জুম’আর সালাত সহীহ হওয়ার জন্য কি খুতবা শর্ত এবং জুম’আর খুতবা কি আরবিতে দেওয়া বাধ্যতামূলক

প্রথমত: ফিকাহবিদ আলেমগণ এ ব্যাপারে একমত যে খুতবাহ হল জুম’আর সালাত বৈধ হওয়ার শর্ত এবং এটি আল্লাহর স্মরণের অংশ যা তিনি তাঁর বাণীতে ফরজ করেছেন।আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন:یٰۤاَیُّهَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡۤا اِذَا نُوۡدِیَ لِلصَّلٰوۃِ مِنۡ یَّوۡمِ الۡجُمُعَۃِ فَاسۡعَوۡا اِلٰی ذِكۡرِ اللّٰهِ وَ ذَرُوا الۡبَیۡعَ ؕ ذٰلِكُمۡ خَیۡرٌ لَّكُمۡ اِنۡ كُنۡتُمۡ تَعۡلَمُوۡنَ “হে ঈমানদারগণ! জুম’আর দিনে যখন সালাতের জন্য ডাকা হয় তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের দিকে ধাবিত হও এবং বেচাকেনা ত্যাগ কর। এটাই তোমাদের জন্য কল্যাণকর; যদি তোমরা জানতে।”[সূরা জুমুআ’ আয়াত: ৯] নাবী (সাল্লাল্লাহি ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজেও নিয়মিত খুতবাহ দিয়েছেন। সুতরাং এ সবই ইঙ্গিত করে যে জুম’আর সালাত বৈধ হওয়ার জন্য খুতবা একটি অপরিহার্য শর্ত। হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেন,” وجملة ذلك أن الخطبة شرط في الجمعة ، لا تصح بدونها كذلك قال عطاء ، والنخعي ، وقتادة ، والثوري ، والشافعي ، وإسحاق ، وأبو ثور ، وأصحاب الرأي ، ولا نعلم فيه مخالفا إلا الحسن “সারসংক্ষেপে বলা যায়, খুতবা জুমু‘আর একটি শর্ত এবং এটি ব্যতীত সালাত বৈধ নয়। যেমনটি বলেছেন আতা, আন-নাখায়ী, কাতাদাহ, সুফিয়ান সাওরী, ইমাম-শাফিঈ, ইসহাক, আবু সাওর এবং অধিকাংশ ওলামাদের মত। আর হাসান আল বসরী ছাড়া এর সাথে দ্বিমত পোষণকারী কাউকে আমরা চিনি না।(ইবনে কুদামাহ আল মুগনী, খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ৭৪)
.
অপরদিকে একদল বিদ্বানগণ বলেন যে, খুতবাহ্ ফরয নয়। শাইখুল ইসলাম হুজ্জাতুল উম্মাহ ইমামু দারিল হিজরাহ আবূ ‘আব্দুল্লাহ মালিক বিন আনাস আল-আসবাহী আল-মাদানী (রাহিমাহুল্লাহ) [জন্ম: ৯৩ হি: মৃত: ১৭৯ হি.]-এর জমহূর অনুসারীগণ বলেনঃ সেটা ফরয, কিন্তু তা অগ্নিপূজকদের ওপর নয়। মির‘আত প্রণেতা ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, আল-‘আল্লামাহ, ইমাম ‘উবাইদুল্লাহ বিন ‘আব্দুস সালাম মুবারকপুরী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪১৪ হি./১৯৯৪ খ্রি.] বলেছেন:”আমি বলব যে, দাঊদ আয যাহিরী, ইবনু হাযম, হাসান আল বসরী এবং জাওবাসী (রাহিমাহুল্লাহ) মত ব্যক্ত করেছেন যে, জুমু‘আর খুতবাহ্ ফরয নয় বরং মুস্তাহাব এবং সেটাই সঠিক। কেননা জুমু‘আর দিনের খুতবার আবশ্যকতার উপর কুরআন-সুন্নাহ থেকে কোন দলীল প্রমাণিত হয়নি এবং আল্লাহ তা‘আলার কথাঃ فَاسْعَوْا إِلى ذِكْرِ اللّهِ ‘‘তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও’’- (সূরাহ্ আল জুমু‘আহ্ ৬২: ৯)। এখানে সেটার উপর কোন দলীল নেই। কেননা আদিষ্টিত ‘‘যিকর’’ দ্বারা সালাতের দিকে দ্রুত যাওয়া উদ্দেশ্য।(মিশকাতুল মাসাবিহ হা/১৪০১ ব্যাখ্যা দষ্টব্য)
.
দ্বিতীয়ত: আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের
ফিকাহবিদ আলেমগণ এ ব্যাপারে একমত যে, খুতবা আরবীতে হওয়াই উত্তম। তবে আরবীতে হওয়া শর্ত কিনা এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে, এ ব্যাপারে সর্বমোট তিনটি মত পাওয়া যায়। যেমন:

(১).প্রথম অভিমত: যে ব্যক্তি আরবীতে খুতবা পেশ করতে সক্ষম তার জন্য আরবীতে খুতবা দেওয়া শর্ত। এমনকি শ্রোতারা যদি আরবী ভাষা না জানেন তবুও। এটি মালেকী মাযহাব ও হাম্বলী মাযহাবের মশহুর অভিমত।(বিস্তারিত জানতে দেখুন: “আল-ফাওয়াকিহুদ দানী” খন্ড:১ পৃষ্ঠা: ৩০৬; কাশ্শাফুল ক্বিনা” খন্ড: ২; পৃষ্ঠা:৩৪)। এই মতের পক্ষে দলিল হচ্ছে, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,«صَلُّوا كَمَا رَأَيْتُمُونِي أُصَلِّي»”তোমরা আমাকে যেভাবে সালাত আদায় করতে দেখেছ সেভাবে সালাত আদায় করবে”।(সহীহ বুখারী হা/৬২৮, ৬৩০, মুসলিম ৬৭৪, তিরমিযী ২০৫,আবূ দাউদ ৫৮৯) আর রাসূল (ﷺ) নিজে আরবিতে খুতবা দিতেন। তিনি আরবি ছাড়া অন্য ভাষায় খুতবা দিয়েছেন বলে কোন প্রমাণ নেই।
.
(২).দ্বিতীয় অভিমত: আরবীতে খুতবা দিতে সক্ষম ব্যক্তির জন্য আরবীতে খুতবা দেওয়া শর্ত; তবে শ্রোতাদের সকলে যদি আরবী ভাষা না জানেন তাহলে তিনি তাদের নিজস্ব ভাষায় খোতবা দিবেন। শাফেয়ী মাযহাবের আলেমদের নিকট এটাই সঠিক অভিমত। কিছু কিছু হাম্বলী আলেমও এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
[দেখুন: ইমাম নববীর “আল-মাজমু” খন্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৫২২]। শাইখুল ইসলাম নাসিরুল হাদীস ফাক্বীহুল মিল্লাত ইমাম মুহাম্মাদ বিন ইদরীস আশ-শাফি‘ঈ আল-মাক্কী (রাহিমাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৫০ হি: মৃত: ২০৪ হি.] বলেছেন,
প্রত্যেক খতীবকে জুমার সময় তাঁর মাতৃভাষায় ওয়াজ করা ওয়াজিব বা অবশ্য কর্তব্য। (তানক্বীহুর রুওয়াত; খন্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২৬৪)

(৩).তৃতীয় অভিমত: খুতবা আরবীতে হওয়া মুস্তাহাব; শর্ত নয়। খতীব আরবীর পরিবর্তে তার নিজের ভাষায় খুতবা দিতে পারেন। এটি ইমাম আবু হানিফা ও কিছু কিছু শাফেয়ী আলেমের অভিমত।(দেখুন: “রাদ্দুর মুহতার” খন্ড: ১; পৃষ্ঠা: ৫৪৩,”আল-মাওসুআ আল-ফিকহিয়্যা”খন্ড: ১৯; পৃষ্ঠা: ১৮০) এই মতের পক্ষে দলিল হচ্ছে, নবীদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন: وَمَا أَرْسَلْنَا مِن رَّسُولٍ إِلَّا بِلِسَانِ قَوْمِهِ لِيُبَيِّنَ لَهُمْ “আমি সব নবীকেই তাদের স্বজাতির ভাষাভাষী করেই প্রেরণ করেছি, যাতে তাদেরকে পরিষ্কার বোঝাতে পারে।”(সূরা ইবরাহীম: ৪) রাসুলুল্লাহর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাতৃভাষা যেহেতু আরবী ছিল এবং সাহাবীদেরও ভাষা আরবী ছিল তাই তিনি আরবীতেই তাদেরকে নসীহত করতেন। এখন যারা নবীজির নায়েব হয়ে জুমার খুতবা দিবেন তাদেরকেও উল্লেখিত আয়াত ও হাদীস অনুসারে তাদের শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে মাতৃভাষায় খুতবা দেয়াটা শরীয়ত সম্মত এবং যুক্তি সংগত।
.
কুরআন সুন্নাহর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের আলোকে চিন্তাভাবনা করলে উপরোক্ত তিনটি মতের মধ্যে তৃতীয় অভিমতটিই অধিক বিশুদ্ধ। এমনকি সমকালীন বেশ কিছু আলেম এ অভিমতটিকে মনোনয়ন করেছেন। যেহেতু খোতবা আরবীতে হওয়া আবশ্যককারী সুষ্পষ্ট কোন দলিল উদ্ধৃত হয়নি। তাছাড়া যেহেতু খুতবার উদ্দেশ্য হচ্ছে উপদেশ দেওয়া, শিক্ষা ও উপকার হাছিল হওয়া। উপস্থিত লোকদের ভাষায় না হলে তো সেটা অর্জিত হবে না। যেমন:

রাবেতা আলমে ইসলামীর অধিভুক্ত “ফিকাহ একাডেমী”-র সিদ্ধান্তে যা এসেছে সেটা নিম্নরূপ:

” الرأي الأعدل هو أن اللغة العربية في أداء خطبة الجمعة والعيدين في غير البلاد الناطقة بها ليست شرطاً لصحتها ، ولكن الأحسن أداء مقدمات الخطبة وما تضمنته من آيات قرآنية باللغة العربية ، لتعويد غير العرب على سماع العربية والقرآن ، مما يسهل تعلمها ، وقراءة القرآن باللغة التي نزل بها ، ثم يتابع الخطيب ما يعظهم به بلغتهم التي يفهمونها

“সর্বাধিক ভারসাম্যপূর্ণ অভিমত হচ্ছে যে সকল দেশের মানুষ আরবীতে কথা বলে না সেসব দেশে জুম’আর খুতবা ও দুই ঈদের খুতবা সহিহ হওয়ার জন্য আরবী ভাষায় হওয়া শর্ত নয়। তবে, ভাল হয় খুতবার ভূমিকা ও খুতবাতে অন্তর্ভুক্ত আয়াতসমূহ আরবীতে পেশ করা; যাতে করে অনারবদেরকে আরবী ভাষা শুনতে ও কুরআন শুনতে অভ্যস্ত করা যায়। এটি আরবী শেখা এবং যে ভাষায় কুরআন নাযিল হয়েছে সে ভাষায় কুরআন পড়াকে সহজ করবে। এরপর খতীব তারা (শ্রোতারা) যে ভাষা বুঝে সে ভাষায় তাদেরকে উপদেশ দিবেন।”(কারারাতুল মাজমায়িল ফিকহি পৃষ্ঠা-৯৯; পঞ্চম অধিবেশন, পঞ্চম সিদ্ধান্ত)
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেছেন,

“لم يثبت في حديث عن النبي صلى الله عليه وسلم ما يدل على أنه يُشترط في خطبة الجمعة أن تكون باللغة العربية ، وإنما كان صلى الله عليه وسلم يخطب باللغة العربية في الجمعة وغيرها ؛ لأنها لغته ولغة قومه ، فَوَعَظَ مَنْ يخطب فيهم وأرشدهم وذكَّرهم بلغتهم التي يفهمونها ، لكنه أرسل إلى الملوك وعظماء الأمم كتبا باللغة العربية ، وهو يعلم أن لغتهم غير اللغة العربية ، ويعلم أنهم سيترجمونها إلى لغتهم ليعرفوا ما فيها .وعلى هذا يجوز لخطيب الجمعة في البلاد التي لا يعرف أهلها أو السواد الأعظم من سكانها اللغة العربية أن يخطب باللغة العربية ، ثم يترجمها إلى لغة بلاده ؛ ليفهموا ما نصحهم وذكَّرهم به ، فيستفيدوا من خطبته .وله أن يخطب خطبة الجمعة بلغة بلاده مع أنها غير عربية ، وبذلك يتم الإرشاد والتعليم والوعظ والتذكير ويتحقق المقصود من الخطبة .غير أن أداء الخطبة باللغة العربية ثم ترجمتها إلى المستمعين أَوْلى ، جمعا بين الاهتداء بهدي النبي صلى الله عليه وسلم في خُطَبِه وكتبه ، وبين تحقيق المقصود من الخطبة خروجا من الخلاف في ذلك ”

“নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে এমন কোন হাদিস সাব্যস্ত হয়নি যা প্রমাণ করে যে, জুম’আর খুতবা আরবীতে হওয়া শর্ত। বরঞ্চ তিনি জুম’আর খুতবা ও অন্যান্য খুতবা আরবী ভাষায় দিতেন যেহেতু তাঁর নিজের ভাষা আরবী এবং তাঁর সমাজের লোকদের ভাষাও আরবী ছিল। তাই তারা যে ভাষা বুঝে তিনি সে ভাষায় তাদের মাঝে খুতবা দিতেন, দিকনির্দেশনা প্রদান করতেন ও তাদেরকে স্মরণ করিয়ে দিতেন। কিন্তু তিনি রাজাবাদশাদের কাছেও আরবী ভাষায় চিঠিপত্র পাঠিয়েছেন। তিনি জানতেন যে, তাদের ভাষা আরবী নয়। তিনি এটাও জানতেন যে, তারা তাদের ভাষায় অনুবাদ করিয়ে চিঠির মর্ম বুঝে নিবে। এর আলোকে যে সকল দেশের অধিবাসীরা আরবী জানে না কিংবা বেশীর ভাগ মানুষ আরবী জানে না সেখানকার জুমার খতীবের জন্য আরবীতে খুতবা (ভাষণ) দেওয়া জায়েয। এরপর সে খুতবা স্থানীয় ভাষায় অনুবাদ পেশ করবেন; যাতে করে লোকেরা কী উপদেশ ও নসীহত করা হল সেটা বুঝতে পারে এবং উপকৃত হতে পারে। খতীবের জন্য জুম’আর খুতবা স্থানীয় অনারবী ভাষায় পেশ করাও বৈধ। এভাবে খুতবা দিলে দিকনির্দেশনা প্রদান, শিক্ষাদান, উপদেশ প্রদান ও নসীহত করা সম্পন্ন হয়, খুতবার উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়। তবে আরবীতে খুতবা দিয়ে সেটা শ্রোতাদের ভাষায় অনুবাদ করাটা উত্তম। এতে করে খুতবা প্রদান ও চিঠিপত্র প্রদানের ক্ষেত্রে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ অটুট রাখা এবং খুতবার উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা উভয়টার মাঝে সমন্বয় সাধিত হয়। তাছাড়া এ সংক্রান্ত আলেমদের মতভেদের ঊর্ধ্বে থাকা যায়।”(ফাতাওয়াল লাজনাদ দায়িমাহ খন্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ২৫৩)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন,

” ولعل الأظهر والأقرب والعلم عند الله تعالى أن يفصَّل في المسألة فيقال :إن كان معظم من في المسجد من الأعاجم الذين لا يفهمون اللغة العربية فلا بأس من إلقائها بغير العربية ، أو إلقائها بالعربية ومن ثم ترجمتها .وأما إن كان الغالب على الحضور هم ممن يفهمون اللغة العربية ، ويدركون معانيها في الجملة ، فالأولى والأظهر الإبقاء على اللغة العربية وعدم مخالفة هدى النبي صلى الله عليه وسلم ، لاسيما وقد كان السلف يخطبون في مساجد يوجد بها أعاجم ، ولم ينقل أنهم كانوا يترجمون ذلك ؛ لأن العزة كانت للإسلام والكثرة والسيادة للغة العربية .وأما ما يدل على الجواز عند الحاجة فإن لذلك أصلاً في الشريعة ، وهو قوله تعالى : ( وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَسُولٍ إِلَّا بِلِسَانِ قَوْمِهِ لِيُبَيِّنَ لَهُمْ) .ومن ذلك أن الصحابة رضي الله عنهم لما غزوا بلاد العجم من فارس والروم لم يقاتلوهم حتى دعوهم إلى الإسلام بوساطة المترجمين ”

“খুব সম্ভব অধিক নিকটবর্তী অভিমত হচ্ছে (সঠিক ইলম আল্লাহ্‌র কাছে) এ মাসয়ালায় অবস্থাভেদে ভিন্ন ভিন্ন অভিমত দেওয়া। বলা হবে যদি মসজিদের অধিকাংশ উপস্থিতি অনারব হয়; যারা আরবী বুঝে না; তাহলে অনারবী ভাষায় খুতবা দিতে কোন আপত্তি নেই। কিংবা আরবী ভাষায় খুতবা দিয়ে পরে এর অনুবাদ পেশ করা। আর যদি অধিকাংশ উপস্থিতি আরবী ভাষা বুঝেন এবং মোটামুটি ভাবটুকু তারা আয়ত্ব করতে পারেন তাহলে উত্তম হচ্ছে আরবী ভাষায় খুতবা দেওয়া এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শের বরখেলাফ না করা। বিশেষতঃ সালাফগণ এমন সব মসজিদে খুতবা দিতেন যেখানে অনারবরা থাকত। কিন্তু এমন কোন উদ্ধৃতি নাই যে, তারা খুতবা অনুবাদ করতেন। কেননা তখন আধিপত্য ছিল ইসলামের এবং নেতৃত্ব ছিল আরবী ভাষার। আর অন্য ভাষায় খুতবা দেওয়া জায়েয হওয়ার পক্ষে শরিয়তে একটি দলিল রয়েছে। তা হল আল্লাহ্‌র বাণী: “আমি প্রত্যেক রাসূলকে তার স্বজাতির ভাষা নিয়ে (ভাষাভাষী করে) পাঠিয়েছি, যাতে সে তাদের কাছে (আল্লাহ্‌র বার্তা) বুঝিয়ে বলতে পারে।”[সূরা ইব্রাহিম, আয়াত: ৪] এ মর্মে আরেকটি দলিল হল সাহাবায়ে কেরাম যখন পারস্য, রোম ইত্যাদি অনারব দেশে অভিযান পরিচালনা করেছেন তখন তারা অনুবাদকদের মাধ্যমে তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার আগে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেননি।”[মাজমুউ ফাতওয়া বিন বায; খন্ড: ১২: পৃষ্ঠা: ৩৭২)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:

” الصحيح في هذه المسألة أنه يجوز لخطيب الجمعة أن يخطب باللسان الذي لا يفهم الحاضرون غيره ، فإذا كان هؤلاء القوم ليسوا بعرب ، ولا يعرفون اللغة العربية ، فإنه يخطب بلسانهم ؛ لأن هذا هو وسيلة البيان لهم ، والمقصود من الخطبة هو بيان حدود الله سبحانه وتعالى للعباد ، ووعظهم ، وإرشادهم ، إلا أن الآيات القرآنية يجب أن تكون باللغة العربية ، ثم تفسر بلغة القوم .ويدل على أنه يخطب بلسان القوم ولغتهم قوله تعالى : ( وما أرسلنا من رسول إلا بلسان قومه ليبين لهم )
فبين الله تعالى أن وسيلة البيان إنما تكون باللسان الذي يفهمه المخاطبون ، فعلى هذا له أن يخطب باللسان غير العربي ، إلا إذا تلا آية فإنه لا بد أن تكون باللسان العربي الذي جاء به القرآن ، ثم بعد ذلك يفسر لهؤلاء القوم بلغتهم ”

“এ মাসয়ালায় সঠিক অভিমত হচ্ছে উপস্থিত মুসল্লিগণ যে ভাষা ছাড়া অন্য ভাষা বুঝে না খতীবের জন্য সে ভাষাতে খুতবা দেওয়া জায়েয। যদি উপস্থিত লোকজন আরব না হয় এবং আরবী ভাষা না জানে তাহলে খতীব তাদের ভাষাতে খুতবা দিবেন। কেননা এটাই হচ্ছে তাদেরকে বুঝানোর মাধ্যম। খুতবার উদ্দেশ্য হচ্ছে বান্দাদের কাছে আল্লাহ্‌র সীমারেখাগুলোর বিবরণ দেওয়া, তাদেরকে উপদেশ দেওয়া, দিকনির্দেশনা দেওয়া। তবে কুরআনের আয়াতগুলো আরবীতে বলা আবশ্যকীয়। এরপর উপস্থিত লোকদের ভাষায় তাফসীর করা। খুতবা স্থানীয় ভাষায় হওয়ার দলিল হচ্ছে আল্লাহ্‌র বাণী: “আমি প্রত্যেক রাসূলকে তার স্বজাতির ভাষা নিয়ে (ভাষাভাষী করে) পাঠিয়েছি, যাতে সে তাদের কাছে (আল্লাহ্‌র বার্তা) বুঝিয়ে বলতে বোঝাতে পারে।”[সূরা ইব্রাহিম, আয়াত: ৪] আল্লাহ্‌ তাআলা স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, বিবরণ হতে হবে সম্বোধিতরা যে ভাষা বুঝে সে ভাষায়। এর আলোকে খতীব অনারবী ভাষায় খুতবা দিতে পারেন। তবে যখন কোন আয়াত তেলাওয়াত করবেন তখন অবশ্যই আরবী ভাষায় করবেন; যে ভাষায় কুরআন নাযিল হয়েছে। এরপর উপস্থিতি লোকদের ভাষায় তাফসীর করবেন”।(ফাতাওয়া নুরুন আলাদ দারব (ফাতাওয়াস সালাত/সালাতুল জুমুআ; ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১১১০৪১)
.
পরিশেষে প্রিয় পাঠক! আমরা সকল মুসলিমকে আরবী ভাষা শেখার প্রতি উদ্বুদ্ধ করছি। যেহেতু এটি কুরআনের ভাষা। এর মাধ্যমে শরিয়তকে বুঝা যাবে। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিসের মর্ম অনুধাবন করা যাবে। আবার এটাও কারো অজানা নয় যে, পৃথিবীর বহু মানুষ পরিপূর্ণ ভাবে আরবি জানেনা, ফলে একজন আরবি ভাষাভাষী আলেম যদি একজন অনারবী সম্প্রদায়ের সামনে আরবি ভাষায় খুতবা প্রদান করেন তাহলে তারা কিছুই বুঝতে পারবে না। ফলে খুতবার উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। সুতরাং মানুষ যে ভাষায় খুতবা শুনলে উপকৃত হবে সে ভাষায় হওয়াই বাঞ্ছনীয়। অত:এব, আল্লাহর প্রশংসা, নবীর প্রতি দুরুদ এবং কিছু আয়াত ও হাদিস আরবিতে বলার পর যদি সেগুলো বাংলা বা শ্রোতাদের ভাষায় বুঝিয়ে দেয়া হয় তাহলে খুতবার উদ্দেশ্যে বাস্তবায়িত হবে। কারণ হাদিসে এসেছে: সামুরা বিন জুনদুব রা. হতে বর্ণিত, كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يخطب قائماً ويجلس بين الخطبتين ويقرأ آيات ويذكر الناس. “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দাঁড়িয়ে খুতবা দিতেন এবং দু খুতবার মাঝে বসতেন। কুরআনের আয়াত তিলাওয়াত করতেন এবং মানুষকে উপদেশ দিতেন।” (সহিহ নাসাঈ, হা/১৪১৭) এখানে বুঝা যাচ্ছে, খতিব সাহেব শ্রোতাদেরকে খুতবার মধ্যে উপদেশ দিবেন ও তাদের করণীয়-বর্জনীয় সম্পর্কে দিক নির্দেশনা দিবেন। আর এ কথা বলা বাহুল্য যে, তাদের অ বোধগম্য ভাষায় বক্তৃতা হলে তারা কিছুই বুঝতে পারবে না যা খুতবার মূল উদ্দেশ্যে পরিপন্থী। আরবিতে খুতবা দেয়া আবশ্যক হলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম খুতবার মধ্যে যে সকল শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করেছেন তার বাইরে যাওয়ার সুযোগ থাকত না। অর্থাৎ হাদিসে বর্ণিত ভাষা ছাড়া নিজে বানিয়ে আরবি বলার সুযোগ থাকত না। যেমন সালাতে নিজের মত করে আরবিতে কিরাআত পাঠ করা জায়েজ নয়।‍ অথচ যারা আরবিতে খুতবা দেন তারা কোন আলেমের লিখিত আরবি বক্তব্য পড়ে থাকেন।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
____________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ওস্তাদ ইব্রাহিম বিন হাসান (হাফি:)।
শিক্ষক, চর বাগডাঙ্গা সেরাজুল হুদা লতিফিয়া নুরিয়া ইসলামিয়া ও হাফিজিয়া মাদরাসা‌ চাঁপাইনবাবগঞ্জ।

Share: