ঘোড়ার গোশত খাওয়া হালাল নাকি হারাম একটি দলিল ভিত্তিক পর্যালোচনা

প্রথমত: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর ঘোড়ার গোশত খাওয়া হালাল নাকি হারাম এই আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে শরীয়তের কিছু হুকুম আহকাম সবার জানা উচিত আর তা হচ্ছে ইসলামে কোনো কিছু হালাল (বৈধ) ও হারাম (অবৈধ) নির্ধারণ করার একমাত্র মালিক, অধিকার ও কর্তৃত্ব আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলার। তিনি কুরআনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন যে হালাল ও হারামের বিধান নির্ধারণ করার ক্ষমতা কেবল তাঁর। এ অধিকার কোন মানুষকে দেওয়া হয়নি, এমনকি ধর্মীয় ও বৈষয়িকতার দৃষ্টিতে কারো মর্যাদা যতই বেশী হোক না কেন, আল্লাহ ব্যতীত এ অধিকার কারো নেই। মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর হাদিসের মাধ্যমে হালাল ও হারামের সীমানা স্পষ্ট করেছেন। সুতরাং কেউ যদি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল কর্তৃক নির্ধারিত হারাম বা হালাল পরিবর্তন করতে চায়, তবে তা ইসলামের দৃষ্টিতে গুরুতর গুনাহ। কেননা এটি আল্লাহর সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ করার সমতুল্য। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, অনধিকার চর্চা বশে মানুষ কর্তৃক আল্লাহরকৃত হালালকে হারাম এবং হারামকে হালালকরণের বহু দৃষ্টান্ত দেখা যায়। অথচ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো হালাল হারাম করার অধিকার আছে বলে বিশ্বাস করাও শিরক/কুফর, যা ঈমানের বিপর্যয়ের কারণ। আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে এ মারাত্মক শির্ক প্রসঙ্গে বলেন,ٱتَّخَذُوٓاْ أَحۡبَارَهُمۡ وَرُهۡبَٰنَهُمۡ أَرۡبَابٗا مِّن دُونِ ٱللَّهِ”আল্লাহর পরিবর্তে তারা তাদের আলেম ও সাধু-দরবেশদেরকে প্রভু বানিয়ে নিয়েছে”। [সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ৩১] সাহাবী আদী ইবন হাতেম রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু আল্লাহর নবীকে এ আয়াত পাঠ করতে শুনে বলেছিলেন, “ওরা তো তাদের ইবাদত করে না।” রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন,«أَمَا إِنَّهُمْ لَمْ يَكُونُوا يَعْبُدُونَهُمْ، وَلَكِنَّهُمْ كَانُوا إِذَا أَحَلُّوا لَهُمْ شَيْئًا اسْتَحَلُّوهُ، وَإِذَا حَرَّمُوا عَلَيْهِمْ شَيْئًا حَرَّمُوهُ»
‘তা বটে। কিন্তু আল্লাহ যা হারাম করেছেন তারা ওদেরকে তা হালাল করে দিলে, ওরা তা হালালই মনে করে। একইভাবে আল্লাহ যা হালাল করেছেন তারা ওদেরকে তা হারাম করে দিলে, ওরা তা হারামই মনে করে।’ (তিরমিযী, হাদীস নং ৩০৯৫) আল্লাহ পবিত্র কুরআনে মুশরিকদের আচরণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন,وَلَا يُحَرِّمُونَ مَا حَرَّمَ ٱللَّهُ وَرَسُولُهُۥ وَلَا يَدِينُونَ دِينَ ٱلۡحَقّ”আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা হারাম করেছেন তারা তাকে হারাম গণ্য করে না এবং সত্য দ্বীনকে তাদের দীন হিসেবে গ্রহণ করে না”। [সূরা আত-তাওবা, আয়াত: ২৯] অন্যত্র তিনি বলেন,قُلۡ أَرَءَيۡتُم مَّآ أَنزَلَ ٱللَّهُ لَكُم مِّن رِّزۡقٖ فَجَعَلۡتُم مِّنۡهُ حَرَامٗا وَحَلَٰلٗا قُلۡ ءَآللَّهُ أَذِنَ لَكُمۡۖ أَمۡ عَلَى ٱللَّهِ تَفۡتَرُونَ”আপনি বলুন, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদেরকে যে রূযী দান করেছেন, তন্মধ্যে তোমরা যে সেগুলোর কতক হারাম ও কতক হালাল করে নিয়েছ, তা কি তোমরা ভেবে দেখেছ? আপনি বলুন, আল্লাহ কি তোমাদেরকে এতদ্বিষয়ে অনুমতি দিয়েছেন, নাকি তোমরা আল্লাহর নামে মনগড়া কথা বলছ?” [সূরা ইউনুস, আয়াত: ৫৯]
দ্বিতীয়ত: আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে সৃষ্টির অন্যতম শ্রেষ্ঠ জীব হিসাবে সৃষ্টি করেছেন। আর মানুষের কল্যাণেই পৃথিবীর অন্য সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। মহান আল্লাহ বলেন:هُوَ الَّذِیۡ خَلَقَ لَكُمۡ مَّا فِی الۡاَرۡضِ جَمِیۡعًا
“তিনিই যমীনে যা আছে সব তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন।” (সূরা বাক্বারাহ: ২/২৯) তাছাড়া সমস্ত মানুষের ওপর, বিশেষতঃ উম্মতে মুসলিমার ওপর আল্লাহ তাআলার অনুগ্রহ হচ্ছে- হালালের পরিধিকে বিস্তৃত করা এবং হালালকে মূল হিসেবে ও প্রধান হিসেবে সাব্যস্ত করা; আর হারামকে সংকীর্ণ করা; এমনকি সংকীর্ণ থেকে আরও সংকীর্ণ করা। বরং তিনি হারামকে রেখেছেন বিরল ও ব্যতিক্রম কিছু হিসেবে। আল্লাহ তাআলা তাঁর কিতাবে বলেন:“আল্লাহ ইচ্ছে করেন তোমাদের কাছে বিশদভাবে বিবৃত করতে, তোমাদের পূর্ববর্তীদের রীতিনীতি তোমাদেরকে অবহিত করতে এবং তোমাদেরকে ক্ষমা করতে। আর আল্লাহ্‌ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়। আর আল্লাহ্‌ তোমাদেরকে ক্ষমা করতে চান। আর যারা কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করে তারা চায় যে, তোমরা ভীষণভাবে পথচ্যুত হও। আল্লাহ্‌ তোমাদের ভার কমাতে চান; আর মানুষকে সৃষ্টি করা হয়েছে দুর্বলরূপে।” [সূরা নিসা, আয়াত: ২৬-২৮]
আল্লাহ তাআলা আরও বলেন:“আল্লাহ্‌ তোমাদের জন্য সহজ চান এবং তোমাদের জন্য কষ্ট চান না।” [সূরা বাক্বারা, আয়াত: ১৮৫] আল্লাহ আরও বলেন:“আল্লাহ্‌ তোমাদের উপর কোন সংকীর্ণতা করতে চান না; বরং তিনি তোমাদেরকে পবিত্র করতে চান এবং তোমাদের প্রতি তাঁর নেয়ামত সম্পূর্ণ করতে চান, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর।” [সূরা মায়েদা, আয়াত: ০৬]
সুতরাং মুসলমানদের জন্য কেবল সে সকল প্রাণী হারাম যেগুলো হারাম হওয়ার বিষয়ে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ﷺ) নির্দেশনা দিয়েছেন কিংবা শরী‘আতে হারাম হওয়ার যে সূত্র বর্ণিত হয়েছে তার আওতাভুক্ত হয়ে যাচ্ছে। তদ্ভিন্ন সকল প্রাণীর গোশত মুসলমানদের জন্য হালাল। আল্লাহ তা‘আলা বলেন:قُلْ لَا أَجِدُ فِي مَا أُوحِيَ إِلَيَّ مُحَرَّمًا عَلَى طَاعِمٍ يَطْعَمُهُ إِلَّا أَنْ يَكُونَ مَيْتَةً أَوْ دَمًا مَسْفُوحًا أَوْ لَحْمَ خِنْزِيرٍ فَإِنَّهُ رِجْسٌ أَوْ فِسْقًا أُهِلَّ لِغَيْرِ اللهِ بِهِ فَمَنِ اضْطُرَّ غَيْرَ باغٍ وَلَا عَادٍ فَإِنَّ رَبَّكَ غَفُورٌ رَحِيمٌ”তুমি বলে দাও, আমার নিকট যেসব বিধান অহি করা হয়েছে, সেখানে ভক্ষণকারীর জন্য আমি কোন খাদ্য হারাম পাইনি যা সে ভক্ষণ করে, কেবল মৃত প্রাণী, প্রবাহিত রক্ত ও শূকরের গোশত ব্যতীত। কেননা এগুলি নাপাক বস্ত্ত এবং ঐ প্রাণী ব্যতীত, যা অবাধ্যতা বশে আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নামে উৎসর্গ করা হয়েছে। তবে যে ব্যক্তি ক্ষুধায় কাতর হয়ে বাধ্যগত অবস্থায় (জীবন রক্ষার্থে) তা খায় কোনরূপ আকাঙ্ক্ষা ও সীমালংঘন ছাড়াই, (তার ব্যাপারে) আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান” (সূরা আন‘আম ৬/১৪৫)।
.
তৃতীয়ত: ইসলামে ঘোড়া একটি গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাসম্পন্ন প্রাণী হিসেবে বিবেচিত। ঘোড়া মুসলিম ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিশেষ মর্যাদা রাখে। ইসলামের শুরুর যুগে ঘোড়া যুদ্ধ এবং আত্মরক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল। প্রাচীন এবং মধ্যযুগে যুদ্ধের ময়দানে ঘোড়াকে প্রধান বাহন হিসেবে ব্যবহার করা হত। ঘোড়ার পিঠে বসে সৈনিকরা শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করত। এমনকি ঘোড়া শুধু যাতায়াতের জন্যই নয়, বরং শক্তি, গতি এবং কৌশলগত সুবিধার জন্য ব্যবহার করা হতো। বিশেষ করে, অশ্বারোহী বাহিনী বা ক্যাভালরি ছিল অনেক সাম্রাজ্যের শক্তির কেন্দ্র। তাছাড়া বিদ্যুৎ সভ্যতা পিছুটান দিলে কেয়ামতের পূর্বে আবার ঘোড়ার প্রয়োজন দেখা দিতে পারে। সেজন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,“ঘোড়ার কপালে কিয়ামত পর্যন্ত কল্যাণ লেখা আছে।”ঘোড়া সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন:”আর তাদের মুকাবিলার জন্য তোমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী শক্তি ও অশ্ব (ঘোড়া) বাহিনী প্রস্তুত কর,” (সূরা আনফাল: ৬০) হাদিসে ঘোড়ার বিশেষ মর্যাদার কথা উল্লেখ রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন:
الْخَيْلُ مَعْقُودٌ فِي نَوَاصِيهَا الْخَيْرُ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ
“ঘোড়ার ললাটে কিয়ামত পর্যন্ত কল্যাণ ও মঙ্গল নিবদ্ধ থাকবে”। (সহীহ বুখারী হা/২৮৫২; নাসাঈ হা/৩৫৭৫)
অপর বর্ণনায় রাসূল ﷺ বলেছেন: “কিয়ামত পর্যন্ত ঘোড়ার কপালের সাথে কল্যাণ ও বরকত আবদ্ধ আছে।”ঘোড়া তিন প্রকার। ঘোড়া কারো জন্য গুনাহের কারণ, কারো জন্য আবরণ, আবার কারো জন্য সাওয়াবের বিষয়। ঘোড়া সাওয়াবের কারণ হবে সে ব্যক্তির জন্য যে আল্লাহর পথে জিহাদের উদ্দেশে পোষে এবং এজন্য প্রস্তুত রাখে। এ ঘোড়া যা কিছু খাবে বা পান করবে তার মালিকের জন্য সাওয়াবের কারণ হবে। যদি সে এটাকে কোন মাঠে চরায় তাহলে এ ঘোড়া যা খাবে তা তার ‘আমালনামায় সাওয়াব হিসেবে লেখা হবে। আর যদি এটি কোন জলাশয়ে এ ঘোড়া পানি পান করে তবে এর প্রতি ফোঁটা পানির বিনিময়ে তার জন্য সাওয়াব লেখা হবে। এমনকি এর প্রস্রাব ও পায়খানার পরিবর্তেও মালিক সাওয়াব পাবে বলে উল্লেখ করেছেন। আর যদি এটি দু’ একটি টিলা অতিক্রম করে তাহলে প্রত্যেক কদম অতিক্রমের বিনিময়ে সাওয়াব লেখা হবে। আর সেই ঘোড়া মালিকের জন্য আবরণ স্বরূপ যা সে অপরের উপকার করার জন্য এবং নিজের সৌন্দর্যের জন্য লালন পালন করেছে এবং সে সকল সময়ই এর পেট ও পিঠের হাক্ব আদায় করেছে (অর্থাৎ ঘোড়ার পানাহারের প্রতি যত্নবান ছিল এবং বন্ধু ও গরীবদেরকে মাঝে মাঝে চড়তে ও ব্যবহার করতে দিয়েছে)। আর যে ঘোড়া তার মালিকের জন্য গুনাহের কারণ হবে তা হলো- যে একে লোক দেখানো, গর্ব এবং অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থের জন্য লালন পালন করেছে। অতঃপর সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রসূল! গাধা সম্পর্কে কী হবে? উত্তরে তিনি বললেন, গাধা সম্পর্কে আমার কাছে কোন আয়াত নাযিল হয়নি। তবে এ অতুলনীয় ও ব্যাপক অর্থবোধক আয়াতটি নাযিল হয়েছে, “যে ব্যক্তি অণু পরিমাণ ভাল কাজ করবে সে তার প্রতিদান পাবে, আর যে ব্যক্তি এক অণু পরিমান মন্দ কাজ করবে সেও তার প্রতিফল ভোগ করবে”- (সূরাহ্ যিলযাল ৯৯: ৭-৮; সহিহ মুসলিম হা/২১৮২)
.
হাদিসে উল্লিখিত “ঘোড়ার ললাটে কিয়ামত পর্যন্ত কল্যাণ ও মঙ্গল নিবদ্ধ থাকবে” কথাটি ইসলামের দৃষ্টিতে ঘোড়াকে গুরুত্ব ও বরকতময় প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত করে। এর অর্থ হচ্ছে: যে ঘোড়াগুলো আল্লাহর পথে জিহাদের জন্য প্রস্তুত করা হয়, তাদের সাথে কল্যাণ বা বরকত সংযুক্ত এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে।হাদীসটির ব্যাখ্যায় ইবনু হাজার আল-আসকালানি,(রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন:” الْمُرَادُ بِهَا مَا يُتَّخَذُ لِلْغَزْوِ ، بِأَنْ يُقَاتَلَ عَلَيْهِ ، أَوْ يُرْتَبَطَ لِأَجْلِ ذَلِكَ “এখানে সেই ঘোড়া বোঝানো হয়েছে যা জিহাদের জন্য প্রস্তুত করা হয়, হয় এর মাধ্যমে লড়াই করার জন্য বা সেই উদ্দেশ্যে এটি পোষা হয়।”( ফাতহুল বারী ফী শারহিল বুখারী, খন্ড: ৬ পৃষ্ঠা: ৫৫) বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:المراد بالخيل: خيل الجهاد لأنه فسر هذا الخير بقوله: (الأجر والمغنم) وهذا إنما يكون في خيل الجهاد ، فخيل الجهاد في نواصيها الخير إلى يوم القيامة ، ويحتمل أن يكون الحديث عاما؛ أي: الخيل كلها سواء كانت ممن يجاهد عليه أم لا ؛ للعموم “হাদিসে উল্লিখিত ‘ঘোড়া’ বলতে মূলত জিহাদের ঘোড়াকে বোঝানো হয়েছে। কারণ, হাদিসে ‘কল্যাণ’ বলতে বোঝানো হয়েছে ‘সওয়াব এবং যুদ্ধলব্ধ ধনসম্পদ’, যা মূলত জিহাদের ঘোড়ার সঙ্গে সম্পর্কিত। সুতরাং জিহাদের জন্য ব্যবহৃত ঘোড়ার কপালে কিয়ামত পর্যন্ত কল্যাণ অব্যাহত থাকবে। তবে এই হাদিসটি একটি সাধারণ অর্থেও প্রযোজ্য হতে পারে, অর্থাৎ এটি সব ধরণের ঘোড়ার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে—যা জিহাদের জন্য ব্যবহার করা হোক বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে।”(ইবনু উসাইমীন; শারহু রিয়াদিস সালিহিন: খণ্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ৩৭৭)
.
▪️এবার আমরা দেখব ঘোড়ার গোশত খাওয়া হালাল নাকী হারাম?
.
ইসলামি শরীয়তে হালাল বা হারাম নির্ণয়ের মানদন্ড হচ্ছে পবিত্র কুরআন ও রাসূল (ﷺ)-এর সহীহ সুন্নাহ। তাছাড়া হালালকে হালাল এবং হারামকে হারাম হিসাবে জানা ঈমানের অন্যতম অংশ। সুতরাং কুরআন ও সুন্নাহ যে বস্তু বা প্রাণীকে হারাম করেছে কেবল সেগুলো হারাম। আর ইসলামি শরীয়তে ঘোড়ার গোশত সংক্রান্ত দলিলগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়।যেহেতু তৎকালীন সময় ঘোড়া যুদ্ধে ব্যবহার করা হত ফলে রাসূল (ﷺ) ইসলামের প্রাথমিক যুগে তার সাহাবীদেরকে সাময়িক এর গোশত খেতে নিষেধ করেছিলেন। অতঃপর ৭ম হিজরী সনে আবার ঘোড়ার গোশত খাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। ফলে সাহাবায়ে কেরাম ঘোড়ার গোশত খেয়েছেন। ইবনু যুবায়র, ফাযালাহ ইবনু উবাইদ, আনাস ইবনু মালেক, আসমা বিনতু আবূবকর, সুওয়াইদ ইবনু গাফলাহ (রহঃ) ও আলকামাহ (রহঃ) তাদের অন্তর্ভুক্ত। তাছাড়া বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে ১৮টি হাদীস বর্ণিত হওয়ায় মুহাদ্দিসগণ এর গোশতকে হালাল গণ্য করেছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি পূর্ববর্তী হাতে গোনা কয়েকজন আলেম এবং পরবর্তী তথা বর্তমানে আমাদের দেশে একদল মাযহাবী আলেম সূরা নাহলের ৮ নং আয়াত ও সূরা আনফালের ৬০ নং আয়াত যেমন;মহান আল্লাহ বলেছেন:”তোমাদের আরোহণ ও শোভা বর্ধনের জন্য তিনি সৃষ্টি করেছেন ঘোড়া, খচ্চর ও গাধা”(সূরা নাহল ১৬/৮)। অপর আয়াতে আল্লাহ বলেন:”আর তোমরা কাফেরদের মুকাবিলার জন্য সাধ্যমত শক্তি ও সদা সজ্জিত অশ্ববাহিনী প্রস্ত্তত রাখ, যা দিয়ে তোমরা আল্লাহর শত্রু ও তোমাদের শত্রুদের ভীত করবে”। (সূরা আনফাল ৮/৬০)।উক্ত আয়াতের আলোকে কিয়াস করে ঘোড়ার গোশত হালাল না হারাম এ নিয়ে বিতর্কের সৃষ্টি করে। তারা বলেন অত্র আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা ঘোড়া, খচ্চর ও গাধা সৃষ্টির দু’টি উদ্দেশ্য আলোচনা করেছেন আর তা হচ্ছে আরোহণ ও শোভাবর্ধন। আল্লাহ খাওয়ার জন্য ঘোড়া সৃষ্টি করেননি।এমনকি যারা ঘোড়ার গোশত খায় তাদেরকে কটাক্ষ করেন। কয়েক মাস আগে এমনই একটি ঘটনা বাংলাদেশের পাবনা জেলার বেড়া উপযেলায় দেখা গিয়েছে। সেখানে কয়েকজন লোক মিলে ঘোড়া যবেহ করে গোশত খেলে এলাকার কিছু মানুষ সেইসব যুবকদের ঘর-বাড়ি ছাড়া করেছেন। তাই বিষয়টি পর্যালোচনার দাবী রাখে। নিম্নে এ বিষয়ে কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর আলোকে আলোচনা করা হল।-
.
হাদীস থেকে দলীল: ঘোড়ার গোশত খাওয়ার ব্যাপারে অনেক হাদীস বর্ণিত হয়েছে। তন্মধ্যে এখানে কয়েকটি উল্লেখিত হ’ল।- عَنْ أَسْمَاءَ- قَالَتْ: نَحَرْنَا فَرَسًا عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَأَكَلْنَاهُ وَنَحْنُ بِالْمَدِينَةِ-“আসমা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ)-এর যুগে আমরা একটি ঘোড়া যবেহ করলাম এবং সেটি খেলাম। আর আমরা তখন মদীনায় ছিলাম”।(সহীহ বুখারী হা/৫৫১১, ৫৫১৯; মুসলিম হা/১৯৪২) অন্য এক বর্ণনায় এসেছে,فَأَكَلْنَاهُ نَحْنُ وَأَهْلُ بَيْتِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘উক্ত গোশত আমরা খেলাম এবং রাসূল (ﷺ)-এর পরিবারের সদস্যরাও খেয়েছিলেন”।(তাবারানী কাবীর হা/২৩২) আরেকটি বর্ণনায় রয়েছে, আসমা (রাঃ) বলেন,أَكَلْنَا لَحْمَ فَرَسٍ لَنَا عَلَى عَهْدِ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم ‘আমরা রাসূলুল্লাহর যুগে আমাদের একটি ঘোড়ার গোশত খেয়েছিলাম।(মুসনাদে আহমাদ হা/২৬৯৭৫)
উপরোক্ত হাদীস সম্পর্কে মহাদ্দিসগন উল্লেখ করেন যে, মদীনায় হিজরতের পর ঘোড়ার গোশত খাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে কেউ যেন বলতে না পারে যে, জিহাদ ফরযের পর ঘোড়ার গোশত হারাম করা হয়েছে। আর নবীর যুগে বাক্যটি বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে কেউ যেন বলতে না পারে যে, সাহাবায়ে কেরামের গোশত খাওয়ার বিষয়টি রাসূল (ﷺ) জানতেন না”।(ফাতহুল বারী ৯/৬৪৯) জাবের (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَهَى يَوْمَ خَيْبَرَ عَنْ لُحُومِ الْحُمُرِ الْأَهْلِيَّةِ، وَأَذِنَ فِي لُحُومِ الْخَيْلِ “রাসূল (ﷺ) খায়বারের (যুদ্ধের) দিন গৃহপালিত গাধার গোশত হারাম করেছেন এবং ঘোড়ার গোশত খাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন।(সহীহ বুখারী হা/৫৫২০; মুসলিম হা/১৯৪১) অন্য এক বর্ণনায় রয়েছে, وَرَخَّصَ فِى الْخَيْلِ ‘আর ঘোড়ার গোশতের ব্যাপারে অনুমতি দেওয়া হয়েছে’।(সহীহ বুখারী হা/৪২১৯) জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,أَكَلْنَا زَمَنَ خَيْبَرَ الْخَيْلَ، وَحُمُرَ الْوَحْشِ، وَنَهَانَا النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنِ الْحِمَارِ الْأَهْلِيِّ،”খায়বারে আমরা ঘোড়া এবং বন্য গাধার গোশত খেয়েছি।পক্ষান্তরে নবী করীম (ﷺ) আমাদেরকে গৃহপালিত গাধার গোশত খেতে নিষেধ করেছেন”(সহীহ মুসলিম হা/১৯৪১) জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,ذَبَحْنَا يَوْمَ خَيْبَرَ الْخَيْلَ، وَالْبِغَالَ، وَالْحَمِيرَ، فَنَهَانَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَنِ البِغَالِ، وَالْحَمِيرِ، وَلَمْ يَنْهَنَا عَنِ الْخَيْلِ- “খায়বারের দিন আমরা ঘোড়া, খচ্চর ও গাধা যবহ করেছি। রাসূল (ﷺ) আমাদেরকে খচ্চর ও গাধার গোশত খেতে বারণ করলেন, কিন্তু ঘোড়ার গোশত খেতে নিষেধ করেননি।(আবূদাউদ হা/৩৭৮৯; আহমাদ হা/১৪৮৮৩;সহীহাহ হা/৩৫৯-এর আলোচনা) আর খায়বারের যুদ্ধ হয়েছিল সপ্তম হিজরীতে। এরপরে যদি ঘোড়ার গোশত হারাম করা হত তাহলে সাহাবায়ে কেরাম অবশ্যই বর্ণনা করতেন।সুতরাং যেহেতু বিপরীত কোন বর্ননা আসেনি সেহেতু ঘোড়ার গোশত খাওয়া হালাল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
.
ঘোড়ার গোশত খাওয়া হালাল এই মর্মে বিখ্যাত কয়েকজন তাবেঈর অভিমত: তাবেঈগণ থেকে ঘোড়ার গোশত হালাল হওয়ার ব্যাপারে বহু বর্ণনা পাওয়া যায়। তার মধ্যে কয়েকটি নিম্নে উল্লেখ করা হল।প্রখ্যাত তাবেঈ হাসান বসরী হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,كَانَ أَصْحَابُ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: يَأْكُلُونَ لُحُومَ الْخَيْلِ فِي مَغَازِيهِمْ”রাসূল (ﷺ)-এর সাহাবীগণ যুদ্ধকালীন সময়ে ঘোড়ার গোশত খেতেন”।(ইবনু আবী শায়বাহ হা/২৪৩১২) প্রখ্যাত তাবেঈ ইবরাহীম নাখঈ বলেন,نَحَرَ أَصْحَابُ عَبْدِ اللهِ فَرَسًا فَقَسَمُوهُ بَيْنَهُم “আব্দুল্লাহর সাথীরা ঘোড়া যবহ করেছিলেন এবং এর গোশত নিজেদের মাঝে বণ্টন করে নিয়েছিলেন”(ইবনু আবী শায়বাহ হা/২৪৩১২; মুছান্নাফে আব্দুর রাযযাক হা/৮৭৩২) আত্বা বিন রাবাহ (রহঃ) বলেন,بَلَغَنَا أَنَّ أَصْحَابَ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانُوا يَأْكُلُونَ الْخَيْلَ- “আমাদের নিকট হাদীস পৌঁছেছে যে, নবী করীম (ﷺ) -এর সাহাবীগণ ঘোড়ার গোশত খেতেন” (মুছান্নাফে আব্দুর রাযযাক হা/৮৭৩৩) আত্বা বিন রাবাহ (রহঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,لَمْ يَزَلْ سَلَفُكَ يَأْكُلُونَهُ قَالَ بن جُرَيْجٍ قُلْتُ لَهُ أَصْحَابِ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَقَالَ نَعَمْ- “তোমার পূর্ব পুরুষেরা ঘোড়ার গোশত খেয়ে আসছেন। ইবনু জুরাইজ বলেন, আমি তাকে বললাম, রাসূলুল্লাহর সাহাবীগণ? তিনি বললেন, হ্যাঁ”।(ফাতহুল বারী ৯/৬৫০; নায়লুল আওতার ৮/১২৬)
.
▪️ঘোড়ার গোশত খাওয়া হালাল এই মর্মে প্রসিদ্ধ চার ইমামের অভিমত:
(১).হানাফী মাযহাবের অবস্থান: ঘোড়ার গোশত খাওয়া হালাল নাকি হালাল নয় এ বিষয়ে হানাফী মাযহাবের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। ইমাম আবু হানীফার নিকট ঘোড়ার গোশত মাকরূহ। তবে তার প্রধান দুই শীষ্য ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ (রহঃ) এবং অন্যান্যরা ঘোড়ার গোশত খাওয়া হালাল বলেছেন। ইমাম ত্বাহাবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,ذَهَبَ أَبُو حَنِيفَةَ إلَى كَرَاهَةِ أَكْلِ الْخَيْلِ وَخَالَفَهُ صَاحِبَاهُ وَغَيْرُهُمَا.”ইমাম আবু হানীফা ঘোড়ার গোশত খাওয়াকে মাকরূহ হওয়ার পক্ষে গিয়েছেন। কিন্তু তার দুই সাথীদ্বয় (ইমাম আবু ইউসুফ ও মুহাম্মাদ) ও অন্যান্যরা বিরোধিতা করেছেন”।(কুদূরী ২/১৮৫; ফাতহুল বারী ৯/৬৫০) ।
(২).মালেকী মাযহাবের অবস্থান: ঘোড়ার গোশত খাওয়া হালাল নাকি হালাল নয় এই মাসালায় মালেকী মাযহাবের বিদ্বানগণ তিনভাগে ভাগ হয়েছেন। একদল জায়েযের পক্ষে, আরেকদল মাকরূহের পক্ষে এবং অন্য দলটি হারামের পক্ষে। তবে ইমাম মালেক (রাহিমাহুল্লাহ) ঘোড়ার গোশত না খাওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন”।(শরহুয যারকানী আলা মুয়াত্তা; ৩/১৯৩) মালেকী মাজহাবের আলেম ইমাম বাজী, হাত্তাব, খলীল ও অন্যান্যরা ঘোড়ার গোশত খাওয়াকে হালাল বলেছেন এবং যবহের ক্ষেত্রে গরুর মতই যবহ করতে হবে বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন।(মাওয়াহিবুজ জলীল; ৩/২২০)।
(৩).শাফেঈ মাযহাবের অবস্থান: শাফেঈ মাযহাবের সকল আলেম ঘোড়ার গোশতকে হালাল বলেছেন। ইমাম শাফেঈ (রাঃ) বলেন,ইমাম শাফেঈ (রাঃ) বলেন,كُلُّ مَا لَزِمَهُ اسْمُ الْخَيْلِ مِنْ الْعِرَابِ وَالْمَقَارِيفِ وَالْبَرَاذِينِ، فَأَكْلُهَا حَلَالٌ،”ঘোড়ার নামে যা কিছু আছে, যেমন ইরাব, মাক্বারীফ ও বিরযান খাওয়া জায়েয’।(কিতাবুল উম্ম ২/২৭৫) ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ)
বলেন,اخْتَلَفَ الْعُلَمَاءُ فِي إِبَاحَةِ لُحُومِ الْخَيْلِ فَمَذْهَبُ الشَّافِعِيِّ وَالْجُمْهُورِ مِنَ السَّلَفِ وَالْخَلَفِ أَنَّهُ مُبَاحٌ لَا كَرَاهَةَ فِيهِ،”ঘোড়ার গোশতের বৈধতার ব্যাপারে বিদ্বানগণ মতপার্থক্য করেছেন। শাফেঈ মাযাহাব এবং পূর্ব ও পরের জমহূর বিদ্বানগণ ঘোড়ার গোশতকে হালাল মনে করেন এবং এর মধ্যে কোন অপসন্দনীয় কিছু নেই বলে উল্লেখ করেন”।(শরহুন নববী ১৩/৯৫) ।
(৪).হাম্বলী মাযহাবের অবস্থান: হাম্বলী মাযহাবের সর্বসম্মত মত হচ্ছে ঘোড়ার গোশত খাওয়া হালাল। তারা বুখারী, মুসলিম ও মুসনাদে আহমাদে বর্ণিত হাদীসগুলো দলীল হিসাবে গ্রহণ করেছেন।হাম্বলি মাযহাবের প্রখ্যাত আলেম ইমাম ইবনু কুদামাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,وَتُبَاحُ لُحُومُ الْخَيْلِ كُلُّهَا عِرَابُهَا وَبَرَاذِينُهَا نَصَّ عَلَيْهِ أَحْمَدُ،”সকল ঘোড়া ও তাদের বাচ্চাদের গোশত জায়েয। ইমাম আহমাদ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর উপরেই দলীল গ্রহণ করেছেন”(ইবনে কুদামাহ আল-মুগনী ৯/৪১১)।
.
▪️ঘোড়ার গোশত খাওয়া হালাল এই মর্মে বিখ্যাত কয়েকজন ইমামের অভিমত:
১. ইমাম ইবনু হাযম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,وَأَمَّا فُتْيَا الْعُلَمَاءِ بِأَكْلِ الْفَرَسِ فَتَكَادُ أَنْ تَكُونَ إجْمَاعًا عَلَى مَا ذَكَرْنَا قَبْلُ وَمَا نَعْلَمُ عَنْ أَحَدٍ مِنْ السَّلَفِ كَرَاهَةَ أَكْلِ لُحُومِ الْخَيْلِ إلَّا رِوَايَةً عَنْ ابْنِ عَبَّاسٍ لَا تَصِحُّ؛ ‘ঘোড়ার গোশত খাওয়ার ব্যাপারে আলেমদের ফৎওয়াগুলো প্রায় সর্বসম্মতভাবে প্রমাণিত। আমরা আগে যা উল্লেখ করেছি তার উপর ভিত্তি করে এবং ইবনে আববাস (রাঃ) কর্তৃক একটি বর্ণনা ব্যতীত যা বিশুদ্ধ নয় পূর্বসূরীদের মধ্যে কেউ ঘোড়ার গোশত খাওয়াকে অপসন্দ করতেন বলে আমরা জানি না’।তিনি অন্যত্র বলেন, وحلالٌ أكلُ الخَيلِ، ‘ঘোড়ার গোশত খাওয়া হালাল”(ইবনু হাযম; আল মুহাল্লা খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ৮৩)।
.
(২). শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] ঘোড়ার গোশতের বৈধতার দীর্ঘ বর্ণনা শেষে বলেন, قَدْ ذَكَرْنَا أَنَّ مَذْهَبَنَا أَنَّهُ حَلَالٌ لَا كَرَاهَةَ فِيهِ ‘আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, আমাদের মাযহাব হচ্ছে এটা হালাল, এর মধ্যে কোন অপসন্দনীয় বিষয় নেই। এরপর তিনি বহু সাহাবী ও তাবেঈর নাম উল্লেখ করেন, যারা ঘোড়ার গোশতকে হালাল সাব্যস্ত করেছেন”(ইমাম নববী আল-মাজমূ‘; খণ্ড: ৯; পৃষ্ঠা: ০৪) ।
.
(৩).শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, আবুল ফাদল আহমাদ বিন আলি ইবনু হাজার আল-আসকালানি,(রাহিমাহুল্লাহ) [জন্ম:৭৭৩ হি: মৃত:৮৫২ হি:] বলেন, وَقَدْ نَقَلَ الْحِلَّ بَعْضُ التَّابِعِينَ عَنِ الصَّحَابَةِ مِنْ غَيْرِ اسْتِثْنَاءِ أحد، ‘বেশ কিছু তাবেঈ সাহাবীগণ থেকে কাউকে বাদ না দিয়ে সবার থেকে ঘোড়ার গোশত হালাল হওয়ার বিবৃতি বর্ণনা করেছেন”(ইবনু হাজার; ফাতহুল বারী ৯/৬৫০)।
.
(৪). হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ শাইখুল ইসলাম ইমাম তাক্বিউদ্দীন আবুল ‘আব্বাস আহমাদ বিন ‘আব্দুল হালীম বিন তাইমিয়্যাহ আল-হার্রানী আন-নুমাইরি, (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন:ولم يثبُتْ عن النبيِّ صلَّى اللهُ عليه وسلَّم أنَّه حَرَّم لحمَ الخَيلِ في حديثٍ صَحيحٍ، ‘কোন একটি ছহীহ হাদীছেও রাসূল (ﷺ) থেকে ঘোড়ার গোশত হারাম হওয়ার বিষয়টি সাব্যস্ত হয়নি”(জামেউল মাসায়েল ৪/৩৪৩) ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন,هِيَ حَلَالٌ عِنْدَ جُمْهُورِ الْعُلَمَاءِ: كَالشَّافِعِيِّ وَأَحْمَد وَصَاحِبَيْ أَبِي حَنِيفَةَ وَعَامَّةِ فُقَهَاءِ الْحَدِيثِ، ‘ইমাম শাফেঈ, আহমাদ ও আবু হানীফার সাথীদ্বয়সহ সকল হাদীসের ফক্বীহদের নিকট ঘোড়ার গোশত হালাল”(ইবনু তাইমিয়া; মাজমূউল ফাতাওয়া; খণ্ড: ৩৫; পৃষ্ঠা: ২০৮)।
(৫).ইমাম ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওজিয়্যা,(রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৫১ হি.] বলেছেন,وَثَبَتَ عَنْهُ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ أَذِنَ فِي لُحُومِ الْخَيْلِ، وَنَهَى عَنْ لُحُومِ الْحُمُرِ، ‘রাসূলুল্লাহ থেকে সাব্যস্ত হয়েছে যে, তিনি ঘোড়ার গোশত খাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন এবং গাধার গোশত খেতে নিষেধ করেছেন। এরপর তিনি এ সংক্রান্ত দু’টি হাদীছ উল্লেখ করে বলেন, وَالْحَدِيثَانِ فِي حِلِّهَا صَحِيحَانِ لَا مُعَارِضَ لَهُمَا ‘হাদীছ দু’টি ঘোড়ার গোশত হালাল হওয়ার ব্যাপারে বিশুদ্ধ সনদে প্রমাণিত। এ দু’টোর বিরোধী কোন বর্ণনা নেই”(ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মা‘আদ, খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৩৪৩-৪৪)।
.
(৬). বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন, لحم الخيل مباح هذا الذي عليه جمهور أهل العلم وهو الصحيح، والرسول صلى الله عليه وسلم أذن في لحوم الخيل،ُ ‘ঘোড়ার গোশত হালাল। এর উপরেই জমহূর বিদ্বানগণের ফৎওয়া। আর এটাই সঠিক। আর নবী (ﷺ) ঘোড়ার গোশতের ব্যাপারে অনুমতি দিয়েছেন”(ফাতাওয়া নূরুন আলাদ-দারব)।
.
(৭).বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] শায়খকে ঘোড়ার গোশত হালাল হওয়ার বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি হালাল উত্তর দিয়ে হারামের পক্ষে উপস্থাপিত দলীলগুলোর কড়া জওয়াব দিয়েছেন।(আশ-শারহুল মুমতে‘; খণ্ড: ১৫; পৃষ্ঠা: ২৮, ৩০)।
.
(৮).সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেছেন,,لا يخفى أن الخيل يباح أكلها على الصحيح من المذهب، وعليه الأصحاب ومن وافقهم من أهل العلم، ‘এটা কোন গোপন বিষয় নয় যে, মাযহাবের সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী ঘোড়ার গোশত খাওয়া জায়েয এবং এটিই আমাদের সাথীগণ এবং আলেমদের মধ্যে যারা তাদের সাথে একমত তাদের মতামত”(ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ; খণ্ড: ২৬; পৃষ্ঠা: ১৮৮)।
.
পরিশেষে প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে ঘোড়ার গোস্ত খাওয়া জায়েয। একাধিক বিশুদ্ধ হাদীস দ্বারা খাওয়া সাব্যস্ত হয়েছে। তবে হা! যদি ঘোড়ার যোগান পর্যাপ্ত না থাকে বা কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য ব্যাপক প্রয়োজন দেখা দেয় তাহলে সে অজুহাতে ঘোড়া যবেহ থেকে বিরত থাকা যায়। তাই বলে বিনা দলিলে হালালকে হারাম বলার অধিকার কারো নেই। মহান আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে কুরআন ও সুন্নাহ সঠিকভাবে বুঝার তাওফীক দান করুন। আমীন! (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
____________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
Share: