প্রথমতঃ সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার দায়িত্ব অত্যন্ত কঠিন এবং দীর্ঘমেয়াদী। আল্লাহ তাআলা পিতা-মাতা এবং সন্তান উভয়কে কতিপয় দায়িত্ব প্রদান করেছেন। তাদের জন্য সেসব দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনের চেষ্টা করা ফরজ। এর ব্যাত্যয় ঘটলে আখিরাতে তাদের উভয়কে বিচারেরে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হতে পারে। মাতৃগর্ভে সন্তানের সঞ্চারণ শুরু হবার সময় হতে বড় হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার দায়িত্ব অব্যাহত থাকে। সন্তানের শরীয়ত সম্মত সমস্ত প্রয়োজন পূরণে পিতা-মাতা অমনোযোগী হলে অবশ্যই তাদেরকে জবাবদিহি করতে হবে। কেননা রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকেই আপন আপন দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’(সহীহ বুখারী, হা/৮৯৩ সহীহ মুসলিম হা/৪৮২৮ তিরমিজি হা/১৭০৫)
.
মহান আল্লাহ নিজের এবং বান্দার উপর জুলুম হারাম করেছেন। হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ বলেন,يَا عِبَادِىْ إِنِّىْ حَرَّمْتُ الظُّلْمَ عَلَى نَفْسِىْ وَجَعَلْتُهُ بَيْنَكُمْ مُحَرَّمًا فَلاَ تَظَالَمُوْا، ‘হে আমার বান্দাগণ! আমি আমার ওপর যুলুম করাকে হারাম করে দিয়েছি। তাই আমি তোমাদের জন্যও যুলুম করা হারাম করে দিলাম। অতএব তোমরা (পরস্পরের প্রতি) যুলুম করো না’ (সহীহ মুসলিম হা/২৫৭৭;সহীহুল জামে‘ হা/৪৩৪৫; মিশকাত হা/২৩২৭।) বিদায় হজে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,(মনে রাখবে) তোমাদের জীবন, সম্পদ, ইজ্জত পরস্পরের মধ্যে যেমন হারাম বা পবিত্র। তেমনি আজকের এ দিন এ শহরে হারাম বা পবিত্র। সাবধান! কোন অপরাধকারী যেন তার জীবনের ওপর যুলুম না করে। সাবধান! কোন অপরাধী যেন নিজের সন্তানের ওপর যুলুম না করে। কোন সন্তান যেন তার পিতার ওপর যুলুম না করে। সাবধান! শয়তান চিরদিনের জন্যে নিরাশ হয়ে গেছে এ শহরে তার কোন পূজা হবে (না এ প্রসঙ্গে)। কিন্তু তোমাদের যে সব কাজের মধ্য দিয়ে তার অনুসারী হবে, অথচ সেসব কাজ তোমরা তুচ্ছ মনে করবে। আর এতেই সে খুশী হবে। (সহীহ তিরমিযী ২১৫৯, ইবনু মাজাহ ৩০৫৫, সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী ১৫৮৯৯, সহীহ আল জামি‘ ৭৮৮০মিশকাতুল মাসাবিহ,হা/২৬৭০)
.
এখন কোন পিতা-মাতা যদি বিনা কারণে সন্তানের উপর জুলুম করেন তাহলে সন্তানের উচিত তার পিতা-মাতার সাথে উত্তম ব্যবহার করা এবং কুরআন সুন্নার আলোকে নসিহত করা। অতঃপর যখন বুঝতে পারবে যে, উপদেশ কোন উপকারে আসছে না, তখন পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। যদি ঘরে অবস্থান করা সন্তানের জন্য অধিক কল্যাণকর হয়, তাহলে ঘরেই অবস্থান করবে। আর গৃহত্যাগ করা সর্বাধিক নিরাপদ হলে গৃহ ত্যাগ করবে। মহান আল্লাহ বলেন,‘যে কেউ আল্লাহকে ভয় করবে, আল্লাহ তার নিষ্কৃতির পথ করে দেবেন।’ অন্যত্র তিনি বলেন, ‘আল্লাহকে যে ভয় করবে, তিনি তার সমস্যার সমাধান সহজ করে দেবেন।’(সূরা আত-ত্বালাক্ব: ২ ও ৪)। তবে প্রয়োজনে সন্তান গৃহত্যাগ করলেও কিন্তু পিতা মাতার সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করা যাবে না।কেননা দুনিয়াতে পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা অপরিহার্য। যে কোন মূল্যে সম্পর্ক বজায় রাখতে হবে। (ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, ২৫/২৭৬-২৭৭, ২৬/৩১১-৩১৫ পৃ.)। তাছাড়া রক্তসম্পর্ক ছিন্নকারী ব্যক্তি জান্নাতে প্রবেশ করবে না’(সহীহ বুখারী,মুসলিম, মিশকাত হা/৪৯২২)
.
পিতা-মাতার সাথে সর্বাবস্থায় সুসম্পর্ক রাখাই ইসলামের নির্দেশ। আল্লাহর পরই পিতা-মাতার হক আদায় করা জরূরী। এমনকি পিতা-মাতা কাফের হলেও তাদের সম্মান ও আনুগত্য করতে হবে; যদি না তারা শিরক, কুফরী বা অন্যায়ের আদেশ দেন। (সূরা আনকাবুত; ২৯/৮)। সুতরাং তারা দুনিয়াবী যত কষ্টই দেন না কেন তা ছোট করে দেখতে হবে এবং ধৈর্য ধারণ করতে হবে। সাধ্যমত বুঝানোর চেষ্টা করতে হবে। কোন অবস্থায় তাদেরকে পরিত্যাগ করা যাবে না। কারণ পিতা-মাতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহর সন্তুষ্টি।’ (ইমাম বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৭৮৩০; সহীহুল জামে‘ হা/৩৫০৭)।
.
রাসূল (ﷺ) বলেন, পিতা হলেন জান্নাতের মধ্যম দরজা। এক্ষণে তুমি তোমার পিতা-মাতাকে হেফাযত কর অথবা পরিত্যাগ কর।’(ইবনু মাজাহ হা/২০৮৯; মিশকাত হা/৪৯২৮, সিলসিলা সহীহাহ হা/৯১৪) রাসূল (ﷺ) বলেন, ‘যে ব্যক্তি তার পিতামাতার উভয়কে কিংবা কোন একজনকে বৃদ্ধাবস্থায় পেল কিন্তু জান্নাতে প্রবেশ করতে পারল না; তার নাক ধূলায় ধূসরিত হৌক! একথা তিনি তিনবার বলেন।’(সহীহ মুসলিম হা/২৫৫১; মিশকাতুল মাসাবিহ হা/৪৯১২)
.
বিগত শতাব্দীতে সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১খ্রি.] বলেছেন, ‘শরীআতসম্মত কারণে পিতা-মাতা থেকে পৃথক হওয়া দোষণীয় নয়। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, পিতা-মাতার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করা যাবে। বরং পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা এবং তাদের অধিকার আদায় করা অপরিহার্য। যেমন: তাদের পানাহার ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করা এবং অন্যান্য ব্যয়ভার বহন করা। যদি পিতা-মাতা সালাত ত্যাগকারীও হয়, তবুও তাদের সঙ্গে সদাচরণ করতে হবে।’(লিক্বাউল বাব আল-মাফতূহ, লিক্বা নং-১৪৪; ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৭৭২২)।
.
সন্তানের উপর পিতা-মাতা বিনা কারণে জুলুম করলে সন্তানের করণীয় কি এমন প্রশ্নের উত্তরে বিংশ শতাব্দীর সর্বশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, সৌদি ফাতাওয়া বোর্ডের সাবেক গ্র্যান্ড মুফতী, শাইখুল ইসলাম, ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন,‘হে প্রশ্নকারী! পিতা-মাতার পক্ষ থেকে যে অত্যাচার আপনার উপর আপতিত হচ্ছে, সে ব্যাপারে আমি আপনাকে ধৈর্যধারণ করার উপদেশ দিচ্ছি এবং অত্যাচার কেন করছে তার কারণ জানার চেষ্টা করতে পরামর্শ দিচ্ছি। প্রয়োজনে আপনি পিতা-মাতাকে যুলুমের কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করুন এবং শরী‘আতের দৃষ্টিতে আপত্তিকর না হলে সেগুলোকে বর্জন করুন। আর যদি অকারণেই আপনার উপর অত্যাচার করা হয়, তাহলে একে প্রতিরোধ করার জন্য পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, সমাজ অথবা এমন কোন মান্যবর ব্যক্তির সাহায্য নিন, যার কথাকে আপনার বাবা-মার মান্যতা দেবেন। এছাড়া সদাসর্বদা পিতা-মাতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করতে থাকুন। মন্দ আচরণকে ভাল ব্যবহার দ্বারা প্রতিহত করুন। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘আর ভাল ও মন্দ সমান হতে পারে না। মন্দকে প্রতিহত করুন তা দ্বারা যা উৎকৃষ্ট, ফলে আপনার ও যার মধ্যে শত্রুতা আছে, সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত।’ (সূরা আল-ফুছছিলাত: ৩৪; ফাতাওয়া নূরুন আলাদ দারব ইবনে বায, অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ফাতওয়া নং৭৫৮৩) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_________________________
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।