নিজের কিংবা রাসূল (ﷺ)-এর জন্মদিন উপলক্ষে বছরের নিদিষ্ট কোন দিন রোজা রাখা জায়েজ কি

উত্তর: নিজের কিংবা রাসূল (ﷺ)-এর জন্মদিন উপলক্ষে বছরের নির্দিষ্ট কোন একদিন রোজা রাখা শরীয়ত সম্মত নয়। কারণ কোন মানুষের জন্মদিন পালন করা; যা বছর ঘুরে বার বার ফিরে আসে তা নব উদ্ভাবিত বিদআত ও বিধর্মীদের অনুকরণ। তাই এ দিনটি পালন করা হারাম; সেটা ইবাদত হিসেবে হোক কিংবা অভ্যাস হিসেবে হোক। তাছাড়া নিজের কিংবা রাসূল (ﷺ)-এর জন্মদিন উপলক্ষে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সাহাবীগণ অথবা তাবেয়ীগণ হতে জন্মদিন কে কেন্দ্র করে রোজা রাখার অনুমোদনমূলক কোন উদ্ধৃতি পাওয়া যায় না। আর ইসলামে যে আমলের শারঈ কোন দলিল নেই তা বিদআত। আম্মাজান আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, مَنْ أَحْدَثَ فِىْ أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيْهِ، فَهُوَ رَدٌّ”আমাদের এই দ্বীনের মাঝে যে নতুন কিছু উদ্ভাবন করবে, তা প্রত্যাখ্যাত হবে”।(সহীহ মুসলিম, হা/১৭১৮) তিনি আরও বলেন,”তোমরা আমার সুন্নাত এবং আমার পরবর্তী খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত পালন করবে। আর তা দৃঢ়তার সাথে ধারণ করবে। সাবধান! তোমরা দ্বীনের মধ্যে নতুন বিষয় আবিষ্কার করা থেকে বিরত থাকবে। কারণ প্রত্যেক নবপ্রবর্তিত বিষয়ই বিদআত এবং প্রত্যেক বিদআতই ভ্রষ্টতা”।(তিরমিযী, হা/২৬৭৬, ইমাম তিরমিযী বলেন,হাদীসটি হাসান সহীহ) এই হাদীসগুলো প্রমান করে শরীয়তে যে আমলের বিশুদ্ধ কোন দলিল নেই সেগুলো পরিত্যাজ্য বাতিল বিদআত, তাছাড়াও এ সমস্ত হাদীছে বিদআত প্রবর্তনের বিরুদ্ধে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হয়েছে এবং উম্মতকে এর ভয়াবহতা সম্পর্কে সাবধান করা হয়েছে। ইমাম ইবনু কাসীর রহিমাহুল্লাহ তার তাফসীরে বলেন,أي عن أمر رسول الله صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ومنهاجه وطريقته وسنته وشريعته فتوزن الأقوال والأعمال بأقواله وأعماله فما وافق ذلك قبل وما خالقه فهو مردود علي قائله وفاعله كائنا من كان.”হুঁশিয়ার হওয়া উচিত যারা রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নির্দেশ, পথ ও মত, ত্বরীক্বা, সুন্নাত ও তাঁর বিধি-বিধানের বিরোধিতা করে। আর তাঁর কথা ও কাজই হলো অন্যের কথা ও কাজের মাপকাঠি, যদি তাঁর কথা ও কাজে মিলে যায় তাহলে গ্রহণযোগ্য হবে আর যদি বিপরীত হয় তাহলে তা যে এবং যাই হোক না কেন তা প্রত্যাখ্যানযোগ্য।(তাফসীরে ইবনু কাসীর, খন্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৩০৭)
.
এখন হয়তো অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন রাসূল (ﷺ) তো নিজের জন্মদিনে রোজা রেখেছেন যেমন: সহিহ মুসলিমে আবু কাতাদা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সোমবারে রোযা রাখা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন: (فِيهِ وُلِدْتُ وَفِيهِ أُنْزِلَ عَلَيَّ “এটি এমন দিন যে দিনে আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং যেদিন আমার ওপর ওহি নাযিল হয়”।(সহীহ মুসলিম হা/১১৬২; আবূ দাঊদ হা/২৪২৬, মুসনাদে আহমাদ হা/২২৫৫০) সুতরাং এই হাদিস থেকে তো প্রমান হয় যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সোমবার রোজা রেখেছিলেন অথচ সেদিন ছিল তাঁর জন্মদিন। তাই আমরা রাখলে সমস্যা কী?
.
এই প্রশ্নের জবাবে আমরা বলবো রাসূল (ﷺ) শুধুমাত্র সোমবারেই রোজা রাখতেন না সাথে বৃহস্পতিবারও রাখতেন। যেমন ইমাম তিরমিযি (রহঃ) আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:( تُعْرَضُ الْأَعْمَالُ يَوْمَ الِاثْنَيْنِ وَالْخَمِيسِ فَأُحِبُّ أَنْ يُعْرَضَ عَمَلِي وَأَنَا صَائِمٌ ) “প্রতি সোমবারে ও বৃহস্পতিবারে আমলনামা পেশ করা হয়। তাই আমি পছন্দ করি আমি রোযা রেখেছি এমতাবস্থায় যেন আমার আমলনামা উপস্থাপন করা হয়”(সুনানে তিরমিযী হা/৭৪৭; ইমাম তিরমিযি হাদিসটিকে ‘হাসান’ আখ্যায়িত করেছেন। আলবানী ‘সহিহুত তিরমিযি’ গ্রন্থে হাদিসটিকে ‘সহিহ’ আখ্যায়িত করেছেন] অপর এক বর্ননায় আম্মাজান আয়িশা (রাঃ) বলেছেন,أَنَّ النَّبِيَّ -صلى الله عليه وسلم- كَانَ يَتَحَرَّى صِيَامَ الإِثْنَيْنِ وَالْخَمِيْسِ”নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সোমবার ও বৃহস্পতিবার সিয়াম পালনের প্রতি বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করতেন। (নাসাঈ হা/২৩৬০; তিরমিযী হা/৭৪৫) পূর্বোক্ত হাদিস থেকে জানা গেল যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সোমবার তাঁর জন্মদিন হওয়ার কারণে যেমন রোযা রেখেছেন তেমনি এ দিনটির মর্যাদার কারণেও রোযা রেখেছিলেন। কেননা এ দিনে আল্লাহ তাঁর ওপর ওহী নাযিল করেছেন। এ দিনে তাঁর আমলনামা আল্লাহর কাছে পেশ করা হয়। তাই নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রোযা থাকা অবস্থায় তাঁর আমলনামা পেশ হওয়া চাইতেন।সুতরাং তিনি জন্মদিন উপলক্ষে শুধুমাত্র সোমবারে রোজা পালন করেননি বরং বৃহস্পতিবারও সিয়াম পালন করতেন আর রাসূল (ﷺ) সোমবার ও বৃহস্পতিবার রোজা থাকার অন্যতম দুটি কারণ হচ্ছে (১).তিনি সোমবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ও এই দিনেই আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রথম অহি প্রাপ্ত হয়েছিলেন। (২).সপ্তাহে প্রতি সোমবার ও বৃহস্পতিবারে বান্দার আমলনামা আল্লাহর নিকট পেশ করা হয়। তিনি বলতেন আমি পছন্দ করি যে, আমার আমলনামা আল্লাহর নিকট সিয়াম অবস্থায় পেশ করা হৌক। একারণে তিনি সোম ও বৃহস্পতিবার সিয়াম পালন করতেন।
.
সুতরাং রাসূল (ﷺ) উম্মত হিসেবে আমাদের নিজের কিংবা রাসূল (ﷺ)-এর জন্মদিনে সিয়াম পালন করা জায়েজ নয়। কেননা এই দিন রাসূল (ﷺ) আমাদেরকে সিয়াম পালন করতে বলেননি। তার পথপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনসহ অন্যান্য সাহাবীরা নিজের কিংবা রাসূল (ﷺ) এর জন্মদিনে সিয়াম পালন করেননি। যদি জন্মদিন উপলক্ষে সিয়াম পালন করা শরিয়তসম্মত আমল হত তাহলে প্রত্যেক সাহাবী এবং পূর্ববর্তী আলেমগণ ও নেকীর কাজে অগ্রগামী ব্যক্তিগণ এ দিনটি পালন করতেন। যখন তাঁরা সেটা করেননি কাজেই জানা গেল যে, এটি নব-প্রচলিত; এটি পালন করা যাবে না। তাছাড়া সিয়াম পালন করা ইবাদত সমূহের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি ইবাদত।আর ইসলামি শরীয়তে যাবতীয় ইবাদতের ক্ষেত্রে শারঈ উসূল বা মূলনীতি হচ্ছে,”সকল ইবাদতই নিষিদ্ধ শুধুমাত্র সেগুলো ছাড়া যেগুলো করার দলিল কুরআন সুন্নায় রয়েছে” অর্থাৎ যে কোন ইবাদত সওয়াবের নিয়তে করতে হলে অবশ্যই সেই ইবাদত সম্পর্কে কুরআন হাদীসে বিশুদ্ধ দলিল থাকতে হবে অন্যথায় বিনা দলিলে ইবাদত করলে বিদআত হবে। প্রমান আম্মাজান আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত,রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, مَنْ أَحْدَثَ فِىْ أَمْرِنَا هَذَا مَا لَيْسَ فِيْهِ، فَهُوَ رَدٌّ ‘আমাদের এই দ্বীনের মাঝে যে নতুন কিছু উদ্ভাবন করবে,তা প্রত্যাখ্যাত হবে”।(সহীহ মুসলিম, হা/১৭১৮) অপর বর্ননায় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, عَلَيْكُمْ بِسُنَّتِى وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ “তোমরা আমার এবং আমার পথপ্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে গ্রহণ করো এবং মাড়ির দাঁত দিয়ে তা কামড়িয়ে ধরো। নতুন উদ্ভাবিত সকল বিষয়ে সতর্ক থাকো; কেননা, সকল বিদআতই গোমরাহি ও পথভ্রষ্টতা”।(আবূ দাঊদ, হা/৪৬০৭, সনদ সহীহ)
.
সৌদি ফতোয়া বোর্ড এবং সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের প্রবীণ সদস্য, যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫৪ হি./১৯৩৫ খ্রি.] আল-বায়ান লি আখতায়ি বাযিল কুত্তাব’ গ্রন্থে বলেন:

لا يخفى ما ورد في الكتاب والسنة من الأمر باتباع ما شرعه الله ورسوله والنهي عن الابتداع في الدين ، قال تعالى : ( قُلْ إِنْ كُنتُمْ تُحِبُّونَ اللَّهَ فَاتَّبِعُونِي يُحْبِبْكُمُ اللَّهُ وَيَغْفِرْ لَكُمْ ذُنُوبَكُمْ ) ، وقال تعالى : ( اتَّبِعُواْ مَا أنزل إِلَيْكُم مِّن رَّبِّكُمْ وَلاَ تَتَّبِعُواْ مِن دُونِهِ أَوْلِيَاء قَلِيلًا مَّا تَذَكَّرُونَ ) ، وقال تعالى : ( وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلاَ تَتَّبِعُواْ السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَن سَبِيلِهِ ) وقال صلى الله عليه وسلم : ( إن أصدق الحديث كتاب الله، وخير الهدي هدي محمد ، وشر الأمور محدثاتها ) ، وقال صلى الله عليه وسلم : ( من أحدث في أمرنا هذا ما ليس منه فهو رد ) وفي رواية لمسلم : ( من عمل عملًا ليس عليه أمرنا فهو رد )
“কুরআন ও হাদিসে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কর্তৃক প্রদত্ত বিধানের অনুসরণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে এবং ধর্মীয় বিষয়ে নতুন কিছু প্রবর্তন করা থেকে নিষেধ করা হয়েছে এটি কারো অজানা নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন: “বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস, তাহলে আমার অনুসরণ কর, ফলে আল্লাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের পাপরাশি মার্জনা করে দিবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীলও দয়ালু।[সূরা আলে ইমরান, আয়াত: ৩১] তিনি আরও বলেন: “তোমরা অনুসরণ কর, যা তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ হয়েছে এবং আল্লাহকে বাদ দিয়ে কর্তাদের অনুসরণ করো না।”।[সূরা আরাফ, আয়াত: ৩] তিনি আরও বলেন: “তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন, যেন তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। নিশ্চিত এটি আমার সরল পথ। অতএব, এ পথে চল এবং অন্যান্য পথে চলো না। তা হলে সেসব পথ তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিবে।”[সূরা আনআম, আয়াত: ১৫৩] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “নিশ্চয় শ্রেষ্ঠ সত্যবাণী হচ্ছে আল্লাহর কিতাব। সর্বোত্তম আদর্শ হচ্ছে নবী মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ। সবচেয়ে নিকৃষ্ট বিষয় হচ্ছে নব প্রবর্তিত বিষয়গুলো।” তিনি আরও বলেন: “যে ব্যক্তি আমাদের দ্বীনে এমন কোন বিষয় চালু করে যা এতে নেই সেটা প্রত্যাখ্যাত”। সহিহ মুসলিমের এ বর্ণনায় এসেছে- “যে ব্যক্তি এমন কোন আমল করে যা আমাদের দ্বীনে নেই সেটা প্রত্যাখ্যাত”(আল-বায়ান লি আখতায়ি বাযিল কুত্তাব’ পৃষ্ঠা: ২৬৮-২৭০)
.
পরিশেষে, মহান আল্লাহ আমাদেরকে কুরআন সুন্নাহর আলোকে তার ইবাদত করার তৌফিক দান করুন এবং যাবতীয় বিদআতি কর্মকান্ড থেকে হেফাজত করুন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_____________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ওস্তাদ ইব্রাহিম বিন হাসান।

Share: