বিড়ালসহ অন্যান্য প্রাণী হত্যা করার শারঈ হুকুম কী

শারঈ মূলনীতি হচ্ছে স্বাভাবিক ভাবে বিশেষ কয়েকটি ক্ষতিকর প্রাণী যেমন ইঁদুর, বিচ্ছু, কাক, চিল, হিংস্র কুকুর, টিকটিকি ইত্যাদি হারাম এলাকার ভিতরে এবং বাহিরে হত্যা করা ছাড়া সব ধরণের প্রাণীকে বিনা কারণে হত্যা করা হারাম। কারন ইসলাম শান্তির ধর্ম, রহমতের ধর্ম। ইসলাম একমাত্র পরিপূর্ণ এবং মানবতার মুক্তির ধর্ম। এ ধর্মে কেউ অত্যাচারের শিকার হয় না। মানুষ তো নয়ই, এমনকি জীব-জন্তুও নয়। মহান স্রষ্টা আল্লাহ তাআলা মানুষ সৃষ্টির পাশাপাশি মানবজাতির প্রয়োজন পূরণের যাবতীয় ব্যবস্থা রেখেছেন এবং তাদের কল্যাণে অসংখ্য জীবজন্তু সৃষ্টি করেছেন। মানুষের ন্যায় তাদেরও রয়েছে এ ভূপৃষ্ঠে সরব বসবাস। তারাও আল্লাহ তাআলার সুবিশাল সৃষ্ট সদস্য। মহান আল্লাহ বলেন,وَ مَا مِنۡ دَآبَّۃٍ فِی الۡاَرۡضِ وَ لَا طٰٓئِرٍ یَّطِیۡرُ بِجَنَاحَیۡهِ اِلَّاۤ اُمَمٌ اَمۡثَالُکُمۡ ؕ “আর যমীনে বিচরণশীল প্রতিটি জীব বা দু’ডানা দিয়ে উড়ে এমন প্রতিটি পাখি, তোমাদের মত এক একটি উম্মত।(সুরা আনআম: ৬/৩৮) ইসলাম জীবজন্তুর ওপর মানুষের অধিকার নিশ্চিত করেছে। প্রাণীদের সুষম খাদ্য গ্রহণ, সুস্থ-সুন্দর জীবন যাপনে তাদের প্রতি স্নেহশীল আচরণ সৃষ্টির সেরা মানবজাতি হিসেবে আমাদের কর্তব্যও বটে।ইসলামে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্র প্রাণীকে অযথা কষ্ট দেওয়া, আটকে রাখা এবং নিরীহভাবে হত্যা করাকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। যারা বিনা অপরাধে পশু পাখি হত্যা তাদেরকে মহা পাপিষ্ঠ বলে ঘোষণা করা হয়েছে। যেমন: এক হাদীসে রাসূল (ﷺ) বলেছেন,”আল্লাহর নিকট সব চাইতে বড় পাপিষ্ঠ তিন ব্যক্তির তৃতীয় নাম্বার সেই ব্যক্তি যে খামোখা পশু হত্যা করে”।(মুস্তাকরাকে হাকেম হা/২৭৪৩, ইমাম বাইহাকী হা/ ১৪৭৮১,ইমাম আলবানী সহীহুল জামে’ হা/১৫৬৭) এমনকি বনী ইসরাঈলের এক মহিলা একটি বিড়াল হত্যার জন্য জাহান্নামের অধিকারী হয়েছে, কারন সে তাকে বেঁধে রেখেছিল। কিন্তু তাকে কোন প্রকার খাবার দেয়নি বা ছেড়েও দেয়নি যাতে সে পোকা-মাকড় শিকার করে খেতে পারে। ফলে বিড়ালটি ক্ষুধার কারণে মারা যায়। অতএব ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে বিড়ালসহ অন্যান্য প্রাণী হত্যা করার তিনটি অবস্থা হতে পারে আর অবস্থা অনুযায়ী হুকুম ভিন্ন হবে। যেমন:

(১). বিড়াল, কুকুর ইত্যাদি প্রানী ক্ষতিকারক।
.
যদিও স্বাভাবিক ভাবে বিড়াল তেমন ক্ষতিকারক হয়না, তবুও যদি কোন বিড়াল মানুষের জন্য ক্ষতিকারক হয় কিংবা সেটি ক্ষতিকারক ভাইরাস জনিত রোগ বহন করে যেমন: বিড়ালটি তার চারপাশে মানুষ দেখলে কামড় দেয়, বাড়ির হাস মুরগী মেরে ফেলে কিংবা সে এমন ভাইরাস সংক্রামিত জীবাণু বহন করে যা মানুষের জন্য চরম ক্ষতিকর ফলে তার অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়ার কোন উপায় থাকেনা। এমন পরিস্থিতিতে মানুষের কল্যাণার্থে বিড়াল কিংবা কুকুরটি অপেক্ষাকৃত কম কষ্ট দিয়ে হত্যা করা দোষনীয় নয়। এমনকি আত্মরক্ষার জন্য কখনো কখনো ক্ষতিকারক জীবজন্ত হত্যা করা ওয়াজিব হয়ে যায়। যেমন: ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, اقْتُلُوا الْحَيَّاتِ كُلَّهُنَّ فَمَنْ خَافَ ثَأْرَهُنَّ فَلَيْسَ مِنِّي
“তোমরা সাপ মারবে। যে ব্যক্তি তাদের প্রতিশোধের ভয় করবে সে আমার দলভুক্ত নয়।(আবু দাউদ হা/৫২৪৯; সহীহুল জা’মে হা/৬২৪৭) অপর বর্ননায় ইবনু ‘আব্বাস (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি প্রতিশোধের ভয়ে সাপ (না মেরে) ছেড়ে দিবে, সে আমাদের দলভুক্ত নয়”।(আবু দাউদ হা/৫২৫০) আবার অনেক প্রাণী মেরে ফেলাতে শরীয়ত নির্দিষ্ট সওয়াবও ঘোষণা করেছে। যেমন: আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; “যে ব্যক্তি টিকটিকিকে প্রথম আঘাতে বধ করবে, তার জন্য (আমলনামায়) একশত নেকি লিখা হবে। আর দ্বিতীয় আঘাতে মারলে (তার জন্য) তার চাইতে কম এবং তৃতীয় আঘাতে মারলে (তার জন্য) তা অপেক্ষা কম লিখা হবে”।(সহীহ মুসলিম হা/৫৯৮৪, ইবনু মাজাহ হা/৩২২৯, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত তারহীব হা/ ২৯৭৮, সহীহুল জামি‘ হা/৬৪৬০)। সুতরাং কুকুর বিড়াল যদি মানুষের জন্য ক্ষতির কারণ হয় যার ক্ষতি থেকে তাকে হত্যা ব্যতীত পরিত্রাণ পাওয়া দুষ্কর হয় তাহলে সেগুলো হত্যা করা বৈধ।
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণকে বিষ বা অন্য কোন কীটনাশক দিয়ে বিড়াল হত্যার অনুমতি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছিল, বিশেষ করে যদি সেগুলি ক্ষতিকারক হয় বা কোন রোগের সংক্রমণের কারণ হয়,

জবাবে অস্থায়ী কমিটির আলিমগন বলেন,

” لا حرج في قتل القطط إذا كانت مؤذية ، أو بها أمراض ضارة ، إذا لم يتيسر التخلص منها بغير القتل ”

বিড়াল যদি ক্ষতিকারক/কষ্টদায়ক হয় বা ক্ষতিকারক রোগ বহন করে,তাহলে তাকে হত্যা করাতে কোন দোষ নেই। তবে শর্ত হলো, যখন তাকে হত্যা করা ছাড়া তার থেকে পরিত্রাণ পাওয়া সম্ভব নয়”।(ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খন্ড: ১৬ পৃষ্ঠা: ১৯০)
.
স্থায়ী কমিটির আলেমদেরকে আরো জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, একটি হাসপাতালে প্রচুর পরিমাণে বিড়াল দেখা যায় তারা রোগীদের ক্ষতি করে এমন বিড়ালদেরকে বিষ প্রয়োগের মাধ্যমে হত্যা করার বিধান কী?
.
তারা উত্তর দিয়েছেন:

” إذا كان الواقع كما ذكر من خطر القطط ، ولم يمكن حفظ المرضى من أذاها ولا اتقاء شرها والتخلص من خطرها إلا بالقضاء عليها ، جاز قتلها بما هو أيسر وأهون في القضاء عليها ، من سم أو رمي بالرصاص ، أو نحو ذلك ”

“যখন পরিস্থিতি এমন হয় যে, বিড়ালগুলির কারণে বিপদ নেমে আসে এবং রোগীদের তাদের ক্ষতি থেকে রক্ষা করা বা তাদের অনিষ্ট থেকে রক্ষা করা সম্ভব না হয় এবং তাদের ক্ষতি থেকে পরিত্রাণ শুধুমাত্র তাদের হত্যা করার মাধ্যমেই নিষ্পত্তি করা যায় তাহলে এটি (হত্যা করা) জায়েয। এক্ষেত্রে তাদেরকে সহজ উপায়ে হত্যা করতে হবে। আর তা বিষ দিয়েই হোক কিংবা গুলি দিয়েই হোক অথবা এরূপ আরো যা রয়েছে ইত্যাদি।(ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খন্ড: ২৬, পৃষ্ঠা: ১৯০)
.
(২). বিড়ালটি ক্ষতিকর নয় কিন্তু অনিচ্ছাকৃত বা ভুলে হত্যা করা:
.
যদি কোন বিড়াল কিংবা কুকুর মানুষের কোন ক্ষতির কারন না হয় কিন্তু মানুষ অনিচ্ছাকৃতভাবে যেমন: গাড়ী এক্সিডেন্টের মাধ্যমে প্রানীটির মৃত্যু হয় ফলে এর জন্য কোন গুনাহ হবেনা ইনশাআল্লাহ। কারন ঐ ব্যক্তি ইচ্ছাকৃত এমনটি করেননি। মহান আল্লাহ বলেছেন,وَ لَیۡسَ عَلَیۡکُمۡ جُنَاحٌ فِیۡمَاۤ اَخۡطَاۡتُمۡ بِهٖ ۙ وَ لٰکِنۡ مَّا تَعَمَّدَتۡ قُلُوۡبُکُمۡ ؕ وَ کَانَ اللّٰهُ غَفُوۡرًا رَّحِیۡمًا”আর এ বিষয়ে তোমরা কোন ভুল করলে তোমাদের কোন পাপ নেই কিন্তু তোমাদের অন্তরে সংকল্প থাকলে (পাপ হবে)। আর আল্লাহ অধিক ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু”। (সুরা আহযাব: ৫) রাসূল ﷺ বলেছেন, إِنَّ اللَّهَ وَضَعَ عَنْ أُمَّتِى الْخَطَأَ وَالنِّسْيَانَ وَمَا اسْتُكْرِهُوا عَلَيْهِ “নিশ্চই আল্লাহ তাআলা আমার উম্মতের ভুল করা, ভুলে যাওয়া ও জবরদস্তিমূলক কাজের শাস্তি ক্ষমা করে দিয়েছেন”।(ইবনু মাজাহ হা/২০৪৩; বায়হাক্বী কুবরা হা/১৫৯০ সনদ হাসান) আলোচ্য হাদীসটি সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উম্মতের উপর থেকে ভুলত্রুটি ইত্যাদির শাস্তি উঠিয়ে নেওয়ার অন্যতম প্রমাণ।
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: আমি আরাফার দিন অনিচ্ছাকৃত ভাবে তিনটি বিড়াল ছানাকে হত্যা করেছি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, (একজন মহিলাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে বিড়ালের কারণে, সে বিড়ালকে বন্দী করে রেখেছিল, তাকে খেতে দেয়নি কিংবা ছেড়েও দেয়নি, তাকে যদি ছেড়ে দিত তাহলে সে জমিনের পোকামাকড় খেয়ে বাঁচতে পারতো) এদিকে লক্ষ্য করে আমার খুব ভয় হয় যে এজন্য কি আমার বড় পাপ হয়ে গেল ? যদি আমার পাপ হয় তাহলে এর বিনিময়ে আমি কি কিছু দান সদকা করতে পারবো(যে দান সদকার বিনিময়ে আমার পাপ মোচন হবে)?

তিনি উত্তরে বলেছেন:

“ليس عليها ذنب في هذا ، لأنها كما قلت في سؤالك بغير قصد ، وقد قال الله تبارك وتعالى : (وَلَيْسَ عَلَيْكُمْ جُنَاحٌ فِيمَا أَخْطَأْتُمْ بِهِ وَلَكِنْ مَا تَعَمَّدَتْ قُلُوبُكُمْ) فليس عليها شيء ، وليس عليها صدقة أيضاً ، وليس عليها ضمان ، لأن هذه القطط ليست ملكاً لأحد حتى تضمن إلى مالكها ، وليس فيها جزاء حتى يتصدق عنها , وأما الحديث الذي ذكرت في سؤالك فإن هذه المرأة دخلت النار لأنها عذبت الهرة حيث حبستها حتى ماتت جوعاً ، فلا هي أطعمتها ولا هي أرسلتها تأكل من خشاش الأرض ”

“যেহেতু এটা অনিচ্ছাকৃতভাবে হয়েছে তাই এজন্য পাপ হয়নি। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন: “আর এ বিষয়ে তোমরা কোন ভুল করলে তোমাদের কোন পাপ নেই; কিন্তু তোমাদের অন্তরে সংকল্প থাকলে (পাপ হবে)। আর আল্লাহ অধিক ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু”। (সুরা আহযাব: ৫) ফলে এর বিনিময়ে কোন সাদকাহ করতে হবে না কিংবা জরিমানাও লাগবেনা। কারণ এ বিড়ালটি কারো অধিকারে নাই (তার মালিক কেউ নাই) যে তাকে জরিমানা দিবে আর এক্ষেত্রে সাদকাহ দিয়ে কোন প্রতিদানও নাই যে সাদকা প্রদান করবে। আর আপনি আপনার প্রশ্নে যে হাদিসটি উল্লেখ করেছেন, এই মহিলাটি বিড়ালটিকে অত্যাচার করার কারণে জাহান্নামে প্রবেশ করেছিল। সে বিড়ালটিকে খেতে দেয়নি এবং ছেড়েও দেয়নি যে,জমিনের পোকামাকড় খেয়ে বাঁচবে, ফলে বিড়ালটি ক্ষুধার জ্বালায় না খেয়ে মারা গেছে।(উসাইমীন, ফাতাওয়া নূরুন ‘আলাদ দারব,১৩/২৬৬)
.
(৩). বিড়ালটি ক্ষতিকর নয় কিন্তু বিনা কারণে ইচ্ছেকৃত তাকে হত্যা করা:
.
আমরা প্রথমেই উল্লেখ করেছি যে, ইসলামের দৃষ্টিতে বিশেষ কয়েকটি প্রাণী ছাড়া সব ধরণের প্রাণীকে বিনা কারণে হত্যা করা হারাম এবং কবিরা গুনাহ। কেননা কুরআন সুন্নায় এ ব্যাপারে কঠোর নিষেধাজ্ঞা এসেছে,আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাঃ) রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেছেনঃ «مَنْ قَتَلَ عُصْفُورًا فَمَا فَوْقَهَا بِغَيْرِ حَقِّهَا، سَأَلَ اللَّهُ عَزَّ وَجَلَّ عَنْهَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ»، قِيلَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، فَمَا حَقُّهَا؟ قَالَ: «حَقُّهَا أَنْ تَذْبَحَهَا فَتَأْكُلَهَا، وَلَا تَقْطَعْ رَأْسَهَا فَيُرْمَى بِهَا»” যে ব্যক্তি চড়ুই বা তার চাইতে ছোট কোন প্রাণীকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে, তাকে আল্লাহ্‌ তা’আলা কিয়ামতের দিন সে সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন। তখন জিজ্ঞাসা করা হলোঃ ইয়া রাসুলাল্লাহ! তার ন্যায্যতা কী? তিনি বললেনঃ তার ন্যায্যতা হলো তাকে যবেহ করে খাওয়া এবং তার মাথা কেটে নিক্ষেপ না করা।(সুনানে নাসাঈ হা/৪৪৪৫; সহিহুত তারগীব ওয়াত তারহীব হা/২২৬৬); মুস্তাদরাকে হাকিম হা/৭১৪৮; হাদীসটি ইমাম হাকিম বুখারী মুসলিমের শর্তে সহীহ বলেছেন) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছেন,إِنَّ أَعْظَمَ الذُّنُوبِ عِنْدَ اللهِ رَجُلٌ تَزَوَّجَ امْرَأَةً فَلَمَّا قَضَى حَاجَتَهُ مِنْهَا طَلَّقَهَا وَذَهَبَ بِمَهْرِهَا وَرَجُلٌ اسْتَعْمَلَ رَجُلاً فَذَهَبَ بِأُجْرَتِهِ وَآخَرُ يَقْتُلُ دَابَّةً عَبَثًا “আল্লাহর নিকট সব চাইতে বড় পাপিষ্ঠ সেই ব্যক্তি, যে কোন মহিলাকে বিবাহ করে, অতঃপর তার নিকট থেকে মজা লুটে নিয়ে তাকে তালাক দেয় এবং তার মোহরও আত্মসাৎ করে। (দ্বিতীয় হল) সেই ব্যক্তি, যে কোন লোককে মজুর খাটায়, অতঃপর তার মজুরী আত্মসাৎ করে এবং (তৃতীয় হল) সেই ব্যক্তি, যে খামোখা পশু হত্যা করে”।(মুস্তাকরাকে হাকেম হা/২৭৪৩, ইমাম বাইহাকী হা/ ১৪৭৮১, ইমাম আলবানী সহীহুল জামে’ হা/১৫৬৭)
.
অপর হাদীসে এসেছে, এক মহিলা বিনা কারণে বন্দী অবস্থায় না খাইয়ে কষ্ট দিয়ে একটি বিড়ালকে মেরে ফেলার কারণে জাহান্নামী হয়েছে। যেমন আবদুল্লাহ রা. হতে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃعُذِّبَتِ امْرَأَةٌ فِي هِرَّةٍ سَجَنَتْهَا حَتَّى مَاتَتْ فَدَخَلَتْ فِيهَا النَّارَ لاَ هِيَ أَطْعَمَتْهَا وَسَقَتْهَا إِذْ حَبَسَتْهَا وَلاَ هِيَ تَرَكَتْهَا تَأْكُلُ مِنْ خَشَاشِ الأَرْضِ “একজন মহিলাকে একটি বিড়ালের জন্য আযাব (শাস্তি) দেয়া হয় এজন্য যে, সে বিড়ালটিকে আটকে রেখেছিল, পরিশেষে সেটি মারা গেল। যার জন্য সে জাহান্নামে গেল। যে মেয়ে লোকটি বিড়ালটিকে বেঁধে রেখেছে, নিজেও পানাহার করায়নি আর সেটিকে সে ছেড়েও দেয়নি, যাতে সে জমিনের পোকামাকড় খেয়ে বাঁচতে পারে। (সহীহ মুসলিম, হা/৫৭৪৫, অধ্যায়ঃ সালাম (كتاب السلام)-পরিচ্ছদঃ বিড়াল হত্যা করা হারাম-হাদীস একাডেমী)
.
উক্ত হাদীসের ব্যাখায় শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন,

” قال القاضي: في هذا الحديث المؤاخذة بالصغائر، قال: وليس فيه أنها عذبت عليها بالنار، قال: ويحتمل أنها كانت كافرة فزيد في عذابها بذلك.

هذا كلامه، وليس بصواب، بل الصواب المصرح به في الحديث أنها عذبت بسبب الهرة، وهو كبيرة لأنها ربطتها ، وأصرت على ذلك حتى ماتت ، والإصرار على الصغيرة يجعلها كبيرة كما هو مقرر في كتب الفقه وغيرها ”

কাযী রহ বলেন: এ হাদিসের মধ্যে রয়েছে স্বগিরা গুনাহের জন্য তাকে শাস্তি দেওয়া হয়েছে।তাকে এজন্য (বিড়াল বেঁধে রেখে মারা যাওয়ার কারণে) জাহান্নামে শাস্তি দেওয়া হয়নি বরং সে হয়তো কাফের ছিল ফলে তার আজাব এই কারণে বৃদ্ধি করা হয়েছে।

এটি সঠিক কথা নয়। বরং হাদিসের মধ্যে স্পষ্ট সঠিক কথা হল যে মহিলাটিকে আজাব দেওয়া হয়েছে বিড়ালের কারণে আর এটা কাবিরা গুনাহ। কেননা সে মহিলা বিড়ালকে বেঁধে রেখেছিল, বেঁধে রেখে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে বাধ্য করেছিল এমনকি সে মৃত্যুবরণ করেছিল। বিড়ালটিকে যে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে বাধ্য করেছিল, এ বাধ্য করাটা হলো সগিরা গুনাহ আর এ সগিরা গুনাহটি তার জন্য কাবিরা গুনায় পরিণত হয়েছে। এটি সকল ফিক্বহ এবং অন্যান্য গ্রন্থেও স্বীকৃতি হয়ে আছে”।(নববী, শারহু সহীহ মুসলিম, খণ্ড, ৬ পৃষ্ঠা: ২০৭-২০৮)
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে: গাড়ির মাধ্যমে (অজান্তে, ইচ্ছাকৃত নয়) কিছু প্রাণীর হত্যা সম্পর্কে আমি জিজ্ঞাসা করছি যে এ বিষয়ে আমার ওপর কি কোন কিছু আবশ্যক হবে? আল্লাহ তাআলা আপনাদেরকে সম্মানিত করুন, এখানে আমি খাস করছি যে (হত্যাকৃত প্রাণীটি হলো) প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর কিন্তু সেই কুকুরটি উপকারী নয়। আবার কখনো কখনো ইচ্ছাকৃত হত্যা করা হয় এক্ষেত্রে কোন কিছু কি আবশ্যক হবে?

উত্তরে বলা হয়েছে:

” لا يجوز تعمد قتل الحيوان غير المؤذي من القطط والكلاب ونحوها ، فاستغفر الله جل وعلا مما حصل منك من القتل لها ”

বিড়াল, কুকুর ইত্যাদির মতো ক্ষতিকারক নয় এমন প্রাণীকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করা জায়েজ নয়, তাই তোমার পক্ষ থেকে যদি এমন হতো হয়ে থাকো তাহলে তুমি আল্লাহ তাআলার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো।(ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খন্ড: ২৬, পৃষ্ঠা:১৭৩)
.
সুতরাং কেউ যদি ইচ্ছাকৃতভাবে কোন নিরপরাধ প্রাণী হত্যা করে তার জন্য আবশ্যকরা কর্তব্য হলো তার সেই ভুলের জন্য আল্লাহর নিকট একনিষ্ঠ ভাবে তওবা করা এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের অপকর্ম না করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করা। এতে আশা করা যায় আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন ইনশাআল্লাহ। কারন আল্লাহ্‌ তাআলার রহমত অবারিত, বান্দার প্রতি তাঁর দয়া সর্বব্যাপী। তিনি সহিষ্ণু; তাৎক্ষণিকভাবে আমাদেরকে পাকড়াও করেন না, শাস্তি দেন না, কিংবা ধ্বংস করে দেন না। বরং আমাদেরকে সময় দেন। তিনি তাঁর নবীকে নির্দেশ দিয়েছেন যাতে করে তিনি তাঁর মহানুভবতার ঘোষণা দেন: “বলে দিন, ‘হে আমার বান্দারা, যারা নিজেদের ওপর বাড়াবাড়ি করেছ! আল্লাহ্‌র রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। আল্লাহ্‌ তো সব গুনাহ মাফ করে দেন। নিশ্চয়ই তিনি পরম ক্ষমাশীল, অসীম দয়ালু”।[সূরা যুমার, ৩৯: ৫৩] বান্দার প্রতি কোমল হয়ে তিনি বলেন: “তবে কি তারা আল্লাহ্‌র কাছে তওবা করবে না (ফিরে আসবে না), তাঁর কাছে ইস্তিগফার করবে না (ক্ষমাপ্রার্থনা করবে না)?! আল্লাহ্‌ তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”[সূরা মায়িদা, ৫: ৭৪] তিনি আরও বলেন: “আর যে তওবা করে, ঈমান রাখে, সৎকাজ করে এবং সঠিক পথে অবিচল থাকে তার প্রতি আমি অবশ্যই ক্ষমাশীল।”[সূরা ত্বহা, ২০: ৮২] তিনি আরও বলেন: “এবং আর যারা কোন অশ্লীল কাজ করে ফেললে কিংবা নিজেদের প্রতি জুলুম করে ফেললে আল্লাহ্‌কে স্মরণ করে এবং নিজেদের পাপের জন্য ইস্তিগফার করে (ক্ষমা চায়)। আল্লাহ্‌ ছাড়া পাপ ক্ষমা করবে কে? আর তারা জেনেশুনে নিজেদের কৃতকর্মের ওপর জিদ ধরে থাকে না।”[সূরা আলে ইমরান, ৩: ১৩৫] তিনি আরও বলেন: “যে লোক কোন খারাপ কাজ করে কিংবা নিজের প্রতি জুলুম করে, তারপর আল্লাহ্‌র কাছে ক্ষমা চায় সে আল্লাহ্‌কে ক্ষমাশীল ও দয়ালু পাবে।”[সূরা নিসা, ৪: ১১০]নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন: “নিশ্চয় আল্লাহ্‌ তাআলা ততক্ষণ পর্যন্ত বান্দার তওবা কবুল করেন যতক্ষণ পর্যন্ত না গড়গড় শব্দ (মৃত্যুর যন্ত্রণা) শুরু হয়।”(সুনানে তিরমিযি হা/৩৫৩৭)
.
পরিশেষে প্রিয় পাঠক উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে শরীয়ত সম্মত কারণ ব্যতীত কুকুর বিড়াল সহ অন্যান্য প্রাণী বিশেষ করে যেগুলো বিনা কারনে হত্যা করার অনুমতি নেই এমন যেকোন প্রানী হত্যা করা বৈধ নয়।কারন মহান স্রষ্টা আল্লাহ তাআলা মানুষ সৃষ্টির পাশাপাশি মানবজাতির প্রয়োজন পূরণের যাবতীয় ব্যবস্থা রেখেছেন। এবং তাদের কল্যাণে অসংখ্য জীবজন্তু সৃষ্টি করেছেন। মানুষের ন্যায় তাদেরও রয়েছে এ ভূপৃষ্ঠে সরব বসবাস। তারাও আল্লাহ তাআলার সুবিশাল সৃষ্ট পরিবারের সদস্য। মহান আল্লাহ বলেন,وَ مَا مِنۡ دَآبَّۃٍ فِی الۡاَرۡضِ وَ لَا طٰٓئِرٍ یَّطِیۡرُ بِجَنَاحَیۡهِ اِلَّاۤ اُمَمٌ اَمۡثَالُکُمۡ ؕ “আর যমীনে বিচরণশীল প্রতিটি জীব বা দু’ডানা দিয়ে উড়ে এমন প্রতিটি পাখি, তোমাদের মত এক একটি উম্মত।(সুরা আনআম: ৬/৩৮) ইসলাম জীবজন্তুর ওপর মানুষের অধিকার নিশ্চিত করেছে। প্রাণীদের সুষম খাদ্য গ্রহণ, সুস্থ-সুন্দর জীবন যাপনে তাদের প্রতি স্নেহশীল আচরণ সৃষ্টির সেরা মানবজাতি হিসেবে আমাদের কর্তব্যও বটে। সুতরাং পশু পাখির উপর দয়ার পরিবর্তে নিষ্ঠুর আচরণ করা কল্যাণ থেকে বঞ্চিত হওয়ার লক্ষণ। যেমন: হাদীসে এসেছে, নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,مَنْ يُحْرَمِ الرِّفْقَ يُحْرَمِ الْخَيْرَ ‏”‏ “যে ব্যক্তি নম্র আচরণ থেকে বঞ্চিত সে প্রকৃত কল্যাণ থেকেই বঞ্চিত।(সহিহ মুসলিম হা/৬৪৯২; ই.ফা. ৬৩৬২, ই.সে. ৬৪১২) পক্ষান্তরে পশু পাখির প্রতি নিষ্ঠুর আচরণের পরিবর্তে যদি তাদের প্রতি দয়া প্রদর্শন করে তাদেরকে পানাহার করিয়ে বাঁচিয়ে তোলা বড় সওয়াবের কাজ। যেমন হাদীসে এসেছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ (একবার) একটি পতিতা মহিলাকে মাফ করে দেয়া হলো। (কারণ) মহিলাটি একবার একটি কুকুরের কাছ দিয়ে যাবার সময় দেখল সে পিপাসায় কাতর হয়ে একটি কূপের পাশে দাঁড়িয়ে জিহবা বের করে হাঁপাচ্ছে। পিপাসায় সে মরার উপক্রম। মহিলাটি (এ করুণ অবস্থা দেখে) নিজের মোজা খুলে ওড়নার সাথে বেঁধে (কূপ হতে) পানি উঠিয়ে কুকুরটিকে পান করাল। এ কাজের জন্য তাকে মাফ করে দেয়া হলো। (এ কথা শুনে) সাহাবীগণ আরয করলেন, পশু-পাখির সাথে ভাল ব্যবহার করার মধ্যেও কি আমাদের জন্য সাওয়াব আছে? রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেনঃ হ্যাঁ। প্রত্যেকটা প্রাণীর সাথে ভাল ব্যবহার করার মধ্যেও সাওয়াব আছে।(সহীহ বুখারী হা/৩৩২১, সহীহ মুসলিম হা/২২৪৫, মুসনাদে আহমাদ হা/১০৬২১, সহীহ আল জামি‘ আস সগীর হা/ ৪১৬৩) অপর এক হাদীসে রাসূল (ﷺ) তার এক সাহাবীকে বলেন, ‘‘তুমি যদি তোমার বকরীর প্রতি দয়া প্রদর্শন কর, আল্লাহ তোমার প্রতি দয়া প্রদর্শন করবেন”।(মুস্তাদরাক হাকেম,সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত তারহীব হা/ ২২৬৪) আল্লাহ আমাদেরকে সকল প্রকার নেককাজ করার তাওফিক দান করুন এবং যাবতীয় মন্দ কর্ম করা থেকে হেফাজতে রাখুন। আমীন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_________________________
আপনাদের দ্বীনি ভাই:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Share: