কোন অমুসলিম কাফেরকে ভাই বলে সম্বোধন করা যাবে কি

উত্তর: শারঈ দৃষ্টিকোণ থেকে “উখুওয়াতুল ইসলাম” বা ইসলামী ভ্রাতৃত্ব হল ঈমানী ভ্রাতৃত্ব।অর্থাৎ প্রত্যেক মু’মিন-মুসলিমগণ সবাই পরস্পর ভাই-ভাই। তাদের মধ্যে প্রধানতম সম্পর্ক হল ঈমানী ভ্রাতৃত্বের। তাই একজন মুমিন অপর মুমিনের প্রতি সম্প্রীতি-ভালবাসা, সহানুভূতি ও সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করবে। তা সে যে দেশেরই হোক, যে ভাষারই হোক। আল্লাহ তাআলা বলেন:إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ“মুমিনরা তো পরস্পর ভাই-ভাই।” (সূরা হুজুরাত: ১০) এই আয়াতে আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেছেন যে সকল মুমিন একে অপরের ভাই। তাদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক কোনো পার্থক্য বা বৈষম্য কিংবা কেবল রক্তের সম্পর্কের কারণে নয় বরং ঈমানের ভিত্তিতে।এটি মুসলিম উম্মাহর একতা ও সংহতির মূল ভিত্তি। উক্ত আয়াতের তাফসিরে ইমাম শাইখ মুহাম্মাদ আল-আমিন শানকিতি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: ” هذه الأخوة التي أثبت الله جل وعلا في هذه الآية الكريمة للمؤمنين بعضهم لبعض هي أخوة الدين لا النسب “এই ভ্রাতৃত্ব যা আল্লাহ তাআলা এই আয়াতে মুমিনদের মধ্যে প্রতিষ্ঠা করেছেন তা হল ধর্মীয় ভ্রাতৃত্ব, রক্তসম্পর্কীয় নয়।” (আদ্বওয়াউল বায়ান; খন্ড: ৭ পৃষ্ঠা: ৪১৭) হাদিসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ“একজন মুসলিম আরেক জন মুসলিমের ভাই।” (সহীহ বুখারী হা/২৪৪২ ও মুসলিম হা/২৫৮০) এই হাদীসটি মুসলিম উম্মাহর পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ব ও ঐক্যের গুরুত্ব বোঝায়। এটি আমাদের একে অপরের প্রতি সহানুভূতি, সহমর্মিতা এবং সাহায্যের গুরুত্বকে স্মরণ করিয়ে দেয়। মুসলিমদের পরস্পর ভাইয়ের সম্পর্ক গভীর। কারণ এখানে ভাতৃত্বের দু’টি বিষয় বিদ্যমান একতো ঈমানদারগণ সকলেই আদি পিতা আদম (আলাইহিস সালাম)-এর সন্তান ও মানুষ হিসেবে ভাই-বোন হওয়ার পাশাপাশি অপরটি ঈমানের বন্ধনে আবদ্ধ দ্বীনি ভাই-বোন। আর এটাই প্রকৃত ভাতৃত্ব। এই অর্থে কোন অমুসলিম কা/ফের-মুশরি/কদেরকে ‘ভাই হিসেবে গ্রহণ করা’ যাবে না।
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেছেন,

يحرم اتخاذ المسيحيين إخوانًا ، قال تعالى: ( يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لَا تَتَّخِذُوا الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى أَوْلِيَاءَ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ وَمَنْ يَتَوَلَّهُمْ مِنْكُمْ فَإِنَّهُ مِنْهُمْ إِنَّ اللَّهَ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ) ، وقال تعالى: ( إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ) فحصر سبحانه الأخوة الحقيقية في المؤمنين ، وثبت عن النبي صلى الله عليه وسلم أنه قال : ( المسلم أخو المسلم ، لا يظلمه ولا يخذله ، ولا يكذبه ، ولا يحقره ) الحديث. وبالله التوفيق. وصلى الله على نبينا محمد، وآله وصحبه وسلم

“ইয়া/হুদি-খ্রি/স্টা/নদেরকে ভাই হিসাবে গ্রহণ করা হারাম। আল্লাহ তাআলা বলেছেন: (হে মুমিনগণ! তোমরা ইয়া-হুদী ও না-সা-রাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না, তারা পরস্পর পরস্পরের বন্ধু। আর তোমাদের মধ্যে কেউ তাদেরকে বন্ধুরূপে গ্রহন করলে সে নিশ্চয় তাদেরই একজন। নিশ্চয় আল্লাহ যালিম সম্প্রদায়কে হেদায়াত দেন না”।(সূরা মায়িদা: ৫১) এছাড়াও আল্লাহ তাআলা বলেছেন:(নিশ্চয়ই মুমিনরা একে অপরের ভাই) [সূরা হুজুরাত: ১০] এখানে আল্লাহ প্রকৃত ভ্রাতৃত্ব শুধুমাত্র মুমিনদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছেন।আর রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, তিনি বলেছেন: ‘‘মুসলিম মুসলিমের ভাই, সে তার উপর অত্যাচার করবে না এবং তাকে অত্যাচারীর হাতে ছেড়ে দেবে না”।(সহীহুল বুখারী: ২৪৪২) আল্লাহই তৌফিকদাতা। আর আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, তাঁর পরিবার এবং সাহাবিদের প্রতি শান্তি ও বরকত বর্ষিত হোক।”(ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৭০)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন:

” الكافر ليس أخاً للمسلم ، والله سبحانه يقول : ( إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ ) الحجرات/10 ، ويقول النبي صلى الله عليه وسلم : ( المسلم أخو المسلم ) .فليس الكافر – يهوديّاً ، أو نصرانيّاً ، أو وثنيّاً ، أو مجوسيّاً ، أو شيوعيّاً ، أو غيرهم – أخاً للمسلم ، ولا يجوز اتخاذه صاحباً ، وصديقاً ”

“অমুসলিম মুসলমানের ভাই নয়। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন: ‘মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই’ (সূরা হুজুরাত, আয়াত: ১০)। এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: ‘মুসলমান মুসলমানের ভাই’। অতএব, অমুসলিম সে ই/য়া/হু/দি, খ্রি/স্টা/ন, মূর্তিপূজক, মজুসি, নাস্তিক বা যে-ই হোক না কেন মুসলমানের ভাই নয়। একজন মুসলমানের জন্য কোনো কাফিরকে বন্ধু বা অন্তরঙ্গ সঙ্গী বানানো জায়েজ নয়।”(মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড ৬; পৃষ্ঠা: ৩৯২)
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে অমুসলিমকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল।

তিনি উত্তর দিয়েছেন:

لا يحل للمسلم أن يصف الكافر- أيا كان نوع كفره ، سواء كان نصرانيّاً ، أم يهوديّاً ، أم مجوسيّاً ، أم ملحداً – : لا يجوز له أن يصفه بالأخ أبداً ، فاحذر يا أخي مثل هذا التعبير ؛ فإنه لا أخوَّة بين المسلمين وبين الكفار أبداً ، الأخوة هي الأخوة الإيمانية ، كما قال الله عز وجل : ( إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ ) .

“কোনো মুসলমানের জন্য এটি বৈধ নয় যে তিনি কোনো অমুসলিমকে সে যেকোনো প্রকারের কাফের হোক, যেমন: খ্রি/স্টা/ন, ই/য়া/হু/দি, মজুসি বা নাস্তিক ভাই’ বলে সম্বোধন করবেন। সুতরাং এ ধরনের ভুল ব্যবহার থেকে সাবধান থাকুন। মুসলমান ও কাফেরদের মধ্যে কোনো প্রকার ভ্রাতৃত্ব নেই। ভ্রাতৃত্ব শুধুমাত্র ঈমানের ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠিত হয়। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেছেন: ‘নিশ্চয়ই মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই”(সূরা হুজুরাত, আয়াত: ১০; ইবনু উসাইমীন, মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ৪৩)
.
পক্ষান্তরে জেনে রাখা ভাল যে মুসলিমরা পরস্পর ঈমানের বন্ধনে আবদ্ধ দ্বীনি ভাই-বোন। আর এটাই প্রকৃত ভাতৃত্ব। কিন্তু এর মানে এই নয় যে অন্য ধর্মাবলম্বীদের ভাই বলা যাবে না বরং কাউকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করা আর ‘ভাই হিসেবে গ্রহণ করা’ বা ‘ভাইয়ের মত’ মনে করার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আগেরটি জায়েজ আর পরেরটি নাজায়েজ। যেভাবে কোন অমুসলিমের সাথে বিশেষ প্রয়োজনে বন্ধুত্ব করা জায়েজ কিন্তু ‘বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করা’ নাজায়েজ। বরং ঈমান ভঙ্গের কারণ। সুতরাং উদ্দেশ্য ঠিক রেখে কোন অমুসলিমকে রক্ত সম্পর্কের কারণে (চাই নিকট আত্মীয় হোক অথবা দূরবর্তী সম্পর্ক হোক), একই গোত্রভুক্ত হওয়ার কারণে, একই দেশের মানুষ হিসেবে কিংবা ইসলামের প্রতি দাওয়াতের স্বার্থে তার সাথে সুসম্পর্কের উদ্দেশ্যে কিংবা তার ক্ষতি থেকে বাঁচার উদ্দেশ্যে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করতে কোন আপত্তি নেই। কেননা মুসলিম-অমুসলিম সকলের আদি পিতা একই।আর এরা দ্বীনি সম্পর্কের দিক দিয়ে ভাই-বোন না হলেও বংশ পরম্পরায় একই পিতামাতার সন্তান এবং মানুষ হিসেবে সকলের উৎস একটাই। এ বিষয়ে একাধিক কুরআনের আয়াত, হাদিস, সালাফ ও মুফাসসিরগনের অভিমত রয়েছে।যেমন মহান আল্লাহ বলেন:وَإِلَىٰ عَادٍ أَخَاهُمْ هُودًا ۗ “আদ সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরণ করেছি তাদের ভাই হুদকে”।[সূরা আরাফ: ৬৫] এখানে আদ সম্প্রদায়ের কাফেরদেরকে নবী সালেহ আলাইহিস সালামের ভাই বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ আদ গোত্রের সবাই হুদ আলাইহিস সালামের বংশীয় ভাই ছিলেন না। তারপরও তাদের ভাই বলা হল কিভাবে? এর জবাবে তাফসীরে কুরতুবীতে এসেছে-قَالَ ابْنُ عَبَّاسٍ أَيِ ابْنُ أَبِيهِمْ. وَقِيلَ: أَخَاهُمْ فِي الْقَبِيلَةِ. وَقِيلَ: أي بشرا من بني أبيهم آدم.”ইবনে আব্বাস (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) বলেছেন, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল তাদের পিতার সন্তান। কেউ বলেছেন এর দ্বারা উদ্দেশ্য হল গোত্রীয় ভাই। কেউ বলেছেন পিতা আদমের সন্তান হিসেবে ভাই”।(তাফসীরে কুরতুবী-৭/২৩৫, দারুল কুতুব মিশর] এছাড়া অন্যত্র এসেছে-وَإِلَىٰ ثَمُودَ أَخَاهُمْ صَالِحًا ۗ [٧:٧٣ “সামুদ সম্প্রদায়ের কাছে প্রেরণ করেছি তাদের ভাই সালেহকে”।(সূরা আরাফ: ৭৩) এখানে কাফির সামুদ সম্প্রদায়কে নবী সালেহের ভাই বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অথচ তারা কাফির এবং সবাই নবীর বংশীয় ভাই নয়। এসব আয়াত দ্বারা একথাই প্রতীয়মান হয় যে, আদম আলাইহিস সালামের সন্তান হিসেবে সকল ধর্মবর্ণের মানুষ আমরা পরস্পর ভাই। কিন্তু এ ভাইয়ের সম্পর্ক মুসলমান পরস্পর ভাইয়ের মত গভীর নয়। মানুষ হিসেবে পরস্পর একটি ন্যুনতম সম্পর্ক মাত্র। তা’ই কোন অমুসলিমকে দ্বীনের পথে নিয়ে আসার আকাংখায়, দ্বীনের দাওয়াত দিতে কাছে টানতে তাকে ভাই বলে সম্বোধন করাতে কোন সমস্যা নেই। অবশ্য এ সকল অমুসলিম তথা হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, অগ্নিপূজক, মাজার পূজারী, নাস্তিক, শিয়া-রাফেযীদেরকে সব সময় ভাইবোন বলে সম্বোধন করা ঠিক নয়। কারণ এতে তাদের মিথ্যা ও বাতিল ধর্মের প্রতি মনে প্রভাব সৃষ্টি হতে পারে। এর পরিবর্তে ফ্রেন্ড, দোস্ত বন্ধু ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করা যেতে পারে। আমরা আল্লাহ্‌র কাছে প্রার্থনা করছি তিনি যেন আমাদের সকলকে ভাল কাজের তাওফিক দান করেন। আমীন!! নিশ্চয় তিনি সে ক্ষমতা রাখেন।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
____________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Share: