দুজনের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ হলে মীমাংসা করার জন্য মিথ্যা বলা জায়েজ কি

সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, আমরা তাঁর প্রশংসা করি, তাঁর নিকট সাহায্য ও ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং তাঁর নিকট তাওবা করি,অতঃপর মূলনীতি হচ্ছে:সৎ ও সত্যবাদী হওয়া,এবং সত্যের বিপরীত মিথ্যা না বলা কারন মিথ্যা বলা অথবা মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া একটি মারাত্মক অপরাধ। মহান আল্লাহ বলেন:یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللّٰهَ وَ كُوۡنُوۡا مَعَ الصّٰدِقِیۡنَ “হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর এবং সত্যবাদীদের সাথে থাক।(সূরা তওবা:১১৯) এবং হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ তোমরা অবশ্যই সত্যের পথ অবলম্বন করবে। কেননা, সততাই মানুষকে কল্যাণের পথে নিয়ে যায়। আর কল্যাণ জান্নাতের দিকে নিয়ে যায়। কোন মানুষ প্রতিনিয়ত সত্য কথা বলতে থাকলে এবং সত্যের প্রতি মনোযোগী থাকলে শেষ পর্যন্ত সে আল্লাহ্‌ তা‘আলার দরবারে পরম সত্যবাদী হিসাবে তালিকাভুক্ত হয়। তোমরা মিথ্যাকে অবশ্যই পরিহার করবে। কেননা, মিথ্যা (মানুষকে) পাপের পথ দেখায়, আর পাপ জাহান্নামের পথে নিয়ে যায়। কোন বান্দাহ প্রতিনিয়ত মিথ্যা বলতে থাকলে এবং মিথ্যার প্রতি ঝুঁকে থাকলে শেষ পর্যন্ত সে আল্লাহ্‌ সে আল্লাহ্‌ তা‘আলার দরবারে চরম মিথ্যাবাদী হিসাবে তালিকাভুক্ত হয়।(সহীহ মুসলিম হা/৬৫৩৩)
.
‎ইসলামি শরীয়ত মানুষের মধ্যে পুনর্মিলন ও ভ্রাতৃত্ব বজায় রাখার বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয় বরং এর জন্য আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বিশেষ পুরস্কার রেখেছেন। পাশাপাশি পরস্পর সম্পর্ক নষ্ট করার ব্যাপারে কঠোর সতর্কবাণীও প্রদান করেছেন। যেমন: প্রখ্যাত সাহাবী আবু দারদা (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমি কি তোমাদের এমন কাজ সম্পর্কে বলব না, যার সাওয়াবের মর্যাদা সিয়াম, সাদাকা ও সালাতের চেয়েও বেশি? আবু দারদা (রাঃ) বলেন, তখন আমরা বললামঃ হে আল্লাহর রসূল! তিনি বললেনঃ সে কাজ হলো, দু’জন মুসলিমের মধ্যে আপোষ করানো। যে ব্যক্তি ঝগড়া ও বিপর্যয় সৃষ্টি করে, সে যেন মস্তক মুণ্ডনকারী”।(আবূ দাঊদ ৪৯১৯, তিরমিযী ২৫০৯,সহীহুল জামি‘ ২৫৯৫) হাদীসে উক্ত ‘আমল দ্বারা উদ্দেশ্য নফল, ফরয না। অর্থাৎ দু‘জন মুসলিমের মাঝে আপোষ করানো নফল সিয়াম, সালাত ও সাদাকা হতে উত্তম।এবং হাদীসে উৎসাহ-উদ্দীপনা আছে দু’জনের মাঝে মীমাংসা করার ব্যাপারে আর উভয়ের মাঝে দ্বন্দ্ব লাগানোকে নিষেধ করা হয়েছে কারণ সংশোধন এর মাঝে আল্লাহর রজ্জুকে মজবুত করে ধরার উপায় আছে। এ কাজে মুসলিমের মাঝে বিচ্ছেদ হবে না। আর দু’জনের মাঝে বিশৃঙ্খলা লাগানো দীনের জন্য বিষফোড়া। অতএব যে ব্যক্তি উভয়ের মধ্যে সংশোধনের চেষ্টা করবে এবং বিশৃঙ্খলা দূর করবে, সে ঐ ব্যক্তির চেয়ে বেশি মর্যাদাবান হবে। যে কেবলমাত্র সিয়াম পালন করে ও গোপনে তাহাজ্জুদের সালাত আদায় করে। (‘আওনুল মা‘বূদ ৮ম খন্ড, হাঃ ৪৯১১; তুহফাতুল আহওয়াযী ৬ষ্ঠ খন্ড, হাঃ ২৫০৬)
.
সম্পর্ক মীমাংসার ক্ষেত্রে এবং অতি প্রয়োজনীয় কোন কল্যাণ অর্জনের জন্য অথবা নিশ্চিত কোন অঘটন থেকে বাঁচার জন্য; যা সত্য বললে কোনভাবেই হবে না এবং তাতে কারোর কোন অধিকারও বিনষ্ট করা হয় না অথবা কোন হারামকেও হালাল করা হয় না এমতাবস্থায় মিথ্যা বলা জায়েজ। তবুও এমতাবস্থায় এমনভাবে মিথ্যাটিকে উপস্থাপন করা উচিৎ যাতে বাহ্যিকভাকে তা মিথ্যা মনে হলেও বাস্তবে তা মিথ্যা প্রমাণিত হয় না। কারণ, কথাটি বলার সময় তার ধ্যানে সত্য কোন একটি দিক তখনো উদ্ভাসিত ছিলো। আরবী ভাষায় যা তাওরিয়া বা মা‘আরীয নামে পরিচিত। এমন পরিস্থিতিতে মিথ্যা বলার জন্য কোন গুনাহ হবে না এই মর্মে দলিল হচ্ছে, রাসূল (ﷺ) বলেন,لَيْسَ الْكَذَّابُ الَّذِى يُصْلِحُ بَيْنَ النَّاسِ، فَيَنْمِى خَيْرًا، أَوْ يَقُولُ خَيْرًا- ‘ঐ ব্যক্তি মিথ্যাবাদী নয়, যে ব্যক্তি মানুষের মধ্যে মীমাংসা করে দেয়। অতঃপর উত্তম কথা বলে”(সহীহ বুখারী হা/২৬৯২; মুসলিম হা/২৬০৫; মিশকাত হা/৪৮২৫) তবে এই মিথ্যা হতে হবে পারস্পরে কল্যাণের উদ্দেশ্যে। ক্ষতির উদ্দেশ্যে নয়। যেভাবে ইবরাহীম (আঃ) বলেছিলেন, إِنِّي سَقِيمٌ ‘আমি অসুস্থ”।(সূরা সাফফাত ৩৭/৮৯)। এর দ্বারা তিনি নিজেকে মানসিকভাবে অসুস্থ বুঝিয়ে বলেছিলেন।قَالَ بَلْ فَعَلَهُ كَبِيرُهُمْ هَذَا ‘ওদের মধ্যকার এই বড় মূর্তিটাই একাজ করেছে’ অর্থাৎ অন্য মূর্তিগুলিকে ভেঙ্গেছে” (সূরা আম্বিয়া ২১/৬৩)। এর দ্বারা তিনি বড় মূর্তিটার প্রতি কওমের অন্ধ বিশ্বাস ভাঙতে চেয়েছিলেন। এছাড়া মদীনায় হিজরতকালে রাস্তায় পথিকদের প্রশ্নের উত্তরে সামনে বসা রাসূল (ছাঃ)-এর পরিচয় সম্পর্কে আবুবকর (রাঃ) বলতেন, هَذَا الرَّجُلُ يَهْدِينِى السَّبِيلَ ‘এ ব্যক্তি আমাকে রাস্তা দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন’ (সহীহ বুখারী হা/৩৯১১)। এর দ্বারা তিনি হেদায়াতের রাস্তা বুঝাতেন। কিন্তু লোকেরা ভাবত রাস্তা দেখানো কোন দক্ষ ব্যক্তি হবেন। আরবী অলংকার শাস্ত্রে এই দ্ব্যর্থবোধক বক্তব্যকে ‘তাওরিয়া’ বলা হয়। যাতে একদিকে সত্য বলা হয়। অন্যদিকে শ্রোতাকেও বুঝানো যায়।
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেন:

” … فالمشروع للمؤمن أن يقلل من الأيمان ولو كان صادقا ؛ لأن الإكثار منها قد يوقعه في الكذب ، ومعلوم أن الكذب حرام ، وإذا كان مع اليمين صار أشد تحريماً ، لكن لو دعت الضرورة أو المصلحة الراجحة إلى الحلف الكاذب فلا حرج في ذلك ؛ لما ثبت عن النبي صلى الله عليه وسلم من حديث أم كلثوم بنت عقبة بن أبي معيط رضي الله عنها أن النبي صلى الله عليه وسلم قال : ( ليس الكذاب الذي يصلح بين الناس فينمي خيرا ويقول خيراً . قالت : ولم أسمعه يرخص في شيء مما يقول الناس إنه كذب إلا في ثلاث : الإصلاح بين الناس ، والحرب ، وحديث الرجل امرأته ، وحديث المرأة زوجها ) رواه مسلم في الصحيح .

فإذا قال في إصلاحٍ بين الناس : والله إن أصحابك يحبون الصلح ، ويحبون أن تتفق الكلمة ، ويريدون كذا وكذا ، ثم أتى الآخرين وقال لهم مثل ذلك ، ومقصده الخير والإصلاح : فلا بأس بذلك للحديث المذكور .وهكذا لو رأى إنساناً يريد أن يقتل شخصاً ظلماً أو يظلمه في شيء آخر ، فقال له : والله إنه أخي ، حتى يخلصه من هذا الظالم إذا كان يريد قتله بغير حق أو ضربه بغير حق ، وهو يعلم أنه إذا قال : أخي تركه احتراما له : وجب عليه مثل هذا لمصلحة تخليص أخيه من الظلم .والمقصود : أن الأصل في الأيمان الكاذبة المنع والتحريم ، إلا إذا ترتب عليها مصلحة كبرى أعظم من الكذب ، كما في الثلاث المذكورة في الحديث السابق ” ا

“মুমিনদের উচিত অধিক শপথ করা থেকে বিরত থাকা যদিও সে সত্যবাদী হয়; কারণ অধিক পরিমাণ শপথ করলে এটা তাকে মিথ্যা বলার দিকে নিয়ে যেতে পারে। আর মিথ্যা বলা হারাম, বিশেষত যখন তা শপথের সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন তা আরও কঠিনভাবে হারাম হয়। তবে যদি প্রয়োজনীয়তা বা বড় ধরনের কোনো মঙ্গলজনক কারণে মিথ্যা শপথ করা হয়, তাহলে তাতে কোনো দোষ নেই। কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, উম্মু কুলসূম বিনতু ‘উকবাহ ইবনু আবূ মু’আয়ত (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃরসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: “যে ব্যক্তি লোকজনের মধ্যে আপোষ-মীমাংসা করে দেয় এবং কল্যাণকর কথা বলে বা কল্যাণকর ব্যবস্থার উন্নয়ন করে, সে মিথ্যুক নয়। উম্মু কুলসুম (রাঃ) আরো বলেন, আমি তিনটি ক্ষেত্র ছাড়া আর কোন ব্যাপারে নবী করীম (সাঃ)-কে কাউকে মিথ্যা বলার অনুমতি দিতে শুনিনিঃ (১) লোকজনের মধ্যে আপোষ-রফা করতে, (২) স্ত্রীর নিকট স্বামীর কথায় এবং (৩) স্বামীর নিকট স্ত্রীর কথায় (বুখারী, হা/২৬৯২ মুসলিম হা/৬৫২৭)

সুতরাং যদি কোনো ব্যক্তি মানুষের মধ্যে মীমাংসা বা সমঝোতার উদ্দেশ্যে এভাবে বলে যে: “আল্লাহর কসম, তোমার লোকেরা মীমাংসা পছন্দ করে, তারা চায় ঐক্য স্থাপন হোক, এবং তারা এটা ওটা চায়।” তারপর সে অন্যদের কাছেও এ রকম কথা বলে এবং তার উদ্দেশ্য থাকে কল্যাণ ও মীমাংসা প্রতিষ্ঠা করা, তাহলে এতে কোনো সমস্যা নেই। এ বিষয়ে উল্লেখিত হাদিসের কারণে এটি বৈধ।অনুরূপভাবে যদি কোনো ব্যক্তি দেখেন যে একজন ব্যক্তি অন্য কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করতে চায় বা অন্য কোনোভাবে তাকে অত্যাচার করতে চায়, তখন সে যদি এই বলে যে: “আল্লাহর কসম, সে আমার ভাই,” যাতে ঐ অত্যাচারী তাকে সম্মানের কারণে ছেড়ে দেয়, এবং তার উদ্দেশ্য যদি হয় অন্যায়ভাবে হত্যা বা অত্যাচার থেকে তাকে বাঁচানো, তবে এ অবস্থায় তার জন্য এ কথা বলা জরুরি। এটি তার ভাইকে অন্যায় থেকে রক্ষা করার জন্য কল্যাণের দৃষ্টিতে অনুমোদিত।
সারমর্ম হলো: মিথ্যা শপথ সাধারণত নিষিদ্ধ ও হারাম। তবে যদি এর মাধ্যমে কোনো বৃহৎ মঙ্গল অর্জিত হয় যা মিথ্যার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তাহলে তা বৈধ হতে পারে। যেমন পূর্বোক্ত হাদিসে উল্লিখিত তিনটি ক্ষেত্রে”।(শাইখ ইবনু বায, মাজমূঊ ফাতাওয়া, ১ খণ্ড; পৃষ্ঠা: ৫৪)।
.
পরিশেষে আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন মুসলমানদেরকে ধর্মীয়ভাবে শক্তিশালী করেন, ধর্মের ওপর অবিচল রাখেন এবং শত্রুর বিরুদ্ধে বিজয়ী করেন। নিশ্চয় তিনি শক্তিশালী ও পরাক্রমশালী (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_____________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Share: