প্রশ্ন: প্রথম কাতারে সালাত আদায়ের ফজিলত কি? সালাতে প্রথম কাতারে নিজের জন্য একটি স্থান সংরক্ষিত রাখা এবং দীর্ঘ সময় তা থেকে দূরে থাকার বিধান কি?
▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। আমাদের নবী মুহাম্মদের প্রতি, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাহাবীগণের প্রতি আল্লাহর রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক। অতঃপর কুরআন সুন্নার আলোকে যা প্রমানিত তা হল প্রথম কাতারে সালাত আদায়ের গুরুত্ব অত্যধিক।কারন রাসূল (ﷺ) বলেছেন,”মানুষ যদি জানত আযান দেয়া ও সালাতের প্রথম কাতারে দাঁড়ানোর মধ্যে কী সাওয়াব রয়েছে এবং লটারী করা ছাড়া এ সুযোগ না পেত, তাহলে লটারী করতো। আর যদি জানতো সালাত আদায় করার জন্য আগে আগে আসার সাওয়াব, তাহলে তারা এ (যুহরের) সালাতে অন্যের আগে পৌঁছাবার চেষ্টা করতো। যদি জানতো ‘ইশা ও ফজরের সালাতের মধ্যে কি আছে, তাহলে (শক্তি না থাকলে) হামাগুড়ি দিয়ে হলেও সালাতে উপস্থিত হবার চেষ্টা করতো।”(সহীহ বুখারী হা/৬১৫; মুসলিম হা/৪৩৭; মিশকাত হা/৬২৮) রাসূল (ﷺ) আরো বলেন, সালাতের প্রথম কাতার ফেরেশতাদের কাতারের মতো। তোমরা যদি প্রথম কাতারের ফযীলত জানতে তাহ’লে অবশ্যই দৌঁড়ে যেতে।(আবূদাঊদ হা/৫৫৪; মিশকাত হা/১০৬৬) তিনি (ﷺ) আরো বলেন, প্রথম কাতারের (মুসল্লীদের) উপর আল্লাহ রহমত বর্ষণ করেন এবং ফেরেশতাগণ দো‘আ করেন’(ইবনু মাজাহ হা/৯৯৭)। তিনি আরো বলেন,পুরুষদের জন্য সর্বোত্তম কাতার হ’ল প্রথম কাতার।”(সহীহ মুসলিম হা/৪৪০; মিশকাত হা/১০৯২) এমনকি মসজিদে যদি শুধুমাত্র একটি কাতার থাকে তাহলে সেটিই প্রথম কাতার হিসাবে গণ্য হবে এবং এর যাবতীয় ফযীলত অর্জিত হবে ইনশাআল্লাহ। কেননা প্রথম কাতার বলতে ইমামের পিছনের কাতারকেই বুঝানো হয়েছে।”(ইবনু হাজার,ফাৎহুল বারী; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ২০৮)।
.
▪️সালাতে প্রথম কাতারে নিজের জন্য একটি স্থান সংরক্ষিত রাখা।
.
একজন ব্যক্তি যদি মসজিদে অবস্থান করেন, তবে তিনি কাতারে নির্দিষ্ট স্থানে নিজের জন্য একটি জায়নামাজ বা অনুরূপ কিছু রাখতে পারেন। প্রয়োজনে তিনি মসজিদের পেছনে বিশ্রাম নিতে পারেন, কুরআন তিলাওয়াত করতে পারেন, কিংবা অযুর প্রয়োজন হলে সাময়িকভাবে মসজিদ থেকে বের হতে পারেন। তবে শর্ত হলো, তিনি ইকামতের পূর্বেই নিজের স্থানে ফিরে আসবেন। এ ক্ষেত্রে তিনি তার রাখা স্থানটির অধিক হকদার থাকবেন যদিও তা প্রথম কাতারে থাকে। কিন্তু যদি কেউ জায়নামাজ বিছিয়ে নির্দিষ্ট স্থান সংরক্ষণ করে রেখে বিনা প্রয়োজনে অল্প সময়ের জন্য হলেও বাইরে চলে যান এবং ইকামত হওয়ার নিদিষ্ট সময় পূর্বে উপস্থিত না থাকেন, তবে সেই স্থানে তার আর কোনো অধিকার থাকবে না। সে ক্ষেত্রে তার রাখা জায়নামাজ সরিয়ে ফেলা হবে এবং সেখানে উপস্থিত অন্য কেউ দাঁড়াবে। কারণ যথাসময়ে ফিরে আসার বিষয়ে অবহেলা বা দেরি করা হলে সংরক্ষিত স্থানের অধিকার বাতিল হয়ে যায়। এ ব্যাপারে দলিল হলো: আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত: নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন: তোমাদের কেউ তার বসার স্থান থেকে উঠে গিয়ে আবার ফিরে এলে সে-ই উক্ত স্থানের অধিক হকদার।(সহীহ মুসলিম হা/ ২১৭৯; আবূ দাউদ ৪৮৫৩; মুসনাদে আহমাদ হা/ ৭৫১৪, ৭৭৫১, ৮৩০৪, ৮৮১০, ১০৪৪২, ১১৫৫৯)।
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন,إٍذا جلس في مكان , ثم بدت له حاجة , أو احتاج إلى الوضوء , فله الخروج . . . . فإذا قام من مجلسه , ثم رجع إليه فهو أحق به , لقول النبي صلى الله عليه وسلم : ( مَنْ قَامَ مِنْ مَجْلِسِهِ ثُمَّ رَجَعَ إِلَيْهِ فَهُوَ أَحَقُّ بِهِ ) “যদি কেউ মসজিদের কোনো স্থানে বসেন, এরপর তার কোনো প্রয়োজনে বা ওযু করতে বের হতে হয়, তাহলে সে বের হতে পারে। পরে যদি সে পুনরায় ফিরে এসে আগের স্থানে বসতে চায়, তবে তিনি সেই (যেখানে বসে ছিলেন) স্থানের অধিক হকদার। কারণ, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:”যে ব্যক্তি তার আসন থেকে উঠে পুনরায় সেখানে ফিরে আসে, সে হল বেশি হকদার।(ইবনু কুদামা আল মুগনী: খন্ড: ২; পৃষ্ঠা: ১০১) ।
.
তিনি (ইবনু কুদামা) মাতালিব আওলান নুহা ফী শারহি গায়াতুল মুনতাহা গ্রন্থে বলেছেন:والعائد قريبا من قيامه لعارضٍ لَحِقَه كتطهرٍ أحق بمكانه الذي كان سبق إليه من كل أحد . فلو جلس فيه أحد , فله إقامته . . .”যে ব্যক্তি কোনো কারণবশত সামান্য সময়ের জন্য উঠে গিয়েছিল, যেমন পবিত্রতা অর্জনের জন্য, সে তার আগের জায়গায় ফিরে এসে বসার বেশি হকদার, অন্য যে কারও তুলনায়। যদি তার অনুপস্থিতিতে কেউ সেই জায়গায় বসে যায়, তাহলে সে (প্রথম ব্যক্তি) তাকে উঠিয়ে সেখানে বসতে পারে…(মাতালিব আওলান নুহা ফী শারহি গায়াতুল মুনতাহা খন্ড:১; পৃষ্ঠা: ৭৮৬)।
.
হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ শাইখুল ইসলাম ইমাম তাক্বিউদ্দীন আবুল ‘আব্বাস আহমাদ বিন ‘আব্দুল হালীম বিন তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আন-নুমাইরি, (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন:
: ليس لأحد أن يفرش شيئا ويختص به مع غيبته، ويمنع به غيره، هذا غصب لتلك البعقة، ومنع للمسلمين مما أمر الله تعالى به من الصلاة، والسنة أن يتقدم الرجل بنفسه، وأما من يتقدم بسجادة فهو ظالم إن لم ينته عنه، ويجب رفع تلك السجاجيد، ويمكن الناس من مكانها، هذا مع أن أصل الفرش بدعة، لا سيما في مسجد النبي صلى الله عليه وسلم، ولما قدم عبد الرحمن بن مهدي من العراق وفرش في المسجد أمر مالك بن أنس بحبسه تعزيرا له حتى روجع في ذلك، فذكر أن فعل هذا في مثل هذا المسجد بدعة يؤدب صاحبها. وعلى الناس الإنكار على من يفعل ذلك والمنع منه، لا سيما ولاة الأمر الذين لهم ولاية على المسجد، فإنه يتعين عليهم رفع هذه السجاجيد، ولو عوقب أصحابه بالصدقة بها لكان هذا مما يسوغ في الاجتهاد
“কোনো ব্যক্তির এ অধিকার নেই যে, সে নিজের অনুপস্থিতিতে কোনো স্থান জায়নামাজ বা অন্যকিছু দিয়ে দখল করে রাখবে এবং অন্যদেরকে তা ব্যবহারে বাধা দেবে। এটি একধরণের ঐ স্থান দখল করে রাখা এবং মুসল্লিদেরকে আল্লাহর নির্দেশিত সালাত থেকে বিরত রাখার শামিল। সুন্নাহর নির্দেশ হলো, মানুষ স্বয়ং আগে এসে নিজের জায়গা দখল করবে। কিন্তু যে আগে থেকে জায়নামাজ বিছিয়ে রাখে, সে স্পষ্ট জালিম যদি সে এ কাজ থেকে বিরত না থাকে। এসব জায়নামাজ অপসারণ করা এবং সাধারণ মানুষকে স্বাধীনভাবে সে স্থান ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া আবশ্যক। উল্লেখ্য, মসজিদে জায়নামাজ বিছানোই মূলত বিদআত, বিশেষত মাসজিদে নববীতে। ইতিহাসে দেখা যায়, ইরাক থেকে আগত আবদুর রহমান ইবনে মাহদী যখন মাসজিদে জায়নামাজ বিছান, ইমাম মালিক ইবনে আনাস তাকে শাস্তিস্বরূপ আটকের নির্দেশ দেন, যতক্ষণ না তাকে বিষয়টি পুনরায় চিন্তা করার জন্য বলা হয়। পরবর্তীতে এ নিয়ে আলোচনায় তিনি স্পষ্ট বলেন, “এমন পবিত্র মাসজিদে এ ধরনের কাজ বিদআত, এবং এরকম ব্যক্তিকে শাস্তি দেওয়া উচিত।”এক্ষেত্রে সমাজের দায়িত্ব হলো, এমন অপকর্মের প্রতিবাদ করা এবং তা বন্ধ করার চেষ্টা করা। বিশেষত যারা মাসজিদ পরিচালনার দায়িত্বে নিয়োজিত।তাদের জন্য আবশ্যক হলো এসব জায়নামাজ সরিয়ে দেওয়া। যদি অপরাধীদের শাস্তি হিসেবে এসব জায়নামাজ সদকা করে দেওয়া হয়, তবে এটি গ্রহণযোগ্য ইজতেহাদ হিসেবে বিবেচিত হবে।(অর্থাৎ তা শরিয়তসম্মত সমাধান হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে)”।(ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ২২; পৃষ্ঠা:১৯৩)
..
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] মসজিদে একটি স্থান সংরক্ষিত করার পরে মসজিদ থেকে বের হওয়া নিষেধ সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন:والصحيح في هذه المسألة أن الحجز والخروج من المسجد لا يجوز ، وأن للإنسان أن يرفع المصلَّى المفروش ؛ لأن القاعدة : (ما كان وضعه بغير حق فرفعه حق) ، لكن لو خيفت المفسدة برفعه من عداوة أو بغضاء ، أو ما أشبه ذلك ، فلا يُرفع ، لأن درأ المفاسد أولى من جلب المصالح ، وإذا علم الله من نيتك أنه لولا هذا المصلى المفروش لكنت في مكانه ، فإن الله قد يثيبك ثواب المتقدمين ؛ لأنك إنما تركت هذا المكان المتقدم من أجل العذر “এ মাসয়ালার ক্ষেত্রে সঠিক কথা হল: মসজিদের কোনো জায়গা দখল করা অত:পর মসজিদ ত্যাগ করা জায়েজ নয়। আর যে ব্যক্তি কোনো অধিকার ছাড়া স্থান সংরক্ষণ করে,তার সংরক্ষিত মুসল্লা স্থান থেকে সরিয়ে দেওয়া বৈধ; কারণ মূলনীতি হলো: “যা অন্যায়ভাবে স্থাপন করা হয়েছে, তা অপসারণ করাই ন্যায্য”। তবে যদি এটি সরিয়ে নেওয়ার ফলে শত্রুতা, বিদ্বেষ বা অনুরূপ কোনো ক্ষতিকর পরিণতি বা ফিতনার আশঙ্কা থাকে,তাহলে তা সরানো উচিত নয়, কারণ মন্দ প্রতিরোধ করাই কল্যাণ অর্জনের চেয়ে অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত। নিশ্চয়ই, আল্লাহ তোমার নিয়ত সম্পর্কে অবগত। যদি তোমার অন্তরে এই সংকল্প থাকে যে, যদি সুযোগ থাকত, তুমি সামনের কাতারেই থাকতে, তবে আল্লাহ তোমাকে সামনের কাতারে বসা ব্যক্তিদের মতোই পুরস্কৃত করবেন। কারণ, তুমি কেবল একটি বৈধ কারণেই সেই স্থানটি ছেড়েছো।..(ইবনু উসাইমীন; আশ-শারহুল মুমতি’,খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ১৩৫ থেকে সংক্ষেপিত) ।
.
পরিশেষে উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে প্রথম কাতারে সালাত আদায়ের অত্যাধিক ফজিলত রয়েছে, তাই সকল মুসলিমদের উচিত আগে ভাগে মসজিদের চলে আসা এবং প্রথম কাতারে সালাত আদায়ে সর্বদা সচেষ্ট থাকা। এখন প্রথম কাতারে নিজের জন্য একটি স্থান সংরক্ষণ করে কোন ব্যক্তি যদি মসজিদের বারিন্দায় অবস্থান করে অথবা জরুরি প্রয়োজনে যেমন: প্রস্রাব-পায়খানা কিংবা ওযু করার জন্য মসজিদ থেকে বের হয় অতঃপর ইকামাতের পূর্বে যথা সময়ে জামাআতে হাজির হয় তাহলে সংরক্ষিত ওই স্থানের জন্য এই ব্যক্তি অধিক হকদার সুতরাং তার সংরক্ষিত জায়গা থেকে তার মুসল্লা সরানো উচিত হবে না। কিন্তু একজন ব্যাক্তি যদি প্রথম কাতারে নিজের জন্য একটি স্থান দখল করে বিনা প্রয়োজনে মসজিদ থেকে বের হয় অথবা নিজ বাড়িতে চলে যায় অতঃপর পরবর্তী ওয়াক্তের জামআত শুরু হওয়ার সময় পুনরায় আসে তাহলে এটি জায়েজ নয় এবং এক্ষেত্রে সে তার সংরক্ষিত জায়গার জন্য উপযুক্ত নয় বরং সেখানে উপস্থিত যারা রয়েছেন তারা তার মুসল্লা সরিয়ে উপস্থিত কেউ সেখানে দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করবে। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
________________________
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: শাইখ নাসরুল্লাহ আল মাদানী (হাফি.)।