নিয়ত সম্পর্কে বিস্তারিত

প্রশ্ন: নিয়ত শব্দের অর্থ কি? নিয়ত পড়তে হয় নাকি করতে হয়? সালাত পড়ার পূর্বে কিভাবে নিয়ত করে সালাতে দাঁড়াবো? নিয়ত করার সহীহ পদ্ধতি কোনটি? সকল আমলে সলেহ এর নিয়ত কিভাবে করতে হয়?
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: ‘নিয়ত’ একটি আরবি শব্দ (نية বা نيَّة), যার অর্থ সংকল্প বা ইচ্ছা করা। ইংরেজিতে একে Intention বলা হয়। নিয়তের স্থান হল অন্তর। নিয়ত অন্তরের কাজ, মুখের কাজ নয়। হাফেয ইবনু রজব (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, النية هي: قصد القلب ولا يجب التلفظ بما في القلب في شيء من العبادات ‘নিয়ত হল অন্তরের ইচ্ছা। কোন ইবাদতের ক্ষেত্রে অন্তরে যা আছে তা মুখে বলা ওয়াজিব নয়’।(জামিঊল ঊলূম ওয়াল হিকাম; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৯২) আর শরীআতের পরিভাষায় নিয়ত বলতে দু’টি জিনিস বুঝায়। (১). অভ্যাস থেকে ইবাদতকে আলাদা করা এবং (২). এক ইবাদত থেকে অন্য ইবাদতকে আলাদা করা। নিয়ত হলো এমন এক অন্তরের সংকল্প, যা কর্মের বৈধতা নির্ধারণ করে। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন,إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ، وَإِنَّمَا لِكُلِّ امْرِئٍ مَا نَوَى“নিশ্চয়ই সকল কাজের প্রাপ্য নিয়াতের ওপর নির্ভরশীল। আর প্রত্যেক মানুষ তার নিয়ত অনুযায়ী প্রতিফল পাবে।”(সহীহ বুখারী হা/১; সহীহ মুসলিম হা/১৯০৭) হাদীসে উল্লিখিত নিয়তের উপর নির্ভরশীলের অর্থ হচ্ছে- কর্মের সওয়াব বা শাস্তি নিয়ত অনুসারেই আল্লাহ নির্ধারণ করবেন। সালাত, রোজা, হজ্জ যাকাত ও অন্যান্য ইবাদত বিশুদ্ধ হওয়ার জন্য যেসব শর্ত রয়েছে তার মধ্যে নিয়ত একটি অন্যতম শর্ত। নিয়ত করতে হয়; পড়তে হয় না। তবে ব্যতিক্রম হচ্ছে হজ্ব বা ওমরায় ইহরাম বাঁধার সময় মুসলিম বলবে,“লাব্বাইকা ‘উমরাতান অথবা লাব্বাইকা হাজ্জান।”(সাহীহ মুসলিম, হা/১২৩২) অনুরূপভাবে বর্ণিত হয়েছে যে, যখন হজে বা কুরবানিতে পশু জবাই করা হবে তখন মুসলিম মুখে উচ্চারণ করবে। সে বলবে, ‘হে আল্লাহ, এটা আমার পক্ষ থেকে অথবা অমুকের পক্ষে থেকে। আপনি আমার পক্ষ থেকে তা কবুল করে নিন, নিশ্চয়ই আপনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।’ এগুলো ছাড়া ইসলামি শরীয়তে অন্য যেসব ইবাদত আছে তাতে মুখে নিয়ত উচ্চারণ করা বিদ‘আত। চাই তা রোজা হোক, সালাত হোক, বা অন্য কোনো ইবাদত হোক। কারণ নবী ﷺ থেকে প্রমাণিত হয়নি যে, তিনি ওই সকল জায়গায় মুখে নিয়ত উচ্চারণ করেছেন। সুতরাং মুখে উচ্চারণ করে নাওয়াইতু আন…’’-জাতীয় কিছু বলে যে নিয়ত পড়া হয় তা সর্বসম্মতিক্রমে বিদআত। কারণ নবী (ﷺ) থেকে প্রমাণিত হয়নি যে, তিনি ওই সকল জায়গায় মুখে নিয়ত উচ্চারণ করেছেন। আর রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন, “যে ব্যক্তি এমন কোনো কাজ করল, যাতে আমাদের (শার‘ঈ) নির্দেশনা নেই, তা প্রত্যাখ্যাত হবে।”(সহীহ মুসলিম, হা/১৭১৮) তিনি ﷺ আরও বলেছেন,“(দ্বীনের মধ্যে) প্রতিটি নব আবিষ্কার থেকে সাবধান! কারণ প্রতিটি নব আবিষ্কার হলো বিদ‘আত।”(আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৭)
.
▪️নিয়ত কিভাবে করতে হবে? এবং নিয়তের প্রকারভেদ কি?
আমরা ইতিপূর্ব উল্লেখ করছি যাবতীয় ইবাদতের জন্য নিয়ত একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। নিশ্চিতভাবেই, নিয়ত সংশোধন করা এবং কাজের শুরুতে তা সঠিকভাবে নির্ধারণ করা ইবাদতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক। এর উপরই কাজের গ্রহণযোগ্যতা বা অগ্রহণযোগ্যতা নির্ভর করে, এবং এটি হৃদয়ের সুস্থতা বা অসুস্থতার মাপকাঠি হিসেবে কাজ করে। কারণ, হৃদয় তখনই বিশুদ্ধ হয়, যখন তার সমস্ত কাজ ও প্রচেষ্টা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে নিবেদিত থাকে। ইবনু হাজার হাইছামী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,اَلْأَعْمَالُ الَّتِيْ قُصِدَ بِهَا غَيْرُ اللهِ تَعَالَى يَبْطُلُ ثَوَابُهَا صَارَتْ كَالْهَبَاءِ الْمَنْثُوْرِ “যে সমস্ত আমল আল্লাহ ছাড়া অন্যের উদ্দেশ্যে করা হয়, সেগুলোর সওয়াব বাতিল হয়ে যায় এবং তা বিক্ষিপ্ত ধূলিকণার মতো হয়ে যায়।”(ইবনু হাজার; আয-যাওয়াজিরু আন ইকতিরাফিল কাবাইর ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৬৯) ইবনু শাহীন (রাহিমাহুল্লাহ) ও লালকাঈ (রাহিমাহুল্লাহ) যৌথভাবে সাঈদ ইবনু জুবাইর (রাহিমাহুল্লাহ) থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন,لَا يُقْبَلُ قَوْلٌ وَعَمَلٌ إلَّا بِنِيَّةِ وَلَا يُقْبَلُ قَوْلٌ وَعَمَلٌ وَنِيَّةٌ إلَّا بِمُوَافَقَةِ السُّنَّةِ”আল্লাহর নিকট কোন কথা ও আমল গ্রহণযোগ্য হয় না বিশুদ্ধ নিয়ত ব্যতীত। আর কোন কথা, আমল ও নিয়ত কবুল হয় না সুন্নাত মোতাবেক না হওয়া পর্যন্ত।” (পর্যন্ত’।(ইবনু তাইমিয়্যাহ, মাজমূ‘ঊল ফাতাওয়া, ২২তম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ১৭৭; আল-ইসতিক্বামাহ, ২য় খণ্ড,পৃষ্ঠা: ৩০৯) সুতরাং নিয়ত জায়েয কাজকে ইবাদতে পরিণত করে। আর নিয়ত এমন একটি বিষয়, যা মূলত মনের ইচ্ছা ও সংকল্পকে নির্দেশ করে, এবং এর স্থান অন্তরে। এর সাথে মুখের কোনো সম্পর্ক নেই। এ কারণে নবী (ﷺ) বা তাঁর কোনো সাহাবী থেকে এই বিষয়টির কোনো শব্দবদ্ধ উল্লেখ পাওয়া যায়নি, এবং আমরা তাঁদের কাছ থেকে এর কোনো আলোচনা শুনিনি। তাই আমাদের উচিত প্রতিটি কাজের জন্য বিশুদ্ধ নিয়ত স্থির করা, যাতে তা কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য হয় এবং এতে কোনো লোক দেখানো বা আত্মপ্রচার না থাকে।ইবাদতের ক্ষেত্রে নিয়ত কিভাবে করতে হবে এই বিষয়ে দুইজন ইমামের বক্তব্য।
.
হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ শাইখুল ইসলাম ইমাম তাক্বিউদ্দীন আবুল ‘আব্বাস আহমাদ বিন ‘আব্দুল হালীম বিন তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আন-নুমাইরি, (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: নামাজ বা অন্যান্য ইবাদত শুরু করার সময় কি নিয়ত ভাষায় উচ্চারণ করা আবশ্যক? যেমন, কেউ যদি বলে— “আমি নামাজ পড়ার নিয়ত করছি” বা “আমি রোজা রাখার নিয়ত করছি”, তাহলে কি এটি বাধ্যতামূলক? তিনি উত্তরে বলেন:
، نية الطهارة من وضوء ، أو غسل أو تيمم ، والصلاة والصيام ، والزكاة والكفارات ، وغير ذلك من العبادات ؛ لا تفتقر إلى نطق اللسان باتفاق أئمة الإسلام ، بل النية محلها القلب باتفاقهم ، فلو لفظ بلسانه غلطا خلاف ما في قلبه فالاعتبار بما ينوي لا بما لفظ .ولم يذكر أحد في ذلك خلافا ، إلا أن بعض متأخري أصحاب الشافعي خرج وجها في ذلك ، وغلطه فيه أئمة أصحابه ، ولكن تنازع العلماء هل يستحب اللفظ بالنية ؟ على قولين : فقال طائفة من أصحاب أبي حنيفة ، والشافعي ، وأحمد : يستحب التلفظ بها لكونه أوكد .وقالت طائفة من أصحاب مالك ، وأحمد ، وغيرهما : لا يستحب التلفظ بها ؛ لأن ذلك بدعة لم ينقل عن رسول الله صلى الله عليه وسلم ولا أصحابه ولا أمر النبي صلى الله عليه وسلم أحدا من أمته أن يلفظ بالنية ولا علم ذلك أحدا من المسلمين ، ولو كان هذا مشروعا لم يهمله النبي صلى الله عليه وسلم وأصحابه ، مع أن الأمة مبتلاة به كل يوم وليلة .وهذا القول أصح ، بل التلفظ بالنية نقص في العقل والدين : أما في الدين فلأنه بدعة ، وأما في العقل فلأن هذا بمنزلة من يريد أكل الطعام فقال : أنوي بوضع يدي في هذا الإناء أني آخذ منه لقمة ، فأضعها في فمي فأمضغها ، ثم أبلعها لأشبع فهذا حمق وجهل .وذلك أن النية تتبع العلم ، فمتى علم العبد ما يفعل كان قد نواه ضرورة ، فلا يتصور مع وجود العلم به أن لا تحصل نية ، وقد اتفق الأئمة على أن الجهر بالنية وتكريرها ليس بمشروع ، بل من اعتاده فإنه ينبغي له أن يؤدب تأديبا يمنعه عن التعبد بالبدع ، وإيذاء الناس برفع صوته ، والله أعلم .
“ইসলামের ইমামদের ঐক্যমত্য অনুযায়ী, পবিত্রতা অর্জনের জন্য যেমন ওযু, গোসল, তায়াম্মুম, সালাত, রোজা, যাকাত, কাফফারা এবং অন্যান্য ইবাদত করা হয়, সেগুলোর ক্ষেত্রে মৌখিকভাবে নিয়ত উচ্চারণের প্রয়োজন নেই। তাঁদের মতে, নিয়তের স্থান অন্তরে। যদি কেউ ভুলবশত এমন কিছু বলে ফেলে যা তার অন্তরের বিপরীত, তবে তার মুখে বলা কথা নয়, বরং তার অন্তরে যে নিয়ত রয়েছে, তাই গুরুত্বপূর্ণ। এই বিষয়ে কোনো ইমামও দ্বিমত করেননি। তবে আশ-শাফি’ই মাজহাবের পরবর্তী অনুসারীদের মধ্যে কেউ কেউ মুখে নিয়ত উচ্চারণের পক্ষে মত দিয়েছেন, যদিও তাঁদের মাজহাবের প্রধান আলেমরা এটিকে ভুল বলে গণ্য করেছেন। নিয়ত উচ্চারণ করা কঠিন কিনা এ বিষয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে দুটি মতামত রয়েছে। ইমাম আবু হানিফা, ইমাম শাফেয়ি এবং ইমাম আহমদ (রহ.)-এর কিছু অনুসারী বলেছেন, মুখে নিয়ত উচ্চারণ করা মুস্তাহাব (অর্থাৎ সুন্নত নয়, তবে করলে ভালো), কারণ এটি নিয়তকে আরও দৃঢ় করে। অপরদিকে, ইমাম মালিক, ইমাম আহমদ (রহ.) এবং তাঁদের অন্যান্য অনুসারীরা বলেছেন, মুখে নিয়ত উচ্চারণ করা সুন্নত নয়, বরং এটি বিদআত। কারণ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বা তাঁর সাহাবীগণ কখনো এটি করেছেন না এবং তিনি তাঁর উম্মতের কাউকে নিয়ত উচ্চারণ করার নির্দেশও দেননি। যদি এটি বৈধ ও গ্রহণযোগ্য হতো, তবে নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এবং তাঁর সাহাবিগণ কখনোই এটি উপেক্ষা করতেন না, বিশেষ করে যখন মুসলিমরা প্রতিদিন এবং রাতে এর সম্মুখীন হতো। এ কারণে দ্বিতীয় মত অধিক গ্রহণযোগ্য এবং প্রমাণিত। বরং, মুখে নিয়ত উচ্চারণ করা ধর্মীয় এবং বুদ্ধিবৃত্তিক দুটি দিক থেকেই অপ্রয়োজনীয়। ধর্মীয়ভাবে, এটি বিদআত, কারণ রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) কখনো এটি করেননি। বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে, এটি অযৌক্তিক। যেমন, কেউ যদি খাওয়ার সময় বলে, “আমি হাত দিয়ে খাবার ধরার নিয়ত করছি, এক টুকরো মুখে নেব, চিবাব এবং গিলে ফেলব,” তা যেমন অপ্রাসঙ্গিক, তেমনি ইবাদতের ক্ষেত্রেও মুখে নিয়ত উচ্চারণ করা অযৌক্তিক। কারণ, নিয়ত স্বাভাবিকভাবেই অন্তরে জন্ম নেয় এবং যখন কেউ ইবাদতের জন্য প্রস্তুতি নেয়, তখন তার অন্তরে নিয়ত হয়। সুতরাং, মুখে উচ্চারণের কোনো প্রয়োজন নেই। সকল ইমাম একমত যে, উচ্চস্বরে নিয়ত বলা বা বারবার পুনরাবৃত্তি করা শরিয়তে অনুমোদিত নয়। যদি কেউ এটি অভ্যাসে পরিণত করে, তবে তাকে সতর্ক করা উচিত যাতে সে বিদআত থেকে বাঁচতে পারে এবং অন্যদের বিরক্ত না করে।”(ইবনু তাইমিয়্যাহ ফাতাওয়া আল-কুবরা, খন্ড: ১, পৃষ্ঠা: ২১৪-২১৫)
.
আর রোজা করার জন্য মুখে নিয়াত উচ্চারণ করা বা নিয়াত পড়ার ব্যাপারে বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুফাসসির, মুহাদ্দিস, ফাক্বীহ ও উসূলবিদ আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল:“এই প্রশ্ন ফরজ রোজা বা নফল নামাজের নিয়ত উচ্চারণ করা প্রসঙ্গে। এটি কি জায়েজ?”
জবাবে শাইখ বলেন:
: التلفظ بالنية في جميع العبادات بدعة، فلا يقول الإنسان عند الوضوء: اللهم إني نويت أن أتوضأ، ولا عند الصلاة نويت أن أصلي، ولا عند الصدقة نويت أن أتصدق، ولا عند الصيام نويت أن أصوم، ولا عند الحج نويت أن أحج، فالتلفظ بالنية في جميع العبادات لم يرد عن النبي صلى الله عليه وعلى آله وسلم، ولماذا تتلفظ بالنية؟ أليس النية محلها القلب، أليس الله عز وجل يقول: ﴿ولقد خلقنا الإنسان ونعلم ما توسوس به نفسه﴾. بلى نقول هذا: فالله عالم بالنية، كيف تعلم ربك بأنك ناوي؟ قد يقول: أقول هذا لإظهار الإخلاص لله فنقول: الإخلاص محله القلب أيضاً، وما كان محله القلب يكفي النية في القلب. نعم.
“সকল ইবাদতের ক্ষেত্রে নিয়াত মুখে উচ্চারণ করা বিদ‘আত। এর মানে হলো, যখন কেউ ওজু করতে যায়, সে এ কথা বলবে না যে, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নী নাওয়াইতু আন আতাওয়াদ্বদ্বাআ’ তথা ‘হে আল্লাহ, আমি ওজু করার নিয়ত করলাম’। নামাজ পড়ার সময় কেউ বলবে না যে, ‘নাওয়াইতু আন উসাল্লিয়া’ তথা ‘আমি নামাজ পড়ার নিয়ত করলাম’। দান করার সময় কেউ বলবে না যে, ‘নাওয়াইতু আন আতাসাদ্দাক্বা’ তথা ‘আমি দান করার নিয়ত করলাম’। রোজা করার সময় কেউ বলবে না যে, ‘নাওয়াইতু আন আসূমা’ তথা ‘আমি রোজা করার নিয়ত করলাম’। হজ্ব করার সময় কেউ বলবে না যে, ‘নাওয়াইতু আন আহুজ্জা’ তথা ‘আমি হজ্ব করার নিয়ত করলাম’। কোনো ইবাদতের ক্ষেত্রেই মুখে নিয়ত উচ্চারণ করার বিষয়টি নবী ﷺ থেকে বর্ণিত হয়নি। তাহলে কেন তুমি মুখে নিয়ত উচ্চারণ করবে? নিয়ত করার জায়গা কি অন্তর নয়? মহান আল্লাহ কি বলেননি যে, ‘আর অবশ্যই আমি মানুষকে সৃষ্টি করেছি এবং তার প্রবৃত্তি তাকে যে কুমন্ত্রণা দেয় তাও আমি জানি’ (সূরাহ ক্বাফ: ১৬)? হ্যাঁ, অবশ্যই আমরা এ কথা বলি যে, আল্লাহ নিয়ত (অন্তরের সংকল্প) সম্পর্কে অবগত। তাহলে কীভাবে তুমি তোমার প্রতিপালক জানাবে যে, তুমি নিয়ত করেছ? হয়ত সে (উত্তরদাতা) বলবে যে, আমি বলছি, আল্লাহ’র প্রতি ইখলাস তথা একনিষ্ঠতা জাহির করার মাধ্যমে (তা জানাব)। আমরা বলব, ইখলাসের জায়গাও অন্তর। আর যার জায়গা অন্তর, তার জন্য অন্তরে নিয়ত করাই যথেষ্ট।”(উসাইমীন,ফাতাওয়া নূরুন ‘আলাদ দারব,পৃষ্ঠা:৩৪৯) সুতরাং এর মাধ্যমে প্রমাণিত হলো যে, নিয়ত মুখে উচ্চারণ করে পড়া শরিয়তসম্মত নয়,বরং ইহা বিদ‘আত। যেহেতু নিয়ত হলো অন্তরের কর্ম। আর মুখে উচ্চারণ না করলে অন্তরের অভিপ্রায় সম্পর্কে আল্লাহ ব্যতীত আর কেউ তা জানতে পারে না। এছাড়াও নবী ﷺ থেকে এটা প্রমাণিত হয়নি যে, তিনি নিয়ত মুখে উচ্চারণ করতেন এবং বলতেন, ‘হে আল্লাহ, আমি রোজা রাখার নিয়ত করলাম, অথবা নামাজ পড়ার নিয়ত করলাম, কিংবা এই কাজের নিয়ত করলাম, বা ওই কাজের নিয়ত করলাম।
.
▪️নিয়ত সাধারণত দুই প্রকারের হয়:
.
(১). আবশ্যিক (ফরজ) নিয়ত: এটি এমন নিয়ত যা ছাড়া কোনো ইবাদত শুদ্ধ হয় না। যেমন—ওজু, সালাত, যাকাত, রোজা ও হজ্জের নিয়ত ইত্যাদি। এগুলো এমন বিষয়, যা নিয়ত ছাড়া সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। যেমন যদি কেউ সালাত পড়ার জন্য বা কুরআন স্পর্শ করার জন্য ওজু করে, তবে সে ওজু করার সময় তার নিয়ত হিসেবে তা করবে। একইভাবে সালাতে দাঁড়ানোর সময় যদি সে জানে যে এটি যোহরের সালাত এবং সে তা আদায় করার উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে পড়ে তাহলে সেটিই তার নিয়ত হয়ে যাবে। যদি সে ইমামের পিছনে সালাত পড়ে তবে তাকে মনে রাখতে হবে যে, সে ইমামের অনুসরণ করবে। এরপর তাকবির তাহরিমা (সালাত শুরু করার সংকেত) বলবে। সালাতের রাকআত সংখ্যা আলাদা করে নির্ধারণ করার প্রয়োজন নেই, কারণ যদি এটি যোহর সালাত হয়, তার রাকআত সংখ্যা জানা থাকে। তাছাড়া, সালাতটি ফরজ না নফল তা নিয়ে চিন্তা করারও দরকার নেই। কারণ যদি এটি যোহর হয় তা ফরজ হবে এবং যদি এটি সুন্নত সালাত হয় তা নফল হবে। কিছু মানুষ মনে করে যে, “আমি যোহরের সালাত পড়ার নিয়ত করছি” —এটি উচ্চারণ করা জরুরি, কিন্তু এটা শরিয়তসম্মত নয়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কখনো এইভাবে নিয়ত করেননি, কারণ নিয়তের স্থান অন্তরে। রোজার ক্ষেত্রেও একইভাবে, যদি কেউ রাতে সিদ্ধান্ত নেয় যে সে পরদিন রোজা রাখবে, তাহলে সে রোজার নিয়ত করে ফেলেছে। এমনকি সেহরি খাওয়াও রোজার নিয়তের প্রমাণ। এই ধরনের নিয়ত ভুলে যাওয়া সাধারণত কঠিন, কারণ এটি স্বাভাবিকভাবেই হয়ে যায়।
.
(২). নফল ও সওয়াবের নিয়ত: এটি একটি মুস্তাহাব (পছন্দনীয়) নিয়ত, যা সাধারণ কাজকেও ইবাদতে রূপান্তরিত করতে পারে এবং সওয়াব অর্জনের উপকারিতা প্রদান করে। অনেকেই এই নিয়ত ভুলে যায়, অথচ এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঠিক নিয়ত দ্বারা সাধারণ কাজগুলোও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে ইবাদতে পরিণত হতে পারে। যেমন, খাওয়া, পান করা এবং ঘুমানো যদি এগুলোর উদ্দেশ্য আল্লাহর সন্তুষ্টি হয়, তবে তা সওয়াবের কাজ হয়ে যায়। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, “তুমি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য যা কিছু খরচ করো, তার জন্য তুমি সওয়াব পাবে এমনকি তোমার স্ত্রীর মুখে যে খাবার তুলে দাও, সেটার জন্যও।” (সহিহ বুখারি, হা/৫৬) প্রখ্যাত সাহাবী মু’আয (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন, “আমি ঘুমাই এবং ঘুম থেকে উঠি (নফল নামাজ পড়ার জন্য), আর আমি আমার ঘুমের জন্যও সওয়াব কামনা করি, যেমন ঘুম থেকে ওঠার জন্য সওয়াব কামনা করি।” (সহিহ বুখারি, হা/৪০৮৮) তিনি এই কথা দ্বারা বুঝিয়েছেন যে, ইবাদতের শক্তি অর্জনের জন্য বিশ্রাম নেওয়াও সওয়াবের কাজ হতে পারে। হাফিজ ইবনে হাজার (রাহিমাহুল্লাহ) আল-ফাতহ গ্রন্থে বলেছেন: ومعناه أنه يطلب الثواب في الراحة كما يطلبه في التعب ؛ لأن الراحة إذا قصد بها الإعانة على العبادة حصلت”এটির অর্থ হলো, যেমন একজন মানুষ কষ্ট করে ইবাদতের সওয়াব অর্জন করতে চায়, তেমনি যদি বিশ্রামের উদ্দেশ্য ইবাদতের জন্য শক্তি সঞ্চয় করা হয়, তবে সেটাও সওয়াবের কাজ হবে।”
.
কীভাবে এই নিয়ত মনে রাখা যায়?
নিয়তকে মনে রাখার সহজ উপায় হলো, কাজ শুরু করার আগে কিছু সময় ধরে গভীরভাবে চিন্তা করা এবং তাড়াহুড়ো না করা। যখন কোনো কাজ শুরু করবেন, তখন নিজেকে প্রশ্ন করুন এই কাজটি হালাল নাকি হারাম? এরপর ঠিক করুন আপনার নিয়ত কী উদ্দেশ্যে আপনি এই কাজটি করছেন? যতবার আপনি এই প্রশ্ন করবেন, ততবার নিয়তের কথা আপনার মনে আসবে। এটি ধীরে ধীরে অভ্যাসে পরিণত হবে, এবং একসময় এমন হবে যে, যেকোনো কাজ শুরু করার আগে স্বাভাবিকভাবে আপনি ভাববেন: “আমি কি এটি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করছি?” যখন এই অভ্যাসটি তৈরি হবে, তখন জীবনের প্রতিটি কাজ—খাওয়া, ঘুমানো, দান-সদকা, অন্যকে সাহায্য করা—সবই হয়ে উঠবে ইবাদত। এর ফলে, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত সওয়াবের কাজে রূপান্তরিত হবে, ইনশা’আল্লাহ।ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) তার “আল-শারহুল মুমতি” গ্রন্থে বলেন: ” والنية لا يمكن أن تتخلف عن عمل اختياري ، يعني أن كل عمل يعمله الإنسان مختاراً فإنه لا بد فيه من النية .. وبذلك نعرف أن ما يحصل لبعض الناس من الوسواس ؛ حيث يقول: أنا ما نويت ! أنه وهم لا حقيقة له ، وكيف يصح أنه لم ينو وقد فعل ” “কোন ইচ্ছাধীন আমল থেকে নিয়ত বাদ পড়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ প্রত্যেক যে আমল মানুষ নিজ ইচ্ছায় করে সে আমলের নিয়ত না থেকে পারে না।… এর মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, কিছু মানুষ যে ওয়াসওয়াসা (শয়তানের কুমন্ত্রণা)-র শিকার হয়ে বলেন: ‘আমি নিয়ত করিনি’ এটা বিভ্রম; যার কোন অস্তিত্ব নেই। কিভাবে নিয়ত না করা সম্ভব; অথচ সে কাজটি সম্পাদন করেছে।”(উসাইমীন আল-শারহুল মুমতি” খন্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ৩৫৩-৩৫)
.
▪️এক আমলে একাধিক নিয়তের কারণে কি একাধিক নেকী হয়?
হ্যাঁ; একই আমলে একাধিক নিয়ত থাকার কারণে একাধিক নেকী হয়। উদাহরণস্বরূপ কোনো মুসলিম যদি অযু অবস্থায় মসজিদে ঢুকে দুই রাকাত সালাতপড়ে কিন্তু একই সাথে ফজরের সুন্নত, অযুর সুন্নত এবং মসজিদে প্রবেশের সুন্নতের নিয়ত করে, তাহলে সে যা যা নিয়ত করল সেগুলোর নেকী পাবে। আল্লাহ মহান অনুগ্রহের মালিক।প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন:لَوْ أَحْرَمَ بِصَلَاةٍ يَنْوِي بِهَا الْفَرْضَ وَتَحِيَّةَ الْمَسْجِدِ صَحَّتْ صَلَاتُهُ وَحَصَلَ لَهُ الْفَرْضُ وَالتَّحِيَّةُ جَمِيعًا “যদি কেউ সালাত শুরু করার সময় একই সাথে ফরয এবং মসজিদে প্রবেশের দুই রাকাত সুন্নতের নিয়ত করে তাহলে তার সালাত সঠিক হবে এবং ফরয সালাতের নেকী ও মসজিদে প্রবেশের নামাযের নেকী উভয়টা সে পাবে।”(নববী আল-মাজমু;খণ্ড:১পৃষ্ঠা;৩২৫)
.
আবু হামীদ গাজালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত্যু: ৫০৫‌ হি:] তার ‘ইহয়াউ উলূমিদ্দীন’- এ বলেন:
الطَّاعَاتُ .. مُرْتَبِطَةٌ بِالنِّيَّاتِ فِي أَصْلِ صِحَّتِهَا ، وَفِي تَضَاعُفِ فَضْلِهَا .أَمَّا الْأَصْلُ فَهُوَ أَنْ يَنْوِيَ بِهَا عِبَادَةَ اللَّهِ تَعَالَى لَا غَيْرُ ، فَإِنْ نَوَى الرِّيَاءَ صَارَتْ مَعْصِيَةً .وَأَمَّا تَضَاعُفُ الْفَضْلِ فَبِكَثْرَةِ النِّيَّاتِ الْحَسَنَةِ ، فَإِنَّ الطَّاعَةَ الْوَاحِدَةَ يُمْكِنُ أَنْ يَنْوِيَ بِهَا خَيْرَاتٍ كَثِيرَةً ، فَيَكُونُ لَهُ بِكُلِّ نِيَّةٍ ثَوَابٌ إِذْ كل واحدة منها حسنة ثم تضاعف كل حسنة عشر أمثالها كما ورد به الخبر.
وَمِثَالُهُ : الْقُعُودُ فِي الْمَسْجِدِ ، فَإِنَّهُ طَاعَةٌ وَيُمْكِنُ أَنْ يَنْوِيَ فِيهِ نِيَّاتٍ كَثِيرَةً حَتَّى يَصِيرَ من فضائل أعمال المتقين ، ويبلغ به درجات المقربين .
أَوَّلُهَا : أَنْ يَعْتَقِدَ أَنَّهُ بَيْتُ اللَّهِ ، وَأَنَّ داخله زائر الله فيقصد به زيارة مولاه رجاء لما وعده به رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَيْثُ قال : ( من قعد في المسجد فقد زار الله تعالى وحق على المزور أن يكرم زائره).
وثانيها : أَنْ يَنْتَظِرَ الصَّلَاةَ بَعْدَ الصَّلَاةِ .
وثالثها التَّرَهُّبُ بِكَفِّ السَّمْعِ وَالْبَصَرِ وَالْأَعْضَاءِ عَنِ الْحَرَكَاتِ والترددات ، فإن الاعتكاف كف ، وهو في معنى الصوم وهو نوع ترهب .
ورابعها : عُكُوفُ الْهَمِّ عَلَى اللَّهِ ، وَلُزُومُ السِّرِّ لِلْفِكْرِ فِي الْآخِرَةِ ، وَدَفْعُ الشَّوَاغِلِ الصَّارِفَةِ عَنْهُ بِالِاعْتِزَالِ إلى المسجد .
وخامسها : التَّجَرُّدُ لِذِكْرِ اللَّهِ أَوْ لِاسْتِمَاعِ ذِكْرِهِ وَلِلتَّذَكُّرِ به .
وسادسها : أَنْ يَقْصِدَ إِفَادَةَ الْعِلْمِ بِأَمْرٍ بِمَعْرُوفٍ وَنَهْيٍ عَنْ مُنْكَرٍ ، إِذِ الْمَسْجِدُ لَا يَخْلُو عَمَّنْ يسئ في صلاته أو يتعاطى مالا يَحِلُّ لَهُ .
وسابعها : أَنْ يَسْتَفِيدَ أَخًا فِي اللَّهِ .
وثامنها : أَنْ يَتْرُكَ الذُّنُوبَ حَيَاءً مِنَ اللَّهِ تَعَالَى ، وَحَيَاءً مِنْ أَنْ يَتَعَاطَى فِي بَيْتِ اللَّهِ ما يقتضي هتك الحرمة .
فَهَذَا طَرِيقُ تَكْثِيرِ النِّيَّاتِ ، وَقِسْ بِهِ سَائِرَ الطاعات والمباحات ، إِذْ مَا مِنْ طَاعَةٍ إِلَّا وَتَحْتَمِلُ نِيَّاتٍ كَثِيرَةً ، وَإِنَّمَا تَحْضُرُ فِي قَلْبِ الْعَبْدِ الْمُؤْمِنِ بِقَدْرِ جدِّهِ فِي طَلَبِ الْخَيْرِ ، وَتَشَمُّرِهِ لَهُ ، وتفكره فيه ، فبهذا تزكوا الْأَعْمَالُ وَتَتَضَاعَفُ الْحَسَنَاتُ”
“ইবাদতগুলো নিয়তের সাথে সম্পৃক্ত মৌলিক শুদ্ধতা ও মর্যাদা বহুগুণ হওয়ার দিক থেকে।
মৌলিক শুদ্ধতা হল এ ইবাদতের মাধ্যমে শুধু আল্লাহর ইবাদতের নিয়ত করা; ভিন্ন কিছু নয়। যদি রিয়া তথা লৌকিকতার নিয়ত করে তাহলে সেটা পাপ হয়ে যাবে। আর মর্যাদা বহুগুণ হওয়ার দিক হলো ভালো নিয়তের সংখ্যাধিক্যের কারণে। একটা ইবাদতে অনেক ভালো নিয়ত করা যেতে পারে। তখন প্রতিটি নিয়তের জন্য নেকী হবে। কেননা সেগুলোর প্রত্যেকটা নেক কাজ। এরপর সেই নেককাজগুলোকে অনুরূপ দশগুণ বৃদ্ধি করা হবে যেমনটা হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। এর উদাহরণ হলো মসজিদে বসে থাকা। এটা একটা ইবাদত। এটাতে বহু নিয়ত করা যেতে পারে যাতে করে এটা মুত্তাকীদের নেক আমলে রূপ নেয় এবং এর মাধ্যমে ব্যক্তি আল্লাহর নৈকট্যপ্রাপ্তদের স্তরে পৌঁছতে পারে।
এক: এই বিশ্বাস করা যে এটা আল্লাহর ঘর। এখানে যিনি প্রবেশ করেন তিনি আল্লাহর যিয়ারতকারী। সুতরাং তিনি মসজিদে প্রবেশের দ্বারা উদ্দেশ্য করবেন মাওলার যিয়ারত করা। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এটার ওয়াদা দিয়ে বলেছেন: “যে ব্যক্তি মসজিদে বসে থাকল সে আল্লাহর যিয়ারতে থাকল। আর যার যিয়ারতে আসা হয়েছে তার উপর দায়িত্ব হল আগন্তুককে সম্মান করা।”
দুই: এক সালাতের পর অন্য সালাতের জন্য অপেক্ষা করা।
তিন: চোখ, কান এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নড়াচড়া করা থেকে বিরত থাকার মাধ্যমে বৈরাগী হওয়া। কেননা ইতিকাফ করার অর্থ বিরত থাকা। আর এটা রোযার মতই। এটাও এক প্রকার বৈরাগ্য।
চার: আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকা, আখিরাতের চিন্তায় নির্জনতা অবলম্বন করা এবং আল্লাহ থেকে বিমুখ করে এমন সকল ব্যস্ততাকে প্রতিহত করা।
পাঁচ: আল্লাহর যিকির করার জন্য বা তাঁর যিকির শোনার জন্য কিংবা যিকির থেকে উপদেশ গ্রহণ করার জন্য নিঃসঙ্গ থাকা।
ছয়: সৎকাজের আদেশ ও মন্দকাজে নিষেধ করার মাধ্যমে জ্ঞান দানের উদ্দেশ্য করা। কারণ মসজিদে এমন কেউ না কেউ থাকে যার সালাত ঠিকভাবে হয় না অথবা হালাল নয় এমন কিছুতে সে লিপ্ত হয়।
সাত: কোন দ্বীনি ভাই (আল্লাহর জন্য কোনো ভাই) পাওয়া।
আট: আল্লাহকে লজ্জা করে গুনাহ বর্জন করা এবং আল্লাহর ঘরে তার মর্যাদা লঙ্ঘিত হয় এ লজ্জা করে পাপ ত্যাগ করা। এটা নিয়ত বৃদ্ধি করার এটি একটি নমুনা। এর উপরে অন্য সকল ইবাদত ও বৈধ কাজগুলোকে কিয়াস করুন। কেননা প্রতিটি ইবাদতই বিপুল পরিমাণ নিয়তের সম্ভাবনা রাখে। কল্যাণ অন্বেষণে মুমিন বান্দার প্রচেষ্টা, প্রস্তুতি ও চিন্তার মাত্রা অনুযায়ী তার হৃদয়ে সেগুলো উপস্থিত হয়। আর এভাবেই আমলগুলো বাড়ে এবং নেকী বৃদ্ধি পায়।”(গাযালি;ইহয়াউ উলূমিদ্দীন’ খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৩৭০-৩৭১)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন:
” إذا توضأ الإنسان صلى ركعتين ينويهما سنة الوضوء , وإذا دخل المسجد بعد الوضوء صلى ركعتين ينويهما سنة التحية وسنة الوضوء، يحصل له الأجر ، أجر سنة الوضوء وأجر تحية المسجد والحمد لله ، فضل الله واسع ، وإذا صلاها بنية راتبة الظهر، توضأ ودخل المسجد ونوى سنة الظهر وسنة الوضوء وتحية المسجد حصل له ذلك ، والحمد لله ” .
“ব্যক্তি যদি অযু করার পর দুই রাকাত সালাত আদায় করে তখন সে অযুর সুন্নতের নিয়ত করতে পারে। আবার অযু করার পর মসজিদে ঢুকে মসজিদে প্রবেশের সুন্নত সালাত ‘তাহিয়্যাতুল মাসজিদ’ ও অযুর সুন্নতের নিয়ত করলে সে উভয় নেকী পাবে: অযুর সুন্নতের নেকী এবং তাহিয়্যাতুল মাসজিদের নেকী। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য। তাঁর অনুগ্রহ বিশাল। আর যদি এই সালাতকে যোহরের আগের সুন্নতের নিয়তে আদায় করে; অর্থাৎ অযু করে মসজিদে ঢুকে যোহরের সুন্নত, অযুর সুন্নত এবং মসজিদে প্রবেশের সুন্নতের নিয়ত করে তাহলে সবগুলোর নেকী সে পাবে। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর।”(ফাতাওয়া নূরুন ‘আলাদ দারব; খণ্ড: ১১; পৃষ্ঠা: ৫৭)
.
পরিশেষে উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিষ্কার যে নিয়ত হল সেই মানসিক সংকল্প বা ইচ্ছা, যা মানুষ তার অন্তরে পোষণ করে এবং এর সাথে মুখের কোন সম্পর্ক নেই। নবী (ﷺ) বা তাঁর সাহাবীদের কাছ থেকে নিয়ত সংক্রান্ত কোনো নির্দিষ্ট শব্দ বা নির্দেশনা প্রাপ্ত হয়নি এবং আমরা তাঁদের কাছ থেকে এ বিষয়ে কিছু শুনিনি। বরং যেসব শব্দ পবিত্রতা (ওযু বা গোসল) ও সালাত শুরু করার সময় নিয়ত করার জন্য ব্যবহৃত হয়, তা শয়তান মানুষের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। শয়তান এসব শব্দকে লোকদের জন্য প্রতিযোগিতার ময়দান হিসেবে তৈরি করেছে যেখানে সে তাদেরকে আবদ্ধ করে এবং কষ্ট দেয়। এর মাধ্যমে তারা নিয়ত করার সময় অসহিষ্ণুতা ও বিভ্রান্তি অনুভব করে কিন্তু এ সমস্ত কিছু সালাতের সাথে সংশ্লিষ্ট নয়। আসলে নিয়ত হল কোনো কাজ করার জন্য অন্তরে সংকল্প করা। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_____________________________
আপনাদের দ্বীনি ভাই,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
Share: