভিত্তি ছাড়া মুসলিমদের মাঝে প্রকৃত ঐক্য সম্ভব নয়। কুরআন ও সুন্নাহর বিশুদ্ধ মানহাজে একতাবদ্ধ না হলে ঐক্যের দাবি কেবল একটি শ্লোগানই থেকে যাবে। সুতরাং যারা বলে “আমরা যে বিষয়ে একমত, সে বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকব; আর যে বিষয়ে একমত নই, তা মার্জনা করব” এ বক্তব্য কোনো শরঈ নীতিমালা নয়, বরং একটি বিভ্রান্তিকর বিদআতি বক্তব্য। এর মধ্যে কোনো কল্যাণ নেই। এটি ফিতনাহ। এর ফলে সত্য ও বাতিলের মাঝে বিভাজন বিলুপ্ত হয়, এবং বিদ‘আত ও হারামের প্রতি সহনশীলতা জন্ম নেয়। সুতরাং আমাদের উচিত, বিশুদ্ধ আক্বীদা ও সহীহ বুঝের ওপর অটল থাকা যার মাধ্যমে মতভেদ দূর হবে এবং দ্বীনের প্রকৃত ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হবে, ইনশা আল্লাহ। আল্লাহ আমাদের সিরাতুল মুস্তাকিমের পথে অটল থাকার তৌফিক দান করুন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: শাইখ নাসরুল্লাহ আল মাদানী (হাফি.)। লিসান্স মাদীনা বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব।

Share: