তারাবীহ এর জামাআতে কেউ যদি এশার ফরজ সালাতের নিয়তে দাঁড়ায় তাহলে তার সালাত সহীহ হবে কি

প্রশ্ন: তারাবীহ এর জামাআতে কেউ যদি এশার ফরজ সালাতের নিয়তে দাঁড়ায় তাহলে তার সালাত সহীহ হবে কি? কিংবা কোনো ব্যক্তি যদি সুন্নত বা নফল সালাত আদায়কারীর পিছনে ফরজ সালাত আদায় করে তাহলে তা গ্রহণযোগ্য হবে কি?
▬▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর যে ব্যক্তি মসজিদে এসে দেখে যে, তারাবীহ এর জামাত শুরু হয়ে গেছে কিন্তু তিনি এখনও এশার সালাত আদায় করেননি, তিনি তখন অন্তরে এশার সালাতের নিয়্যত করে তারাবীহ এর জামাতে অংশগ্রহণ করবেন।তারপর ইমাম যখন দুই রাকাআত তারাবীহ এর সালাত শেষ করে বৈঠকে বসবেন তিনিও তার সাথে বসে তাশাহুদ পড়ে চুপ থাকবেন অতঃপর ইমাম যখন ডানে বামে সালাম ফিরাবেন তখন তিনি দাঁড়িয়ে গিয়ে এশার বাকি দুই রাকাআত স্বাভাবিক নিয়মে পূর্ণ করবেন। জেনে রাখা ভাল যে ক্বিয়ামুল লাইল (যেমন তারাবীহ, বিতির, তাহাজ্জুদ) কখনোই এশার সলতের আগে নয়, বরং তা এশার সালাতের পর পড়তে হয়, বিশেষ করে এশার সুন্নত সলতের পর।” নফল সালাত আদায়কারীর পিছনে ফরয সালাত আদায় করা যায়। এই মর্মে দলিল হচ্ছে প্রখ্যাত সাহাবী জাবের রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,كَانَ مُعَاذٌ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ يُصَلِّيْ مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الْعِشَاءَ ثُمَّ يَرْجِعُ إِلٰى قَوْمِهِ فَيُصَلِّيْ بِهِمُ الْعِشَاءَ وَهِيَ لَهُ نَافِلَةٌ “মুআয ইবনু জাবাল রাযিয়াল্লাহু আনহু রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে ফরয সালাত আদায় করতেন। তারপর নিজ সম্প্রদায়ের নিকট এসে তাদের সালাতের ইমামতি করতেন”।(সহীহ বুখারী, হা/৭০১, ৭১১; সহীহ মুসলিম, হা/৪৬৫)। অত্র হাদীসে প্রমাণিত হয় যে, নফল সালাত আদায়কারীর পিছনে ফরয সালাত আদায় করা যায়।
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.]-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল যদি কোন মুসলিম মসজিদে এসে লোকদেরকে তারাবীহ এর সালাত আদায়রত অবস্থায় পায় এবং সে ব্যক্তি তখনো এশার সালাত আদায় করেনি সেক্ষেত্রে তিনি কি এশার সালাতের নিয়্যতে তাদের সাথে তারাবীহ এর জামাতে যোগ দিতে পারবেন কি?

উত্তরে তিনি বলেন:

لا حرج أن يصلي معهم بنية العشاء في أصح قولي العلماء ، وإذا سلم الإمام قام فأكمل صلاته ، لما ثبت في الصحيحين عن معاذ بن جبل رضي الله عنه أنه كان يصلي مع النبي صلى الله عليه وسلم صلاة العشاء ثم يرجع إلى قومه فيصلي بهم تلك الصلاة ولم ينكر ذلك النبي عليه الصلاة والسلام ، فدل على جواز صلاة المفترض خلف المتنفل ، وفي الصحيح عن النبي عليه الصلاة والسلام أنه في بعض أنواع صلاة الخوف صلى بطائفة ركعتين ثم سلم ثم صلى بالطائفة الأخرى ركعتين ثم سلم فكانت الأولى فرضه أما الثانية فكانت نفلا وهم مفترضون ، والله ولي التوفيق

“আলেমগণের দুইটি মতের অধিকতর সঠিক মত অনুসারে তাদের সাথে এশার নিয়তে যোগ দিয়ে সালাত আদায় করতে কোন সমস্যা নেই। ইমাম সালাম ফিরালে তিনি উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর অবশিষ্ট সালাত সম্পন্ন করবেন।”যেহেতু সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিম এ মু’আয ইবনে জাবা’ল (রাদিয়াল্লাহু আনহু) হতে প্রমাণিত হয়েছে যে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে এশার সালাত আদায় করে নিজ গোত্রে ফিরে গিয়ে তাদেরকে এশার সালাত পড়াতেন এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ ব্যাপারটির বিরোধিতা করেননি। এ হাদিস প্রমাণ করে যে, নফল সালাত আদায়কারী ব্যক্তির পিছনে ফরয সালাত আদায়কারী ব্যক্তির সালাত আদায় করা জায়েয। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে সহীহ গ্রন্থে এসেছে যে, কোন এক সালাতুল খওফ (ভয়ের সময়ের সংক্ষেপিত সালাত)এর সময় এক গ্রুপকে নিয়ে দুই রাকাত সালাত আদায় করে সালাম ফিরিয়ে ফেলেন। আবার দ্বিতীয় গ্রুপকে নিয়ে দুই রাকাত সালাত আদায় করে সালাম ফিরান। এক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রথমবারের আদায়কৃত সালাত হচ্ছে ফরয। কিন্তু দ্বিতীয় বারের সালাত তাঁর জন্য নফল, তাঁর পেছনে সালাত আদায়কারীদের জন্য ফরজ। আল্লাহই তাওফিক দাতা।”(মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড: ১২; পৃষ্ঠা:১৮১)
.
শাইখ (রাহিমাহুল্লাহ) আরও বলেন:
السنة أن يكون التهجد في رمضان وغيره بعد سنة العشاء الراتبة كما كان النبي صلى الله عليه وسلم يفعل ذلك . ولا فرق في ذلك بين كون التهجد في المسجد أو في البيت
“সুন্নত পদ্ধতি হচ্ছে রমজানে বা অন্য সময়ে এশার সুন্নত সালাতের পরে তাহাজ্জুদ এর সালাত আদায় করা, যেমনটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম করতেন। এক্ষেত্রে তাহাজ্জুদ এর সালাত বাড়ীতে বা মসজিদে আদায়ে কোন পার্থক্য নেই।”(মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড: ১১; পৃষ্ঠা: ৩৬৮)
.
এমনকি অন্যান্য সালাতের ক্ষেত্রেও একই হুকুম প্রযোজ্য হবে। যেমন যদি কোনো ব্যক্তি একাকী সালাত শুরু করে এবং সালাতের মাঝে অন্য কেউ এসে তার সঙ্গে জামাআতে শামিল হয়, তাহলে তার ইমাম হিসেবে দাঁড়ানোতে কোনো সমস্যা নেই। বরং এটি ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে অনুমোদিত ও গ্রহণযোগ্য একটি বিষয়। এবার সালাত আদায়কারীর প্রথম ব্যক্তি ফরজ সালাত পড়ুক কিংবা নফল সালাত আদায় করুক তাতে কোন সমস্যা নেই ইনশাআল্লাহ। এই মর্মে দলিল হচ্ছে ইবনু ‘আব্বাস (রাযি.) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা আমি আমার খালা (মায়মুনা (রাযি.)-এর নিকট রাত্রি যাপন করলাম। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতের সালাতে দাঁড়ালেন, আমিও তাঁর সাথে সালাত আদায় করতে দাঁড়ালাম। আমি তাঁর বামপাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তিনি আমার মাথা ধরে তাঁর ডানপাশে দাঁড় করালেন।”(সহীহ বুখারী হা/৬৯৯) এই হাদীসটি উল্লেখ করে ইমাম বুখারী এর শিরোনাম দিয়েছেন:بَاب إِذَا لَمْ يَنْوِ الْإِمَامُ أَنْ يَؤُمَّ ثُمَّ جَاءَ قَوْمٌ فَأَمَّهُمْ.”যদি ইমাম ইমামাতের নিয়ত না করেন, পরে কিছু লোক এসে শামিল হয় এবং তিনি তাদের ইমামাত করেন”।(সহীহ বুখারী অধ্যায়; ১০/৫৯) অপর বর্ননায় আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, “আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) একবার রমজান মাসে (নফল) সালাত আদায় করছিলেন। তখন আমি এসে তাঁর পাশে দাঁড়ালাম। এরপর আরেকজন এসে দাঁড়াল, তারপর আরেকজন এভাবে আমরা এক জামাআত হয়ে গেলাম। যখন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) অনুভব করলেন যে আমরা তাঁর পিছনে দাঁড়িয়েছি, তখন তিনি তাঁর সালাত সংক্ষিপ্ত করে ফেললেন।”(সহিহ মুসলিম, হা/১১০৪)
.
জেনে রাখা ভাল যে কিছু আলেমের মতে এই কাজটি নফল সালাতের জন্য বৈধ হলেও ফরজ সালাতের জন্য নয়। তবে বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী, এটি ফরজ নফল উভয় ক্ষেত্রেই বৈধ। হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ শাইখুল ইসলাম ইমাম তাক্বিউদ্দীন আবুল ‘আব্বাস আহমাদ বিন ‘আব্দুল হালীম বিন তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আন-নুমাইরি, (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন:والصحيح جواز ذلك في الفرض والنفل “এবং সঠিক হল যে এটি ফরজ ও নফল উভয় ক্ষেত্রেই জায়েজ।”(মাজমূ‘উ ফাতাওয়া; খণ্ড:২২; পৃষ্ঠা: ২৫৮)

বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন ,

ولكن الصحيح أنه يصح في الفرض والنفل ، أما النفل فقد ورد به النص ، وأما الفرض فلِأنَّ ما ثبت في النفل ثبت في الفرض إلا بدليل .

“তবে সঠিক হল যে এটি ফরজ ও নফল উভয় ক্ষেত্রে সঠিক। নফল সম্পর্কে এর প্রমাণ এসেছে, আর নফলে যেটা প্রমাণিত হয়েছে সেটা ফরজেও প্রমাণিত হবে যদি ফরজের জন্য আলাদা কোন দলিল না থাকে। (যদি আলাদা দলিল থাকে তাহলে তার বিধান আলাদা হবে, নচেৎ নফলের বিধান ফরজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে) (আল-শারহ আল-মুমতি’,খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৩০৪)।

ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে জিজ্ঞাসা করা হলো নফল সালাত আদায়কারীর পিছনে কি ফরয সালাত আদায় করা জায়েয হবে? অথবা ফরয সালাত আদায় কারীর পিছনে কি নফল সালাত আদায় করা চলবে? এমন প্রশ্ন করা হলে জবাবে শাইখ বলেন:

“উভয়টিই বিশুদ্ধ। অনুরূপভাবে আসর সালাত আদায়কারীর পিছনে যোহর সালাত আদায় করা জায়েয হবে এবং যোহর সালাত আদায়কারী ইমামের পিছনে আসর সালাত আদায় করা যাবে। কেননা প্রত্যেকে নিয়ত অনুযায়ী আমল করবে। তার ফল পাবে। একারণে ইমাম আহমাদ (রহঃ) বলেছেন, আপনি যদি মসজিদে গিয়ে দেখেন ইমাম তারাবীহ সালাত আদায় করছেন, আর আপনার এশা সালাত বাকী আছে, তবে তার সাথেই এশার সালাত আদায় করে নিন। উহা আপনার জন্য ফরয আদায় হবে আর ইমামের হবে নফল।(ইবনু উসাইমীন ফাতাওয়া আরকানুল ইসলাম প্রশ্ন নং-৩০৭)
▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬
✍️জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: উস্তায ইব্রাহিম বিন হাসান হাফি.
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি,সৌদি আরব।

Share: