মধ্য শাবানের রাতে শবে বরাত এর নামে যে অনুষ্ঠান ও ইবাদত পালন করা হয় সেগুলোর শারঈ হুকুম

প্রশ্ন: দক্ষিণ এশিয়ার অনেক মুসলিম মধ্য শাবানের রাতে শবে বরাত এর নামে যে অনুষ্ঠান ও ইবাদতগুলো পালন করে সেগুলোর শারঈ হুকুম কি?
▬▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর: শবেবরাত’ শব্দটি একটি যৌগিক শব্দ, যা দুটি অংশ নিয়ে গঠিত ‘শব’ ও ‘বরাত’। ‘শব’ ফারসি ভাষার শব্দ, যার অর্থ রাত বা রজনী। আর ‘বরাত’ আরবি শব্দ, যার অর্থ মুক্তি, সম্পর্কহীনতা, নিষ্কৃতি বা নির্দোষ প্রমাণিত হওয়া। তবে আমাদের দেশে ‘বরাত’ শব্দটি ভুলভাবে ‘ভাগ্য’ বা ‘সৌভাগ্য’ অর্থে ব্যবহৃত হয়।কুরআন ও সহিহ হাদিসে কোথাও ‘শবেবরাত’ বা ‘লাইলাতুল বারাআত’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি। সাহাবি ও তাবিঈদের যুগেও এ পরিভাষার প্রচলন ছিল না। ইতিহাস থেকে জানা যায়, ৪৪৮ হিজরিতে প্রথমবারের মতো জেরুজালেমের বাইতুল মুকাদ্দাস মসজিদে মধ্য শা‘বানের রাতে ‘সালাতুল আলফিয়া’ নামে একটি নতুন ইবাদত চালু করা হয়। এ উপলক্ষে ব্যাপক আলোকসজ্জারও আয়োজন করা হতো।পরবর্তীতে এই প্রথার সঙ্গে নানা বিদআত, পাপাচার ও সীমালঙ্ঘন জড়িয়ে পড়ে, অথচ ইসলামি শরীয়তে এর কোনো ভিত্তি নেই। বরং ১৫ই শাবানের (শবেবরাতের) রাত্রি অন্য যে কোন রাতের ন্যায়। এই রাতে আলাদাভাবে বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে শবেবরাত উদযাপন করা শরিয়তসম্মত নয়; সেটা সালাত পড়ার মাধ্যমে হোক, যিকিরের মাধ্যমে হোক,কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে হোক কিংবা মিষ্টান্ন বা খাবার খাওয়ানোর মাধ্যমে হোক।সকল দিক থেকেই এই রাতকে কোনো ইবাদতের মাধ্যমে নির্দিষ্ট করা বিদ‘আত। কেননা রাসূল (ﷺ) থেকে কোন সহিহ হাদিসে এ রাতে বিশেষ কোন ইবাদত বা অভ্যাস পালন করার শরয়ি ভিত্তি জানা যায় না।অথচ দুঃখজনক হলেও সত্যি, দক্ষিণ এশিয়ার কোনও কোনও মুসলিম দেশ বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানে অসংখ্য মুসলিম শাবান মাসের মধ্যবর্তী দিন (১৫তম দিন) শবেবরাত উদযাপন করে থাকে। এ রাতে বিভিন্ন মসজিদে আলোকসজ্জা করা হয়, গুরুত্বের সাথে সেখানে সারারাত জাগ্রত থেকে সালাত আদায় করা হয়। দিনে সিয়াম পালন করা হয়, রাত জেগে যিকির করা হয়। পাশাপাশি অনেক পাপের কাজও সংঘটিত হয়। যেমন নারী-পুরুষের অবাধ মিলামিশা ও এ রাতের প্রশংসায় গান-বাজনার আসর বসা ইত্যাদি। অনেক সাধারণ মানুষের বন্ধমূল ধারণা হল এগুলো ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। আর শয়তান তাদের এ সকল কর্মকান্ডকে আরো চাকচিক্যময় করে দিয়েছেন এবং এটাকে মুসলিমদের নিদর্শনের অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছেন’ অথচ এই বিষয়ে যা কিছু বর্ণিত আছে সেগুলো সহিহ নয়। বরং এটি অন্য রাতগুলোর মতোই একটি (সাধারণ) রাত। আর এ কারণে আলেমগণ এই দিন উদযাপনকে বিদআত হিসেবে গণ্য করেছেন।কেননা রাসূল (ﷺ) বলেছেন:مَنْ أَحْدَثَ فِي أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيهِ فَهُوَ رَدٌّ“যে ব্যক্তি এমন কোনো কাজ করল, যাতে আমাদের (শার‘ঈ) নির্দেশনা নেই, তা প্রত্যাখ্যাত হবে।”(সহীহ মুসলিম, হা/১৭১৮) তিনি ﷺ আরও বলেছেন,وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الْأُمُورِ، فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ“(দ্বীনের মধ্যে) প্রতিটি নব আবিষ্কার থেকে সাবধান! কারণ প্রতিটি নব আবিষ্কার হলো বিদ‘আত।”(আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৭) প্রচলিত শবেবরাত কেন্দ্রিক যতগুলো বর্ননা পাওয়া যায় সেগুলো সম্পর্কে ইবনে দিহইয়্যা বলেন: শবে বরাতের হাদিসগুলো মাওযু (বানোয়াট)। একটি হাদিস মাকতু। যে ব্যক্তি এমন কোন হাদিসের উপর আমল করে যে হাদিসের ব্যাপারে সাব্যস্ত হয়েছে যে, এটি মিথ্যা সে ব্যক্তি শয়তানের খাদেম।”(আল-ফাতনির রচিত “তাযকিরাতুল মাওযুআত” পৃষ্ঠা: ৪৫) এ বিষয়ে আরও জানতে দেখুন: ইবনুল জাওযির “আল-মাওযুআত” ২/১২৭; ইবনুল কাইয়্যেম এর “আল-মানার আল-মুনীফ ফিস সাহীহ ওয়ায যায়ীফ” পৃষ্ঠা: ৯৮; ইমাম আস-শাওকানীর “আল-ফাওয়ায়েদ আল-মাজমুআ” পৃষ্ঠা: ৫১)
.
মহান আল্লাহর কিতাব এবং রাসূল ﷺ এর সুন্নাহয় ১৫ই শাবান তথা শবেবরাত উপলক্ষে কোনো ইবাদত করা, অনুষ্ঠান পালন করা বিশুদ্ধ দলিল দ্বারা সাব্যস্ত হয়নি। তাই শবেবরাত উদযাপন করা এবং এ উপলক্ষে কোনো ইবাদত করা নিষিদ্ধ বিদ‘আত। এ ব্যাপারে কয়েকজন যুগশ্রেষ্ঠ বিদ্বানের বক্তব্য নিম্নরূপ:
.
(১). মুহাম্মাদ ইবনু ওয়াযাহ আল-কুরতুবী (রাহিমাহুল্লাহ) স্বীয় সনদে ইমাম ‘আব্দুর রহমান বিন যাইদ বিন আসলাম (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৮২ হি.] থেকে বর্ণনা করেন,তিনি আব্দুর রহমান বিন যাইদ বিন আসলাম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,لم أدرك أحدا من مشايخنا ولا فقهائنا يلتفتون إلى ليلة النصف من شعبان ،ولم ندرك أحدا منهم يذكر حديث مكحول ولا يرى لها فضلًا على ما سواها من الليالي.”আমি আমাদের কোনো শাইখ বা ফাক্বীহকে এরূপ পাইনি যে, তাঁরা মধ্য শাবানের রাতের দিকে ভ্রুক্ষেপ করেছেন। আমি তাঁদের কাউকে এরূপ পাইনি যে, তাঁরা এ ব্যাপারে মাকহূলের (ব্যক্তির নাম)-হাদীস বর্ণনা করেছেন। অন্যান্য রাতের ওপর এই রাতের মর্যাদা আছে বলে তাঁরা মনে করতেন না।”(ইমাম ইবনু ওয়াদ্বদ্বাহ আল-বিদা‘উ ওয়ান নাহয়ু ‘আনহা; আসার নং: ১১৩; সনদ: সাহীহ (তাহক্বীক্ব: ‘আমর ‘আব্দুল মুন‘ইম সালিম); পৃষ্ঠা: ৮৪)
.
(২). ইমাম ইবনু ওযায়াহ (রাহিমাহুল্লাহ) স্বীয় সনদে বর্ণনা করেন,أن ابن أبي ملكية قيل له إن زياداً النميري يقول إن ليلة النصف من شعبان أجرها كأجر ليلة القدر فقال ابن أبي ملكية: لو سمعته منه وبيدي عصاً لضربته بها، وكان زيادُ قاضياً.”ইবনু আবী মুলাইকাহ (রাহিমাহুল্লাহ)-কে বলা হলো, “যিয়াদ আন-নুমাইরী মনে করেন যে শা‘বানের ১৫তম রাতের ফজিলত লাইলাতুল কদরের সমতুল্য।” তখন ইবনু আবী মুলাইকাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বললেন, “যদি আমি তার কাছ থেকে এটি শুনতাম এবং আমার হাতে লাঠি থাকত, তবে আমি তাকে লাঠি দিয়ে প্রহার করতাম।” উল্লেখ্য, সে সময় যিয়াদ বিচারকের পদে আসীন ছিলেন।(ইমাম ইবনু ওযায়াহ, কিতাবু ফীহি মা জাআ ফিল বিদ‘ঈ, পৃষ্ঠা: ১০১, হা/১২০; তরতুশী, কিতাবুল হাওয়াদেছ ওয়াল বিদ‘ঈ, ইবনু ওয়াযাহ হতে পৃষ্ঠা: ২৬৩, হা/২৩৫)
(৩). হাফেয ইবনু রজব (রাহিমাহুল্লাহ) একটি গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্যের পর বলেন:وليلة النصف من شعبان كان التابعون من أهل الشام: كخالد بن معدان, ومكحول, ولقمان ابن عامر, وغيرهم يعظمونها ويجتهدون فيها العبادة, وعنهم أخذ الناس فضلها وتعظيمها, وقد قيل: إنه بلغهم في ذلك آثارٌ إسرائيلية, فلما اشتهر ذلك عنهم في البلدان اختلف تعظيمها، فمنهم من قبله منهم ووافقهم على تعظيمها، منهم طائفة من عبّاد أهل البصرة، وغيرهم، وأنكر ذلك أكثر العلماء من أهل الحجاز، منهم: عطاء، وابن أبي مليكه، ونقله عبد الرحمن بن زيد بن أسلم عن فقهاء أهل المدينة، وهو قول أصحاب مالك وغيرهم، وقالوا: ذلك كله بدعة، واختلف علماء أهل الشام في صفة إحيائها على قولين:”শাবান মাসের ১৫তম রাতকে (শাম) সিরিয়াবাসী তাবি‘ঈগণের মধ্যে যেমন খালেদ ইবনু মা‘দান, মাকহূল, লুক্বমান ইবনু আমির (রাহিমাহুল্লাহ) প্রমুখ এ রাতটি খুব সম্মানিত মনে করতেন এবং এ রাতে ইবাদত করতে জোর প্রচেষ্টা চালাতেন। তাঁদের নিকট থেকেই জনসাধারণ এই রাতের মাহাত্ম্য ও মর্যাদা গ্রহণ করেছে। কথিত আছে, এ ব্যাপারে তাঁদের নিকট কিছু ইসরাঈলী বর্ণনা পৌঁছেছে। তাঁদের নিকট থেকে এই বিষয়টি যখন দেশে বিদেশে প্রসিদ্ধি লাভ করল, তখন জনসাধারণ এ ব্যাপারে মতদ্বৈধতায় লিপ্ত হলো। ফলে কিছু মানুষ তা তাঁদের নিকট থেকে গ্রহণ করল এবং এই রাতকে মর্যাদা প্রদানের ব্যাপারে তাঁদের সাথে একাত্মতা পোষণ করল। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন একদল যেমন বাগদাদ ও অন্যান্য অঞ্চলের কিছু সাধক। তবে হেজাজের অধিকাংশ আলেম এই বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আত্তা ইবনু আবী রাবাহ, এবং ইবনু আবী মুলায়কাহ,আবদুর রহমান ইবনু যায়েদ ইবনু আসলাম (রাহিমাহুল্লাহ) প্রমুখ তারা মদিনাবাসী ফাক্বীহগণ থেকে এ বিষয়টি বর্ণনা করেছেন, যারা ইমাম মালেক (রাহিমাহুল্লাহ) ও তার ছাত্রবর্গ ও অন্যান্যদের অভিমত উল্লেখ করেছেন। এবং তারা এগুলো সব বিদ‘আত বলে অভিহিত করেছেন।”ইমাম ইবনু রজব লাত্বাইফুল মা‘আরিফ; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ১৩৭)
·
(৪). ইমাম আবূ ইসহাক্ব আশ-শাত্বিবী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৯০ হি.] বিভিন্ন সময় কেন্দ্রিক বিদ’আতের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন: “فالبدعة إذن عبارة عن طريقة في الدين مخترعة، تضاهي الشرعية، يقصد بالسلوك عليها المبالغة في التعبد لله سبحانه… ومنها التزام الكيفيات والهيآت المعينة، كالذكر بهيئة الاجتماع على صوت واحد، واتخاذ يوم ولادة النبي صلى الله عليه وسلم عيداً، وما أشبه ذلك. ومنها التزام العبادات المعينة، في أوقات معينة، لم يوجد لها ذلك التعيين في الشريعة، كالتزام صيام يوم النصف من شعبان، وقيام ليلته.”সুতরাং বিদআত হচ্ছে দ্বীনি বিষয়ে নব উদ্ভাবিত এমন এক পথ যা শরয়ি পথের প্রতিদ্বন্দ্বী; এ পথ অনুসরণের উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহ্‌ তাআলার ইবাদতে অতিরঞ্জন…। এর মধ্যে রয়েছে নির্দিষ্ট পদ্ধতি ও কাঠামোর অনুসরণ। যেমন সম্মিলিতভাবে এক সুরে যিকির করার পদ্ধতি, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জন্মদিনকে ঈদ (উৎসব) হিসেবে উদযাপন করা ও এ ধরণের অন্যান্য উৎসব। এর মধ্যে রয়েছে নির্দিষ্ট কিছু সময়ে নির্দিষ্ট কিছু ইবাদত পালন করা; শরিয়তে এমন কোন নির্দিষ্টতার দলিল পাওয়া যায় না। যেমন— মধ্যবর্তী শাবানের দিনে রোযা রাখা ও রাতে নামায আদায় করা।”(আল-ই‘তিসাম;খণ্ড:১; পৃষ্ঠা: ৩৭-৩৯) ইমাম আবূ ইসহাক্ব আশ-শাত্বিবী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৯০ হি.] অপর ফাতাওয়ায় বিভিন্ন বিদ‘আত বর্ণনা করতে গিয়ে মধ্য শাবানের দিনে রোজা রাখা এবং রাতে ক্বিয়াম করাকে বিদ‘আত বলে অভিহিত করেছেন। তিনি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, صيام يوم نصف شعبان وقيام ليلته: – ومنها: التزام العبادات المعينة في أوقات معينة لم يوجد لها ذلك التعيين في الشريعة؛ كالتزام صيام يوم النصف من شعبان وقيام ليلته.”মধ্য শাবানের দিনে রোজা রাখা এবং রাতে ক্বিয়াম করা; এর অন্তর্ভুক্ত হলো নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট ইবাদত পালন করা,যে নির্দিষ্টকরণের অস্তিত্ব শরিয়তে পাওয়া যায় না। যেমন মধ্য শাবানের দিনে রোজা এবং রাতে ক্বিয়াম পালন করা।”(আল-ই‘তিসাম; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৪৬)
·
(৫). সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেছেন,
لم يثبت في تخصيص ليلة النصف من شعبان بدعاء أو عبادة دليل صحيح، فتخصيصها بذلك بدعة؛ لقول النبي صلى الله عليه وسلم: «فإن كل محدثة بدعة وكل بدعة ضلالة».
“”মধ্য শাবানের রাতকে কোনো নির্দিষ্ট দো‘আ বা ইবাদতের জন্য বিশেষভাবে নির্ধারণ করার বিষয়ে কোনো সহীহ দলিল পাওয়া যায়নি। তাই এই রাতকে ইবাদত ও দো‘আর জন্য নির্দিষ্ট করা বিদ‘আত। কারণ, নবী ﷺ বলেছেন: ‘নিশ্চয়ই প্রত্যেক নব আবিষ্কৃত বিষয় বিদ‘আত, আর প্রত্যেক বিদ‘আতই পথভ্রষ্টতা।”(সহীহ মুসলিম, হাদিস নং ৮৬৭; ফাতাওয়া লাজনাহ দাইমাহ, ফাতওয়া নং: ২১২৬৪, প্রশ্ন নং: ৮)
.
(৬). বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল প্রশ্ন: “মধ্য শাবানের রাত উদ্‌যাপন করা এবং এই রাত জাগরণ করা কি জায়েজ?” জবাবে তিনি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন:
: لا يجوز الاحتفال بليلة النصف من شعبان، وليس له أصل، ولا ليلة سبع وعشرين من رجب التي يسمونها ليلة الإسراء والمعراج؛ كلها بدعة، لا يحتفل بليلة النصف من شعبان، ولا بليلة سبع وعشرين من رجب، كل هذا من البدع التي أحدثها الناس، وهكذا الاحتفال بالمولد النبوي بدعة، لا يجوز الاحتفال بالمولد النبوي، ولا بليلة النصف من شعبان، ولا بليلة سبعة وعشرين من رجب التي يسمونها ليلة الإسراء والمعراج؛ كل هذا بدعة، لم يفعله رسول الله صلى الله عليه وسلم، ولا خلفاؤه الراشدون، ولا صحابته رضي الله عنهم، ولا السلف الصالح في القرون المفضلة الثلاثة؛ بل هذا مما أحدثه الناس، نسأل الله العافية.
১৫ই শাবানের রাত উদযাপন করা বৈধ নয়, কারণ এর কোনো ধর্মীয় ভিত্তি নেই। একইভাবে, ২৭শে রজবের রাত—যাকে ‘ইসরা ও মেরাজের রাত’ বলা হয় উদযাপন করাও বৈধ নয়। এগুলো সবই জনসাধারণের উদ্ভাবিত বিদ‘আতের অন্তর্ভুক্ত।যা ইসলামি শরিয়তে অনুমোদিত নয়। অনুরূপভাবে নাবী ﷺ এর জন্মদিবস পালন করা বিদ‘আত। নবী ﷺ এর জন্মদিবস, মধ্য শাবানের রাত এবং ২৭শে রজবের রাত তথা ইসরা ও মেরাজের রাত পালন করা জায়েজ নয়। এগুলো সবই বিদ‘আত। আল্লাহর রাসূল ﷺ নিজে এগুলো পালন করেননি, তাঁর সুপথপ্রাপ্ত খলিফারা (রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুম) এবং তিনটি শ্রেষ্ঠ যুগের ন্যায়নিষ্ঠ সালাফগণও এসব উদযাপন করেননি। বরং এগুলো পরবর্তীতে মানুষের উদ্ভাবিত প্রথা। আমরা আল্লাহর কাছেই সঠিক পথের জন্য আশ্রয় প্রার্থনা করি।((দ্র.: বিন বায অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ফাতওয়া নং-১০১৭৮)
.
(৭). সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:
أحبُّ أن أنبِّه علىٰ ثلاث مسائل تُفعَل في النِّصف من هٰذا الشهر أو يذكرها العامة في النِّصف من هٰذا الشهر- شهر شعبان.
المسألة الأولى: أن كثيرًا من العامة يظنون أنَّ ليلة النصف من شعبان هي ليلة القدر، وأنَّه يُكتب فيها ما يكون في السنة، ومن المعلوم أنَّ ليلة القدر في رمضان؛ ودليل ذٰلك قوله تبارك وتعالى في القرآن الكريم: ﴿إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةِ الْقَدْرِ﴾ [سورة القدر: 1]. وفي قوله تعالى: ﴿حم وَالْكِتَابِ الْمُبِينِ إِنَّا أَنْزَلْنَاهُ فِي لَيْلَةٍ مُبَارَكَةٍ إِنَّا كُنَّا مُنْذِرِينَ فِيهَا يُفْرَقُ كُلُّ أَمْرٍ حَكِيمٍ﴾ [الدخان :1- 4] فهذا نصٌّ في أن القرآن نزل في ليلة القدر التي يفرق فيها ويفصل كل أمر حكيم؛ ثم قوله تعالى: ﴿شَهْرُ رَمَضَانَ الَّذِي أُنْزِلَ فِيهِ الْقُرْآنُ هُدًى لِلنَّاسِ وَبَيِّنَاتٍ مِنَ الْهُدَى وَالْفُرْقَانِ﴾ [البقرة: 185]. وهٰذا يدل دلالة أكيدة على أن ليلة القدر في رمضان؛ بل هي في العشر الأواخر من رمضان.
المسألة الثانية: وهي أنَّ بعض الناس يخصُّ ليلته بقيام ويومه بصيام بناء على أحاديث ضعيفة وردت في ذٰلك؛ ولـٰكن حيث لا تصح هٰذه الأحاديث الضعيفة؛ فإنَّ ليلة النصف من شعبان لا تُخصُّ بقيام. ولـٰكن إن كان الإنسان قد اعتاد أن يقوم الليل، فليقم ليلة النصف كغيرها من الليالي، وإن كان لم يعتد ذٰلك فلا يخصها بقيام. كذٰلك في الصوم لا يُخصُّ النصف من شعبان بصوم؛ لأن ذٰلك لم يرد عن رسول الله صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ؛ لكن لو صام الأيام الثلاثة البيض؛ وهي اليوم الثالث عشر، واليوم الرابع عشر، واليوم الخامس عشر، لو صامها فإن صيامها من السنة لـٰكن ليس باعتقاد أنَّ لهٰذا مزية على سائر الشهور وإن «كان رسول الله صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يكثر الصوم في شعبان أكثر من غيره من الشهور حتى كان يصومه كله أو إلا قليلا منه».
المسألة الثالثة: أن بعض الناس يصنع الطعام في اليوم الخامس عشر من شعبان ويدعو إليه الناس، أو يوزعه على الجيران والأقارب معتقدًا أنَّ لذٰلك مزيَّة وفضلاً؛ ولـٰكني أقول: ليس الأمر كذٰلك، فلا يشرع فيه صنع الطعام ولا الدعوة ولا الصدقة؛ بل هو كغيره من الأيام، يصنع فيه من الطعام ما يصنع في غيره وليس له مزية. هٰذه ثلاث بدع يعتادها بعض الناس، فأحببت التنبيه عليها.
“আমি তিনটি বিষয়ে সতর্ক করতে চাচ্ছি,যা সাধারণত এই মাসের মধ্য দিবসে (১৫ই শাবান) পালন করা হয় অথবা যে বিষয়গুলো জনসাধারণ মধ্য শাবান প্রসঙ্গে আলোচনা করে থাকে। যথা:
প্রথম বিষয়: অধিকাংশ সাধারণ মানুষ মনে করে মধ্য শাবানের (১৫ই শাবানের রাত) রাত হলো কদরের রাত, এই রাতে পুরো বছরের ভাগ্যের বিষয়াদি নির্ধারণ করা হয়। অথচ এটি স্পষ্টভাবে জানা যে, লাইলাতুল কদর (শবে কদর) রমজান মাসেই রয়েছে। এর দলিল হলো মহান আল্লাহর এই বাণী, “নিশ্চয় আমি এটি (কুরআন) অবতীর্ণ করেছি কদরের রাতে।” (সূরা কদর: ১) মহান আল্লাহ আরও বলেছেন,”হা-মীম। সুস্পষ্ট কিতাবের কসম! নিশ্চয় আমি এটি নাজিল করেছি; এক বরকতময় রাতে; নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী। এই রাতে প্রতিটি প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়।”(সূরাহ দুখান:১-৪) এটি এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট প্রমাণ করে যে, কুরআন লাইলাতুল কদরে অবতীর্ণ হয়েছে, যেই রাতে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারণ করা হয়। পাশাপাশি আল্লাহ আরও বলেন “রমজান মাস, যাতে কুরআন নাজিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে।”(সূরা বাকারা: ১৮৫) এটি জোরালোভাবে প্রমাণ করছে যে,লাইলাতুল কদরের রাত রমজান মাসে। এবং এই রাত রমাজানের শেষ দশকে রয়েছে।
.
দ্বিতীয় বিষয়: কিছু মানুষ ১৫ই শাবানের রাতকে বিশেষভাবে সালাত (কিয়ামুল লাইল) ও দিনে রোজা রাখার মাধ্যমে নির্দিষ্ট করে,শুধুমাত্র এ ব্যাপারে বর্ণিত কিছু দুর্বল ও ভিত্তিহীন হাদিসের উপর ভিত্তি করে। যেহেতু এই সংক্রান্ত হাদিসগুলো বিশুদ্ধ নয়, সেহেতু মধ্য শাবানের রাতকে ক্বিয়ামের (সালাতের) মাধ্যমে নির্দিষ্ট করা যাবে না। কিন্তু কোনো ব্যক্তি যদি নিয়মিত রাতে ক্বিয়াম করতে অভ্যস্ত হয়, তাহলে সে অন্যান্য রাতের মতো মধ্য শাবানের রাতেও ক্বিয়াম করবে। কিন্তু সে যদি এতে অভ্যস্ত না হয়, তাহলে এই রাতকে ক্বিয়ামের মাধ্যমে নির্দিষ্ট করবে না। তা নির্দিষ্ট করা বিদ‘আত হবে।অনুরূপভাবে ১৫ই শাবানের দিনকে রোজার মাধ্যমে নির্দিষ্ট করা যাবে না। কেননা এ বিষয়ে রাসূলুল্লাহ ﷺ থেকে সাব্যস্ত হয়নি। কিন্তু কেউ যদি আইয়্যামে বীদ্বের তিনদিন তথা প্রত্যেক মাসের ১৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোজা থাকে, তাহলে (শাবান মাসেও) তা রাখা সুন্নাত। কিন্তু এই বিশ্বাস পোষণ করা যাবে না যে, অন্যান্য মাসের রোজার ওপর এই রোজার বিশেষ মাহাত্ম্য (ফজিলত) রয়েছে। যদিও আল্লাহর রাসূল ﷺ শাবান মাসে অন্য মাসের চেয়ে বেশি রোজা রাখতেন। এমনকি তিনি পুরো শাবান মাস বা তার চেয়ে কিছু কম সংখ্যক রোজা রাখতেন।
তৃতীয় বিষয়: কিছু লোক ১৫ই শাবানে বিশেষভাবে খাদ্যসামগ্রী তৈরি করে এবং এই খাবারের দিকে মানুষকে আহ্বান করে, অথবা প্রতিবেশি ও আত্মীয়স্বজনের মাঝে তা বিতরণ করে, এই বিশ্বাস রেখে যে, এই কাজের বিশেষ মাহাত্ম্য ও শ্রেষ্ঠত্ব (সওয়াব) রয়েছে। কিন্তু আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই— এটি শরিয়তসম্মত কোনো আমল নয়। এই দিনে বিশেষ খাবার তৈরি করা, কাউকে আমন্ত্রণ জানানো বা দান-সদকা করা—এসবের কোনো শরয়ি ভিত্তি নেই। বরং এটি (১৫ই শাবান) অন্য দিনগুলোর মতোই একটি (সাধারণ) দিন। এই দিন সেই খাদ্যই তৈরি করা হবে, যা অন্য দিনগুলোতে তৈরি করা হয়। এর কোনো বিশেষ শ্রেষ্ঠত্ব নেই।সুতরাং এই হলো তিনটি বিদ‘আত, কিছু লোক যা পালন করতে অভ্যস্ত হয়েছে। আমি এগুলোর ব্যাপারেই সতর্ক করার ইচ্ছা করেছিলাম।”(ইবনু ‘উসাইমীন; মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল; খণ্ড: ৭; পৃষ্ঠা: ২৭৯-২৮১)
.
(৮). যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫৪ হি./১৯৩৫ খ্রি.] প্রদত্ত ফাতওয়া—
الحاصل أنه لم يثبت بخصوص ليلة النصف من شعبان دليل يقتضي إحياءها بالقيام، ولم يثبت كذلك في يوم الخامس عشر من شعبان دليل يقتضي تخصيصه بالصيام، فما يفعله بعض الناس خصوصًا العوام في هذه الليلة أو في هذا اليوم هذا كله بدعة يجب النهي عنه، والتحذير منه.
“সংক্ষেপে বলা যায়, নির্দিষ্টভাবে মধ্য শাবানের রাতের ব্যাপারে এমন কোনো নির্ভরযোগ্য দলিল সাব্যস্ত হয়নি, যা এই রাতে কিয়ামের মাধ্যমে ইবাদত করা জরুরি বলে প্রমাণ করে। একইভাবে, ১৫ই শাবানের দিনে রোজা রাখার ব্যাপারেও কোনো প্রামাণ্য দলিল নেই, যা এই দিনকে বিশেষভাবে নির্ধারণ করার নির্দেশ প্রদান করে। অথচ কিছু মানুষ, বিশেষত আমজনতা, এই রাত বা দিনকে কেন্দ্র করে যে সব আমল করে থাকে, তা সম্পূর্ণরূপে বিদ‘আত। এটি পরিহার করা এবং মানুষকে এ থেকে সতর্ক করা ওয়াজিব।”(আল-মুনতাক্বা মিন ফাতাওয়া আল-ফাওযান; প্রশ্ন নং: ১৫৬)
.
(৯). প্রচলিত শাবানের রাত (শবে বরাত) শিশুদের মাঝে মিষ্টান্ন বিতরণ করার মাধ্যমে কি উদযাপন করা যাবে কি এমন প্রশ্নের জবাবে স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ আরেক ফাতওয়ায় বলেছেন,
“لا يجوز الاحتفال بمناسبة ليلة القدر ولا غيرها من الليالي ولا الاحتفال لإحياء المناسبات؛ كليلة النصف من شعبان، وليلة المعراج، ويوم المولد النبوي؛ لأن هذا من البدع المحدثة التي لم ترد عن النبي صلى الله عليه وسلم ولا عن أصحابه، وقد قال صلى الله عليه وسلم: من عمل عملا ليس عليه أمرنا فهو رد، ولا يجوز الإعانة على إقامة هذه الاحتفالات بالمال ولا بالهدايا ولا توزيع أكواب الشاي، ولا يجوز إلقاء الخطب والمحاضرات فيها؛ لأن هذا من إقراراها والتشجيع عليها، بل يجب إنكارها وعدم حضورها”
“লাইলাতুল ক্বদর উদযাপন করা বা অন্য কোন রাত উদযাপন করা, কিংবা শবে বরাত, শবে মেরাজ, ঈদে মিলাদুন্নবী ইত্যাদি উপলক্ষগুলো উদযাপন করা জায়েয নেই। কেননা এসব হচ্ছে– নবপ্রবর্তিত বিদআত; যেগুলোর সমর্থনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তাঁর সাহাবীবর্গ থেকে এমন কিছু উদ্ধৃত হয়নি। বরং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করে যা আমাদের শরিয়তে নেই সেটা প্রত্যাখ্যাত”। এ ধরণের উপলক্ষগুলো উদযাপনের জন্য অর্থ, উপঢৌকন বা চা বিতরণ করার মাধ্যম সহযোগিতা করাও জায়েয নেই। এ ধরণের উপলক্ষে খোতবা ও আলোচনা পেশ করাও জায়েয নেই। কেননা এর মাধ্যমে এ উপলক্ষগুলো উদযাপনের প্রতি সমর্থন দেয়া হয় ও উৎসাহ দেয়া হয়। বরং এগুলোর নিন্দা করা এবং এগুলোতে উপস্থিত না হওয়া ওয়াজিব।”(ফাতাওয়া লাজনাহ দাইমাহ, খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ২৫৭-২৫৮)
(১০). আমাদের ইমাম আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: আমাদের সমাজে কিছু কিছু উপলক্ষকেন্দ্রিক কিছু প্রথা আছে আমরা বংশানুক্রমে যেগুলো পালন করে আসছি। যেমন– ঈদুল ফিতর উপলক্ষে কেক ও বিস্কুট তৈরী করা, রজব মাসের ২৭ তারিখ ও শাবানের ১৫ তারিখ উপলক্ষে গোশত ও ফল-ফলাদির ডিশ তৈরী করা এবং আশুরার দিনে বিশেষ ধরণের কিছু মিষ্টান্ন তৈরী করা অনিবার্য। এসব ব্যাপারে শরিয়তের হুকুম কী?
জবাবে তিনি বলেন:
أما إظهار الفرح والسرور في أيام عيد الفطر وعيد الأضحى فإنه لا بأس به إذا كان في الحدود الشرعية، ومن ذلك أن يأتي الناس بالأكل والشرب وما شابه ذلك، وقد ثبت عن النبي صلى الله عليه وسلم أنه قال: أيام التشريق أيام أكل وشرب وذكر لله عز وجل. ويعني بذلك الأيام الثلاثة التي تلي عيد الأضحى، حيث يضحي الناس ويأكلون من ضحاياهم ويتمتعون بنعم الله عليهم، وكذلك في عيد الفطر لا بأس بإظهار الفرح والسرور ما لم يتجاوز الحد الشرعي.أما إظهار الفرح بليلة السابع والعشرين من رجب أو في ليلة النصف من شعبان أو يوم عاشوراء فإنه لا أصل له، بل هو منهي عنه، ولا يحضر المسلم إذا دعي لمثل هذه الاحتفالات؛ فقد قال صلى الله عليه وسلم: إياكم ومحدثات الأمور؛ فإن كل محدثة بدعة، وكل بدعة ضلالة.وليلة السابع والعشرين من رجب يدعي بعض الناس أنها ليلة المعراج التي عرج فيها الرسول صلى الله عليه وسلم إلى الله عز وجل، وهذا لم يثبت من الناحية التاريخية، وكل شيء لم يثبت فهو باطل، والمبنى على الباطل باطل. وحتى لو افترضنا أن ذلك قد حدث في تلك الليلة فإنه لا يجوز لنا أن نحدث فيها شيئاً من شعائر الأعياد أو العبادات؛ لأن ذلك لم يثبت عن النبي صلى الله عليه وسلم، ولم يثبت عن أصحابه الذين هم أولى الناس به وهم أشد الناس حرصا على سنته واتباع شريعته، فكيف يجوز لنا أن نحدث ما لم يكن في عهد النبي صلى الله عليه وسلم ولا في عهد أصحابه؟! وحتى ليلة النصف من شعبان لم يثبت عن الرسول صلى الله عليه وسلم شيء من تعظيمها أو إحيائها، وإنما أحياها بعض التابعين بالصلاة والذكر، لا بالأكل والفرح وظهور شعائر الأعياد”.
“ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার দিন আনন্দ ও খুশি প্রকাশ করতে কোন বাধা নেই; যদি সেটা শরিয়তের গণ্ডির মধ্যে হয়। যেমন– লোকেরা সবাই খাবার ও পানীয় ইত্যাদি নিয়ে একত্রিত হওয়া। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সাব্যস্ত হয়েছে যে, “তাশরিকের দিনগুলো পানাহার ও আল্লাহ্‌র যিকিরের দিন”। তিনি এর দ্বারা বুঝাতে চেয়েছেন ঈদুল আযহার পরের তিনদিন যে সময়ে মানুষ কোরবানি করে, কোরবানির গোশত খায় এবং আল্লাহ্‌র নিয়ামত উপভোগ করে। অনুরূপভাবে ঈদুল ফিতরের দিনও আনন্দ-খুশি প্রকাশ করতে কোন বাধা নেই; যদি সেটা শরিয়তের গণ্ডি অতিক্রম না করে। আর রজব মাসের ২৭ তারিখে কিংবা ১৫ শাবানের রাতে কিংবা আশুরার দিনে খুশি প্রকাশ করা– এর কোন ভিত্তি নেই। বরং সেটা নিষিদ্ধ। কোন মুসলিম এ ধরণের কোন অনুষ্ঠানের দাওয়াত পেলে সেখানে যাবেন না। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “তোমরা নবপ্রবর্তিত বিষয়গুলো থেকে বেঁচে থাক। কেননা প্রত্যেক নবপ্রবর্তিত বিষয় বিদাআত। আর প্রত্যেক বিদাআতই ভ্রষ্টতা”।” রজব মাসের ২৭ শে রাতকে কেউ কেউ লাইলাতুল মে’রাজ দাবী করেন; যে রাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ্‌র সান্নিধ্যে মে’রাজে গিয়েছেন। ঐতিহাসিক দিক থেকে এটি সাব্যস্ত হয়নি। আর যা কিছু সাব্যস্ত নয় সেটা বাতিল। বাতিলের উপর ভিত্তি করে যা কিছু গড়ে ওঠে সেটাও বাতিল। যদি আমরা ধরে নেই যে, সে রাতেই মেরাজ সংঘটিত হয়েছে তদুপরি সে রাতে কোন প্রকার উৎসব-অনুষ্ঠান বা ইবাদত প্রবর্তন করা আমাদের জন্য জায়েয হবে না। কারণ এসব কিছু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সাব্যস্ত হয়নি এবং তাঁর সাহাবীবর্গ থেকেও সাব্যস্ত হয়নি যারা তাঁর সবচেয়ে কাছের মানুষ এবং তাঁর সুন্নত ও শরিয়ত অনুসরণে সবচেয়ে আগ্রহী। তাহলে আমাদের জন্য কিভাবে এমন কিছু প্রবর্তন করা জায়েয হতে পারে যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের যামানায় ছিল না এবং তাঁর সাহাবীদের যামানায় ছিল না?! এমন কি মধ্য শাবানের রাতের ব্যাপারেও নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এ রাতকে অতিরিক্ত মর্যাদা দেয়া ও ইবাদতে রাত কাটানো সাব্যস্ত হয়নি। বরং কিছু তাবেয়ি থেকে নামায ও যিকিরের মাধ্যমে এ রাত কাটানো সাব্যস্ত হয়েছে; খাওয়া-দাওয়া, আনন্দ-ফুর্তি বা উৎসব-অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নয়।”(ফাতাওয়া ইসলামিয়্যা; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৬৯৩)
.
উল্লেখ্য যে প্রচলিত শবেবরাতের ব্যাপারে এরূপ মাহাত্ম্য নবী (ﷺ) থেকে একটি হাদীস বর্নিত হয়েছে যেখানে বলা হয়েছে, এই রাতে মহান আল্লাহ সৃষ্টির দিকে রহমতের দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও মুশাহিন (হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারী) ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করেন। আমাদের শাইখ বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম ইমাম আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) এই হাদীসকে সাহীহ বলে অভিহিত করেছেন।(সিলসিলাহ সাহীহাহ, হা/১১৪৪) কিন্তু বিপরীতে অধিকাংশ আলেম হাদিসটি জয়ীফ বলেছেন। সুতরাং যদিও এই সহীহ ধরে নেওয়া হয় এবং এই রাতের মাহাত্ম্য সাব্যস্ত হলেও, এই রাত উপলক্ষে ইবাদত সাব্যস্ত হয় না। আর যেহেতু এই রাত বা দিন উপলক্ষে কোনো ইবাদত শরিয়তে সাব্যস্ত হয়নি সুতরাং তা শরিয়ত মনে করে পালন করা একটি গর্হিত বিদ‘আত।
.
পরিশেষে প্রিয় পাঠক! আপনাদের সবার উদ্দেশ্যে একটা কথাই বলতে চাই, শাবান মাসে উদযাপনের কিছু নাই। শাবান মাসের মধ্যবর্তীতে কিংবা শেষদিকে বিশেষ কোন ইবাদত নাই। আলাদা ফজিলত আছে মনে করে এ ধরণের কিছু করা বিদাআত ও গর্হিত কাজ। প্রকৃত শবে বরাত বা ভাগ্য রাজনী/বরকতময় রাত হল কদরের রাত। সুতরাং বরকত পেতে চাইলে অর্ধ শাবানের রাত নয়; রামাযানের শেষ দশকের ‘শবে কদর’ উদযাপন করুন। আল্লাহ আমাদেরকে বিদ‘আত ও বিদ‘আতীদের থেকে বেঁচে থাকার এবং রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নাহ অনুযায়ী আমল করার তাওফীক্ব দান করুন। আমীন, ইয়া রাব্বাল ‘আলামীন।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬
আপনাদের দ্বীনি ভাই জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: উস্তায ইব্রাহিম বিন হাসান হাফি.
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি আবহা, সৌদি আরব।
Share: