প্রশ্ন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গালি দেওয়ার শারঈ হুকুম কি? যে ব্যক্তি রাসূল (ﷺ)-কে গালি দিবে তার দুনিয়াবী শাস্তি কি?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: মানবতার শ্রেষ্ঠ আদর্শ, বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এমন এক মহান ব্যক্তিত্ব, যাঁর জীবন ছিল পরিপূর্ণ নৈতিকতার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। মাত্র ২৩ বছরের মধ্যে তিনি আরবের অন্ধকার যুগের চেহারা বদলে দিয়ে সভ্যতার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছিলেন। তৎকালীন সমাজের চরম অন্যায়, অবিচার ও বর্বরতাকে মুছে দিয়ে সত্য, ন্যায় ও কল্যাণের আলো ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।তিনি ছিলেন এমন এক ব্যক্তিত্ব, যাঁকে মহান আল্লাহ বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছেন:وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا رَحْمَةً لِّلْعَالَمِينَ “(হে মুহাম্মাদ) আমি তোমাকে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত স্বরূপ পাঠিয়েছি।” (সূরা আম্বিয়া: ১০৭) রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর চরিত্র ছিল এত উচ্চতর যে, স্বয়ং আল্লাহ তাঁর প্রশংসা করেছেন:وَإِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ “নিশ্চয়ই তুমি মহান চরিত্রের অধিকারী।” (সূরা কলম: ৪) তাঁর চরিত্রের এই মহিমা শুধু মুসলিম মনীষীদের কাছেই নয়, বরং বহু অমুসলিম চিন্তাবিদও স্বীকার করেছেন। ফরাসি ইতিহাসবিদ প্রফেসর সেডিউ বলেন: “নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ছিলেন সদা হাস্যোজ্জ্বল ও সদালাপী। তিনি অধিকাংশ সময় নীরব থাকতেন, আল্লাহর স্মরণে মগ্ন থাকতেন এবং অনর্থক কথা বলতেন না। অশ্লীলতা ও মন্দ কাজ তিনি অত্যন্ত ঘৃণা করতেন। তিনি ছিলেন সঠিক মত ও পরিপূর্ণ জ্ঞানের অধিকারী।”(রহমাতুল্লিল আলামীন,খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২২৫) এই মহান ব্যক্তি শুধু ধর্মীয় নেতা নন, বরং তিনি ছিলেন উত্তম শিক্ষক, আদর্শ শাসক, দায়িত্বশীল পিতা এবং দয়ার সাগর। তাঁর আদর্শ অনুসরণ করলেই পৃথিবীতে শান্তি, সুবিচার ও মানবকল্যাণ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে।
.
অথচ দুঃখজনক হলেও সত্যি বাংলাদেশের মতো একটি মুসলিম প্রধান দেশে, যেখানে মুসলিম শাসকরা শাসন করছেন, সেখানে মহান চরিত্রের অধিকারী, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব, রাসূল (ﷺ) এর প্রতি মুহূর্তে অবমাননার ঘটনা ঘটে। অথচ, এসব নাস্তি/ক ও মুরতা/দদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না, ফলে এই অপরাধ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসব পরিস্থিতি দেখে তাওহীদি জনতার মধ্যে গভীর ক্ষোভ এবং আক্রোশ সৃষ্টি হচ্ছে। জেনে রাখুন! সকল নবী ও রাসূলের প্রতি ঈমান আনা ইসলামী আকিদার অন্যতম রুকন; যে রুকনগুলোর প্রতি ঈমান না-আনলে কোন মুসলমানের ঈমান পূর্ণ হবে না। মুসলিমের আকিদা শুধু সকল নবীদের প্রতি ঈমান আনাকে ফরজ করে না; বরং তাদের সকলকে সম্মান করা, মর্যাদা দেয়া, তাঁদের মর্যাদার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ সম্মান দেয়াকে ফরজ করে। যেহেতু তাঁরা হচ্ছেন- শ্রেষ্ঠ মানব, আল্লাহর নির্বাচিত মাখলুক। তাঁরা হচ্ছেন- হেদায়েতের আলোকবর্তিকা; যা অন্ধকার পৃথিবীকে আলোকিত করেছে, হৃদয়গুলোর পাশবিকতা দূর করে কোমলতা এনেছে। তাঁদেরকে ছাড়া শান্তি ও সফলতার কোন পথ নেই। তাইতো সকল আলেম ইজমা তথা ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে, নবীদেরকে গালি দেয়া, হেয় প্রতিপন্ন করা হারাম। যে ব্যক্তি কর্তৃক এমন কিছু সংঘটিত হবে সে মুরতাদ হয়ে যাবে; যেমনিভাবে কেউ আমাদের নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গালি দিলে মুরতাদ হয়ে যায়। কারন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে গালি দেয়া হলো বড় কুফরী এবং ঈমান বঙ্গের কারন। কোনো ব্যক্তি যদি মুসলিম- অমুসলিম যেই হোক নবী (ﷺ)-কে গালি দেয়, তাহলে সে কুফরী করবে এবং মুরতাদ হয়ে যাবে। এই মর্মে দলিল হচ্ছে,আল্লাহ তাআলা বলেন, আর আপনি তাদেরকে প্রশ্ন করেন, তাহলে অবশ্যই তারা বলবে, আমরা তো আলাপ-আলোচনা ও খেল-তামাশা করছিলাম। বলুন, তোমরা কি আল্লাহ, তার আয়াতসমূহ ও তার রাসূলকে বিদ্রুপ করছিলে? তোমরা ওজর পেশ করো না, তোমরা তো ঈমান আনার পর কুফরী করেছ”(সূরা আত-তওবা, ৯/৬৫-৬৬)। উক্ত আয়াতের তাফসিরে ইমাম ইবনে হাজম আল-যাহেরী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:صَحَّ بِالنَّصِّ أَن كل من اسْتَهْزَأَ بِاللَّه تَعَالَى ، أَو بِملك من الْمَلَائِكَة ، أَو بِنَبِي من الْأَنْبِيَاء عَلَيْهِم السَّلَام ، أَو بِآيَة من الْقُرْآن ، أَو بفريضة من فَرَائض الدّين بعد بُلُوغ الْحجَّة إِلَيْهِ ، فَهُوَ كَافِر”প্রত্যক্ষ দলিলের ভিত্তিতে বিশুদ্ধভাবে সাব্যস্ত: যে ব্যক্তির নিকট দলিল পৌঁছার পরও সে ব্যক্তি যদি মহান আল্লাহকে কিংবা কোন ফেরেশতাকে কিংবা কোন নবীকে কিংবা কুরআনের কোন আয়াতকে কিংবা ইসলামের কোন একটি ফরজ বিধানকে বিদ্রূপ করে সে ব্যক্তি কাফের”।(আল-ফাসল ফিল মিলাল ওয়াল আহওয়া ওয়ান নিহাল; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ১৪২) শাইখ সুলাইমান আলে-শাইখ বলেন:” من استهزأ بالله ، أو بكتابه ، أو برسوله ، أو بدينه : كفر ، ولو لم يقصد حقيقة الاستهزاء ، إجماعاً “যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে, কিংবা আল্লাহর কিতাবের সাথে কিংবা তাঁর রাসূলের সাথে, কিংবা তাঁর ধর্মের সাথে বিদ্রূপ করে: সকল আলেমের ইজমার ভিত্তিতে সে কাফের। যদিও সে এর দ্বারা প্রকৃতপক্ষে বিদ্রূপ করা উদ্দেশ্য না করে থাকুক।(তাইসীরুল আযিযিল হামিদ,পৃষ্ঠা: ৬১৭) আবু বকর ইবনুল আরাবী (রাহিমাহুল্লাহ) তাঁর তাফসির গ্রন্থে বলেন: “তারা যা বলেছিল তা হয়তো মন থেকে বলেছিল কিংবা ঠাট্টাচ্ছলে বলেছিল। যেভাবেই বলুক না কেন: এটা কুফরি। কেননা কুফরি দিয়ে ঠাট্টা করাও কুফরি এ নিয়ে উম্মতের মাঝে কোন মতভেদ নেই। আর বাস্তব তথ্য হচ্ছে হক্ক ও জ্ঞানের ভাই। আর ঠাট্টা-মশকরা হচ্ছে- বাতিল ও অজ্ঞতার ভাই।(ইবনুল আরাবী তাফসির খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৫৪৩) হাদিসে থেকেও প্রমাণিত হয়,”যে ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে গালি দিবে, তাকে হত্যা করতে হবে। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কা‘ব ইবনুল আশরাফকে হত্যা করার আদেশ দিয়েছিলেন। কারণ সে আল্লাহ ও তার রাসূলকে কষ্ট দিয়েছিল (সহীহ বুখারী, হা/৪০৩৭; সহীহ মুসলিম, হা/১৮০১)। জনৈকা ইহূদী মহিলা রাসূল (ﷺ) কে গালি দিত। তখন একজন মুসলিম তাকে হত্যা করলে রাসূল (ﷺ) তার রক্তমূল্য দেননি”।(আবুদাউদ হা/৪৩৬২; মিশকাত হা/৩৫৫০; ইরওয়া হা/১২৫১-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য)। জনৈক ব্যক্তি রাসূল (ﷺ) গালি দিত। তখন রাসূল (ﷺ) বললেন, কে আমার এই শত্রুকে হত্যা করবে? খালিদ বিন অলীদ (রাঃ) বলেন, আমি। তখন খালেদ (রাঃ)-কে পাঠানো হয় এবং তিনি তাকে হত্যা করেন (মুছান্নাফে আব্দুর রাযযাক ৫/২৩৭; ইবনু হাযম আল মুহাল্লা ১২/৪৩৭)। একবার দু’জন মহিলা গানের মাধ্যমে নবী করীম (ﷺ) -এর নিন্দা করলে রাসূল (ﷺ) তাদের হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন”।(ইবনু কাইয়ুম যাদুল মা‘আদ; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৩৮৬) সুতরাং যে ব্যক্তি এমন মহা পাপে লিপ্ত হয়েছে তার কর্তব্য হচ্ছে- অনতিবিলম্বে সত্যিকার তওবা করা। দুই সাক্ষ্যবাণী উচ্চারণ করে ইসলামে ফিরে আসা এবং সকল নবীগণকে সম্মান করা।
.
❑যে ব্যক্তি কোন নবীকে হেয় প্রতিপন্ন করবে তার কাফের হওয়া প্রসঙ্গে আমরা এখানে আলেমগণের কিছু উক্তি উল্লেখ করব:
ইবনে নুজাইম আল-হানাফি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:” ويكفر بعيبه نبياً بشيء “কেউ কোন নবীর উপর কোন দোষারোপ করলে সে কাফের হয়ে যাবে।”(আল-বাহরুর রায়েক; খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ১৩০) কাযী ইয়ায (রাহিমাহুল্লাহ)
বলেন:”من استخف به – يعني بنبينا صلى الله عليه وسلم – أو بأحد من الأنبياء ، أو أزرى عليهم ، أو آذاهم ، أو قتل نبيا ، أو حاربه : فهو كافر بإجماع “যে ব্যক্তি তাঁকে (অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে) অপমান করবে কিংবা অন্য কোন নবীকে অপমান করবে কিংবা মর্যাদা ক্ষুণ্ণ করবে, কিংবা তাদেরকে কষ্ট দিবে কিংবা কোন নবীকে হত্যা করবে কিংবা কোন নবীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে সে ব্যক্তি সর্বসম্মতিক্রমে কাফের।”(আশ-শিফা বি তারিফিল মুস্তফা; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ২৮৪) আল-দিরদির আল-মালেকী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:” من سب نبياً مجمعاً على نبوته ، أو عرَّض بسب نبي فقد كفر“যাঁর নবী হওয়া সর্বসম্মত এমন কাউকে যে ব্যক্তি গালি দিবে কিংবা কোন নবীকে গালি দেয়ার কারণ হবে সে ব্যক্তি কাফের হয়ে যাবে”।(হাশিয়াতুদ দুসুকী আলাশ শারহিল কাবীর; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৩০৯) আল-শারবিনী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:” من كذب رسولاً أو نبياً أو سبه أو استخف به أو باسمه … فقد كفر“যে ব্যক্তি কোন নবীকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করবে কিংবা গালি দিবে কিংবা অপমান করবে কিংবা নবীর নামকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করবে…সে কাফের হয়ে যাবে।”(মুগনিল মুহতাজ; খণ্ড: ৫;পৃষ্ঠা: ৪২৯)
.
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন:” مِن خصائص الأنبياء أنَّ مَن سبَّ نبيًّا مِن الأنبياء قتل باتفاق الأئمة وكان مرتداً ، كما أنَّ مَن كفر به وبما جاء به كان مرتداً ، فإن الإيمان لا يتم إلا بالإيمان بالله وملائكته وكتبه ورسله“নবীদের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- যে ব্যক্তি কোন একজন নবীকে গালি দিবে ইমামদের সর্বসম্মতিক্রমে তাকে মুরতাদ হিসেবে হত্যা করা হবে। যেমনিভাবে কোন নবীকে অস্বীকার করলে ও তিনি যা নিয়ে এসেছেন সেটাকে অস্বীকার করলে যে কেউ মুরতাদ হয়ে যায়। কারণ কারো ঈমান পরিপূর্ণ হবে না যতক্ষণ না সে আল্লাহর প্রতি, তাঁর ফেরেশতাগণের প্রতি, তাঁর গ্রন্থাবলীর প্রতি ও তাঁর রাসূলগণের প্রতি ঈমান না আনবে”।(সাফাদিয়্যা; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২৬২) তিনি (রাহিমাহুল্লাহ) আরো বলেছেন:إنَّ سبَّ الله أو سبَّ رسوله كفر ظاهراً وباطناً ، سواء كان الساب يعتقد أن ذلك محرَّم أو كان مستحلاًّ له ، أو كان ذاهلاً عن اعتقاده ، هذا مذهب الفقهاء ، وسائر أهل السنَّة القائلين بأن الإيمان قول وعمل”নিশ্চয়ই আল্লাহ বা তাঁর রাসূলকে গালি দেওয়া চাহে তা প্রকাশ্যে হোক বা গোপনে আন্তরিক ও বাহ্যিকভাবে কুফর। গালি প্রদানকারী ব্যক্তি তা হারাম বলে বিশ্বাস করুক বা বৈধ মনে করুক, কিংবা সে তার বিশ্বাস সম্পর্কে উদাসীন থাকুক সব অবস্থায়ই এটি কুফর। এটি ফকিহগণ ও আহলুস সুন্নাহর সর্বসম্মত মত, যারা এই বিশ্বাস রাখেন যে, ঈমান হল বক্তব্য ও কর্মের সমষ্টি।”
(ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ), আস-সারেমুল মাসলূল ‘আলা শাতিমির রাসূল (ﷺ) খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৫১৩)
.
আল মাওযূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ আল-কুয়েতিয়াহ -তে বলা হয়েছে:ورد في الكتاب العزيز تعظيم جُرم تنقص النبي صلى الله عليه وسلم أو الاستخفاف به ، ولعن فاعله ، وذلك في قول الله تعالى : ( إن الذين يؤذون الله ورسوله لعنهم الله في الدنيا والآخرة وأعد لهم عذابا مهيناً ) ، وقوله تعالى : ( ولئن سألتهم ليقولن إنما كنا نخوض ونلعب قل أبالله وآياته ورسوله كنتم تستهزئون لا تعتذروا قد كفرتم بعد إيمانكم إن نعف عن طائفة منكم نعذب طائفة بأنهم كانوا مجرمين ) ، وقد ذهب الفقهاء إلى تكفير من فعل شيئاً من ذلك “পবিত্র কুরআনে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে অবমাননার ভয়াবহতা স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে এবং এর জন্য কঠোর শাস্তির ঘোষণা এসেছে।” আল্লাহ তাআলা বলেন:”নিশ্চয় যারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে কষ্ট দেয়, আল্লাহ তাদেরকে দুনিয়া ও আখিরাতে লা’নত করেন এবং তিনি তাদের জন্য প্ৰস্তুত রেখেছেন লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি”।(সূরা আহযাব: ৫৭) তিনি আল্লাহ তাআলা আরো বলেন,”আর আপনি তাদেরকে প্রশ্ন করেন, তাহলে অবশ্যই তারা বলবে, আমরা তো আলাপ-আলোচনা ও খেল-তামাশা করছিলাম। বলুন, তোমরা কি আল্লাহ, তার আয়াতসমূহ ও তার রাসূলকে বিদ্রুপ করছিলে? তোমরা ওজর পেশ করো না, তোমরা তো ঈমান আনার পর কুফরী করেছ”(সূরা আত-তওবা, ৯/৬৫-৬৬)। ফকিহগণ এই বিষয়ে একমত যে, যে কেউ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গালি দেয়, সে কাফির।(আল মাওযূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ আল-কুয়েতিয়াহ,খণ্ড: ২২; পৃষ্ঠা: ১৮৪)
.
❑ “যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে গালমন্দ করে তার দুনিয়াবি শাস্তি কী?
.
এ বিষয়ে আলেমদের মধ্যে কিছুটা মতাভেদ থাকলেও বিশুদ্ধ কথা হচ্ছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর এবং তাঁর রাসূলকে গালমন্দ করলে ইসলামি ফৌজদারি দণ্ডবিধি মোতাবেক ইসলাম ত্যাগের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড যদি সে তওবা না করে: এ ব্যাপারে দলিল হচ্ছে,প্রখ্যাত সাহাবী ‘আব্দুল্লাহ বিন মাস‘ঊদ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) [মৃত: ৩২ হি.] থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,لا يَحِلُّ دَمُ امْرِئٍ مُسْلِمٍ إِلاَّ بإِحْدَى ثَلاثٍ: الثَّيِّبُ الزَّانِي، وَالنَّفْسُ بِالنَّفْسِ، وَالتَّاركُ لِدِينه المُفَارِقُ للجمَاعَةِ“তিন কারণের কোনও একটি ব্যতীত কোন মুসলিমের রক্ত প্রবাহিত করা হালাল নয়। ক. বিবাহিত জিনাকারী। খ. হত্যার বিনিময়ে হত্যা। গ. যে ব্যক্তি ইসলাম ত্যাগ করে (মুসলিমদের) জামাআত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়।” (সহীহ বুখারি, হাদিস ৬৮৭৮, জামে তিরমিযী, হাদিস ১৪০২, মুসান্নাফ আব্দুর রাযযাক, হাদিস ১৮৭০৪, বায়হাকী ৮: ১৯৪ ইত্যাদি) এছাড়াও এ মর্মে একাধিক হাদিস রয়েছে।
.
তাছাড়া মুরতাদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারে ইসলামি স্কলারদের মাঝে কোন দ্বিমত নাই আল হামদুলিল্লাহ। আল ইমামুল ‘আল্লামাহ আবু ‘উমার ইউসুফ ইবনু ‘আব্দিল বার (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৪৬৩ হি.] বলেছেন:إن من ارتد عن دينه حل دمه، وضربت عنقه، والأمة مجتمعة على ذلك“যে তার দীন (ইসলাম) ত্যাগ করে তাকে হত্যা করা বৈধ হয়ে যাবে এবং তার শিরশ্ছেদ করা হবে। এ বিষয়ে পুরো উম্মতের মতৈক্য রয়েছে।” (আত তামহীদ; খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ৩০৬) ইমাম ইবনে মুনযির (রহিমাহুল্লাহ) বলেন:أجمع عامة أهل العلم على أنَّ مَن سبَّ النبيَّ صلى الله عليه وسلم عليه القتل” “সমস্ত আলেম একমত যে, যে ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গালি দেয়, তাকে হত্যা করা হবে।”(তাফসিরে কুরতুবি,খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ৮২) ইমাম খাত্তাবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, “لا أعلم أحداً مِن المسلمين اختلف في وجوب قتله” ا”আমি এমন কোনো মুসলিমকে জানি না, যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গালি দেওয়ার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়া নিয়ে মতবিরোধ করেছে।” (মা‘আলিমুস সুনান, খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ২৯৫)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল: “যে ব্যক্তি আল্লাহ (عَزَّ وَجَلَّ) কিংবা রাসূল ﷺ কে গালি দিয়েছে, তার তাওবাহ কি কবুল করা হবে?”
জবাবে শাইখ বলেন: “এ ব্যাপারে ‘আলিমগণ দুটি মতে মতদ্বৈধতা করেছেন। যথা:
১ম মত: যে ব্যক্তি আল্লাহ কিংবা রাসূল ﷺ কে গালি দিয়েছে, তার তাওবাহ কবুল করা হবে না। এটি হাম্বালীদের প্রসিদ্ধ অভিমত। বরং গালিদাতাকে (মুসলিম শাসক কর্তৃক) কাফির হিসেবে হত্যা করতে হবে। তার জানাযাহ’র নামাজ পড়া হবে না, তার জন্য রহমতের দু‘আ করা হবে না এবং মুসলিমদের কবরস্থান থেকে দূরের কোনো স্থানে তাকে কবর দিতে হবে।
২য় মত: যে ব্যক্তি আল্লাহ কিংবা রাসূল ﷺ কে গালি দিয়েছে, তার তাওবাহ কবুল করা হবে, যখন আমরা জানব যে, সে সত্যিকারার্থেই আল্লাহ’র কাছে তাওবাহ করেছে, ভুল করেছে বলে স্বীকার করেছে এবং মহান আল্লাহকে তাঁর প্রকৃত সিফাতে তা‘যীম (সম্মানসূচক বিশেষণ) দ্বারা বিশেষিত করেছে। যেহেতু ব্যাপকার্থবোধক দলিলসমূহ প্রমাণ করছে যে, তার তাওবাহ কবুল করা হবে। যেমন আল্লাহ বলেছেন, “বল, ‘হে আমার বান্দাগণ, যারা নিজেদের ওপর বাড়াবাড়ি করেছ, তোমরা আল্লাহ’র রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। অবশ্যই আল্লাহ সকল পাপ ক্ষমা করে দেবেন। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু’।” (সূরাহ যুমার: ৫৩)
কাফিরদের কেউ কেউ আল্লাহকে গালি দেয়, তথাপি তাদের তাওবাহ কবুল করা হয়। এটিই বিশুদ্ধ মত। তবে রাসূল ﷺ কে গালিদাতার কথা ভিন্ন। তার তাওবাহ কবুল করা হবে, কিন্তু তাকে হত্যা করা ওয়াজিব। পক্ষান্তরে আল্লাহকে গালিদাতার তাওবাহ কবুল করা হবে এবং তাকে হত্যা করা হবে না। কেননা আল্লাহ আমাদেরকে অবহিত করেছেন যে, বান্দা তাওবাহ করলে তিনি তাঁর হকের ক্ষেত্রে (বান্দার কৃত গুনাহ) মাফ করে দেন, আর তিনি সকল গুনাহ ক্ষমা করে থাকেন।
কিন্তু রাসূল ﷺ কে গালিদাতার সাথে দুটি বিষয় জড়িত। যথা:
এক. শার‘ঈ বিষয়; যেহেতু তিনি আল্লাহ’র রাসূল ﷺ। এক্ষেত্রে গালিদাতা তাওবাহ করলে তার তাওবাহ কবুল করা হবে।
দুই. ব্যক্তিগত বিষয়। এক্ষেত্রে গালিদাতার তাওবাহ কবুল করা হবে না। কেননা এটি মানুষের হক। আর এটা জানা যায় না যে, তিনি তাঁর হকের ব্যাপারে (সবাইকে) মাফ করে দিয়েছেন। এর ওপর ভিত্তি করে গালিদাতাকে হত্যা করতে হবে। কিন্তু তাকে হত্যা করা হলে, আমরা তাকে গোসল দিব, কাফন পরিহিত করব, তার জানাযাহ’র নামাজ পড়ব এবং মুসলিমদের সাথেই তাকে কবর দিব।
শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) এই মতটি পছন্দ করেছেন। এ ব্যাপারে তিনি একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। গ্রন্থটির নাম ‘আস-সারিমুল মাসলূল ফী তাহাত্তুমি ক্বাতলি সাব্বির রাসূল’। কেননা গালিদাতা রাসূল ﷺ এর হক নষ্ট করেছে। অনুরূপভাবে সে যদি রাসূল ﷺ কে মিথ্যা অপবাদ দেয়, তাহলেও তাকে হত্যা করা হবে, কশাঘাত করা হবে না।
যদি বলা হয়, এটি কি প্রমাণিত হয়নি যে, কিছু লোক রাসূল ﷺ এর জীবদ্দশায় তাঁকে গালি দিয়েছিল, তথাপি তিনি তাদের তাওবাহ কবুল করেছিলেন?
তাহলে এর জবাব হিসেবে বলা হবে, এটি সঠিক কথা। কিন্তু এটি তাঁর ﷺ জীবদ্দশায় ঘটেছে, এবং তিনি তাঁর হক বিলোপ করেছেন। পক্ষান্তরে রাসূল ﷺ এর মৃত্যুর পর তাঁর হক বিলোপ করার অধিকার কারও নেই। সুতরাং রাসূল ﷺ কে গালি দেওয়ার ফলে (অবধারিতভাবে) যে কর্তব্য পালনের প্রয়োজন দেখা দেয়, আমাদের জন্য তা বাস্তবায়ন করা ওয়াজিব। সে কর্তব্য হলো গালিদাতাকে হত্যা করা। আর গালিদাতার তাওবাহ কবুল হওয়ার বিষয়টি তার এবং আল্লাহ’র মধ্যকার ব্যাপার।
যদি বলা হয়, যেহেতু এরূপ সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে, এমন কিছু তাঁর জীবদ্দশায় হলে তিনি গালিদাতাকে ক্ষমা করে দিতেন, তাহলে এই সম্ভাবনা কি এটা আবশ্যক করছে না যে, আমরা তার বিধানের ক্ষেত্রে তাওয়াক্বকুফ (ক্ষান্ত হওয়া) অবলম্বন করব?
তাহলে এর জবাব হিসেবে বলা হবে, এই সম্ভাবনা তাওক্বকুফ অবলম্বন করাকে আবশ্যক করে না। কেননা গালি দেওয়ার কারণে গোলযোগ সৃষ্টি হয়। আর এই গালির প্রভাব যে কোন পর্যায়ে পৌঁছবে, তা (আমাদের) জানা নেই। সুতরাং মূলনীতি অনুযায়ী এর বিধানকে তার মূলের ওপর ছেড়ে দিতে হবে।
যদি বলা হয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাসূল ﷺ কি তাঁর গালিদাতাকে মাফ করে দেননি?
তাহলে এর জবাব হিসেবে বলা হবে, হ্যাঁ, অবশ্যই। কখনো কখনো রাসূল ﷺ এর জীবদ্দশায় মাফ করা হয়েছিল, এতে কল্যাণ নিহিত থাকার কারণে। আর সে কল্যাণ হলো হৃদ্যতা। যেমন রাসূল ﷺ নির্দিষ্টভাবে জানতেন যে, কারা মুনাফিক্ব। কিন্তু তিনি তাদেরকে হত্যা করেননি, যাতে মানুষ এই সমালোচনা করতে না পারে যে, মুহাম্মাদ তার সাথীদেরকে হত্যা করছে। কিন্তু বর্তমানে আমরা যদি কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির ব্যাপারে জানতে পারি যে, সে মুনাফিক্ব, তাহলে অবশ্যই আমরা তাকে হত্যা করব। ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘সুবিদিত মুনাফিক্বকে হত্যা না করার বিষয়টি কেবল রাসূল ﷺ এর জীবদ্দশাতেই সীমাবদ্ধ’।”( ইবনু ‘উসাইমীনমাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ১৫০-১৫২ অনুবাদ আব্দুল্লাহ মৃধা)
.
❑ মুরতাদ (ইসলাম ত্যাগী) বা আল্লাহর-রাসূল, কুরআন ইত্যাদিকে গালমন্দকারীকে হত্যা করার দায়িত্ব কার?
.
ইসলামের সব ধরণের হুদুদ কায়েম বা ফৌজদারি দণ্ডবিধি (যথা: মৃত্যুদণ্ড, বেত্রাঘাত, জেল, জরিমানা বা অন্যান্য শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ) বাস্তবায়ন করার একমাত্র অধিকারী সরকার বা তার স্থলাভিষিক্ত; সাধারণ কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নয়। ইমাম আবু ‘আব্দুল্লা-হ্ মুহাম্মাদ বিন আহমাদ আল ক্বুরত্বুবী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭১ হি.] বলেন:وأما من يقيم هذا الحد – أي : جلد شارب الخمر – فاتفقوا على أن الإمام يقيمه وكذلك الأمر في سائر الحدود“আলেমগণ এ ব্যাপারে একমত যে, এই হদ (তথা মদ পানকারীর উপর চাবুক মারার বিধান) বাস্তবায়ন করবে ইমাম (রাষ্ট্রপ্রধান)। সকল হুদুদ (দণ্ড প্রয়োগ) এর ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য।” (বিদায়াতুল মুজতাহিদ ২/২৩৩) সঊদী স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটি সহ অন্যান্য আলেম বলেন, ‘হাদ্দ (মৃত্যুদণ্ড, সাজা, শাস্তি) প্রতিষ্ঠিত করার বিষয়টি মুসলিম ইমাম, সুলতান, শাসক অথবা তার স্থলাভিষিক্ত বা প্রতিনিধির উপর নির্ভরশীল। মুসলিম শাসক ও তাঁর প্রতিনিধি ব্যতীত অন্য কারোর জন্য ‘হাদ্দ’ ক্বায়েম করা অনুমোদিত নয়। কোন মুসলিম ব্যক্তি বা সমাজের জন্য হাদ্দ ক্বায়েম করা জায়েয নয়। কারণ এর ফলে যে বিশৃঙ্খলা, গোলযোগ, অস্থিরতা, অরাজকতা, নৈরাজ্য ও অশান্তির পরিবেশ সৃষ্টি হবে তাকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা কোন ব্যক্তি বা সমাজের নেই (ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ,খণ্ড: ২২; পৃষ্ঠা: ৫-১০; মাজমূঊ ফাতাওয়া ইবনে বায,খণ্ড: ৯; পৃষ্ঠা: ৩০৩ লিক্বাউল বাব আল-মাফতূহ্, লিক্বা নং-৩১)। তবে কেবল মনিব কর্তৃক দাস-দাসীর উপর দণ্ড প্রয়োগের বিষয়টি ভিন্ন। কারণ তা হাদিস দ্বারা প্রমাণিত।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
__________________________
উপস্থপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।