ভূমিকা: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের দায়িত্ব আল্লাহর বিধানের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা, কারণ এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্দেশিত এবং মানুষের কল্যাণেই নির্ধারিত। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা যা কিছু বিধান দিয়েছেন তা আমাদের সৃষ্টিকর্তার প্রতি আস্থা ও ভালোবাসার একটি নিদর্শন। তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট থাকা মানেই তাঁর ইলম ও হিকমতের প্রতি পূর্ণ আস্থা রাখা। আল্লাহর বিধানের প্রতি আত্মসমর্পণ করা মানে এই যে, আমরা নিজের ইচ্ছাকে তাঁর ইচ্ছার সঙ্গে সমন্বয় করি। এমনকি কোনো বিধান আমাদের মন ও দেহের জন্য কঠিন মনে হলেও আমরা তা মান্য করি এই বিশ্বাসে যে এটি আমাদের জন্য কল্যাণকর। কারন মহান আল্লাহ তাআলা “হিকমত” বা প্রজ্ঞার গুণে গুণান্বিত। কেননা আল্লাহর সুন্দর নামগুলোর একটি নাম হলো الحكيم “আল-হাকীম” (বিচারক, নিপুণ ও প্রজ্ঞাবান)। “আল-হাকীম” হচ্ছেন যিনি সবকিছুর অস্তিত্বগত ও আইনগত সিদ্ধান্ত দেন এবং কর্ম ও সৃষ্টির দিক থেকে সবকিছুকে নিপুণভাবে সম্পাদন করেন। ‘হাকীম’ শব্দটা ‘হুকম’ (বিধান দান) এবং ‘হিকমাহ’ (প্রজ্ঞা) শব্দমূল থেকে উদ্ভূত। আল্লাহ তায়ালা একমাত্র বিধানদাতা। তার বিধানসমূহে রয়েছে চূড়ান্ত প্রজ্ঞা, পূর্ণতা ও নিপুনতা। আল্লাহ তাআলা সৃষ্টিকুলের স্রষ্টা। তিনি জানেন কোন বিধান তাদের জন্য উপযুক্ত এবং কোন বিধান তাদের জন্য উপযুক্ত নয়। আর আল্লাহ তায়ালা যে বিধানই আরোপ করেন না কেন এর পেছনে রয়েছে সুমহান প্রভূত প্রজ্ঞা। হতে পারে আমরা সে প্রজ্ঞাগুলো জানতে পারব কিংবা আমাদের বিবেক-বুদ্ধি সেগুলোর দিশা পাবে না। আবার হতে পারে আমরা কিছু বিষয় জানতে পারব আর এর অনেকগুলো আমাদের অজানা থেকে যাবে। আর এতে কোন সন্দেহ নাই যে আল্লাহর প্রতিটি বিধান মানুষের কল্যাণের জন্য। তাঁর প্রতিটি বিধানেই রয়েছে সুনিপুণ হেকমত ও সুগভীর প্রজ্ঞা। সুতরাং যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং তাকে ভালোবাসে তার জন্য আবশ্যক হচ্ছে আল্লাহর প্রতিটি বিধানের কাছে নিঃশর্তভাবে আত্মসমর্পণ করা। এটি ঈমানের দাবি। এর বিপরীতে আল্লাহর কোন একটি বিধানকে অপছন্দ করা বা ঘৃণা করা ঈমান ভঙ্গের অন্যতম একটি কারণ।আল্লাহ তাআলা বলেন,ذَ ٰلِكَ بِأَنَّهُمۡ كَرِهُوا۟ مَاۤ أَنزَلَ ٱللَّهُ فَأَحۡبَطَ أَعۡمَـٰلَهُمۡ “এটা এজন্যে যে, আল্লাহ যা নাজিল করেছেন তারা তা অপছন্দ করেছে। কাজেই তিনি তাদের আমলসমূহ বাতিল করে দিয়েছেন।” [সূরা মুহাম্মদ: ৯] এ আয়াত দ্বারা বুঝা যায়, আমল সমূহ বাতিল হওয়ার অন্যতম কারণ আল্লাহর নাযিলকৃত বিষয় অপছন্দ করা। উক্ত বিষয় আমল করলেও অপছন্দ করার কারণে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যাবে। অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ আরো বলেন, لَقَدِ ابْتَغَوُا الْفِتْنَةَ مِنْ قَبْلُ وَقَلَّبُوْا لَكَ الْأُمُوْرَ حَتَّى جَاءَ الْحَقُّ وَظَهَرَ أَمْرُ اللهِ وَهُمْ كَارِهُوْنَ ‘তারা পূর্ব থেকেই বিভেদ সৃষ্টির সুযোগ সন্ধানে ছিল এবং আপনার কার্য সমূহ উলট-পালট করে দিচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত সত্য প্রতিশ্রুতি এসে গেল এবং জয়ী হ’ল আল্লাহর হুকুম, যে অবস্থায় তারা অপছন্দ করল’ (সূরা তওবা: ৪৮)। রাসূল (ﷺ) যা কিছু নিয়ে এসেছেন সে ব্যাপারে কেউ যদি অপছন্দ করে তাহলে সে ব্যক্তি মুসলিম ইমামগনের সর্বসম্মতিক্রমে কাফের। আর এ বিষয়ে ইজমা নকল করেছেন। ইমাম বাহওয়াতি (রাহিমাহুল্লাহ) “কাশশাফুল ক্বিনা’খন্ড: ৬ পৃষ্ঠা: ১৬৮)
.
মহান আল্লাহ তায়ালা পুরুষদের জন্য বহুবিবাহ বৈধ করেছেন। তিনি তাঁর মহান কিতাবে বলেছেন: “তোমরা যদি এতিম মেয়েদের (বিয়ে করার) ক্ষেত্রে সুবিচার করতে না পারার আশঙ্কা করো, তাহলে (সাধারণ) নারীদের মাঝে তোমাদের পছন্দ হয় এমন দুইজন, তিনজন কিংবা চারজনকে পর্যন্ত বিয়ে করতে পারো। কিন্তু যদি (একাধিক স্ত্রীর সাথে) সুবিচার করতে না পারার আশঙ্কা করো, তাহলে মাত্র একজনকে অথবা নিজেদের অধিকারভুক্ত দাসীদের (রাখতে পারবে)। এটা তোমাদের অবিচার না করার নিকটতর।”[সূরা নিসা: ৩] বহুবিবাহের বৈধতার পক্ষে এটি দ্ব্যর্থহীন দলীল। ইসলামী শরীয়তে একজন পুরুষ এক, দুই, তিন বা চার বিয়ে করতে পারে। একসাথে চারের বেশি বিয়ে করা তার জন্য বৈধ না। মুফাস্সিরগণ ও ফকীহগণ এই কথা বলেছেন। এই ব্যাপারে মুসলিমদের ইজমা সংঘটিত হয়েছে; এতে কোনো মতভেদ নেই। সুতরাং নারী কিংবা পুরুষ যদি মনে করে, ইসলাম পুরুষদেরকে একাধিক বিয়ের বিধান দিয়ে নারীদের প্রতি জুলুম করেছে,অথবা এই বিধানটি অস্বীকার করবে,কিংবা মনে করে,এই বিধানটি বর্তমান যুগে অনুপযোগী বা এটিকে কেউ ঘৃণার চোখে দেখে তাহলে সে ইসলাম থেকে বহিষ্কৃত মুরতাদ ও কাফের বলে গণ্য হবে। ফলে তাকে তওবার আহ্বান জানানো হবে। তওবানা করলে তাকে হত্যা করা হবে।
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: কিছু নারী ইউরোপীয় সংস্কৃতি ও পশ্চিমা সভ্যতাকে উত্তম বলে মনে করে এবং বলে যে, ইসলামী শরীয়ত যে একাধিক বিবাহ বৈধ করেছে তা ভুল। অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে এটি বৈধ। এই ধরনের ধারণার প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কী?
জবাবে শাইখ বলেন,
: من كره تعدد الزوجات وزعم أن عدم التعدد أفضل، فهو كافر مرتد عن الإسلام؛ لأنه -نعوذ بالله- منكر لحكم الله وكاره لما شرع الله، والله يقول سبحانه: {ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ كَرِهُوا مَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأَحْبَطَ أَعْمَالَهُمْ} [محمد:9]، من كره ما أنزل الله حبط عمله، فالذي يكره تعدد الزوجات ويرى أن الشريعة يعني قد ظلمت أو أن في حكم الله في هذا ناقص أو مو بطيب، أو أن ما يفعلونه في بلاد النصارى من الواحدة أن هذا أولى وأفضل، هذا كله ردة عن الإسلام نعوذ بالله، كالذي يقول: إن فرض الصلاة ما هو مناسب، لو ترك الناس بدون الصلاة كان أحسن أو بدون صيام أحسن أو بدون زكاة، من قال هذا فهو كافر، من قال: إن عدم الصلاة أولى أو عدم الصيام أولى أو عدم الزكاة أولى أو عدم الحج أولى كان كافراً، وهكذا لو قال: لا بأس أن يحكم بغير الشريعة، يجوز، ولو قال: حكم الشريعة أفضل، لكن إذا قال: إن الحكم بغير ما أنزل الله جائز أو أنه حسن، كل هذا ردة عن الإسلام نعوذ بالله.فالحاصل من كره ما أنزل الله وما شرعه الله هو مرتد، وهكذا من أحب ورضي بما حرم الله وقال: إنه طيب وإنه مناسب كالزنا والسرقة يكون كافراً أيضاً .نعم. نسأل الله
“যে ব্যক্তি একাধিক বিবাহকে অপছন্দ করে এবং দাবি করে যে একাধিক বিবাহ নিষিদ্ধ করা উত্তম তাহলে সে ব্যক্তি নিঃসন্দেহে কাফির এবং ইসলাম থেকে বিচ্যুত। কারণ সে আল্লাহর বিধানকে অস্বীকার করেছে এবং আল্লাহর শরীয়তকে ঘৃণা করেছে (নাউ’যুবিল্লাহ)। আল্লাহ তা’আলা বলেন, {ذَلِكَ بِأَنَّهُمْ كَرِهُوا مَا أَنزَلَ اللَّهُ فَأَحْبَطَ أَعْمَالَهُمْ}“এটা এ জন্যে যে, আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন, তারা তা অপছন্দ করে।সুতরাং আল্লাহ তাদের কর্মসমূহ বাতিল করে দেবেন।(সূরা মুহাম্মদ: ৯)যে ব্যক্তি আল্লাহর নাযিল করা বিধানকে অপছন্দ করে তার সমস্ত আমল ধ্বংস হয়ে যাবে। সুতরাং যে ব্যক্তি একাধিক বিবাহকে ঘৃণা করে এবং মনে করে যে শরীয়ত নারীদের উপর অন্যায় করেছে অথবা এই বিধান অপূর্ণাঙ্গ অথবা খ্রিষ্টান সমাজের মতো এক বিবাহের প্রথাই উত্তম এইসব চিন্তা-ভাবনা তাকে ইসলাম থেকে বের করে দেবে (নাউ’যুবিল্লাহ)। যেমন কেউ যদি বলে সালাত ফরজ নয় বরং মানুষের উচিত সালাত বর্জন করাই উত্তম। অথবা বলে রোজা না রাখা, যাকাত না দেয়া, বা হজ পালন না করাই উত্তম তাহলে সে নিঃসন্দেহে কাফির হবে। অনুরূপভাবে কেউ যদি বলে “ইসলামী শরীয়তের হুকুম-আহকামই শ্রেষ্ঠ,” তবে আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তার বাইরে কোন বিধান মানার অনুমতি দেওয়া যায় বা সেটা উত্তম বলা যায় তাহলেও সে ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাবে। মোট কথা যে ব্যক্তি আল্লাহর নাযিল করা বিধানকে অপছন্দ করে বা যে কাজ আল্লাহ হারাম করেছেন তা পছন্দ করে এবং এটিকে ভালো ও উপযুক্ত বলে মনে করে যেমন ব্যভিচার বা চুরি তাহলে সেই ব্যক্তিও কাফির হয়ে যাবে।
(নাউ’যুবিল্লাহ) আমরা আল্লাহর কাছে রক্ষা ও ক্ষমা প্রার্থনা করছি।”(শাইখের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট, ফাতওয়া নং: ৪৮৮৩)
.
অপরদিকে কোন নারী যদি ইসলামে একাধিক বিবাহ জায়েজ একথা অন্তরে বিশ্বাস রাখে এবং আল্লাহর উক্ত বিধানের প্রতি সম্মান বজায় রাখে কিন্তু ব্যক্তিগত মানবিক দুর্বলতা ও অনিচ্ছার কারণে স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করুক এটা না চায় বা তার দ্বিতীয় বিয়েকে অপছন্দ করে তাহলে তাতে সমস্যা নেই। এ কারণে সে ঈমান থেকে বের হয়ে যাবে না বা মুনাফিক বলে গণ্য হবে না। এর উদাহরণ হিসেবে বলা যায় মানুষ রোগাক্রান্ত হলে অস্ত্রোপচার, ইনজেকশন নেওয়া বা ওষুধ খাওয়াকে স্বভাবগতভাবে অপছন্দ করে কিন্তু সুস্থতার স্বার্থে তা মেনে নেয়।অনুরূপভাবে জি-হাদ তথা কাফেরদের সাথে যু/দ্ধে লিপ্ত হওয়া স্বভাবগতভাবে মানুষের অপছন্দনীয়। এ ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেন:كُتِبَ عَلَيْكُمُ الْقِتَالُ وَهُوَ كُرْهٌ لَكُمْ وَعَسَى أَنْ تَكْرَهُوا شَيْئًا وَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ وَعَسَى أَنْ تُحِبُّوا شَيْئًا وَهُوَ شَرٌّ لَكُمْ وَاللَّهُ يَعْلَمُ وَأَنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ “তোমাদের জন্য যুদ্ধ ফরয করা হয়েছে, অথচ তোমাদের কাছে সেটি অপছন্দনীয়। তবে এমন হতে পারে যে, তোমরা একটা জিনিস অপছন্দ করো অথচ সেটা তোমাদের জন্য ভালো; আবার এমনও হতে পারে যে, তোমরা একটা জিনিস পছন্দ করো অথচ সেটা তোমাদের জন্য খারাপ। আল্লাহ জানেন (প্রকৃতপক্ষে কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ) আর তোমরা জানো না।”[সূরা বাকারা: ২১৬]
.
অনুরূপভাবে ঠাণ্ডার রাতে ঘুম থেকে উঠে অজু করে মসজিদে যাওয়া, সফরের কষ্ট, ক্লান্তি ও নানা রোগ-ব্যাধি সত্বেও পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা, নিজের সম্পদ থেকে জাকাত বের করে গরিবদেরকে দান করা, রমজান মাসে তীব্র গরমে সারাদিন ক্ষুধা-পিপাসায় কাতর হয়ে রোজা রাখা; ইত্যাদি মানুষের স্বভাবজাত অপছন্দনীয় বিষয়। কিন্তু তারপরও কেউ যদি আল্লাহর বিধানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন পূর্বক জাহান্নামের আগুনের ভয়ে এ কাজগুলো করে তাহলে তার জন্য রয়েছে অবারিত সওয়াব। ঠিক তদ্রুপ কোন নারী যদি স্বামীর একাধিক বিয়ের প্রতি অন্তরে কষ্ট অনুভব করার পরেও আল্লাহর বিধানের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং স্বামীকে সন্তুষ্ট করার স্বার্থে তা মেনে নেয় তাহলে সে আল্লাহর কাছে সওয়াবের অধিকারী হবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ বলেন, وَٱصۡبِرُوٓاْۚ إِنَّ ٱللَّهَ مَعَ ٱلصَّٰبِرِينَ﴾ [الانفال: ٤٦]“তোমরা ধৈর্য্যধারণ কর। নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথে আছেন।” [সূরা আল-আনফাল, আয়াত: ৪৬] রাসূল ﷺ বলেছেন,”মুসলিম ব্যক্তির উপর যে কষ্ট-ক্লেশ, রোগ-ব্যাধি, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, দুশ্চিন্তা, কষ্ট ও পেরেশানী আপতিত হয়, এমনকি তার দেহে যে কাঁটা ফুটে, এসবের বিনিময়ে আল্লাহ তার গুনাহসমূহ ক্ষমা করে দেন”।(সহীহ বুখারী হা/৫৬৪১) এছাড়াও বুখারী ও মুসলিম বর্ণিত হাদীসে রয়েছে: আনাস ইবনে মালেক রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন:(حُفَّتْ الْجَنَّةُ بِالْمَكَارِهِ ، وَحُفَّتْ النَّارُ بِالشَّهَوَاتِ) “জান্নাতকে অপছন্দনীয় বিষয় দিয়ে বেষ্টিত করা হয়েছে। আর জাহান্নামকে কামনা-বাসনা দ্বারা বেষ্টিত করা হয়েছে।”(সহীহ বুখারী হা/৬৪৮৭; ও মুসলিম হা/২৮২৩)
.
উক্ত হাদিসের ব্যাখায় শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন:
فَأَمَّا الْمَكَارِه فَيَدْخُل فِيهَا الِاجْتِهَاد فِي الْعِبَادَات , وَالْمُوَاظَبَة عَلَيْهَا , وَالصَّبْر عَلَى مَشَاقّهَا , وَكَظْم الْغَيْظ , وَالْعَفْو وَالْحِلْم وَالصَّدَقَة وَالْإِحْسَان إِلَى الْمُسِيء وَالصَّبْر عَنْ الشَّهَوَات , وَنَحْو ذَلِكَ
“অপছন্দনীয় বিষয়াবলির মধ্যে রয়েছে: ইবাদতে শ্রম দেয়া ও নিয়মানুবর্তিতা রক্ষা করা, ইবাদত সম্পাদনের কষ্টে ধৈর্যধারণ করা, রাগকে দমন করা, ক্ষমা, সহিষ্ণুতা, দানশীলতা, মন্দ আচরণকারীর প্রতি সদাচরণ করা, কামনা-বাসনা ত্যাগ করার ক্ষেত্রে ধৈর্য ধরা প্রভৃতি।” (ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং১৪৮০৯৯) অনুরূপভাবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাণী, তিনি বলেন: “আমি কি তোমাদেরকে এমন কাজ জানাবো না, যা করলে আল্লাহ (বান্দার) পাপরাশি দূর করে দেন এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন?” লোকরা বলল: হে আল্লাহর রাসূল! আপনি বলুন। তিনি বললেন: “অপছন্দ সত্ত্বেও পরিপূর্ণরূপে অযু করা, মসজিদের পথে বেশি বেশি কদম ফেলা এবং এক নামাযে পর অন্য নামাযের জন্য অপেক্ষা করা। আর এ কাজগুলোই হলো রিবাত (প্রস্তুতি)।”[হাদীসটি মুসলিম হা/২৫১) বর্ণনা করেন আবু হুরাইরার সূত্রে] নববী রাহিমাহুল্লাহ বলেন: والمكاره تكون بشدة البرد وألم الجسم ونحو ذلك ““পরিপূর্ণভাবে অযু করা অপছন্দনীয় হয় তীব্র শীতের কারণে এবং শরীরে ব্যাথ্যা থাকলে কিংবা অনুরূপ কোন বিষয়ের ক্ষেত্রে।”( শারহু সহীহ মুসলিম খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ১৪১)
.
অনুরূপ বিষয় হলো: কোন নারী সতীনের উপস্থিতিকে অপছন্দ করা। এটি প্রকৃতিগত বিষয়। কারণ সতীন তার স্বামীকে নিয়ে তার সাথে টানাটানি করবে। কিন্তু আল্লাহর ফরযকৃত যুদ্ধকে অপছন্দ করা, আর কারো মন যুদ্ধকে অপছন্দ করার মাঝে পার্থক্য রয়েছে। অনুরূপভাবে আল্লাহর প্রণীত বহুবিবাহের বিধানকে অপছন্দ করা আর সতীনের উপস্থিতিকে মনে অপছন্দ করা আলাদা বিষয়। আল্লাহ যা ফরয করেছেন এবং শরীয়ত হিসেবে দিয়েছেন সেটিকে দ্বীন এবং আল্লাহর নৈকট্য হিসেবে ভালোবাসতে হবে, যদিও ফরয কাজটি মনের কাছে অপছন্দনীয় এবং কঠিন হয়। তবে বান্দার ঈমান যত পূর্ণ হবে, ততই এই অপছন্দনীয় বিষয়গুলোও প্রকৃতিগতভাবে বান্দার কাছে প্রিয় হয়ে উঠবে যেমনিভাবে শরয়ি দিক থেকেও পছন্দনীয় থাকে। ইসলাম ভঙ্গকারী বিষয়গুলোর মাঝে উল্লেখ করা হয়েছে আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন সেটাকে অপছন্দ করা এবং তাঁর শরীয়তকে অপছন্দ করা।
.
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম আল-জাওযিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৫১ হি.] বলেছেন:
“وليس من شرط الرضى ألا يحس بالألم والمكاره بل ألا يعترض على الحكم ولا يتسخطه ولهذا أشكل على بعض الناس الرضى بالمكروه وطعنوا فيه وقالوا : هذا ممتنع على الطبيعة وإنما هو الصبر وإلا فكيف يجتمع الرضى والكراهية وهما ضدان .
والصواب : أنه لا تناقض بينهما وأن وجود التألم وكراهة النفس له لا ينافي الرضى كرضى المريض بشرب الدواء الكريه ورضى الصائم في اليوم الشديد الحر بما يناله من ألم الجوع والظمأ ورضى المجاهد بما يحصل له في سبيل الله من ألم الجراح وغيرها”
“সন্তুষ্টির শর্ত এই নয় যে কষ্ট-বেদনা অনট-বেদনা রুর তীর্ণ করেছেন তা অফছএকটা জিনিস পুভব না করা। বরং শর্ত হলো আল্লাহর বিধানের ব্যাপারে আপত্তি না করা এবং এর প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ না করা। তাই কিছু মানুষের কাছে অপছন্দনীয় ব্যাপারে সন্তুষ্ট থাকার বিষয়টি জটিল ঠেকেছে এবং তারা এতে আপত্তি করেছেন। তারা বলেছেন: এটা স্বভাবতই অসম্ভব। বরং সেটা ধৈর্য। তা না হলে সন্তুষ্টি ও অপছন্দ কীভাবে একত্রিত হতে পারে? যেহেতু দুটি বিপরীত বিষয়। সঠিক মত হলো: এই দুটির মাঝে কোনো বৈপরিত্য নেই। কষ্ট ও মানসিক অপছন্দের উপস্থিতি সন্তুষ্টিকে নাকচ করে না। যেমন: রোগী অপছন্দনীয় ঔষধ পান করার ব্যাপারে তুষ্ট থাকে। তীব্র গরমের দিনে রোযাদার ক্ষুৎপিপাসার যে বেদনা অনুভব করে তার ব্যাপারে সন্তুষ্ট থাকে। মুজাহিদ আল্লাহর রাস্তায় ক্ষত-বিক্ষত হলে যে ব্যথা পায় তাতে রাজী-খুশি থাকে।”[মাদারিজুস সালিকীন: ২/১৭৫]
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বিষয়টি স্পষ্ট করার জন্য বলেন:
قوله تعالى: (وهو كره لكم) : (كره) مصدر بمعنى اسم المفعول ، يعني: وهو مكروه لكم ؛ والمصدر بمعنى اسم المفعول يأتي كثيراً، مثل: (وَإِنْ كُنَّ أُولَاتِ حَمْلٍ) [الطلاق: 6] يعني: محمول ؛ وقول الرسول صلى الله عليه وسلم: ( من عمل عملاً ليس عليه أمرنا فهو رد )، أي مردود .
وجملة ( وهو كره لكم ) في محل نصب على الحال؛ والضمير ( هو ) يعود على القتال؛ وليس يعود على الكتابة؛ فإن المسلمين لا يكرهون ما فرضه الله عليهم؛ وإنما يكرهون القتال بمقتضى الطبيعة البشرية؛ وفرق بين أن يقال: إننا نكره ما فرض الله من القتال؛ وبين أن يقال: إننا نكره القتال؛ فكراهة القتال أمر طبيعي؛ فإن الإنسان يكره أن يقاتل أحداً من الناس فيقتله؛ فيصبح مقتولاً؛ لكن إذا كان هذا القتال مفروضاً علينا صار محبوباً إلينا من وجهٍ، ومكروهاً لنا من وجهٍ آخر؛ فباعتبار أن الله فرضه علينا يكون محبوباً إلينا؛ ولهذا كان الصحابة رضي الله عنهم يأتون إلى الرسول صلى الله عليه وسلم يصرون أن يقاتلوا؛ وباعتبار أن النفس تنفر منه يكون مكروهاً إلينا “.
ثم قال في فوائد الآية : ” ومنها: أنه لا حرج على الإنسان إذا كره ما كتب عليه؛ لا كراهته من حيث أمَر الشارع به؛ ولكن كراهته من حيث الطبيعة؛ أما من حيث أمر الشارع به فالواجب الرضا، وانشراح الصدر به “
“আল্লাহ তাআলা বলেন: وَهُوَ كُرۡهٞ لَّكُمۡۖ এটি তোমাদের জন্য অপছন্দনীয়।) كره (কুরহুন) শব্দটি مصدر তথা ক্রিয়ামূল; তবে এটি اسم المفعول (কর্মবাচক বিশেষ্যের) অর্থে ব্যবহৃত। অর্থাৎ এটি তোমাদের কাছে অপছন্দনীয়। اسم المفعول এর অর্থে مصدر এর ব্যবহার অনেক পাওয়া যায়। যেমন:وَإِنْ كُنَّ أُولَاتِ حَمْلٍ“যদি তারা গর্ভ ধারণ করা ওয়ালা হয়।”[সূরা তালাক: ৬] অর্থাৎ গর্ভ ধারণ করা ‘গর্ভে ধারণকৃত’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এছাড়া রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন: من عمل عملاً ليس عليه أمرنا فهو رد (যে ব্যক্তি এমন কাজ করে যা আমাদের শরীয়তে নেই সেটা প্রত্যাখ্যাত করা)।” অর্থাৎ প্রত্যাখ্যান করা ‘প্রত্যাখ্যাত’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।وَهُوَ كُرْهٌ لَكُمْ (এটি তোমাদের জন্য অপছন্দনীয়) বাক্যটি حال (ক্রিয়া বিশেষণ) হওয়ার কারণে نصب (নসব) অবস্থায় রয়েছে। সর্বনাম ‘هو’র প্রত্যাবর্তনস্থল (বিশেষ্য) হলো القتال। এর প্রত্যাবর্তনস্থল (নামপদ) الكتابة (ফরয করা) নয়। মুসলিমগণ আল্লাহ তাদের উপর যা আবশ্যক করেছেন সেটাকে অপছন্দ করে না। বরং মানবীয় প্রকৃতিগত কারণে তারা যুদ্ধকে অপছন্দ করে। ‘আল্লাহ যে যুদ্ধ আবশ্যক করেছেন আমরা সেটাকে অপছন্দ করি’ আর ‘আমরা যুদ্ধকে অপছন্দ করি’ এ দুই কথার মধ্যে ফারাক আছে। যুদ্ধকে অপছন্দ করা এটা প্রকৃতিগত বিষয়। মানুষ কারো সাথে লড়াই করে তাকে হত্যা করাকে অপছন্দ করে; যার ফলশ্রুতিতে সেও নিহত হবে। কিন্তু এই যুদ্ধ যদি আমাদের উপর ফরয করা হয়, তখন এটি এক দিক থেকে আমাদের কাছে পছন্দনীয়; অন্য দিক থেকে অপছন্দনীয়। আল্লাহ আমাদের উপর ফরয করেছেন এই দিক থেকে এটি আমাদের কাছে পছন্দনীয়। এ কারণে সাহাবীরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে এসে যুদ্ধ করার জন্য পীড়াপীড়ি ব্যক্ত করতেন। আর যেহেতু আমাদের মন যুদ্ধ থেকে দূরে থাকতে চায়, সে দিক থেকে এটি আমাদের কাছে অপছন্দনীয়।”তারপর তিনি এ আয়াতের শিক্ষায় বলেন: “এই আয়াতের অন্যতম শিক্ষা হলো মানুষের উপর যা আবশ্যক করা হয়েছে সে কাজটি অপছন্দ করা তার জন্য দোষণীয় না। তবে শরীয়তদাতার নির্দেশ হিসেবে নয়; বরং প্রকৃতিগতভাবে সেটি অপছন্দ করতে পারে। আর শরীয়তদাতার নির্দেশের দিক থেকে এর প্রতি তুষ্ট থাকা এবং এ বিধানের ব্যাপারে অন্তর প্রসন্ন রাখা আবশ্যক।”(ইবনে উসাইমীনের তাফসীরুল কুরআন; ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৪৮০৯৯)
.
অন্য স্থানে ইবনু উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ বলেন:وقوله: (وَهُوَ كُرْهٌ لَكُمْ) يجب أن تعلم أن الضمير في قوله: (وَهُوَ) يعود على القتال وليس يعود على الكتابة، لأن الصحابة رضي الله عنهم لايمكن أن يكرهوا فريضة الله ، لكن يكرهون القتل ويقاتلون فيقتلون.وفرق بين أن يكره الإنسان حكم الله، أو أن يكره المحكوم به “আল্লাহর বাণী “এটি তোমাদের কাছে অপছন্দনীয়” এর ব্যাপারে জানা আবশ্যক যে, এখানে সর্বনাম هو এর উৎস বিশেষ্য হলো القتال (যুদ্ধ); الكتابة (আবশ্যকতা) নয়। কারণ সাহাবীরা আল্লাহর ফরযকৃত বিষয়কে অপছন্দ করতে পারেন না। কিন্তু তারা যুদ্ধকে অপছন্দ করতেন। যুদ্ধে লিপ্ত হলে তারা নিহত হবেন। কেউ আল্লাহর দেয়া বিধানকে অপছন্দ করা’ আর ‘যে বিষয়ে বিধান এসেছে সেটাকে অপছন্দ করা’ এ দুটোর মধ্যে পার্থক্য আছে”।(মুআল্লাফাতুশ শাইখ ইবনু উসাইমীন: খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৪৩৮)
.
কিন্তু এর বিপরীতে স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করার কারণে স্ত্রী যদি তার প্রতি কোন ধরনের জুলুম-নির্যাতন করে, খারাপ আচরণ ও গালাগালি করে, তার গোপনীয়তা প্রকাশ, গিবত ও আমানতের খেয়ানত করে, তাকে অপমান-অপদস্থ করে বা অন্য কোন ভাবে তাকে কষ্ট দেয় তাহলে সে মারাত্মক গুনাগার হবে। এই বিষয়গুলো সাধারণভাবেই কবিরা গুনাহ। কিন্তু স্বামীর সাথে করা হলে তার ভয়াবহতা আরও বেশি। আব্দুল্লাহ্ বিন্ ’উমর (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন:لَا يَنْظُرُ اللهُ إِلَى امْرَأَةٍ لَا تَشْكُرُ لِزَوْجِهَا، وَهِيَ لَا تَسْتَغْنِيْ عَنْهُ.‘‘আল্লাহ্ তা‘আলা এমন মহিলার দিকে (সন্তুষ্টির দৃষ্টিতে) তাকান না যে নিজ স্বামীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না; অথচ সে তার স্বামীর প্রতি সর্বদাই মুখাপেক্ষিণী’’।(নাসায়ী সুনানুল কুবরা হা/ ৯১৩৫:মুস্তাকরাক হাকেম হা/২৭৭১) অপর বর্ননায় রাসূল ﷺ বলেন,”কোন মহিলা তার স্বামীকে দুনিয়াতে কষ্ট দিলে তার জান্নাতী অপরূপা সুন্দরী স্ত্রীরা বলে: তাকে কষ্ট দিও না। আল্লাহ্ তোমাকে ধ্বংস করুক! কারণ সে তো তোমার কাছে কিছু দিনের জন্য। বেশি দেরি নয় যে, সে তোমাকে ছেড়ে আমাদের কাছে চলে আসবে’’।(ইবনু মাজাহ্ হা/২০৪৪) সুতরাং স্বামীর দ্বিতীয় বিবাহ করলে স্ত্রীর তার কর্তব্য হবে,আল্লাহর বিধানের প্রতি আত্মসমর্পণ এবং স্বামীর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে সর্বোচ্চ ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দেওয়া। তা করা সম্ভব না হলে বুক ভরা সীমাহীন কষ্ট সহ্য করে সংসার অব্যাহত রাখা আবশ্যক নয়। ইচ্ছা করলে সে খোলা তালাকের মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার অধিকার রাখে।যেমন আল্লাহ তা‘আলা বলেন; ‘‘অতঃপর যদি তোমাদের ভয় হয় যে, তারা উভয়েই আল্লাহর নির্দেশ বজায় রাখতে পারবে না, তাহলে সেক্ষেত্রে স্ত্রী যদি কিছু বিনিময় দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় তবে উভয়ের কারো পাপ হবে না।’’ (সূরা আল- বাকারহ্; ২/২২৯)। এখানে খুলা’ (খোলা তালাকের) কথা বলা হচ্ছে। অর্থাৎ, স্ত্রী স্বামী থেকে পৃথক হতে চাইলে, স্বামী তার স্ত্রীকে দেওয়া মোহরানা ফিরিয়ে নিতে পারে।
.
সারকথা হলো: মুমিন নারীর জন্য আল্লাহ কর্তৃক আরোপিত বহুবিবাহের বিধানের প্রতি সন্তুষ্ট থাকা আবশ্যক। তাকে বিশ্বাস করতে হবে যে এতে রয়েছে প্রজ্ঞা ও কল্যাণ। তার উচিত হবে না এ হুকুম ও বিধানকে অপছন্দ করা; যদিও তার মন তার সাথে ভাগ বসাতে আসা সতীনের উপস্থিতিকে অপছন্দ করে যেমনিভাবে মানুষ যুদ্ধকে অপছন্দ করে। আর স্বাভাবিক ভাবে বহু বিবাহ অপছন্দ করা ঈমান ভঙ্গের কারণ নয়। যেমন সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] জিজ্ঞেস করা হয়েছিল: কিছু মহিলা পুরুষের একাধিক বিবাহের আলোচনা শুনলে বিরক্ত বোধ করে, এবং পুরুষের একাধিক বিবাহের আলোচনা শুনলে তাঁদের আচরণে পরিবর্তন আসে। এই বিষয়ে মহিলাদের জন্য আপনার কী উপদেশ থাকবে?
শাইখ জবাবে বলেন,
تعني بالتعدّد تعدّد الزوجات والمرأة بطبيعتها تكره التعدّد ويحدث لها من الغيرة ما يصل إلى حد الجنون تقريبا.
السائل : نعم يا شيخ.
الشيخ : وهي غير ملومة بذلك لأن هذه طبيعة المرأة لكن المرأة العاقلة لا تُغلّب جانب العاطفة والغيرة على جانب الحكمة والشريعة فالشرع أباح للرجل أن يُعدّد بشرط أن يأمن نفسه من الجوْر وأن يكون قادرا على العدل قال الله تعالى { فَانكِحوا ما طابَ لَكُم مِنَ النِّساءِ مَثنى وَثُلاثَ وَرُباعَ فَإِن خِفتُم أَلّا تَعدِلوا فَواحِدَةً أَو ما مَلَكَت أَيمانُكُم ذلِكَ أَدنى أَلّا تَعولوا } يعني ألا تجوروا فأوجب الله الاقتصار على الواحدة إذا خاف الإنسان ألا يعدل.والمرأة لا شك أنها إذا سمعت أن زوجها يريد أن يتزوّج تتغيّر على زوجها ولكن ينبغي لها أن توطّد نفسها وتطمئنها وتعلم أن هذا النفور والغيرة التي حصلت ستزول إذا حصل الزواج كما هو مجرّب لكن على الزوج أن يتقي الله عز وجل في إقامة العدل بين الزوجة الأولى والثانية لأن بعض الأزواج إذا رغِب في الثانية أجْنف عن الأولى ونسي ما كان بينهما من الحياة السعيدة قبل ذلك فيميل إلى الثانية أكثر ومن كان كذلك فليستعد لهذه العقوبة التي ذكرها النبي صلى الله عليه وعلى ءاله وسلم “من كانت له امرأتان فمال إلى إحداهما جاء يوم القيامة وشقّه مائل” والعياذ بالله يشهده العالم كلهم، يشهدونه وشقّه مائل لأنه مال عن العدل فجوزي بمثل ذنبه نسأل الله العافية. نعم.
““নারীরা স্বাভাবিকভাবেই স্বামীর একাধিক বিবাহকে অপছন্দ করে থাকে। তাদের স্বভাবগত ঈর্ষা বা আবেগ অনেক সময় এমন মাত্রায় পৌঁছায় যা প্রায় পাগলামির পর্যায়ে চলে যায়।
প্রশ্নকারী: জি, শাইখ।
শাইখ: নারীদের এধরনের আচরণের জন্য দোষারোপ করা যায় না, কেননা এটি তাদের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। তবে জ্ঞানী ও বিচক্ষণ নারী কখনো আবেগ এবং ঈর্ষাকে শরীয়াহ ও প্রজ্ঞার উপর প্রাধান্য দেয় না। শরীয়াহ এমন একাধিক বিবাহকে বৈধ করেছে, তবে এতে শর্ত হলো—পুরুষকে অবশ্যই জুলুম থেকে বাঁচতে হবে এবং ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হবে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা বলেছেন:{فَانكِحوا ما طابَ لَكُم مِنَ النِّساءِ مَثنى وَثُلاثَ وَرُباعَ فَإِن خِفتُم أَلّا تَعدِلوا فَواحِدَةً أَو ما مَلَكَت أَيمانُكُم ذلِكَ أَدنى أَلّا تَعولوا}} “সুতরাং বিবাহ কর (স্বাধীন) নারীদের মধ্যে যাকে তোমাদের ভাল লাগে; দুই, তিন অথবা চার। আর যদি আশংকা কর যে সুবিচার করতে পারবে না, তবে একজনকে (বিবাহ কর) অথবা তোমাদের অধিকারভুক্ত (ক্রীত অথবা যুদ্ধবন্দিনী) দাসীকে (স্ত্রীরূপে ব্যবহার কর)।এটাই তোমাদের পক্ষপাতিত্ব না করার অধিকতর নিকটবর্তী”।(সূরা নিসা: ৩) এখানে বোঝানো হয়েছে যে একাধিক বিবাহ কেবল তখনই বৈধ যখন পুরুষ নিজেকে জুলুম থেকে রক্ষা করতে পারে এবং ইনসাফ (সর্বোচ্চ সুবিচার) নিশ্চত করতে পারে। কিন্তু পুরুষ যদি একাধিক স্ত্রীর ক্ষেত্রে সুবিচার করতে অক্ষম হয় তখন তার জন্য এক স্ত্রীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকা ওয়াজিব। আর একজন নারী যখন শুনতে পায় যে তার স্বামী অন্য একজনকে বিয়ে করতে চান তখন স্বাভাবিকভাবেই সে ক্ষুব্ধ হয়। অথচ তার উচিত ছিল সে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করা, ধৈর্য ধারন করা এবং বুঝা যে তার এই আবেগ ও ঈর্ষার অনুভূতি অস্থায়ী। বিয়ের পর এটি স্বাভাবিকভাবেই দূর হয়ে যাবে। মূলত তা পরীক্ষামূলক এবং এই বিষয়টি বাস্তবে বহুবার প্রমাণিত হয়েছে। অন্যদিকে স্বামীর জন্য আবশ্যক হলো প্রথম এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর মধ্যে সুবিচার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আল্লাহকে ভয় করা। কেননা অনেক স্বামী দ্বিতীয় বিয়ের পর প্রথম স্ত্রীর প্রতি অবিচার করেন এবং আগের সব সুখময় দিনগুলোকে ভুলে যান। তারা দ্বিতীয় স্ত্রীর প্রতি অধিক মনোযোগী হয়ে পড়েন। যারা এমন করেন, তাদের উচিত কিয়ামতের দিনের ভয়াবহ পরিণতির কথা স্মরণ করা। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন:“যে ব্যক্তির দুইজন স্ত্রী আছে এবং সে একজনের প্রতি অন্যজনের তুলনায় বেশি ঝুঁকে পড়ে কিয়ামতের দিন সে একপাশ বাকা অবস্থায় উপস্থিত হবে।” (আবু দাউদ, হাদিস: ২১৩৩)। এই শাস্তি হবে সেই ব্যক্তির জন্য যে পৃথিবীতে স্ত্রীদের মধ্যে সুবিচার করেনি। সকলের সামনে তাকে এ অবস্থায় উপস্থিত করা হবে। আমরা আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি।
প্রশ্নকারী: শাইখ, খরচ ও রাত যাপনে ইনসাফ করার বাইরে আর কোন ক্ষেত্রে ইনসাফ করতে হবে?
শাইখ: সম্ভবপর সকল ক্ষেত্রেই ইনসাফ করতে হবে। যে ক্ষেত্রগুলোতে ন্যায়বিচার সম্ভব সেগুলোর কোনো দিকেই অবহেলা করা যাবে না। এমনকি যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রেও সক্ষম হলে ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে হবে।
প্রশ্নকারী: আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিন এবং আপনার জীবনে বরকত দান করুন”।(ইবনু উসাইমীন; ফাতাওয়া নূরুন ‘আলাদ-দারব, পৃষ্ঠা: ২২৬)
.
আল্লাহ আমাদেরকে দুনিয়াবী জীবনের যাবতীয় পরীক্ষা ঈমানের সাথে মোকাবেলা করার তৌফিক দান করুন। আমীন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
___________________
আপনাদের দ্বীনি ভাই:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।