প্রশ্ন: “তুমি যখন আহার করবে তাকেও আহার করাবে। তুমি পোশাক পরিধান করলে তাকেও পোশাক দিবে”। এই হাদীসের মর্ম কি এটা যে, স্বামী নিজের জন্য ৫০০ টাকার পোশাক কিনলে স্ত্রীকে ও ৫০০ টাকা দিতে হবে নাকি তাকে একই দামের একটি পোশাক কিনে দিতে হবে?
▬▬▬▬▬▬▬◄❖►▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, আমরা তাঁর প্রশংসা করি, তাঁর নিকট সাহায্য ও ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং তাঁর নিকট তাওবা করি। অতঃপর মুআবিয়াহ ইবনু হাইদাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের কারো স্ত্রীর অধিকার স্বামীর উপর কতটুকু?’ তিনি বললেন, ‘‘তুমি খেলে তাকে খাওয়াবে এবং তুমি পোশাক পরিধান করলে তাকেও পোশাক দিবে।(তার) চেহারায় মারবে না, তাকে গালমন্দ করবে না এবং তার থেকে পৃথক থাকলে বাড়ীর ভিতরেই থাকবে।’’ (অর্থাৎ অবাধ্য স্ত্রীকে বাধ্য করার জন্য বিছানা পৃথক করতে পারা যাবে, কিন্তু রুম পৃথক করা যাবে না)।(আবূ দাউদ ২১৪২, ২১৪৩, ২১৪৪, ইবনু মাজাহ ১৮৫০ রিয়াদুস সলেহিন,২৮২; হাদীসটি সহীহ)
.
হাদীসটির বিশুদ্ধ ব্যাখ্যা: এই হাদীসটি স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক অধিকার এবং দায়িত্বের বিষয়ে ইসলামিক নির্দেশনা প্রদান করে। এতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বামীদের প্রতি তাদের স্ত্রীর সাথে সদাচরণ এবং ন্যায্য আচরণের আদেশ দিয়েছেন। এই হাদিসটি নির্দেশ করে যে, স্ত্রীর ভরণপোষণের জন্য ব্যয় করা স্বামীর উপর ওয়াজিব এবং এটি স্ত্রীর অন্যতম অধিকার। এই ব্যয়ের ক্ষেত্রে যা প্রয়োজন তা হল স্বামীর সমর্থ্য অনুযায়ী স্ত্রীর পর্যাপ্ত খাবার-পানীয় এবং পোশাকের চাহিদা নিশ্চিত করা। স্বামী যদি স্ত্রীর এই প্রয়োজন পূর্ণ করতে সক্ষম হয় তাহলে এর অতিরিক্ত কিছু দেওয়া আবশ্যক নয়। হাদীসটির অর্থ এটা নয় যে যদি স্বামী নিজের জন্য ৫০০ টাকা মূল্যের একটি পোশাক কিনে, তাহলে স্ত্রীকেও একই পরিমাণ অর্থ দিতে হবে বা তাকে ওই পরিমাণ (৫০০ টাকার) পোশাক কিনে দিতে হবে। বরং এর অর্থ হলো স্বামীর সামর্থ্য অনুযায়ী তার জন্য প্রয়োজনীয় খাবার এবং পোশাকের ব্যবস্থা করবে, যা তার স্ত্রীর জন্য উপযুক্ত। হাদিসে বর্ণিত “تطعمها إذا طعمت” (যখন তুমি খাবে, তখন তাকেও খাওয়াবে) এই বাক্যাংশটি দ্বারা যা বুঝানো হয়েছে তা হচ্ছে স্বামী যেমন নিজের জন্য ব্যয় করেন তেমনি স্ত্রীকেও সেই ব্যয়ে অংশীদার করতে হবে। তবে এর অর্থ এই নয় যে স্বামী যদি নিজের জন্য একটি পোশাক কেনেন স্ত্রীর জন্যও তা কিনতে হবে বা তার পরিবর্তে অর্থ প্রদান করতে হবে।(বিস্তারিত জানতে দেখুন ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১২১৪২৪)
.
হাদীসটির ব্যাখ্যায় সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:
“يعني : لا تخص نفسك بالكسوة دونها ، ولا بالطعام دونها ، بل هي شريكة لك ، يجب عليك أن تنفق عليها كما تنفق على نفسك ، حتى إن كثيرا من العلماء يقول : إذا لم ينفق الرجل على زوجته وطالبت بالفسخ عند القاضي ، فللقاضي أن يفسخ النكاح ؛ لأنه قصَّر بحقها الواجب لها”
“(হাদিসে) যা বোঝানো হয়েছে তা হল: তুমি নিজের জন্য পোশাক বা খাবারের বিষয়ে আলাদা করে চিন্তা করো না, বরং সে (স্ত্রী) তোমার অংশীদার। তার ওপর তোমার তেমনি খরচ করা আবশ্যক যেমন তুমি নিজের ওপর কর। এমনকি অনেক আলেম বলেছেন যদি কোনো স্বামী তার স্ত্রীর ভরণপোষণে ব্যর্থ হয় এবং স্ত্রী যদি আদালতে গিয়ে বিচারকের কাছ বিচ্ছেদের দাবি জানায় তবে বিচারক এ ক্ষেত্রে বিবাহ বিচ্ছেদ অনুমোদন করতে পারেন। কারণ স্বামী তার স্ত্রীর প্রতি আবশ্যক অধিকার পালনে ব্যর্থ হয়েছে।”(ইবনু উসাইমীন; শারহু রিয়াদিস সালিহিন খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ১৩১)
.
হাদীসের প্রতিটি বাক্যের মূল অর্থ, শিক্ষা ও ব্যাখ্যা:
(১). খাওয়া এবং পরিধান করানো:
স্বামীর দায়িত্ব হলো নিজের স্ত্রীর ভরণ-পোষণের দায়িত্ব পালন করা। এর অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে: স্বামীর সামর্থ্যের ভিত্তিতে স্ত্রীর প্রয়োজন অনুযায়ী খাবার এবং পোশাকের ব্যবস্থা করা। এই নির্দেশনার মাধ্যমে বোঝানো হয়েছে যে, স্ত্রীর মৌলিক চাহিদা পূরণে স্বামীকে উদাসীন হওয়া যাবে না
(২). চেহারায় আঘাত না করা:
ইসলাম চেহারায় আঘাত করা বা মারধরের বিরুদ্ধে কঠোরভাবে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। এটি স্ত্রীর প্রতি সদাচরণের অংশ। স্ত্রীর ওপর কোনো ধরনের সহিংসতা ইসলাম অনুমোদন করে না।
(৩). কটু কথা বলা নিষেধ:
স্ত্রীকে “কুৎসিত” বা অবমাননাকর কথা বলা নিষিদ্ধ। এটি তার মানসিক ও আত্মিক ক্ষতি করতে পারে। স্ত্রীকে যথার্থ সম্মান ও মর্যাদা দেওয়া স্বামীর কর্তব্য। হাদিসে বলা হয়েছে: “তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি উত্তম যে তার স্ত্রীর নিকট উত্তম।”(তিরমিজি, হা/ ১১৬২)
(৪). বিচ্ছিন্ন হওয়া:
স্ত্রীর কোনো ভুলের কারণে বা শৃঙ্খলার জন্য শাস্তি হিসেবে যদি বিছানা পৃথক করার প্রয়োজন হয়, তবে তা বাড়ির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। এটি দ্বন্দ্ব সমাধানের উদ্দেশ্যে এবং স্ত্রীকে অপমানিত না করার একটি নীতি। বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া বা সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন করার মাধ্যমে শাস্তি দেওয়া ইসলাম সমর্থন করে না।
পরিশেষে, হাদীসটি স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের মধ্যে ভারসাম্য ও ন্যায়বিচার বজায় রাখার শিক্ষা দেয়। এটি স্বামীদের প্রতি নির্দেশ দেয় যেন তারা তাদের স্ত্রীর প্রতি দায়িত্বশীল ও সদয় হয়। পাশাপাশি পারিবারিক সমস্যার ক্ষেত্রে যেন সহিংসতা বা অপমানের পথ বেছে না নিয়ে গঠনমূলক সমাধানের পথ অনুসরণ করা হয়।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।।
_____________________
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।