প্রশ্ন: মহান আল্লাহ আরশের উপর উঠেছেন এই আক্বীদা কি নবী মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর ছিল নাকি মহাপাপিষ্ঠ ফেরাউনের ছিল?” (জাহমিয়াদের বাতিল আক্বীদা ও মিথ্যা যুক্তি খন্ডন)।
▬▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তরের সারাংশ: মহান আল্লাহ আরশের উপর উঠেছেন এই আক্বীদা নবী মূসা (আলাইহিস সালাম) সহ সমস্ত নবী-রাসূলের ছিল, মহাপাপিষ্ঠ ফেরাউনের নয়। বিস্তারিত জানতে পুরো আর্টিকেলটি পড়ুন।
.
দলিলসহ বিস্তারিত উত্তর: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। আমাদের নবী মুহাম্মদের প্রতি, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাহাবীগণের প্রতি আল্লাহর রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক। অতঃপর বঙ্গীয় জাহমি মতাদর্শের অন্যতম প্রচারক এবং দেওবন্দি আক্বীদার প্রতিনিধি বিলাল বিন আলী, যিনি জাহমিয়া ফিরকার অনুসারী হিসেবে পরিচিত। এই ব্যক্তি দিনের পর দিন ধারাবাহিকভাবে বিভ্রান্তিকর ও অসত্য তথ্য প্রচার করে সাধারণ মানুষের ঈমানের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তার কথাবার্তা ও দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্টতই কুফরি আক্বীদার দিকে ইঙ্গিত করে, সে বিদআতি আক্বীদার প্রচারক এবং বাতিল বক্তব্যের মাধ্যমে সাধারন মানুষের ঈমান নষ্ট করার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা সচেতন সাধারণ মুসলিমদেরকে বলবো বাংলাদেশি জাহমিদের পাতি নেতা বেলাল বিন আলী এবং গরিবের আবু হানিফা খ্যাত জনাব রেজাউল করিম আবরার এই দুই আক্বীদায় মিসকিন বক্তার আক্বিদা সংক্রান্ত মিথ্যা তথ্যের পোস্ট এবং ভিডিও গুলো দেখা ও বিশ্বাস করা থেকে সাবধান থাকবেন। এবার মূল প্রসঙ্গে আসি। “আর-রাহমান আরশের উপর উঠেছেন” এটি আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের বিশুদ্ধ আক্বিদা, যা নাজাতপ্রাপ্ত একমাত্র দলের আক্বীদা। অপরদিকে “আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান” এই বাতিল আক্বিদাটি কেবল মুসলিম নামধারী বিদআতি ফিরকাগুলোর নয় বরং অনেক কাফের, মুশরিক, ই-হু-দি, খ্রি-ষ্টা-ন, হিন্দু ও অন্যান্য বিভ্রান্ত সম্প্রদায়েরও প্রচলিত আক্বীদা। কিন্ত দুঃখজনক হলেও সত্যি বঙ্গীয় বাতিল ফিরকার লোকেরা দীর্ঘদিন ধরে সালাফি মানহাজের বিশুদ্ধ দাওয়াতকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে সূরা কাসাসের ৩৮ নং আয়াত এবং সূরা গাফিরের ৩৬-৩৭ নং আয়াতের বিকৃত ব্যাখ্যা করে এক ভয়ংকর বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। তারা মিথ্যাভাবে দাবি করে “আল্লাহ আরশের উপর প্রতিষ্ঠিত” এই আক্বিদা নাকি আহলে সুন্নাহর নয়, বরং ফেরাউনের আক্বিদা! (লা হাওলা ওয়া লা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ) এ এক চরম বিভ্রান্তিকর, মিথ্যা এবং ধ্বংসাত্মক বক্তব্য! এবার তাদের নিজস্বভাবে ব্যাখ্যা করা সূরা গাফিরের ৩৬-৩৭ নম্বর আয়াতের সঠিক তাফসির তুলে ধরব এবং তাদের এই ভিত্তিহীন দাবি চিরতরে মাটিচাপা দেব ইনশাআল্লাহ।
.
পবিত্র কুরআনে দুটি স্থানে ফেরাউন এবং তার মন্ত্রী হামানের সাথে আসমানে আল্লাহ দেখার জন্য প্রাসাদ নির্মাণের কথোপকথন উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রথমত: আল্লাহর বানী: وَ قَالَ فِرۡعَوۡنُ یٰۤاَیُّهَا الۡمَلَاُ مَا عَلِمۡتُ لَكُمۡ مِّنۡ اِلٰهٍ غَیۡرِیۡ ۚ فَاَوۡقِدۡ لِیۡ یٰهَامٰنُ عَلَی الطِّیۡنِ فَاجۡعَلۡ لِّیۡ صَرۡحًا لَّعَلِّیۡۤ اَطَّلِعُ اِلٰۤی اِلٰهِ مُوۡسٰی ۙ وَ اِنِّیۡ لَاَظُنُّهٗ مِنَ الۡكٰذِبِیۡنَ “আর ফিরআউন বলল, হে পরিষদবর্গ! আমি ছাড়া তোমাদের অন্য কোনো ইলাহ আছে বলে জানি না! অতএব হে হামান! তুমি আমার জন্য ইট পোড়াও এবং একটি সুউচ্চ প্রাসাদ তৈরী কর; হয়ত আমি সেটাতে উঠে মূসার ইলাহকে দেখতে পারি। আর আমি তো মনে করি, সে অবশ্যই মিথ্যাবাদীদের অন্তর্ভুক্ত।”(সূরা কাসাস: ২৮/৩৮)
দ্বিতীয়ত: আল্লাহর বাণী: وَ قَالَ فِرۡعَوۡنُ یٰهَامٰنُ ابۡنِ لِیۡ صَرۡحًا لَّعَلِّیۡۤ اَبۡلُغُ الۡاَسۡبَابَ, اَسۡبَابَ السَّمٰوٰتِ فَاَطَّلِعَ اِلٰۤی اِلٰهِ مُوۡسٰی وَ اِنِّیۡ لَاَظُنُّهٗ كَاذِبًا ؕ وَ كَذٰلِكَ زُیِّنَ لِفِرۡعَوۡنَ سُوۡٓءُ عَمَلِهٖ وَ صُدَّ عَنِ السَّبِیۡلِ ؕ وَ مَا كَیۡدُ فِرۡعَوۡنَ اِلَّا فِیۡ تَبَابٍ “ফিরআউন আরও বলল,হে হামান! আমার জন্য তুমি নির্মাণ করো এক সুউচ্চ প্রাসাদ যাতে আমি অবলম্বন পাই,আসমানে আরোহনের অবলম্বন, যেন দেখতে পাই মূসার ইলাহকে; আর নিশ্চয় আমি তাকে মিথ্যাবাদী মনে করি। আর এভাবে ফিরআউনের কাছে শোভনীয় করা হয়েছিল তার মন্দ কাজকে এবং তাকে নিবৃত্ত করা হয়েছিল সরল পথ থেকে এবং ফিরআউনের ষড়যন্ত্র কেবল ব্যর্থই ছিল।”(সূরা গাফির: ৩৭-৩৮)
.
এই আয়াতগুলো থেকে সহজেই বোঝা যায় যে নিশ্চয়ই মূসা (আলাইহিস সালাম) মহাপাপিষ্ঠ ফিরআউনকে জানিয়েছিলেন যে আল্লাহ আসমানে আছেন ।আসমানে গিয়ে পরীক্ষা করতে চেয়েছিল। অতঃপর ফিরাউন, মূসা (আলাইহিস সালাম)-কে মিথ্যাবাদী প্রমাণ করার জন্য তার অনুসারীদের সামনে আসমানে গিয়ে পরীক্ষা করতে চেয়েছেন। নিঃসন্দেহে যুক্তির দিক থেকে ফেরাউন তার অনুসারীদের বোঝাতে চেয়েছিল যে নবী মূসা (আলাইহিস সালাম) ভুল বলেছেন বরং তার (ফেরাউনের) চেয়ে বড় আর কোনো ইলাহ নেই। তাই ফেরাউন তার অনুসারীদের বলেছিল যে, নবী মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর এই দাবিকে সে মিথ্যা মনে করে যে তার (অর্থাৎ ফেরাউনের) অন্য কোনো ইলাহ আছে। এজন্য সে তার মন্ত্রী হামানকে একটি সুউচ্চ প্রাসাদ নির্মাণ করতে বলেছিল, যাতে তার অনুসারীদের কাছে প্রমাণ করতে পারে যে মূসার প্রভুর অস্তিত্ব নেই। যদি ফেরাউনের এই কাজ তার নিজের বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে হতো যে আল্লাহ তাআলা কোথায় আছেন, তাহলে তার যুক্তি বাতিল হয়ে যেত। কারণ মূসার দাবিকে মিথ্যা প্রমাণ করার জন্য তার নিজের বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে যুক্তি দেওয়া যুক্তিসঙ্গত নয়! বরং তা মূসার বিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে হতে হবে, আর তা হলো আল্লাহ তাআলা আসমানে আছেন। তাই সে সুউচ্চ প্রাসাদ নির্মাণ করতে বলেছিল, যাতে সে আসমানের দরজায় পৌঁছাতে পারে এবং তার অনুসারীদের কাছে প্রমাণ করতে পারে যে মূসা (আলাইহিস সালাম) তার দাবিতে মিথ্যাবাদী যে তার অন্য কোনো ইলাহ আছে; বরং এটি কেবল মূসার নিছক দাবি মাত্র। এছাড়াও, যদি ফেরাউনের এ কাজ মূসা (আলাইহিস সালাম)-এর আক্বিদার (বিশ্বাসের) বিপরীত হতো, তাহলে তিনি (মূসা আলাইহিস সালাম ) এর জবাব দিতেন যে আকাশে তার ইলাহ নেই এবং এ-ও বলতেন যে মূসার ইলাহর অস্তিত্ব নেই তা প্রমাণ করার জন্য তোমার এই কর্ম (সুউচ্চ প্রাসাদ নির্মাণ) কোনো কাজে আসবে না। কারণ আমি (মূসা) কখনো দাবি করিনি যে আমার ইলাহ আসমানে। কিন্তু মূসা (আলাইহিস সালাম) এমন কিছু বলেননি। বরং তিনি নীরব ছিলেন। তার নীরবতা প্রমাণ করে যে তিনি (মূসা) বিশ্বাস করতেন যে আল্লাহ আকাশে আছেন, যেমনটি অন্যান্য নবী ও রাসূলগণও তাদের উম্মতকে সংবাদ দিয়েছেন।
.
এবার চলুন দেখি ইতিহাসখ্যাত ইসলামি বিদ্বানগণ “নিশ্চয় আমি তাকে (মূসাকে) মিথ্যাবাদী মনে করি” এই আয়াতের বিশুদ্ধ তাফসির সম্পর্কে কী বলেছেন।
..
(১). ইয়াহইয়া ইবনে সালাম (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ২০০ হি.] দ্বিতীয় আয়াতটির ব্যাখ্যায় বলেন: (لعلي أبلغ الأسباب) “আমি যেন কারণসমূহে পৌঁছাতে পারি।” অর্থাৎ দরজাসমূহে। (فأطلع إلى إله موسى) “যাতে আমি মুসার ইলাহ’কে দেখতে পায়” অর্থাৎ যে দাবি সে করে। ( وإني لأظنه كاذبا) “ নিশ্চয় আমি তাকে মিথ্যাবাদী মনে করি” অর্থাৎ আসমানে কেউ নেই সে ইচ্ছাকৃতভাবে মিথ্যা বলছে।”(তাফসিরুল কুরআনিল আযীয; ইবনে আবি যমনীন; ৪র্থ খণ্ড,পৃষ্ঠা: ১৩৪)।
(২). হারিস আল-মুহাসিবি (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ২৪৩ হি.]
বলেন: (وإني لأظنه كاذبا فيما قال لي إنه في السماء، فطَلَبَه حيث قال له موسى مع الظن منه بموسى عليه السلام أنه كاذب، ولو أن موسى عليه السلام أخبره أنه في كل مكان بذاته لطلبَه في الأرض أو في بيته وبدنه ولم يتعز ببنيان الصرح)
“নিশ্চয় আমি তাকে (মূসাকে) মিথ্যাবাদী মনে করি, যেহেতু সে আমাকে বলেছিল যে, আল্লাহ আসমানে আছেন। অতএব, সে তাকে সেখানেই খুঁজেছিল যেখানে মূসা (আলাইহিস সালাম) তাকে বলেছিলেন। তবে সে মূসা (আলাইহিস সালাম) কে মিথ্যাবাদী মনে করছিল। যদি মূসা (আলাইহিস সালাম) তাকে বলতেন যে, আল্লাহ তা’আলা সত্তাগতভাবে সর্বত্র আছেন, তাহলে সে তাকে পৃথিবীতে বা তার নিজের ঘরে বা দেহে খুঁজত, এবং উচ্চ প্রাসাদ নির্মাণের প্রয়োজন হত না।” (ফাহমুল কুরআন ওয়া মা’আনিহ; মুহাসাবি কর্তৃক লিখিত; চতুর্থ খণ্ড)।
.
(৩). উসমান আদ-দারিমি (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত:২৮০ হি.] বলেন:(ففي هذه الآية بيان بَيِّن ودلالة ظاهرة أن موسى كان يدعو فرعون إلى معرفة الله بأنه فوق السماء، فمن أجل ذلك أمر ببناء الصرح، ورام الاطلاع إليه) এই আয়াতে সুস্পষ্ট প্রমাণ এবং স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে যে, মূসা (আলাইহিস সালাম) ফেরাউনকে আল্লাহর পরিচয় দিতে ডাকতেন এই বলে যে, আল্লাহ আসমানের উপর আছেন। এজন্যই ফেরাউন সুউচ্চ প্রাসাদ নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছিল এবং তা থেকে আল্লাহকে দেখার চেষ্টা করেছিল।”(আর-রাদ্দু ‘আলাল জাহমিয়্যাহ; আদ-দারিমি; পৃষ্ঠা: ৩৭)।
.
(৪). ইবনে জারির আত-তাবারী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত:৩১০ হি.] বলেন: {وَإِنِّي لأظُنُّهُ} فيما يقول من أن له معبودًا يعبده في السماء، وأنه هو الذي يؤيده وينصره، وهو الذي أرسله إلينا {من الكاذبين}.(নিশ্চয় আমি তাকে মিথ্যাবাদী মনে করি, সে যা বলে – ‘যে তার প্রভু আসমানে আছেন, তিনিই তাকে সাহায্য করেন এবং সমর্থন করেন এবং তিনিই তাকে আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন’।” (জামি’উল-বায়ান ফি তা’বীলিল-কুরআন; ইমাম তাবারী; ১৯তম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৫৮১)। তিনি দ্বিতীয় আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেন: (وإني لأظنه كاذبا) “নিশ্চয় আমি তাকে মিথ্যাবাদী মনে করি” অর্থাৎ আমি মনে করি মুসা মিথ্যা বলছে যে, তার আসমানে একজন রব আছেন যে তাকে আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন।”(জামি’উল -বায়ান, ইমাম তাবারী; (২১তম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩৮৭)।
.
(৫). ইবনে খুযাইমাহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত:৩১১ হি.] বলেন: (وفي قوله وإني لأظنه كاذبا دلالة على أن موسى قد كان أعلمه أن ربه جلا وعلا أعلى وفوق.)“নিশ্চয় আমি তাকে মিথ্যাবাদী মনে করি” এই বাক্যে ইঙ্গিত আছে যে মুসা (আলাইহিস সালাম) তাকে জানিয়েছিল যে,তার রব সুবহানাহু ওয়া তাআলা উপরে ও ঊর্ধ্বে আছেন।”(ইবনু খুযাইমাহ, কিতাবুত তাওহীদ, ১ম খণ্ড,পৃষ্ঠা: ২৬৪)।
.
(৬). ইমাম আবুল হাসান আশআ’রী রহিমাহুল্লাহ [মৃ: ৩২৪ হি.] বলেন : كُذِّبَ مُوسَى عَلَيْهِ السَّلَامُ فِي قَوْلِهِ: إِنَّ اللَّهَ سُبْحَانَهُ فَوْقَ السَّمَاوَاتِ.”ফেরাউন মূসা আলাইহিস সালামের এই কথা (আক্বীদা)-কে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল যে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা আসমানের উপরে আছেন।”(আল-ইবানাহ আন উসূলিদ দিআনাহ: পৃষ্ঠা: ১০৫)।
.
(৭). আবু আহমদ আল-কারজি (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত:৩৬০ হি.] বলেন: ফেরাউনের বক্তব্য :وَ قَالَ فِرۡعَوۡنُ یٰۤاَیُّهَا الۡمَلَاُ مَا عَلِمۡتُ لَکُمۡ مِّنۡ اِلٰهٍ غَیۡرِیۡ ۚ فَاَوۡقِدۡ لِیۡ یٰهَامٰنُ عَلَی الطِّیۡنِ فَاجۡعَلۡ لِّیۡ صَرۡحًا لَّعَلِّیۡۤ اَطَّلِعُ اِلٰۤی اِلٰهِ مُوۡسٰی অর্থ: “আর ফিরআউন বলল, হে পরিষদবর্গ! আমি ছাড়া তোমাদের অন্য কোন ইলাহ আছে বলে জানি না! অতএব হে হামান! তুমি আমার জন্য ইট পোড়াও এবং একটি সুউচ্চ প্রাসাদ তৈরী কর; হয়ত আমি সেটাতে উঠে মূসার ইলাহকে দেখতে পারি।” অতঃপর তিনি বলেন: حجة على من يزعم أن الله بنفسه في الأرض؛ حال في كل مكان، وينكر كينونته بنفسه في السماء وعلمه في الأرض. إذ محال أ، يقول فرعون هذا القول إلا وقد دلّـلَه موسى -صلى الله عليه- أن إلهه في السماء دون الأرض. فإن كان فرعون أنكر كينونته في السماء وثبته في الأرض فقد وافق القوم فرعون في قوله. وإن كان أنكره في السماء والأرض معًا فقد خالفوا موسى -صلى الله عليه – مع خلافهم لجميع الأنبياء والناس، وأهل الملل كافة سواهم. ولا أعلم في الأرض باطلا إلا وهذا أوحش منه، نعوذ بالله من الضلالة.) “এটি তাদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী দলিল, যারা দাবি করে যে আল্লাহ নিজ সত্তায় পৃথিবীতে অবস্থান করেন; তিনি সর্বত্র বিরাজমান, আর তারা আসমানে তাঁর সত্তাগত অবস্থান ও পৃথিবীতে কেবল তাঁর জ্ঞানের উপস্থিতি অস্বীকার করে। কারণ ফেরাউন এই দাবি কখনোই করত না যদি না মুসা (আলাইহিস সালাম) তাকে প্রমাণ করে দিতেন যে তার ইলাহ আসমানে, পৃথিবীতে নয়। যদি ফেরাউন শুধু আসমানে আল্লাহর সত্তা অস্বীকার করে পৃথিবীতে তা স্বীকার করে থাকে, তাহলে এই দলটি ফেরাউনের কথারই সমর্থন করছে। আর যদি সে (ফেরাউন) আসমানে ও পৃথিবী উভয় স্থানেই আল্লাহর সত্তা অস্বীকার করে থাকে তাহলে তারা (জাহামিয়ারা) মুসা (আলাইহিস সালাম)-এর বিপরীত মত পোষণের পাশাপাশি সকল নবী, সাধারণ মানুষ ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের সাথেও বিরোধ করছে। পৃথিবীতে এর চেয়ে ভয়াবহ ভ্রষ্টতা ও মিথ্যা আর নেই। আল্লাহ আমাদেরকে পথভ্রষ্টতা থেকে রক্ষা করুন।”(আবু লাইস আস-সমরকান্দি; বাহরুল উলুম; ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৬০৯)।
.
(৮). আবুল লাইস আস-সামারকান্দি (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত:৩৭৫ হি.] তার তাফসির ‘বাহরুল উলুম’-এ বলেন:
আল্লাহ তাআলা বলেন:{وَإِنّى لاظُنُّهُ مِنَ الكاذبين} أي: أحسب موسى بما يقول أن في السماء إلهاً من الكاذبين) “নিশ্চয় আমি তাকে মিথ্যাবাদীদের মধ্যে গণ্য করি” অর্থাৎ আমি মনে করি মুসা (আলাইহিস সালাম) যে বলে আসমানে একজন ইলাহ আছেন সে মিথ্যাবাদী।”(ইবনে আবি যামানীন; তাফসিরুল কুরআনিল আযীয, ৪র্থ খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১৩৪)।
.
(৯). আবু সুলায়মান আল-খাত্তাবী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত:৩৮৮ হি.] তার বই শিআর আদ-দীন-এ বলেন: (وقال حكاية عن فرعون أنه قال {يا هَامَانُ ابْنِ لِي صَرْحًا لَعَلِّي أَبْلُغُ الْأَسْبَابَ * أَسْبَابَ السَّمَاوَاتِ فَأَطَّلِعَ إِلَى إِلَهِ مُوسَى} فوقع قصد الكافر إلى الجهة التي أخبره موسى عنها ولذلك لم يطلبه في طول الأرض ولا عرضها ولم ينزل إلى طبقات الأرض السفلى. فدل ما تلوناه من هذه الآي على أن الله سبحانه في السماء مستو على العرش، ولو كان بكل مكان لم يكن لهذا التخصيص معنى ولا فيه فائدة، *وقد جرت عادة المسلمين خاصتهم وعامتهم بأن يدعو ربهم عند الابتهال والرغبة إليه ويرفعوا أيديهم إلى السماء وذلك لاستفاضة العلم عندهم بأن ربهم المدعو في السماء سبحانه) “ফিরাউন যখন বলল, ‘হামান, আমার জন্য একটি সুউচ্চ প্রাসাদ তৈরি করো, যেন আমি আসমানের দরজা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারি এবং মুসার ঈলাহকে দেখতে পারি,’ তখন সে মূলত সেই দিকেই মনোনিবেশ করেছিল, যা সম্পর্কে মুসা (আলাইহিস সালাম) তাকে জানিয়েছিলেন। তাই সে কখনো মাটির গভীরে বা পৃথিবীর বিস্তৃত স্থানে তাকে খোঁজেনি। এই আয়াতগুলো প্রমাণ করে যে, আল্লাহ (সুবহানাহু ওয়া তাআলা) আসমানে আরশের ওপরে সমুন্নত আছেন। যদি তিনি সর্বত্রই থাকতেন, তবে আসমানের উল্লেখ করার কোনো অর্থ থাকতো না, এবং এতে কোনো উপকারও থাকতো না। এছাড়া,মুসলিমদের সাধারণ অভ্যাস হলো, যখন তারা আন্তরিকভাবে দোয়া করে এবং আল্লাহর কাছে কিছু প্রার্থনা করে, তখন তারা তাদের হাত আসমানের দিকে তোলে। এর কারণ হলো, তারা সুস্পষ্টভাবে জানে যে, তাদের রব, যাকে তারা ডাকছে, তিনি আসমানে আছেন।”(হাফিজ ইবনে আল-কাইয়িম আল-জাওযিয়াহ; শরহে সুনানে আবি দাউদ; খণ্ড ১৩, পৃষ্ঠা: ৩৫-৩৬)
.
(১০). আবু উসমান আস-সাবুনি (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৪৪৯ হি.] উল্লেখ করেছেন: (وأخبر الله سبحانه عن فرعون اللعين أنه قال لهامان: {ابن لي صرحا لعلي أبلغ الأسباب * أسباب السموات فأطلع إلى إله موسى وإني لأظنه كاذبا} . وإنما قال ذلك لأنه سمع موسى عليه السلام يذكر أن ربه في السماء، ألا ترى إلى قوله {وإني لأظنه كاذبا} يعني في قوله: إن في السماء إلهًا، وعلماء الأمة وأعيان الأئمة من السلف رحمهم الله لم يختلفوا في أن الله تعالى على عرشه، وعرشه فوق سماواته.)
“পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা অভিশপ্ত ফিরাউনের উক্তি উদ্ধৃত করেছেন: “হামান, আমার জন্য একটি সুউচ্চ প্রাসাদ নির্মাণ কর, যাতে আমি আসমানের পথসমূহে আরোহণ করতে পারি। সেখানে পৌঁছে মুসার ইলাহ’কে দেখে আসব। নিঃসন্দেহে আমি তাকে মিথ্যাবাদী মনে করি।” ফিরাউন এ কথা এজন্যই বলেছিল যে, সে মুসা (আলাইহিস সালাম)-কে তার প্রতিপালক সম্পর্কে বলতে শুনেছিল, ‘তিনি আসমানে আছেন। লক্ষ্য করো, ফিরাউন বলেছে, “আমি নিশ্চিতভাবেই তাকে মিথ্যাবাদী মনে করি।” অর্থাৎ মুসার এই দাবির প্রতি সন্দেহ পোষণ করে যে, আসমানে কোনো সত্যিকার ইলাহ আছেন। অথচ উম্মাহর বিশিষ্ট আলিমগণ ও সালাফে সালিহীনের নেতৃস্থানীয় ইমামদের মাঝে এ ব্যাপারে কোনো মতবিরোধ নেই যে, আল্লাহ তাআলা স্বীয় আরশের উপর সমুন্নত, আর তাঁর আরশ সমস্ত আসমানের ঊর্ধ্বে।”(আকীদাতুস সালাফ ওয়া আসহাবিল হাদিস,আবু উসমান আস-সাবুনি; তাহকীক: নাসির আল-জাদী’; পৃষ্ঠা: ১৭৬)।
.
(১১). ইমাম ইবনু আব্দিল বার্র আল-মালিকি (রাহিমাহুল্লাহ) (মৃত: ৪৬৩ হি.) বলেন: (فَدَلَّ على أن موسى عليه السلام كان يقول: إلهي في السماء، وفرعون يظنه كاذبا.) “এ ঘটনা প্রমাণ করে যে, মুসা আলাইহিস সালাম বলতেন, “আমার ইলাহ আসমানে আছেন, আর ফিরাউন এ দাবিকে মিথ্যা বলে প্রত্যাখ্যান করেছিল।”(ইবনে আব্দিল বার; আত-তামহিদ লিমা ফিল মুআত্তা মিনাল মা’আনি ওয়াল আসানিদ ৭ম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১৩৩)। তিনি (রাহিমাহুল্লাহ) আরো বলেছেন: ولم يزل المسلمون إذا دهمهم أمر يقلقهم فزعوا إلى ربهم فرفعوا أيديهم وأوجههم نحو السماء يدعونه ومخالفونا ينسبونا في ذلك إلى التشبيه والله المستعان ومن قال بما نطق به القرآن فلا عيب عليه عند ذوي الألباب“আর মুসলিমরা সর্বদাই এ আমলের ওপরই ছিল তারা অকস্মাৎ কোনো বিপদে আক্রান্ত হলে তাদের রবের কাছে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ছুটে যায়, আকাশের দিকে নিজেদের হাত উঠিয়ে ও চেহারা তুলে তাকিয়ে দোয়া করতে থাকে। পক্ষান্তরে আমাদের বিরোধীরা এ ক্ষেত্রে আমাদেরকে তাশবিহ তথা সাদৃশ্যবাদের দিকে সম্পৃক্ত করে (অর্থাৎ আল্লাহ ওপরে আছেন বলে আমরা তাদের মতে সাদৃশ্যবাদী মুশাব্বিহা হয়ে গেছি)! আল্লাহুল মুস্তাআন। যাদের বুদ্ধি আছে, তাদের নিকটে সে ব্যক্তির কোনোই দোষ নেই, যে কুরআনের কথা অনুযায়ী কথা বলেছে।” [বিস্তারিত দ্রষ্টব্য: ইবনু আব্দিল বার্র কৃত আল-ইস্তিজকার, খণ্ড: ৭; পৃষ্ঠা: ৩৩৭; দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যা (বৈরুত) কর্তৃক প্রকাশিত; প্রকাশকাল: ১৪২১ হি./২০০০ খ্রি. (১ম প্রকাশ)।
.
(১২). সাদ বিন আলী যাঞ্জানী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত:৪৭১ হি.] তার সুন্নাহ বিষয়ক কবিতার ব্যাখ্যায় বলেন: (وأخبر عن فرعون أنه قال: {يَا هَامَانُ ابْنِ لِي صَرْحًا لَعَلِّي أَبْلُغُ الْأَسْبَابَ * أَسْبَابَ السَّمَاوَاتِ فَأَطَّلِعَ إِلَى إِلَهِ مُوسَى وَإِنِّي لَأَظُنُّهُ كَاذِبًا} وكان فرعون قد فهِم عن موسى أنه يُثبت إلهًا فوق السماء حتى رام بصرحه أن يطلع إليه، واتهم موسى بالكذب في ذلك، ومُخالفنا ليس يعلم أن الله فوقه بوجود ذاته فهو أعجز فهمًا من فرعون.) “ফেরাউন সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন: “ফিরআউন আরও বলল, হে হামান! আমার জন্য তুমি নির্মাণ কর এক সুউচ্চ প্রাসাদ যাতে আমি অবলম্বন পায়। আসমানে আরোহনের অবলম্বন, যেন দেখতে পায় মুসার ইলাহকে; আর নিশ্চয় আমি তাকে মিথ্যাবাদী মনে করি।”ফেরাউন বুঝেছিল যে, মুসা আলাইহিস সালাম. আসমানের উপরে একজন স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণ করছেন। তাই সে এই প্রাসাদ বানিয়ে সেখানে পৌঁছতে চাইল এবং মুসাকে এ বিষয়ে মিথ্যাবাদী ভাবল। অথচ আমাদের বিরোধীরা (যারা আল্লাহর স্থান নিয়ে ভিন্ন মত পোষণ করে) ফেরাউনের চেয়েও জ্ঞানহীন তারা স্বীকার করে না যে আল্লাহ তার সত্তাগতভাবে আসমানের উপরে আছেন।”(ইবনুল কাইয়্যিম আল-জাওজিয়্যাহ, “ইজতিমাউল জুয়ুশিল ইসলামিয়্যাহ আলা গাজয়ীল মু‘আত্তিলা ওয়াল জাহমিয়্যাহ” পৃষ্ঠা: ১৯৭-১৯৮)-তে এটি উল্লেখ করেছেন। এ গ্রন্থটি আওয়াদ আব্দুল্লাহ আল-মুতিক কর্তৃক তাহকীক এবং এটি প্রথম সংস্করণ।
.
(১৩). আবুল কাসেম ইসমাঈল আল-আসবাহানী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৫৩৫ হি.] বলেন: (وأخبر عن فرعون أنه قال:{يَاهَامَانُ ابْنِ لِي صَرْحًا لَعَلِّي أَبْلُغُ الْأَسْبَابَ أَسْبَابَ السَّمَاوَاتِ فَأَطَّلِعَ إِلَى إِلَهِ مُوسَى وَإِنِّي لَأَظُنُّهُ كَاذِبًا} فكان فرعون قد فهِم عن موسى أنه يثبت إلهًا فوق السماء حتى رام بصرحه أن يطلع إليه،واتّهم موسى بالكذب في ذلك)ফেরাউন সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন: “ফিরআউন আরও বলল, হে হামান! আমার জন্য তুমি নির্মাণ করো এক সুউচ্চ প্রাসাদ যাতে আমি অবলম্বন পায়। আসমানে আরোহনের অবলম্বন, যেন দেখতে পায় মুসার ইলাহকে; আর নিশ্চয় আমি তাকে মিথ্যাবাদী মনে করি।” ফেরাউন বুঝেছিল যে, মুসা আলাইহিস সালাম আসমানের উপরে একজন স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণ করছেন। তাই সে এই প্রাসাদ বানিয়ে সেখানে পৌঁছতে চাইল এবং মুসা আলাইহিস সালাম এর দাবিকে মিথ্যা বলে সন্দেহ করল।”(আল-হুজ্জাহ ফি বায়ানিল মাহাজ্জাহ ইসমাইল আল-আসবাহানি; ২য় খণ্ড)।
.
(১৪). হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] এই আয়াতের তাফসিরে বলেন: يعني أظن موسى كاذبا في أن الله إلهه في السماء، والمخالف في هذه المسألة قد أنكر هذا، يزعم أن موسى كاذب في هذا بطريق القطع واليقين، مع مخالفته لرب العالمين، وتخطئته لنبيه الصادق الأمين، وتركه منهج الصحابة والتابعين، والأئمة السابقين، وسائر الخلق أجمعين. ونسأل الله تعالى أن يعصمنا من البدع برحمته، ويوفقنا لاتباع سنته.”আমি মনে করি মুসা মিথ্যা বলছে যে আল্লাহ আসমানে আছেন।” কিন্তু যে ব্যক্তি এই বিষয়ে (আল্লাহর অবস্থান সংক্রান্ত) ভিন্ন মত পোষণ করে, সে মূলত এটা অস্বীকার করে। সে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে মুসা আলাইহিস সালাম এ ব্যাপারে মিথ্যাবাদী- অথচ এভাবে সে বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহর বিরোধিতা করে, সত্যবাদী ও আমানতদার নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে ভুল বলে আখ্যা দেয় এবং সাহাবা, তাবেঈন, পূর্ববর্তী ইমামগণ ও সমগ্র উম্মতের অনুসৃত পথ থেকে সরে যায়। আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, তিনি যেন তার রহমতে আমাদেরকে বিদ‘আত থেকে রক্ষা করেন এবং তার সুন্নাহ অনুসরণের তাওফিক দেন।”(ইবন কুদামার “ইসবাতু সিফাতিল উলুয়্যী” পৃষ্ঠা: ৬৫)।
.
(১৫). হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ শাইখুল ইসলাম ইমাম তাক্বিউদ্দীন আবুল ‘আব্বাস আহমাদ বিন ‘আব্দুল হালীম বিন তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আন-নুমাইরি, (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন: ومن اعتقد أنه ليس فوق السماوات إله يعبد، ولا على العرش رب يصلى له ويسجد، وأن محمدا لم يعرج به إلى ربه، ولا نزل القرآن من عنده فهو معطل فرعوني ضال مبتدع؛ فإن فرعون كذب موسى في أن ربه فوق السماوات، وقال: يا هامان ابن لي صرحا لعلي أبلغ الأسباب أسباب السماوات فأطلع إلى إله موسى وإني لأظنه كاذبا .ومحمد – صلى الله عليه وسلم – صدق موسى في أن ربه في السماوات، فلما كان ليلة المعراج وعرج به إلى الله تعالى وفرض عليه ربه خمسين صلاة، ذكر أنه لما رجع إلى موسى قال له: ارجع إلى ربك فاسأله التخفيف لأمتك، فإن أمتك لا تطيق ذلك، فرجع إلى ربه فخفف عنه عشرا، ثم رجع إلى موسى فأخبره بذلك، فقال: ارجع إلى ربك فاسأله التخفيف لأمتك. وهذا الحديث في الصحاح .فمن وافق فرعون وخالف موسى ومحمدا فهو ضال، ومن مثل الله بخلقه فهو ضال. قال نعيم بن حماد: من شبه الله بخلقه فقد كفر، ومن جحد ما وصف الله به نفسه فقد كفر. وليس ما وصف الله به نفسه ولا رسوله تشبيها.
“যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে যে,(১).আসমানের উপরে কোনো ইলাহ নেই, যার ইবাদত করা যায়,(২).আরশের উপর কোনো রব নেই, যার উদ্দেশ্যে সালাত আদায় করা যায় এবং যাকে সিজদা করা যায়,(৩).মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে মি‘রাজের মাধ্যমে তার রবের কাছে উঠানো হয়নি,(৪).এবং কুরআন আল্লাহর কাছ থেকে অবতীর্ণ হয়নি, সে একজন ফেরাউনী পথভ্রষ্ট মু‘আত্তিল (আল্লাহর গুণাবলী বা সত্তাকে অস্বীকারকারী) ও বিদ‘আতী। কারণ ফেরাউন মুসা আলাইহিস সালাম-কে এই বিষয়ে মিথ্যাবাদী বলেছিল যে, তার রব আসমানের উপরে রয়েছেন। ফেরাউন বলেছিল: “ফিরআউন আরও বলল, হে হামান! আমার জন্য তুমি নির্মাণ কর এক সুউচ্চ প্রাসাদ যাতে আমি অবলম্বন পায়। আসমানে আরোহনের অবলম্বন, যেন দেখতে পায় মুসার ইলাহকে; আর নিশ্চয় আমি তাকে মিথ্যাবাদী মনে করি।”অথচ মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মুসা আলাইহিস সালাম-এর এই সত্যতা স্বীকার করেছেন যে, তার রব আসমানের উপরে আছেন। মি‘রাজের রাতে যখন তাকে আল্লাহর দিকে উঠানো হয়েছিল এবং তার রব তার উপর পঞ্চাশ ওয়াক্ত সালাত ফরজ করেছিলেন, তখন তিনি (মুসা আলাইহিস্ সালাম এর সাথে সাক্ষাতের ঘটনা) বর্ণনা করেছেন:মুসা আলাইহিস সালাম আমাকে বললেন: “আপনার রবের কাছে ফিরে যান এবং আপনার উম্মতের জন্য সালাত হ্রাসের আবেদন করুন। কেননা তারা এটা পালন করতে সক্ষম হবে না।” আমি ফিরে গেলে আল্লাহ দশ ওয়াক্ত কমিয়ে দিলেন। অতঃপর তিনি মুসা আলাইহিস সালাম এর কাছে ফিরে এসে এটা জানালেন। আবার মুসা আলাইহিস সালাম নবী করিম সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কে বললেন: আপনার রবের কাছে ফিরে যান এবং এবং আপনার উম্মতের জন্য সালাত হ্রাসের আবেদন করুন…( সহিহ হাদীস) সুতরাং,যে ব্যক্তি ফেরাউনের সাথে একমত হয়ে মুসা আলাইহিস সালাম ও মুহাম্মাদ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বিরোধিতা করে, সে পথভ্রষ্ট।যে আল্লাহকে তাঁর সৃষ্টির সাথে সাদৃশ্য দেয়, সেও পথভ্রষ্ট।ইমাম নু‘আইম ইবনে হাম্মাদ রহিমাহুল্লাহ বলেন, যে আল্লাহকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করে, সে কাফির । আর যে আল্লাহ নিজেকে যেসব গুণে বর্ণনা করেছেন তা অস্বীকার করে ,সেও কাফির । অথচ ,আল্লাহ ও তাঁর রসূল যেসব গুণ বর্ণনা করেছেন , তা কোনো সাদৃশ্য ( তাশবীহ) নয়। (ইবনু তাইমিয়াহ মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ১৯৯-২০০)।
.
১৬). ইমাম শামসুদ্দীন আয-যাহাবী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৪৮) বলেন:يعني: أظن موسى كاذبا أن إلهه في السماء، ولو لم يكن موسى عليه السلام يدعوه إلى إله في السماء لما قال هذا؛ إذ لو كان موسى قال له: إن الإله الذي أدعوك إليه، ليس في السماء/ لكان هذا القول من فرعون عبثًا، ولكان بناؤه القصر جنونًا.)“(ফেরাউন বলেন)”আমি মনে করি মুসা মিথ্যা বলছে যে তার রব আসমানে রয়েছেন।’ যদি মুসা আলাইহিস সালাম ফেরাউনকে বলতেন, ‘যে রবের দিকে আমি আহবান করি, তিনি আসমানে নেই,’ তাহলে ফেরাউনের এই কথা অর্থহীন হতো এবং তার প্রাসাদ নির্মাণ পাগলামি ছাড়া কিছুই হতো না!”(ইমাম যাহাবীর “কিতাবুল আরশ”খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা:১৭)।
..
(১৭). আল্লামাহ ইবন আবীল ইয্ আল-হানাফি রহিমাহুল্লাহ [মৃ: ৭৯২ হি.] বলেন:مَنْ نَفَى الْعُلُوَّ مِنَ الْجَهْمِيَّةِ فَهُوَ فِرْعَوْنِي ، وَمَنْ أَثْبَتَهُ فَهُوَ مُوسَوِيٌّ مُحَمَّدِي.”যে ব্যক্তি জাহমিয়াদের মধ্যে থেকে আল্লাহ তাআলার সুউচ্চ সত্তাকে অস্বীকার করবে, সে একজন ফেরাউনি।আর যে ব্যক্তি এটিকে স্বীকার করবে, সে মূসার অনুসারী এবং মুহাম্মদী।”(শারহুল আক্বীদাতিত ত্বহাভিয়াহ: পৃষ্ঠা: ১৮৬)
.
(১৮). সৌদি আরবের প্রথিতযশা মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ ইমাম ‘আব্দুর রহমান বিন নাসির আস-সা‘দী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৩৭৬ হি./১৯৫৬ খ্রি.] বলেছেন,” (وَقَالَ فِرْعَوْنُ) متجرئا على ربه، ومموها على قومه السفهاء، أخِفاء العقول: (يَا أَيُّهَا الْمَلأ مَا عَلِمْتُ لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرِي) أي: أنا وحدي، إلهكم ومعبودكم، ولو كان ثَمَّ إله غيري، لعلمته، فانظر إلى هذا الورع التام من فرعون!، حيث لم يقل ” ما لكم من إله غيري ” بل تورع وقال: (مَا عَلِمْتُ لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرِي) وهذا، لأنه عندهم، العالم الفاضل، الذي مهما قال ؛ فهو الحق، ومهما أمر أطاعوه.فلما قال هذه المقالة، التي قد تحتمل أن ثَمَّ إلها غيره، أراد أن يحقق النفي، الذي جعل فيه ذلك الاحتمال، فقال لـ ” هامان ” (فَأَوْقِدْ لِي يَا هَامَانُ عَلَى الطِّينِ) ليجعل له لبنا من فخار. (فَاجْعَلْ لِي صَرْحًا) أي: بناء (لَعَلِّي أَطَّلِعُ إِلَى إِلَهِ مُوسَى وَإِنِّي لأظُنُّهُ مِنَ الْكَاذِبِينَ) ولكن سنحقق هذا الظن، ونريكم كذب موسى.فانظر هذه الجراءة العظيمة على الله، التي ما بلغها آدمي، كذب موسى، وادَّعى أنه إله، ونفى أن يكون له علم بالإله الحق، وفعل الأسباب، ليتوصل إلى إله موسى، وكل هذا ترويج!!ولكن العجب من هؤلاء الملأ الذين يزعمون أنهم كبار المملكة، المدبرون لشئونها، كيف لعب هذا الرجل بعقولهم، واستخف أحلامهم، وهذا لفسقهم الذي صار صفة راسخة فيهم.فسد دينهم، ثم تبع ذلك فساد عقولهم، فنسألك اللهم الثبات على الإيمان، وأن لا تزيغ قلوبنا بعد إذ هديتنا، وتهب لنا من لدنك رحمة إنك أنت الوهاب”.
“ফেরাউন তার প্রভুর প্রতি ধৃষ্টতা প্রদর্শন করে এবং তার বোকা জনগণকে ধোঁকা দিয়ে বলল ‘যাদের বুদ্ধি-বিবেক লোপ পেয়েছিল’-“হে পরিষদবর্গ! আমি ছাড়া তোমাদের অন্য কোন ইলাহ আছে বলে জানি না!” অর্থাৎ, আমিই একমাত্র তোমাদের মাবুদ ও ইলাহ। যদি আমার অন্য কোনো ইলাহ থাকত, তবে আমি অবশ্যই তা জানতাম। দেখো, ফেরাউন এর পরিপূর্ণ সতর্কতা! সে সরাসরি বলেনি, “তোমাদের অন্য কোনো ইলাহ নেই,” বরং “আমি ছাড়া তোমাদের অন্য কোনো ইলাহ আছে বলে জানি না” বলে সংযত ভাষা ব্যবহার করেছে। কারণ, সে তাদের নিকট ছিল জ্ঞানী ও শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। সে যা-ই বলুক, তা সত্য বলে গণ্য হত। সে যা আদেশ করত, তারা তা মেনে নিত।যখন সে এই কথাটি বলল-যাতে অন্যান্য ইলাহ থাকার সম্ভাবনা থেকে যায়- তখন সে সেই সম্ভাবনা দূর করতে চাইল। তাই সে হামানকে বলল, ‘হে হামান! আমার জন্য কাদা পোড়াও’ (যাতে করে ইট তৈরি করা যায়) এবং “আমার জন্য একটি উচ্চ প্রাসাদ নির্মাণ কর, যাতে আমি মূসার ইলাহকে দেখতে পায়। নিশ্চয় আমি মনে করি, মুসা মিথ্যাবাদী।” অর্থাৎ, আমি তোমাদেরকে এই ধারণাটাই নিশ্চিত করবো এবং মুসার দাবিকে মিথ্যা প্রমাণ করব।দেখো,আল্লাহর প্রতি এই চরম ধৃষ্টতা! কোনো মানুষ এতদূর যায়নি। অতঃপর সে মুসাকে মিথ্যাবাদী আখ্যা দিল, নিজেকে ইলাহ দাবি করল, সত্য ইলাহ’কে নাকচ করল এবং মুসার ইলাহকে খুঁজে বের করার জন্য নানান উপায় অবলম্বন করল। এ সবই ছিল প্রতারণা!কিন্তু আশ্চর্য হলো সেই প্রধানদের বিষয়, যারা রাজ্যের বড় নেতা ও শাসনকর্তা বলে দাবি করত। কীভাবে এই ব্যক্তি তাদের বুদ্ধি-বিবেক নিয়ে খেলা করল এবং তাদের জ্ঞানকে হেয় করল! এটি তাদের পাপাচারের ফল, যা তাদের চরিত্রে গেঁথে গিয়েছিল। তাদের দ্বীন নষ্ট হওয়ার পর তাদের বিবেকও নষ্ট হয়ে গেল। হে আল্লাহ! আমরা আপনার নিকট প্রার্থনা করি, আমাদের ঈমানের উপর অবিচল থাকার তাওফিক দিন।আমাদের হৃদয়কে সত্য পথ থেকে বিচ্যুত করবেন না। যেহেতু আপনি আমাদের হিদায়াত দান করেছেন। আমাদের উপর রহমত বর্ষণ করুন। নিশ্চয়ই আপনি পরম দাতা।”(আত-তাহরীর ওয়াত-তানবীর; খণ্ড: ২০; পৃষ্ঠা: ১২১-১২৪ পৃ.; তাফসীর আস-সাদী পৃষ্ঠা: ৬১৬)
.
পরিশেষে উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে, মহান আল্লাহ আরশের উপর উঠেছেন যারা দাবি করে এটি মহাপাপিষ্ট ফেরাউনের আক্বীদা ছিল তাদের দাবি একেবারেই ভিত্তিহীন ও মিথ্যা। বরং রহমান আরশের উপর উঠেছেন এটি নবী মূসা (আলাইহিস সালাম) সহ সকল নবী-রাসূলদের আক্বীদা এবং এটি এই উম্মতের আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাআতের বিশুদ্ধ আক্বীদা। অপরদিকে “আল্লাহ সর্বত্র বিরাজমান” এই বাতিল আক্বিদাটি কেবল মুসলিম নামধারি বিদআতি ফিরকাগুলোর নয় বরং অনেক কাফের, মুশরিক, ই-হু-দি, খ্রি-ষ্টা-ন, হিন্দু ও অন্যান্য বিভ্রান্ত সম্প্রদায়েরও প্রচলিত আক্বীদা। আল্লাহ আমাদেরকে বাতিল ফিরকাদের ফিতনা থেকে হেফাজত করুন। আমীন!!(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬

বৃহস্পতিবার, ২৭ই রমাদান ১৪৪৬ হিজরি।
২৭ই মার্স ২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ।
সম্পাদনায়: শাইখ মুহাম্মাদ নাসরুল্লাহ মাদানী (হাফি.)।
লিসান্স মাদীনা বিশ্ববিদ্যালয়, সৌদি আরব।