প্রশ্ন: তারাবীহ সালাত সুন্নাহ সম্মত পদ্ধতি কি? একসাথে চার রাকআত আদায় করে শেষ বৈঠকে সালাম ফিরানো জায়েজ?
▬▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর তারাবিহ সালাত এক সালামে চার রাকাআত পড়া এবং এতে একবার বা দুইবার তাশাহহুদ পড়া এটি রাসূল (ﷺ)-এর সুন্নতসম্মত পদ্ধতি নয়। এমনকি প্রসিদ্ধ চারটি মাজহাবের মধ্যে মালিকি, শাফেয়ি ও হাম্বলি মাজহাবসহ অধিকাংশ ফকিহ এ পদ্ধতিকে মাকরুহ (অপছন্দনীয়) বলেছেন। এমনকি কিছু আলেম একে হারাম বলেও অভিহিত করেছেন। অন্যদিকে, হানাফি মাজহাবের অনুসারীরা সহিহ বুখারিতে উল্লেখিত আয়েশা (রাঃ)-এর বর্ণিত হাদিসের ভিত্তিতে এক সালামে চার রাকাআত আদায়কে বৈধ ও অনুমোদিত মনে করেন। তবে দলিলের বিচারে এ মতটি দুর্বল, কারণ এতে হাদিসের যথাযথ ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি রয়েছে। বরং বিশুদ্ধ ও সুন্নতসম্মত পদ্ধতি হল তারাবিহ ও কিয়ামুল লাইল (রাতের সালাত) দুটি করে রাকাআত আদায় করা এবং প্রত্যেক দুই রাকাআতের পর সালাম ফিরিয়ে সালাত শেষ করা। এরপর শেষ অংশে বিতির সালাত আদায় করা। এভাবেই রাসূল (ﷺ) এবং তাঁর সাহাবারা সালাত আদায় করতেন এবং এটিই সুন্নতের প্রকৃত অনুসরণ। এরপর শেষ অংশে বিতির সালাত আদায় করবে। এ পদ্ধতির প্রমাণ পাওয়া যায় বুখারি ও মুসলিমের হাদিসে, প্রখ্যাত সাহাবী ইবনে উমর (রাঃ) এর হাদিস- “এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে রাতের সালাত সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন:مَثْنَى مَثْنَى، فَإِذَا خَشِيَ الصُّبْحَ صَلَّى وَاحِدَةً فَأَوْتَرَتْ لَهُ مَا صَلَّى) “রাতের সালাত দুই রাকাত, দুই রাকাত। আপনাদের মধ্যে কেউ যদি ফজরের ওয়াক্ত হয়ে যাওয়ার আশংকা করেন তবে তিনি যেন আরো এক রাকাত সালাত পড়ে নেন। যাতে করে এ রাকাতটি পূর্বে আদায়কৃত সংখ্যাকে বিতির (বেজোড়) করে দেয়।”(সহীহ বুখারী হা/৯৪৬;ও ইমাম মুসলিম হা/৭৪৯) এটিই ছিল রাসূল (ﷺ) এর আমল। যেমনটি আম্মাজান আয়েশা থেকেও বর্ননা পাওয়া যায়। আবু সালামাহ্ ইবনে আব্দুর রহমান থেকে বর্নিত তিনি আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) কে প্রশ্ন করেছিলেন: “রমজানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সালাত কেমন ছিল? তিনি বললেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানে বা রমজানের বাইরে ১১ রাকাতের বেশি আদায় করতেন না। তিনি ৪ রাকাত সালাত আদায় করতেন এর সৌন্দর্য ও দৈর্ঘ্য সম্পর্কে প্রশ্ন করবেন না (অর্থাৎ তা অনেক সুন্দর ও দীর্ঘ হতো)। এরপর তিনি আরো ৪ রাকাত সালাত আদায় করতেন এর সৌন্দর্য ও দৈর্ঘ্য সম্পর্কে প্রশ্ন করবেন না (অর্থাৎ তা অনেক সুন্দর ও দীর্ঘ হতো)। এরপর তিনি ৩ রাকাত সালাত আদায় করতেন। আমি বলতাম: ইয়া রাসূলুল্লাহ! আপনি কি বিতির পড়ার আগে ঘুমিয়ে যাবেন?” তিনি বলতেন: “হে আয়েশা! আমার চোখ দুটি ঘুমালেও অন্তর ঘুমায় না।”(হাদিসটি বর্ণনা করেছেন ইমাম বুখারী হা/১৯০৯) ও ইমাম মুসলিম হা/৭৩৮)
.
ইমাম ইবনে বাত্তাল (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৪৪৯ হি;] বলেন:
“قول عائشة رضي الله عنها (يصلى أربعاً) ذلك مُرَتَّب على قوله صلى الله عليه وسلم: (صلاة الليل مثنى مثنى)؛ لأنه مفسِّرٌ وقاضٍ على المجمل، وقد جاء بيان هذا في بعض طرق هذا الحديث، روى ابن أبى ذئب، عن ابن شهاب، عن عروة، عن عائشة، قالت: (كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يصلى بالليل إحدى عشرة ركعة بالوتر، يسلم بين كل ركعتين) [رواه مسلم]”
“আয়েশা (রাঃ)-এর এই বক্তব্য “তিনি চার রাকাআত সালাত আদায় করতেন”, মূলত নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর এই বাণী “রাতের সালাত দুই দুই রাক’আত করে” এর ব্যাখ্যা ও স্পষ্টীকরণ হিসেবে এসেছে। কেননা এটি মূল নির্দেশনার সাধারণ ব্যাখ্যা এবং তার সিদ্ধান্তমূলক ব্যাখ্যা প্রদান করছে। এই হাদিসের কিছু সনদে এ বিষয়টির বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। ইবনে আবি যিব, যিনি ইবনে শিহাব থেকে, তিনি উরওয়াহর মাধ্যমে আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেছেন: “আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) রাতে বিতরসহ মোট এগারো রাক’আত সালাত আদায় করতেন এবং প্রতি দুই রাক’আতের পর সালাম ফিরাতেন।”(সহীহ মুসলিম; শারহু সহিহ বুখারী; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ১৪২)
.
আল ইমামুল ‘আল্লামাহ আবু ‘উমার ইউসুফ ইবনু ‘আব্দিল বার (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৪৬৩ হি.] বলেছেন,
وذهب فقهاء الحجاز وبعض أهل العراق إلى أنه كان يسلم في كل ركعتين منها، على ظاهر قوله صلى الله عليه وسلم: ( صلاة الليل مثنى مثنى ).فمن ذهب إلى هذا تأول في قولها: ( يصلي أربعا ثم أربعا ) أي حسنهن وطولهن ورتل القرآن فيهن، وكذلك أيضا فعل في الأربع بعدهن حسنهن وطولهن، ثم الثلاث بعدهن لم يبلغ فيهن من الطول ذلك المبلغ ، لكنه سلم في كل ركعتين من صلاته تلك كلها، فهذا معنى: ( أربعا ثم أربعا ثم ثلاثا ) عند هؤلاء…ثم قال ابن عبد البر: وجه رابع: وهو أنه كان ينام بعد الأربع، ثم ينام بعد الأربع، ثم يقوم فيوتر بثلاث … ”
“হিজাজের ফকীহগণ এবং ইরাকের কিছু আলেম এই অভিমত পোষণ করেছেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর স্পষ্ট হাদিস অনুযায়ী (রাতের সালাত দুই দুই রাক’আত করে) তা নির্দেশ করে যে তিনি প্রতি দুই রাক’আত পরপর সালাম ফিরাতেন। সুতরাং যারা (উম্মে সালামা রা. এর) বর্ণনাকে এভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে, “তিনি চার রাক’আত আদায় করতেন, এরপর আরও চার রাক’আত আদায় করতেন”, তারা এর অর্থ করেছেন যে, তিনি এই সালাতকে দীর্ঘ করতেন, তা সৌন্দর্যমণ্ডিত করতেন এবং এর মাঝে কুরআনের তিলাওয়াত দীর্ঘায়িত করতেন। একইভাবে পরবর্তী চার রাক’আতও তিনি একই রকম দীর্ঘ, মনোমুগ্ধকর ও পূর্ণতা সহকারে আদায় করতেন। অতঃপর বাকি তিন রাক’আতের ব্যাপারে এত বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায় না। তবে জানা যায় যে, তিনি রাতের সমস্ত সালাত দুই রাক’আত করে আদায় করতেন এবং প্রতিটি দুই রাক’আতের পর সালাম ফেরাতেন। এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী, হাদিসের “চার রাক’আত, এরপর চার রাক’আত, এরপর তিন রাক’আত” কথার অর্থ হলো তিনি প্রতি দুই রাক’আত পর সালাম দিয়ে চার রাক’আত আদায় করতেন, তারপর একইভাবে আরও চার রাক’আত, এবং শেষে তিন রাকাআত। তারপর ইবনু আব্দুল বার বলেন: চারের আরেকটি পদ্ধতি হল তিনি চার রাক’আত আদায় করার পর ঘুমিয়ে গিয়েছিলেন তারপরে আবার চার রাক’আত পড়ার পর ঘুমিয়ে গেছিলেন তারপরে তিনি ঘুম থেকে উঠে তিন রাক’আত বিতির সালাত আদায় করেছেন।”(ইস্তিযকার; খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ২৩৭-২৩৯)
.
আল-আদওয়ী আল মালিকী (রহ.) বলেন:يُسَلِّم من كل ركعتين، أي يندب، ويُكره تأخير السلام بعد كل أربع” ا
“প্রতিটি দুই রাক’আত এর পর সালাম ফিরানো মুস্তাহাব এবং প্রতি চার রাক’আত এর পর সালাম বিলম্বিত করা মাকরূহ।” (হাশিয়া আল-আদওয়ী; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৪৪২) আল-খতীবে শারবিনী শাফি’ই (রহ.) বলেন:”لو صلى أربعاً بتسليمة: لم تصح؛ لأنه خلاف المشروع، بخلاف سنة الظهر والعصر، والفرق بينهما أن التراويح ، لمشروعية الجماعة فيها ، أشبهت الفرائض؛ فلا تغير عما وردت “যদি এক সালামে চার রাক’আত সালাত পড়া হয় তাহলে তা সহীহ হবে না, কারণ এটি শরয়ী নিয়মের পরিপন্থী, যোহর ও আসরের সুন্নাতের বিপরীত। তাদের মধ্যে পার্থক্য হল তারাবীহর মাঝে জামাআত রয়েছে যা ফরজ সালাতের সাথে সাদৃশ্য রাখে। ফলে উল্লিখিত সালাতের পরিবর্তন করা উচিত নয়।”(আল মুগনী; খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ১৫৯)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.]-কে প্রশ্ন করা হয়েছে: তারাবিহ সালাতের কিছু ইমাম দুই রাক’আতের পরে না বসেই এক সালামে চার রাক’আত বা তার বেশি সালাত একত্রে আদায় করেন এবং দাবি করেন যে এটি সুন্নাহর অন্তর্ভুক্ত। আমাদের শরীয়তে কি এই আমলের কোন ভিত্তি আছে?
উত্তরে শাইখ বলেন:
هذا العمل غير مشروع، بل مكروه أو محرم عند أكثر أهل العلم؛ لقول النبي صلى الله عليه وسلم: صلاة الليل مثنى مثنى متفق على صحته من حديث ابن عمر رضي الله عنهما، ولما ثبت عن عائشة رضي الله عنها قالت: كان النبي صلى الله عليه وسلم يصلي من الليل إحدى عشرة ركعة، يسلم من كل اثنتين ويوتر بواحدة متفق على صحته، والأحاديث في هذا المعنى كثيرة.
وأما حديث عائشة المشهور: إن النبي صلى الله عليه وسلم كان يصلي من الليل أربعا، فلا تسأل عن حسنهن وطولهن، ثم يصلي أربعا، فلا تسأل عن حسنهن وطولهن الحديث متفق عليه، فمرادها أنه يسلم من كل اثنتين، وليس مرادها أنه يسرد الأربع بسلام واحد لحديثها السابق، ولما ثبت عنه صلى الله عليه وسلم من قوله: صلاة الليل مثنى مثنى ، كما تقدم، والأحاديث يصدق بعضها بعضا، ويفسر بعضها بعضا، فالواجب على المسلم أن يأخذ بها كلها، وأن يفسر المجمل بالمبيِّن
“এই আমলটি শরীয়তসম্মত নয়, বরং অধিকাংশ আলেমদের নিকট এটি মাকরূহ অথবা হারাম। তারা দলিল হিসেবে ব্যবহার করেছেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর হাদিস: রাতের সালাত দুই রাক’আত দুই রাক’আত করে। অন্য একটি হাদিসে রয়েছে, যা আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের রাত্রির সালাত ১১ রাক’আত ছিল। তিনি প্রত্যেক দুই রাক’আতের পর সালাম ফিরাতেন এবং বিতরের সালাত এক রাক‘আত আদায় করতেন।(মুত্তাফাকুন আলাইহি) এরূপ অর্থবোধক অনেক হাদিস রয়েছে। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহার প্রসিদ্ধ হাদিস: রামাযান বা রামাযানের বাইরে রাসূল (ﷺ) রাত্রির সালাত এগারো রাক‘আতের বেশি আদায় করেননি। তিনি প্রথমে (২+২) চার রাক‘আত পড়তেন। তুমি তার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো না। অতঃপর তিনি (২+২) চার রাক‘আত পড়তেন। তুমি তার সৌন্দর্য ও দীর্ঘতা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করো না। অতঃপর তিন রাক‘আত পড়তেন। (মুত্তাফাকুন আলাইহি) এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো তিনি প্রত্যেক দুই রাক’আতের পরে সালাম ফিরাতেন। এটা উদ্দেশ্য নয় যে, তিনি এক সালামে চার রাক’আত সালাত আদায় করতেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে রাতের সালাত দুই রাক’আত দুই রাকাত করে। যেমনটি উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। হাদিসগুলি একে অপরকে সমর্থন করে এবং একে অপরকে ব্যাখ্যা করে। মুসলিমের উচিত হলো এগুলোকে গ্রহণ করা এবং স্পষ্ট এর ব্যাখ্যাগুলোকে মেনে নেয়া।”(মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড: ৩০; পৃষ্ঠা: ৩৮) আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী।
▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: উস্তায ইব্রাহিম বিন হাসান হাফি.
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি,সৌদি আরব।