প্রশ্ন: কৃষি জমিতে উৎপাদিত ফসল যেমন: ধান, গম, সরিষা, ভু্ট্টা ইত্যাদি শস্যদানার যাকাত আদায়ের শারঈ হুকুম কী? ফসলের যাকাত কখন এবং কীভাবে আদায় করতে হয়?
▬▬▬▬▬▬▬▬❂▬▬▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: যাকাত ইসলামের পাঁচটি রুকন সমূহের মধ্যে অন্যতম একটি রুকন। নিছাব পরিমাণ সম্পদের মালিকের উপর যাকাত আদায় করা ফরয। অনেকে যাকাত দিতে আগ্রহী থাকার পরও বিভিন্ন জটিলতার কারণে যাকাত বণ্টন করেন না। অনেকে না বুঝার কারণে এই ফরয দায়িত্ব পালনের ব্যাপারে অলসতা করেন। অথচ যাকাত একটি ফরয ইবাদত এবং ইসলামের একটি রুকন। যে ব্যক্তি যাকাতের ফরযিয়ত বা আবশ্যকীয়তাকে অস্বীকার করে যাকাত প্রদান করবে না তার কাছে যাকাতের হুকুম তুলে ধরা হবে। এর পরেও যদি অস্বীকার করতে থাকে তাহলে সে কাফের হয়ে যাবে,মৃত্যুর পর তার জানাযার নামায পড়া যাবে না, তাকে মুসলমানদের কবরস্থানে দাফন করা যাবে না। পক্ষান্তরে, সে ব্যক্তি যদি কৃপণতাবশতঃ যাকাত না দেয়; কিন্তু সে যাকাতের ফরযিয়তের উপর ঈমান রাখে তাহলে সে ব্যক্তি কবিরা গুনাহকারী পাপী বিবেচিত হবে। তবে, তাকে কাফের বলা যাবে না। এ অবস্থায় মারা গেলে তাকে গোসল করানো হবে, জানাযার নামায পড়ানো হবে এবং তার পরিণতির সিদ্ধান্ত হবে কিয়ামতের দিন। দুনিয়াতে যে ব্যক্তির উপর যাকাত ফরয হয়েছে তিনি যাকাত প্রদান করতে বাধ্য।অবহেলা করে যাকাত পরিত্যাগকারীর স্থান জাহান্নাম। রাসূল (ﷺ) বলেন, مَانِعُ الزَّكَاةِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ فِي النَّارِ ‘যাকাত ত্যাগকারী ক্বিয়ামতের দিন জাহান্নামে প্রবেশ করবে।(ত্বাবারাণী, আল-মু‘জামুস সাগীর, হা/৯৩৫; সহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৭৬২, সনদ সহীহ)
.
আহলে সুন্নত ওয়াল জামাআতের আলেমদের ইজমার ভিত্তিতে একমত নিদিষ্ট কিছু যেমন: গম, যব, খেজুর, কিসমিস ইত্যাদি ফল ও ফসলের যাকাত ফরজ হয়। উপরোক্ত এই চার প্রকার ব্যতীত অন্যান্য ফল ও ফসলে যাকাত ওয়াজিব হবে কি না আহলে ইলমগণ দ্বিমত পোষণ করেছেন,তবে বিশুদ্ধ মত হচ্ছে, (আল্লাহ ভালো জানেন) যেসব ফল ও ফসল মানুষের সাধারণ খাদ্য হিসাবে বিবেচিত হয় এবং তা ওযন ও গুদামজাত কিংবা সংরক্ষণ করার উপযুক্ত এবং সেগুলো যদি নিছাব পরিমাণ হয়। তাহলে তাতে যাকাত ওয়াজিব, অর্থাৎ ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করলে নষ্ট হয় না, যেমন ভুট্টা, চাল ও অন্যান্য খাদ্যশস্য। হোক তা নিজ জমিতে আবাদ অথবা অন্যের জমি বা বর্গাতে ভাগে পাওয়া সম্পদ। মহান আল্লাহ বলেন,”তোমরা ফসলের হক আদায় কর কর্তনের সময় (সূরা আল-আন‘আম: ১৪১)। হাদীসে এসেছে,ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) হতে বর্ণিত,إِنَّمَا سَنَّ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم الزَّكَاةَ فِيْ هَذِهِ الأَرْبَعَةِ الْحِنْطَةِ وَالشَّعِيْرِ وَالزَّبِيْبِ وَالتَّمْرِ- রাসূল (ﷺ) গম, যব, কিসমিস এবং খেজুর এই চারটি শস্যের যাকাত প্রবর্তন করেছেন।(সুনানুদ দারাকুতনী হা/১৯৩৬; সিলসিলা সহীহা হা/৮৭৯) অন্য হাদীসে এসেছে,মূসা ইবনু ত্বালহা (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,عِنْدَنَا كِتَابُ مُعَاذٍ عَنِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم أَنَّهُ إِنَّمَا أَخَذَ الصَّدَقَةَ مِنَ الْحِنْطَةِ وَالشَّعِيْرِ وَالزَّبِيْبِ وَالتَّمْرِ- রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কর্তৃক মু‘আয (রাঃ)-এর নিকট প্রেরিত পত্র আমাদের নিকট ছিল। যাতে তিনি গম, যব, কিসমিস ও খেজুরের যাকাত গ্রহণ করেছেন।(মুসনাদে আহমাদ হা/২২০৪১; সিলসিলা সহীহা, হা/৮৭৯) উল্লিখিত হাদীছদ্বয়ে বর্ণিত চারটি শস্যের যাকাতের কথা বলা হলেও এই চারটিকেই নির্দিষ্ট করা হয়নি। বরং ওযন ও গুদামজাত সম্ভব সকল শস্যই এর অন্তর্ভুক্ত। যেমন ধান, ভুট্টা ইত্যাদি। হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন,أَجْمَعَ أَهْلُ الْعِلْمِ عَلَى أَنَّ الصَّدَقَةَ وَاجِبَةٌ فِي الْحِنْطَةِ , وَالشَّعِيرِ , وَالتَّمْرِ , وَالزَّبِيبِ . قَالَهُ ابْنُ الْمُنْذِرِ , وَابْنُ عَبْدِ الْبَرِّ“আলেমগণ সর্বসম্মতভাবে একমত যে; গম, যব,খেজুর এবং আঙ্গুরের উপর যাকাত ওয়াজিব। ইবনুল মুনযির এবং ইবনে আব্দুল বার একথাই বলেছেন।(ইবনে কুদামাহ আল মুগনী: খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ২৯৪)
..
▪️কৃষিপণ্যের যাকাতের নিসাব ও যাকাত আদায়ের পরিমাণ:
.
আমরা ইতিমধ্যেই উল্লেখ করেছি শস্যদানা ও ফলফলাদির উপর যাকাত আদায় করা ফরজ যদি সেটা নিসাব পরিমাণ হয়। দলিল হচ্ছে,মহান আল্লাহ বলেন, وَآتُوْا حَقَّهُ يَوْمَ حَصَادِهِ “তোমরা ফসলের হক আদায় কর কর্তনের সময়”।(সূরা আল-আন‘আম: ১৪১)। আর কৃষিপণ্যের নিসাব সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, لَيْسَ فِيْمَا أَقَلُّ مِنْ خَمْسَةِ أَوْسُقٍ صَدَقَةٌ”পাঁচ ওয়াসাক বা ৭৫০ কেজির কম উৎপন্ন দ্রব্যের ওশর নেই এবং পাঁচ আওকিয়া অর্থাৎ ২০০ দিরহামের কম রৌপ্যের যাকাত যাকাত নেই”।(সহীহ বুখারী, হা/১৪৮৪; সহীহ মুসলিম হা/৯৭৯; মিশকাত হা/১৭৯৪)
.
ওয়াসাক্বের পরিমাণ হল- ১ ওয়াসাক সমান ৬০ সা‘। আর ৫ ওয়াসাক্ব সমান ৬০×৫= ৩০০ সা। ১ সা সমান প্রায় ২ কেজি ৫০০ গ্রাম হলে ৩০০ সা সমান প্রায় ৭৫০ কেজি হয়। অর্থাৎ পরিমাণে ১৮ মন ৩০ কেজি। এই পরিমাণ শস্য যেমন: ধান, গম, সরিষা, ভু্ট্টা,কিসমিস ইত্যাদি ফসল বৃষ্টির পানিতে উৎপাদিত হলে ১০ ভাগের ১ ভাগ যাকাত ফরয। আর নিজে পানি সেচ দিয়ে উৎপাদন করলে ২০ ভাগের ১ ভাগ যাকাত দিতে হবে। বর্গাচাষী জমি থেকে ফসল নিয়ে তাদের মাঝে করা চুক্তি অনুযায়ী বণ্টন করে নেবে। অতঃপর তাদের সেই ফসল নিছাব পরিমাণ তথা ১৮ মণ ৩০ কেজি হলে নিয়ম অনুযায়ী নির্ধারিত হারে ওশর দিবে।এক্ষেত্রে জমির পরিমাপ বিবেচ্য নয়, বরং ফসলের পরিমাণ বিবেচ্য। দলিল হচ্ছে,
.
প্রখ্যাত সাহাবী আব্দুল্লাহ বিন ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) [মৃত: ৭৩ হি.] থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন;فِيْمَا سَقَتِ السَّمَاءُ وَالْعُيُوْنُ أَوْ كَانَ عَثَرِيًّا الْعُشْرُ، وَمَا سُقِىَ بِالنَّضْحِ نِصْفُ الْعُشْرِ- “বৃষ্টি ও ঝর্ণার পানি দ্বারা সিক্ত ভূমিতে উৎপাদিত ফসল বা নালার পানিতে উৎপন্ন ফসলের উপর ‘ওশর’ (দশ ভাগের এক ভাগ) যাকাত ওয়াজিব। আর সেচ দ্বারা উৎপাদিত ফসলের উপর ‘অর্ধ ওশর’ (বিশ ভাগের এক ভাগ) যাকাত ওয়াজিব’।(সহীহ বুখারী হা/১৪৮৩, যাকাত’ অধ্যায়, আবু দাঊদ হা/১৫৯৬, মিশকাত হা/১৭৯৭) অপর বর্ননায়, জাবির ইবনু ‘আবদুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃতিনি নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)- কে বলতে শুনেছেন,فِيمَا سَقَتِ الأَنْهَارُ وَالْغَيْمُ الْعُشُورُ وَفِيمَا سُقِيَ بِالسَّانِيَةِ نِصْفُ الْعُشْرِ ” .”যে জমি নদী-নালা ও বর্ষার পানিতে সিক্ত হয় তাতে ‘উশ্র (উৎপাদিত শস্যের দশ ভাগের এক ভাগ যাকাত ) ধার্য হয়। আর যে জমিতে উটের সাহায্যে পানি সরবরাহ করা হয় তাতে অর্ধেক ‘উশ্র (বিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত ) ধার্য হবে।(সহিহ মুসলিম হা/২১৬২; ই.ফা. ২১৪১, ই.সে. ২১৪৪) অপর এক বর্ণনায় মু‘আয ইবনু জাবাল (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন,بَعَثَنِي رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم إِلَى الْيَمَنِ وَأَمَرَنِي أَنْ آخُذَ مِمَّا سَقَتْ السَّمَاءُ وَمَا سُقِيَ بَعْلًا الْعُشْرَ وَمَا سُقِيَ بِالدَّوَالِي نِصْفَ الْعُشْرِ”রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে ইয়ামনে পাঠান এবং নির্দেশ দেন যে, আমি যেন বৃষ্টি এবং ঝর্ণার পানির সাহায্যে উৎপন্ন ফসলে উশর (এক-দশমাংশ) এবং সেচ ব্যবস্থার মাধ্যমে সিক্ত যমীনের ফসলের অর্ধ-উশর যাকাত হিসেবে গ্রহণ করি।(মুসনাদে আহমাদ হা/ ২১৫৩২, নাসায়ী হা/ ২৪৯০; সুনানে দারেমী হা/ ১৬৬৭ সনদ সহীহ)
.
▪️বৃষ্টির পানি ও কৃত্রিম সেচ উভয় মাধ্যমে উৎপাদিত শস্যের যাকাতের পরিমাণ কী:
.
যে শস্য শুধুমাত্র বৃষ্টির পানি অথবা শুধুমাত্র কৃত্রিম সেচের মাধ্যমে উৎপন্ন হয় না। বরং কিছু অংশ বৃষ্টির পানিতে এবং কিছু অংশ কৃত্রিম সেচের মাধ্যমে উৎপন্ন হয়, সে শস্যের যাকাত বের করার নিয়ম হল, যদি বৃষ্টির পানির পরিমাণ বেশী হয় তাহলে العشر অর্থাৎ দশ ভাগের এক ভাগ যাকাত দিতে হবে। আর কৃত্রিম সেচের পরিমাণ বেশী হলে نصف العشر অর্থাৎ বিশ ভাগের এক ভাগ যাকাত দিতে হবে। আর যাদি অর্ধাংশ বৃষ্টির পানিতে এবং অর্ধাংশ কৃত্রিম সেচের মাধ্যমে উৎপন্ন হয় তাহলে ثلاثة أرباع العشر অর্থাৎ দশ ভাগের তিন-চতুর্থাংশ যাকাত দিতে হবে। অর্থাৎ কারো ২০ মণ ধান উৎপন্ন হওয়ার জন্য বৃষ্টির পানির পরিমাণ বেশী হলে তার দশ ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ দুই মণ যাকাত দিতে হবে। আর কৃত্রিম সেচের পরিমাণ বেশী হলে বিশ ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ এক মণ যাকাত দিতে হবে। আর অর্ধাংশ বৃষ্টির পানি ও অর্ধাংশ নিজের সেচের মাধ্যমে উৎপন্ন হলে তার দশ ভাগের তিন-চতুর্থাংশ অর্থাৎ এক মণ বিশ কেজি যাকাত দিতে হবে। ইবনু কুদামা (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, এ ব্যাপারে ওলামায়ে কেরামের মধ্যে কোন মতভেদ আছে বলে আমার জানা নেই।[ইবনু কুদামা, শারহুল কাবীর; খন্ড; ১; পৃষ্ঠা: ৫৬৩; ফাতাওয়া লাজনাহ দায়েমাহ; খন্ড; ৯ পৃষ্ঠা; ১৭৬)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেন:
قوله: ( وثلاثة أرباعه بهما ) أي: ما يشرب بمؤونة، وبغير مؤونة نصفين، يجب فيه ثلاثة أرباع العشر.
مثال ذلك: هذا النخل يسقى نصف العام بمؤونة، ونصف العام بغير مؤونة: أي في الصيف يسقى بمؤونة، وفي الشتاء يشرب من الأمطار، ففيه ثلاثة أرباع العشر.
قوله: (فإن تفاوتا) بمعنى أننا لم نتمكن من الضبط، هل هو النصف، أو أقل، أو أكثر.
قوله: “فبأكثرهما نفعاً” أي: الذي يكثر نفع النخل، أو الشجر، أو الزرع به فهو المعتبر، فإذا كان نموه بمؤونة ، أكثر منه فيما إذا شرب بلا مؤونة ، فالمعتبر نصف العشر؛ لأن سقيه بالمؤونة أكثر نفعاً فاعتبر به.
فصارت الأحوال أربعا هي:
1 ـ ما سقي بمؤونة خالصة.
2 ـ وبلا مؤونة خالصة.
3 ـ وبمؤونة وغيرها على النصف.
4 ـ وبمؤونة وغيرها مع الاختلاف.
فإن كان يسقى بمؤونة خالصة فنصف العشر ، وبلا مؤونة خالصة العشر، وبهما ، نصفين : ثلاثة أرباع العشر، ومع التفاوت يعتبر الأكثر نفعاً.
قوله: ” ومع الجهل العشر” أي: إذا تفاوتا، وجهلنا أيهما أكثر نفعاً، فالمعتبر العشر؛ لأنه أحوط وأبرأ للذمة، وما كان أحوط فهو أولى ”
“যদি ফসল যদি সেচের মাধ্যমে এবং সেচ ছাড়াই উৎপাদিত হয় অর্থাৎ অর্ধেক বছর শেষ দিয়ে আর অর্ধেক বছর শেষ ছাড়াই উৎপাদিত হয় তাহলে দশ ভাগের তিন-চতুর্থাংশ (দশ ভাগের এক ভাগ করে সেই এক ভাগকে চার ভাগ করে তিন ভাগ) যাকাত বের করতে হবে।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়: খেজুর ছয় মাস শেষ দেওয়া হয়েছে আর ছয় মাসের ছাড়াই উৎপাদন করা হয়েছে অর্থাৎ শীতকালে ৬ মাস সে ছাড়াই আর গ্রীষ্মকালে ছয় মাস সেচ দিয়ে উৎপাদন করা হয়েছে তাহলে তার জন্য দশ ভাগের তিন-চতুর্থাংশ ( দশ ভাগের এক ভাগ করে সেই এক ভাগকে চার ভাগ করে তিন ভাগ ) যাকাত বের করতে হবে। তাঁর কথা: “যদি পার্থক্য করা না যায়” অর্থাৎ অর্ধেক নাকি কম নাকি বেশি সেচ দেওয়া হয়েছে এর পরিমাণ যদি না জানা যায় । তার কথা ” যেটা বেশি উপকার হবে” খেজুরের গাছ কিংবা অন্য ফসলে যেটা বেশি উপকার হবে সেটাকে গণ্য করতে হবে। যখন পানি ছাড়াই একটি ফসল যে পরিমাণ উৎপাদন হতো , পানি অর্থাৎ সেচ দিয়ে যদি দেখা যায় ফসলের উৎপাদন বেশি হয়েছে, তাহলে নিসফে ওশর (বিশ ভাগের এক ভাগ) যাকাত বের করতে হবে।
তাহলে বুঝা গেল এখানে চারটি অবস্থা হতে পারে:
(১)। সম্পূর্ণ সেচের মাধ্যমে ফসল উৎপাদন করা।
(২)। সম্পূর্ণ সেচ ছাড়াই ফসল উৎপাদন করা।
(৩)। অর্ধেক সেচ দিয়ে আর অর্ধেক সেচ ছাড়াই ফসল উৎপাদন করা।
(৪)। সেচ দিয়ে বা সেচ ছাড়াই এবং অন্যান্য জিনিসের সাথে মিশ্রিত হয়ে ফসল উৎপাদন করা।
যদি সম্পূর্ণ সেচ দ্বারা হয় তাহলে নিসফে ওশর, আর যদি সেচ ছাড়াই হয় তাহলে ওশর, আর যদি সেচ ছাড়া এবং সেচ দিয়ে উৎপাদন করা হয় , তাহলে দশ ভাগের তিন-চতুর্থাংশ ( দশ ভাগের এক ভাগ করে সেই এক ভাগকে চার ভাগ করে তিন ভাগ) এছাড়াও অন্যান্য ক্ষেত্রে উপকারের দিকটা লক্ষ্য রাখবে সে দিকে লক্ষ্য করে যাকাত বের করতে হবে। যদি ভুলে যাই অর্থাৎ পার্থক্য করা না যায় তাহলে ওশর, কেননা এটা হল জিম্মা থেকে মুক্ত হওয়ার বড় মাধ্যম। আর জিম্মা থেকে মুক্ত হওয়াটাই উত্তম।(উসামীন আশ-শারহুল মুমতি‘ খন্ড: ৬ পৃষ্ঠা: ৭৮)
.
▪️শস্যদানা ও ফলফলাদির যাকাত কখন আদায় করা ফরজ এবং কার পক্ষ থেকে পরিশোধ করতে হবে?
.
ফল ও ফসলের যাকাত দেওয়ার সময় সম্পর্কে বিভিন্ন মাযহাবের ফকিহগণের মতামত থাকলেও বিশুদ্ধ মত হচ্ছে, ফল যখন ব্যবহার উপযোগী হয় ও পেকে যায়, যেমন ফলের আঁটি শক্ত বা খেজুর লাল হয়, তখন তার ওপর যাকাত ওয়াজিব হয়, তবে যখন ফসল খোসা থেকে পরিস্কার করবে বা তাতে মেশিন লাগাবে, তখন আদায় করবে, অনুরূপ খেজুর শুকানোর পর তার যাকাত দিবে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَآتُوْا حَقَّهُ يَوْمَ حَصَادِهِ ‘ফসল তুলবার দিনে তার হক (যাকাত) প্রদান করবে।’(সূরা আন‘আম; ৬/১৪১)। উল্লেখ্য যে, ফসল নিসাব পরিমাণ হওয়ার পর মালিক যেভাবে ইচ্ছা তাতে কর্তৃত্ব করতে পারবে, যেমন বিক্রি ও হেবা করা ইত্যাদি। যদি ফল উপযুক্ত হওয়ার পর মালিক সেখান থেকে বিক্রি বা কাউকে হেবা করে,সেক্ষেত্রে বিশুদ্ধ মতে সেই ফল/ফসলের যাকাত মালিকের ওপর ওয়াজিব হবে, অর্থাৎ বিক্রেতার ওপর। কারণ, যখন সে ফল/ফসলের মালিক ছিল,তখন যাকাত ওয়াজিব হয়েছে। অপরদিকে যদি ফল/ফসল উপযুক্ত হওয়ার পূর্বে মালিক বিক্রি করে দেয় কিংবা হেবা করে, অতঃপর ক্রেতা কিংবা দান গ্রহীতার কাছে/নিয়ন্ত্রণে ফল বা ফসল পরিপাক বা উপযুক্ত হয়,তাহলে ক্রেতা বা দান গ্রহীতার ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে, যদি যেটা নিসাব পরিমাণ হয়। জ্ঞাতব্য যে, মালিকের হস্তক্ষেপ বা সীমালঙ্ঘন ছাড়া যদি ফল বা ফসল ধ্বংস হয় কিংবা চুরি হয় তাহলে তাতে যাকাত ওয়াজিব হবে না। কিন্তু যদি যাকাত ওয়াজিব হওয়ার পর মালিক নিজে ধ্বংস করে,কিংবা সংরক্ষণের যথাস্থানে রাখার পরে মালিকের অলসতা বা অবহেলার কারণে নষ্ট হয় বা হারিয়ে যায় তাহলে তার উপর যাকাত ফরয।তা তার ওপর থেকে যাকাত মওকুফ হবে না।তবে যদি সে দাবি করে সীমালঙ্ঘন ছাড়া নষ্ট হয়েছে, বিশুদ্ধ মতে তার কথা গ্রহণযোগ্য হবে, কসম নেওয়ার প্রয়োজন নেই। ইমাম আহমদ বলেছেন: সদকার জন্য কসম গ্রহণ করা যাবে না।(বিস্তারিত জানতে দেখুন;উসাইমিন শারহুল মুমতে খন্ড: ৬ পৃষ্ঠা: ৮২) এই মর্মে কয়েকটি ফাতওয়া হচ্ছে,
.
ইমাম ইবনে জারির আত তাবারী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, বলেছেন:وَذَلِكَ أَنَّ الْجَمِيعَ مُجْمِعُونَ ، لَا خِلَافَ بَيْنَهُمْ : أَنَّ صَدَقَةَ الْحَرْثِ لَا تُؤْخَذُ إِلَّا بَعْدَ الدِّيَاسِ وَالتَّنْقِيَةِ وَالتَّذْرِيَةِ ، وَأَنَّ صَدَقَةَ التَّمْرِ لَا تُؤْخَذُ إِلَّا بَعْدَ الْجَفَافِ “সর্বসম্মতিক্রমে চাষ করা ফসলের ততক্ষণ পর্যন্ত যাকাত নেওয়া হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত সেটাকে খরকুটা পাথর মাটি কিংবা বিভিন্ন ময়লা থেকে পরিষ্কার না করবে আর খেজুর যতক্ষণ পর্যন্ত না শুকাবে ততক্ষণ পর্যন্ত যাকাত দেওয়া যাবে না। (জামেঊল বায়ান ফী তা’বিলীল কুরআন, ৯ম খণ্ড, পৃষ্ঠা:৬১১)
ইমাম ইবনু হাযম আন্দালুসী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন: ” وَلَا خِلَافَ بَيْنَ أَحَدٍ مِنْ الْأُمَّةِ : فِي أَنَّ الزَّكَاةَ لَا يَجُوزُ إيتَاؤُهَا يَوْمَ الْحَصَادِ ؛ لَكِنْ فِي الزَّرْعِ : بَعْدَ الْحَصَادِ وَالدَّرْسِ وَالذَّرْوِ وَالْكَيْلِ ، وَفِي الثِّمَارِ : بَعْدَ الْيُبْسِ وَالتَّصْفِيَةِ وَالْكَيْلِ”ফসল কাটার দিনে যাকাত দেওয়া জায়েয নয় এ ব্যাপারে উম্মাহর কারো মধ্যেই দ্বিমত নেই। তখনই যাকাত দিতে হবে যখন ফসল কাটার পর মাড়াই করবে, পরিমাপ করবে, ময়লা আবর্জনা থেকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করবে তারপরে যাকাত দিবে আর ফলের ক্ষেত্রে শুকানোর পরে পরিমাপ করে যাকাত বের করবে।(ইবনু হাযম; আল-মুহাল্লা বিল আছার, খন্ড; ৪; পৃষ্ঠা; ২০)
হাম্বলি মাযহাবের আলেম ‘বুহুতি’ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন:
وَيَجِبُ إخْرَاجُ زَكَاةِ الْحَبِّ : مُصَفًّى مِنْ قِشْرِهِ وَتِبْنِهِ ، وَالثَّمَر: يَابِسًا… وَلِأَنَّ ذَلِكَ حَالَةُ كَمَالِهِ، وَنِهَايَةُ صِفَاتِ ادِّخَارِهِ وَوَقْتُ لُزُومِ الْإِخْرَاجِ مِنْهُ ، فَلَوْ خَالَفَ وَأَخْرَجَ سُنْبُلًا وَرُطَبًا وَعِنَبًا : لَمْ يُجْزِئْهُ إخْرَاجُهُ”.
“শষ্যের যাকাত তখনই খরচ হবে যখন সেটাকে খোসা থেকে ছাড়িয়ে শুকিয়ে নিবে, আর ফলের যখন সেটা শুকনো হয়ে যাবে তখন যাকাত ফরজ হবে । কেননা এমন সময় সেটা স্বচ্ছ থাকে এবং পরিপূর্ণ খাবার উপযোগী হয় ফলে যখন কোন শস্য শিষে থাকে বা কাঁচা থাকে তখন সেটা যাকাত বের করা যাবে না কারণ সেটা খাবার উপযোগী নয়। (কাশশাফুল ক্বিনা’; খন্ড; ২ পৃষ্ঠা; ২১২) সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেছেন,
ويجب إخراج زكاة الحب: مصفى ، والثمر: يابسا”
“শষ্যের উপর তখনই যাকাত ফরজ হবে যখন সেটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হবে, আর ফল যখন সেটা শুকনো হয়ে যাবে।(ফাতাওয়ায়ে লাজনা দায়েমা; খন্ড; ৯ পৃষ্ঠা; ১৭৬)
.
ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেন:
” إذا اشتد الحب وبدا صلاح الثمر ، وجبت الزكاة ، وقبل ذلك لا تجب ، ويتفرع على هذا : أنه لو انتقل الملك قبل وجوب الزكاة ، فإنه لا تجب عليه بل تجب على من انتقلت إليه، كما لو مات المالك قبل وجوب الزكاة أي قبل اشتداد الحب ، أو بدو صلاح الثمر فإن الزكاة لا تجب عليه ، بل تجب على الوارث ، وكذلك لو باع النخيل ، وعليها ثمار لم يبد صلاحها ، أو باع الأرض ، وفيها زرع لم يشتد حبه ، فإن الزكاة على المشتري ؛ لأنه أخرجها من ملكه قبل وجوب الزكاة ”
“যখন শস্য পাকবে বা ফল পাকবে,তখন যাকাত ওয়াজিব হবে। আর এর পূর্বে ওয়াজিব হয় না। এর উপর ভিত্তি করে, যাকাত আদায় হওয়ার আগেই যদি মালিকানা একজনের কাছ থেকে অন্য ব্যক্তির কাছে হস্তান্তর করা হয়, তবে তা তার (মূল মালিক) পক্ষ থেকে আদায় করতে হবে না; বরং যার কাছে মালিকানা হস্তান্তর করা হয়েছিল তার উপরওয়াজিব হবে। যেমন যদি যাকাত আদায় হওয়ার আগে অথবা শস্য পেকে যাওয়ার আগে কিংবা ফল পেকে যাওয়ার আগেই মালিকের মৃত্যু হয়, তাহলে তার উপর যাকাত নেই, বরং যাকাত ফরজ হবে তার উত্তরসূরীর উপর। অনুরূপভাবে, যদি কোন ব্যক্তি এমন খেজুর গাছ বিক্রি করে যার উপর এমন ফল আছে যা এখনও পরিপক্ক দেখা যায় নি, অথবা সে এমন জমি বিক্রি করে যার উপর শস্য আছে,আর সে দানা এখনও পরিপাক হয়নি, তাহলে ক্রেতার উপর যাকাত ওয়াজিব হবে। কারণ যাকাত আদায় হওয়ার আগেই এটির মালিকানা (বিক্রেতার) নিকট থেকে (ক্রেতার নিকট) চলে গেছে”।(উসামীন আশ-শারহুল মুমতি‘ খন্ড: ৬ পৃষ্ঠা: ৮০)
.
মোটকথা কৃষি শস্যদানা ও ফলফলাদি যখন ফল চূড়ান্তভাবে পরিপক্ক হয়ে যাবে ফলে ক্রয়-বিক্রয় এবং খাবারের উপযোগী হয়ে যাবে ফলটি দেখতে লাল হয়ে যাবে এবং শক্তিশালী হয়ে যাবে এমন অবস্থায় যাকাত ফরজ হয়ে যাবে কেননা সেটা এখন পরিপূর্ণ ফল। হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন,وَوَقْتُ وُجُوبِ الزَّكَاةِ فِي الْحَبِّ : إذَا اشْتَدَّ ، وَفِي الثَّمَرَةِ : إذَا بَدَا صَلَاحُهَا “শস্যদানার ক্ষেত্রে যাকাত ওয়াজিব হওয়ার সময় হল, যখন তা পূর্ণ/শক্ত হয়ে যায় এবং ফসল/ফলফলাদির ক্ষেত্রে হলো, যখন তার পরিপক্কতা প্রকাশ পাবে।(ইবনু কুদামাহ,আল-মুগনী, খন্ড: ৪ পৃষ্ঠা: ১৬৯)।
▪️এক শস্য অন্য শস্যের নিছাব পূর্ণ করবে কি?
.
ধরুন একজন কৃষকের ১২ মণ ধান ও ১০ মণ গম উৎপন্ন হয়েছে এখন তিনি কি উভয় শস্য একত্রিত করে যাকাত আদায় করবে? নাকি পৃথকভাবে ধান এবং গম উভয়ের কোনটি নিছাব পরিমাণ না হওয়ায় যাকাত আদায় করা থেকে বিরত থাকবে? এ ব্যাপারে আমাদের সালাফগন কুরআন হাদীসের আলোকে গবেষণা করে বিশুদ্ধ মত হিসেবে বলেছেন, ধান,গম, যব, ভুট্টা ইত্যাদি প্রত্যেকটি পৃথক শস্য। অতএব শস্যগুলি পৃথকভাবে প্রত্যেকটি নিসাব পরিমাণ প্রায় ১৮:৩০ কেজি হলেই কেবল যাকাত ফরয হবে অন্যথা ফরয নয়।যেমন নিসাব পরিপূর্ণ করার জন্য গমের সাথে যবকে, খেজুরের সাথে কিসমিসকে, চালের সাথে গমকে মিলানো হবে না। যেহেতু জাত ভিন্ন। যেমনিভাবে গরুর সাথে উটকে কিংবা গানাম (ছাগল-ভেড়া)-কে মিলানো হয় না। কারণ জাত ভিন্ন।
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন,
” ولا يضم جنس إلى آخر ، فلو كان عند الإنسان مزرعة نصفها شعير ، ونصفها بر ، وكل واحد نصف النصاب ، فإنه لا يضم بعضه إلى بعض ؛ لاختلاف الجنس ، كما لا تضم البقر إلى الإبل أو الغنم ؛ لأن الجنس مختلف ”
“এক জাতকে অপর জাতের সাথে মিলানো হবে না। তাই যদি কোন ব্যক্তির একটি কৃষি খামার থাকে এবং এর অর্ধেকে যব হয় আর বাকী অর্ধেকে গম হয় এবং প্রত্যেক জাতের ফসল অর্ধেক নিসাব পর্যন্ত পৌঁছে সেক্ষেত্রে এক ফসলকে অপর ফসলের সাথে মিলানো হবে না। যেহেতু জাত ভিন্ন। যেমনিভাবে গরুকে উটের সাথে কিংবা গানাম (ছাগল-ভেড়া)-র সাথে মিলানো হয় না। যেহেতু জাত আলাদা।”(উসাইমীন,আল-শারহুল মুমতি” খন্ড; ৬ পৃষ্ঠা; ৭৩ থেকে পরিমার্জিতভাবে সমাপ্ত)
.
তবে একই শস্যের বিভিন্ন শ্রেণী একই নিছাবের অন্তর্ভুক্ত। যেমন: মিনিকেট, পারিজা, চায়না, স্বর্ণা সহ বিভিন্ন শ্রেণীর ধান একই নিছাবের অন্তর্ভুক্ত। একই ভাবে অন্যান্য শস্যা যেমন খেজুরের ক্ষেত্রে সুক্কারি খেজুরকে বারহি খেজুরের সাথে যোগ করা হবে। অনুরূপভাবে এক প্রকারের গমকে অপর প্রকারের গমের সাথে যুক্ত করা হবে। এক প্রকারের কিসমিসকে অপর প্রকারের কিসমিসের সাথে যুক্ত করা হবে। এভাবে অন্যান্য শস্য বা ফলের ক্ষেত্রেও।এক জাতীয় ফসলের এক প্রকারকে অপর প্রকারের সাথে মিলানোর প্রমাণ পাওয়া যায় আবু সাঈদ খুদরি (রাঃ) এর পূর্বোক্ত হাদিসের সার্বিকতা থেকে। তা এভাবে যে, যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহিস ওয়া সাল্লাম সাধারণভাবে খেজুরের উপর যাকাত ফরয করেছেন। এটি সুবিদিত যে, খেজুরের মধ্যে নানা প্রকারের খেজুর অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু তিনি এক প্রকারের খেজুরকে অপর প্রকার থেকে আলাদা করার নির্দেশ দেননি।
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেন:
: َلَا خِلَافَ بَيْنَهُمْ , فِي أَنَّ أَنْوَاعَ الْأَجْنَاسِ يُضَمُّ بَعْضُهَا إلَى بَعْضٍ فِي إكْمَالِ النِّصَابِ ”
“তাদের মধ্যে এ নিয়ে কোন মতভেদ নেই যে, নিসাব পরিপূর্ণ করার ক্ষেত্রে এক জাতের অন্তর্ভুক্ত সকল প্রকারের একটিকে অপরটির সাথে যোগ করতে হবে।”(ইবনু কুদামাহ, আল-মুগনী,খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ৩১৬)
.
ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন
” وتضم الأنواع بعضها إلى بعض ، فالسكري مثلاً يضم إلى البرحي ، وهكذا ، وكذلك في البر فالمعية ، واللقيمى ، والحنطة ، والجريبا ، يضم بعضها إلى بعض ”
“এক প্রকারকে অপর প্রকারের সাথে যোগ করতে হবে। উদারণতঃ সুক্কারি (খেজুর)-কে বারহি (খেজুর)-এর সাথে যুক্ত করতে হবে। অনুরূপভাবে গমের ক্ষেত্রে, মায়িয়্যা, লুক্বাইমী, হিনত্বা ও আল-জারিবার একটিকে অপরটির সাথে যুক্ত করতে হবে।”(আল-শারহুল মুমতি” খন্ড: ৬ পৃষ্ঠা: ৭৩)।
.
▪️জমি বর্গা বা ইজারা নিয়ে চাষ করলে সেই জমির ফসলের যাকাত আদায় করবে কে? যদি চাষী তথা ভাড়াটিয়াকে যাকাত আদায় করতে হয় তাহলে কি মোট আয়ের উপর যাকাত দিতে হবে নাকি যা খরচ হয়েছে সেটি বাদ দিয়ে যা অবশিষ্ট থাকে তার উপর?
.
প্রথমত: বর্গা কিংবা ইজারা (ভাড়া) নেওয়া যাকাত যোগ্য ফসলের যাকাত জমির মালিককে আদায় করতে হবে নাকি জমি ভাড়া নেওয়া ব্যক্তিকে; অর্থাৎ যে সেই জমি চাষ করে তাকে যাকাত আদায় করতে হবে এই বিষয়ে আহালুল আলেমগন ইখতেলাফ করেছেন। জমহুর ওলামাদের বিশুদ্ধ মতে, এক্ষেত্রে জমি চাষাবাদকারী ব্যক্তি তথা ফসলের মালিকের ওপর যাকাত ওয়াজিব হবে, চাষি জমির মালিক হোক বা বৈধ চুক্তিতে অপরের জমি চাষ করুক, যেমন ভাড়া বা হেবা অথবা অবৈধভাবে তাতে চাষ করুক যেমন জবরদখল। যদি জমির মালিক ও চাষির মাঝে চাষবাসের চুক্তি হয়, যেমন চুক্তি করল: জমির মালিক জমি দিবে, চাষি চাষ করার যাবতীয় খরচ বহন করবে, যেমন চাষ করা, পানি দেওয়া, কাঁটা ও সংগ্রহ করা ইত্যাদি, তারপর চুক্তি মোতাবেক উভয় ফসল ভাগ করবে। যদি বণ্টন শেষে দু’জনের অংশ যাকাতের নিসাব পরিমাণ তথা ১৮মণ ৩০ কেজি হলে নিয়ম অনুযায়ী নির্ধারিত হারে ওশর দিবে। কিন্তু যদি তা নিসাব পরিমাণ না হয় যাকাত ওয়াজিব হবে না,কারণ ফসলের যাকাতে যৌথ মালিকানার প্রভাব নেই, পশুর বিষয়টি ব্যতিক্রম, এটিই বিশুদ্ধ মত। যদিও হানাফী মাযহাব মত দিয়েছেন যে,জমির মালিকের উপর যাকাত দেওয়া ওয়াজিব। তবে এক্ষেত্রে জমহুর ওলামাদের মতামতই সঠিক।
.
ইমাম ইবনু হাযম আন্দালুসী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
ولا زكاة في تمر , ولا بر , ولا شعير : حتى يبلغ ما يصيبه المرء الواحد من الصنف الواحد منها خمسة أوسق ; والوسق ستون صاعا ; والصاع أربعة أمداد بمد النبي صلى الله عليه وسلم . والمد من رطل ونصف إلى رطل وربع على قدر رزانة المد وخفته , وسواء زرعه في أرض له أو في أرض لغيره بغصب أو بمعاملة جائزة , أو غير جائزة , إذا كان البذر غير مغصوب , سواء أرض خراج كانت أو أرض عشر .وهذا قول جمهور الناس , وبه يقول : مالك , والشافعي , وأحمد , وأبو سليمان .وقال أبو حنيفة : يزكى ما قل من ذلك وما كثر , فإن كان في أرض خراج فلا زكاة فيما أصيب فيها , فإن كانت الأرض مستأجرة فالزكاة على رب الأرض لا على الزارع
“খেজুর, গম বা যবের কোন যাকাত নেই। যতক্ষণ পর্যন্ত কোন ব্যক্তির উল্লেখিত ফসলগুলোর কোন এক প্রকারের নিসাবে অর্থাৎ পাঁচ ওয়াসাক্ব এ না পৌঁছবে। এক ওয়াসক্ব হল ষাট সা’ এবং এক সা’ হল চার মুদ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মুদ অনুযায়ী। সর্বনিম্ন মুদ হলো দেড় রিতল থেকে সোয়া এক রিতল পর্যন্ত। তা তার জমিনে চাষ করা হোক বা অন্যের জমিতে চাষ করা হোক, সেটা লেনাদেনা করা জায়েজ হোক বা নাজায়েজ হোক, তার ফসল হস্তান্তর না হলে সেটা করযোগ্য জমি হোক বা নিজস্ব জমি হোক, ওশর (এক দশমাংশ) দিতে হবে।এটি অধিকাংশ লোকের মত, মালিক,শাফিঈ, আহমদ ও আবু সুলায়মানেরও এমন মত। আবূ হানীফা (রহঃ) বলেনঃ তার যাকাত দিতে হবে, তা কম হোক বা বেশি হোক।ফলে যদি জমিটি খারাজ জমি (করযোগ্য জমি) হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়,তবে এর উৎপাদিত পণ্যের উপর যাকাত নেই।আর যদি জমি ভাড়া দেওয়া হয়, তাহলে যাকাত জমির মালিককে দিতে হবে, চাষাবাদকারীকে নয়।(ইবনু হাযম; আল-মুহাল্লা বিল আছার, খন্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৪৭) আর ইমামগণ হানাফীদের মতকে প্রত্যাখ্যান করেছেন এবং তারা ব্যাখ্যা করেন যে, হানাফীদের মতে যাকাত জমির উপর নয় বরং ফসলের উপর দিতে হবে।
ইবনে কুদামাহ মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেন:
ومن استأجر أرضا فزرعها , فالعشر عليه دون مالك الأرض ، وبهذا قال مالك , والثوري , وشريك , وابن المبارك , والشافعي , وابن المنذر .وقال أبو حنيفة : هو على مالك الأرض ; لأنه من مؤنتها , فأشبه الخراج .ولنا : أنه واجب في الزرع , فكان على مالكه , كزكاة القيمة فيما إذا أعده للتجارة , وكعشر زرعه في ملكه , ولا يصح قولهم : إنه من مؤنة الأرض ؛ لأنه لو كان من مؤنتها لوجب فيها وإن لم تزرع , كالخراج , ولوجب على الذمي كالخراج , ولتقدر بقدر الأرض لا بقدر الزرع , ولوجب صرفه إلى مصارف الفيء دون مصرف الزكاة .
“যদি কোন ব্যক্তি জমি ভাড়া নিয়ে চাষাবাদ করে তাহলে তাকে এক দশমাংশ ফসল যাকাত দিতে হবে। জমির মালিককে যাকাত আদায় করতে হবে না। এটি মালিক, সাওরী, শারীক, ইবনুল মুবারক, শাফেয়ী এবং ইবনুল মুনযির এর মত। আবূ হানীফা বলেন: (যাকাত) জমির মালিককে দিতে হবে। কারণ এটি জমির সরবরাহ,যোগান/রক্ষণাবেক্ষণ খরচের অংশ, তাই এটি খারাজ বা ট্যাক্সের মতো।আর আমাদের মত হল যে, এটি উৎপাদিত ফসলের ক্ষেত্রে ওয়াজিব, ফলে এটি তার মালিকের উপর আবশ্যক। যেমন ব্যবসার জন্য প্রস্তুতকৃত পণ্যের মূল্যের যাকাত এবং তার মালিকানাধীন পণ্যের এক দশমাংশ। আর তাদের কথা সঠিক নয় যে, অবশ্যই এটি জমির সরবরাহের অন্তর্ভুক্ত। কারণ তা যদি জমির সরবরাহের অন্তর্ভুক্ত হতো, তাহলে অবশ্যই সেক্ষেত্রে ওয়াজিব হয়ে যেত। যদিও তা চাষাবাদ না হয়। যেমন, ট্যাক্স। আর অবশ্যই যিম্মাদারি ব্যক্তির উপরও ওয়াজিব হতো। যেমন ট্যাক্স। আর অবশ্যই জমির পরিমাণ অনুসারে তা নির্ধারণ হতো, চাষাবাদ অনুসারে না। আর অবশ্যই তা ব্যয় করা ফাই’য়ের খাতের দিকে ওয়াজিব হয়ে যেত, জাকাতের খাতের দিকে না। (ইবনে কুদামাহ আল মুগনী, ২/৩১৩, ৩১৪ ) আর এটিই শায়খ ইবনে উসাইমিন প্রাধান্য দিয়েছেন।(আশ-শারহুল মুমতি-৬, ৮৮)।
.
দ্বিতীয়ত: শস্য উৎপাদনের ব্যয় সংক্রান্ত বিষয়ে বলবো, রাসূল (ﷺ) উৎপাদন খরচের দিকে লক্ষ্য রেখেই ফসলের যাকাতের পরিমাণ নির্ধারণ করেছেন। আর সেচ হচ্ছে উৎপাদনের প্রধান খরচ। তাই এর উপর ভিত্তি করে যাকাতের পরিমাণ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, বৃষ্টি ও ঝর্ণার পানি দ্বারা সিক্ত ভূমিতে উৎপাদিত ফসল বা নালার পানিতে উৎপন্ন ফসলের উপর ‘ওশর’ (দশ ভাগের এক ভাগ) যাকাত ওয়াজিব। আর সেচ দ্বারা উৎপাদিত ফসলের উপর ‘অর্ধ ওশর’ (বিশ ভাগের এক ভাগ) যাকাত ওয়াজিব’। অত্র হাদীছে বর্ণিত সেচ দ্বারা উদ্দেশ্য হল, উৎপাদন ব্যয়। কেননা সেচের মাধ্যমে মূলত উৎপাদন কম-বেশী হয় না; বরং খরচ কম-বেশী হয়। আর এই খরচের কম-বেশীর কারণে যাকাতের হারের কম-বেশী করা হয়েছে।পক্ষান্তরে সেচ ব্যতীত জমি চাষ করতে অন্যান্য যে অর্থ ব্যয় হয়, যেমন চাষ করা, ফসল কাটা, সংগ্রহ করা, মেশিন লাগানো, পানির কুপ খনন ও প্রণালি তৈরি করা ইত্যাদির কারণে উৎপাদন হার বৃদ্ধি পায়। এক্ষেত্রে কৃষক যা খরচ করেন তার বিনিময়ে অতিরিক্ত উৎপাদন লাভ করেন। অতএব এ ধরনের খরচ যাই হোক না কেন! তা বা দেওয়া যাবেনা বরং তা বাদ না দিয়ে উৎপাদিত পূর্ণ শস্যের যাকাত আদায় করতে হবে। এটাই জমহুর ওলামাদের বিশুদ্ধ মত, যেহেতু ফসলের উপর যাকাত ওয়াজিব, তাই তাকে পুরো ফসলের যাকাত দিতে হবে, যদি তা ন্যূনতম নিসাবে পৌঁছে যা পাঁচ ওয়াসাক: ওয়াসাক হল ষাট “সা”, যা প্রায় ৬৫৭ কিলোগ্রামের সমান। উল্লেখ্য যে হাম্ভলী মাজহাব তথা ইমাম আহমেদ মত অনুযায়ী শস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে যদি কেউ ঋণ করে থাকে, তাহলে শস্য কর্তনের পরে প্রথমে শস্য উৎপাদনের জন্য যে ঋণ নিয়েছে তা পরিশোধ করে অবশিষ্ট শস্যের যাকাত আদায় করতে পারে।ইবনু ওমর (রাঃ) বলেন,يَبْدَأُ بِمَا اسْتَقْرَضَ، ثُمَّ يُزَكِّيْ مَا بَقِيَ-‘প্রথমে যে ঋণ নিয়েছে তা পরিশোধ করবে। অতঃপর অবশিষ্টাংশের যাকাত আদায় করবে।(সুনানুল কুবরা লিল বায়হাক্বী হা/৭৩৯৭; সদন সহীহ, তাহক্বীক; আহমাদ শাকের, কিতাবুল খারাজ পৃষ্ঠা: ১৫৩) তবে জমহুর ওলামাদের বিশুদ্ধ মত হচ্ছে, সেচ ব্যতীত অন্যান্য অতিরিক্ত খরচ বাদ দেওয়া হবেনা। বরং পুরু ফসলের উপরই যাকাত আদায় করতে হবে যদি সেটা নিসাব পরিমাণ হয়।
.
ইমাম ইবনু হাযম আন্দালুসী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,
ولا يجوز أن يعد الذي له الزرع أو التمر ما أنفق في حرث أو حصاد , أو جمع , أو درس , أو تزبيل أو جداد أو حفر أو غير ذلك – : فيسقطه من الزكاة وسواء تداين في ذلك أو لم يتداين , أتت النفقة على جميع قيمة الزرع أو الثمر أو لم تأت , وهذا مكان قد اختلف السلف فيه … – وذكر الخلاف ثم قال : –
قال أبو محمد : أوجب رسول الله صلى الله عليه وسلم في التمر والبر والشعير : الزكاة جملة إذا بلغ الصنف منها خمسة أوسق فصاعدا ; ولم يسقط الزكاة عن ذلك بنفقة الزارع وصاحب النخل ; فلا يجوز إسقاط حق أوجبه الله تعالى بغير نص قرآن ولا سنة ثابتة ، وهذا قول مالك , والشافعي , وأبي حنيفة , وأصحابنا .
“যার ফসল বা খেজুর চাষ করতে গিয়ে ফসল কাটা, ফসল সংগ্রহ, মাড়াই, সার, খনন ইত্যাদি কাজে যা খরচ হয়েছে, তার জন্য ঋণ গ্রহণ করলো কি না করলো বা মোট খরচ কত করেছে তা বাদ দেয়া জায়েয নয়। ফসল চাষ করা বা খেজুর চাষ করার সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করেছে কি করেনি এটি এমন একটি বিষয় যা নিয়ে সালাফদের মাঝে এখতেলাফ রয়েছে…।তিনি ইখতেলাফ গুলো বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছেন, তারপর তিনি বলেেন; আবু মুহাম্মদ বলেছেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খেজুর, গম ও যবের মোট পরিমাণের যাকাত দেওয়া ওয়াজিব করেছেন,
যদি তা ন্যূনতম নেসাবে পৌঁছায়, আর নেসাব হলো পাঁচ ওয়াসাক বা তার চেয়ে বেশি।যা পাঁচ ওয়াসক বা আরো বেশি। আর খেজুর চাষী বা মালিকের খরচের কারণে যাকাত মওকুফ হয় না। আল্লাহ তায়ালা যা আবশ্যক করেছেন সেটা কোরআন এবং হাদিসের দলিল ছাড়া বাতিল করা জায়েজ নাই। এটি মালিক ,শাফীঈ , আবু হানিফা এবং আমাদের সংগীদের কথা।(ইবনু হাযম; আল-মুহাল্লা বিল আছার, খন্ড: ৪; পৃষ্ঠা:৬৬)
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] এবং আল-মাওসুআতুল ফিক্বহিয়্যাহ”গ্রন্থে এসেছে
ما ينفقه الزارع في تسوية الأرض أو تنظيفها : لا يؤثر في الزكاة، فيجب العشر أو نصفه ، كما سبق .إلا أن الحنابلة ذهبوا إلى أن النفقة على الزرع إن كانت دينا: يُسقطها مالكه منه قبل احتساب العشر .قال أحمد: من استدان ما أنفق على زرعه ، واستدان ما أنفق على أهله : احتسب ما أنفق على زرعه ، دون ما أنفق على أهله.
“জমি সমতল করা বা পরিষ্কার করার জন্য কৃষক যা খরচ করে, তাতে যাকাতের মাঝে প্রভাব ফেলবে না (সে ক্ষেত্রে যাকাতের মধ্যে থেকে সেগুলো কাটবে না)। হলে তার ওপর ওশর অথবা নিসফে ওশর আবশ্যক যেমনটি ইতিপূর্বে বলা হয়েছে। হাম্বলী মাযহাবের মতে, ফসলের খরচ যদি ঋণ হয়, তাহলে তার মালিক ওশর বের করার পূর্বে সে ঋণের খরচ বের করে নেবে। আহমাদ রহ. বলেন: যে ব্যক্তি ফসল চাষ করার জন্য ঋণ করেছে এবং পরিবারের প্রতি খরচ করার জন্যেও ঋণ করেছে, সে ব্যক্তি ফসল চাষ করার জন্য যতটুকু ঋণ করেছে ততটুকু পরিমাণ জমির ফসল থেকে কেটে নিবে (তারপর ফসলের যাকাত বের করবে) কিন্তু পরিবারের প্রতি খরচ করার জন্য যে ঋণ নেওয়া হয়েছিল সে ঋণের টাকা সেই ফসলের মধ্য থেকে কাটবে না”।(ইবনু কুদামাহ,আল-মুগনী: খন্ড: ৩,পৃষ্ঠা: ৩০ এবং আল-মাওসুআতুল ফিক্বহিয়্যাহ”খন্ড: ২৩ পৃষ্ঠা:২৮৮)
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল: আমার যায়তুন গাছের রোপনকৃত ক্ষেত রয়েছে।তাতে মূলত আসমানী পানি দ্বারা সেচ দেয়া হয়। আর এটি সর্বজনবিদিত যে, তার যাকাত একদশমাংশ। কিন্তু এই ক্ষেতে চাষাবাদ করতে গিয়ে ও সার প্রয়োগ করতে গিয়ে এবং তা হতে ফসল সংগ্রহের সময় পারিশ্রমিক হিসেবে যে সকল লোক খাটানো হয়, তার ব্যয় বহুল খরচ রয়েছে….। এমনকি কখনো কখনো উৎপাদন/উৎপন্নদ্রব্যের এক চতুর্থাংশ খরচ হয়ে যায়। ফলে উৎপাদন/উৎপন্নদ্রব্যের সমষ্টির উপর যাকাত দিতে হবে নাকি উৎপাদন করতে গিয়ে যে সকল খরচা রয়েছে; সেগুলো আলাদা হয়ে যাবে এবং বাকি উৎপন্নদ্রব্যের যাকাত দিতে হবে?
তারা উত্তর দিয়েছেন:
“في وجوب الزكاة للزيتون خلاف، والأحوط لك إخراج الزكاة عنه ، إذا بلغت الثمرة نصابا ، وهو خمسة أوسق، والوسق ستون صاعا بصاع النبي صلى الله عليه وسلم .ومقدار الزكاة عشر الثمرة .وأما التكاليف : فإنها لا تخصم من الثمرة ؛ بل يزكى جميع الثمرة.وبالله التووسلم وصلى الله على نبينا محمد وآله وصحبه وسلم.
“যাইতুনে যাকাত ওয়াজিব হওয়ার ক্ষেত্রে মতভেদপূর্ণ। তবে তোমার জন্য সতর্কতামূলক দিক হলো যে, তা হতে যাকাত বের করা। যখন তা নিসাব পরিমাণ হবে।আর তা হলো পাঁচ ওয়াসাক্ব এবং এক ওয়াসাক্ব সমান মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সা’ অনুযায়ী ষাট সা’। আর যাকাতের পরিমাপ হলো ফসলের একদশমাংশ। অতঃপর তা উৎপাদন করতে গিয়ে যে সকল খরচপাতি রয়েছে সেগুলো ফসল হতে আলাদা করা যাবে না। বরং সমস্ত ফসলের যাকাত দিতে হবে।ওয়া-বিল্লাহি আত-তাওফীক্ব। ওয়া সাল্লাল্লাহু আলা’ নিবিয়্যিনা মুহাম্মাদ ওয়া আ-লিহি ওয়া সাহবিহি ওয়া সাল্লাম। ফাতওয়া প্রদান করেছেন— স্থায়ী কমিটি ফাতাওয়া লাজনাহ দাইমাহ; খন্ড: ৮,পৃষ্ঠা: ৫১)
.
▪️জমির মালিক ফসল বিক্রি করার পর মূল্য দিয়ে শস্যার যাকাত আদায় করতে পারবে কি? অথবা বিক্রির পর যারা শরিক রয়েছে উৎপাদিত ফসলের শরিকানা স্বরূপ তাদেরকে মূল্য দিতে পারবে কি?
.
এ মাসালায় জমহুর আলেমদের মত হল উৎপাদিত ফসলের পরিবর্তে মূল্য দিয়ে যাকাত বের করা জায়েজ নেই তবে যদি শারঈ প্রয়োজন দেখা দেয় তাহলে অর্থ মূল্য দিয়ে যাকাত দেওয়া যাবে কোন সমস্যা নাই।
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন,
مذهبنا أنه لا يجوز إخراج القيمة في شيء من الزكوات ، وبه قال مالك وأحمد وداود إلا أن مالكاً جوز الدراهم عن الدنانير وعكسه وقال أبو حنيفة: يجوز, فإن لزمه شاة فأخرج عنها دراهم بقيمتها أو أخرج عنها ما له قيمة عنده كالكلب والثياب جاز…”
“আমাদের মাজহাব হল কোন কিছুর যাকাতের ক্ষেত্রে অর্থ দিয়ে যাকাত দেওয়া জায়েজ নাই। এমনটি মালিক, আহমাদ এবং আবু দাউদ বলেছেন। তবে মালেক রহিমাহুল্লাহ বলেন দিরহামের বিনিময়ে দিনার এবং দিনারের বিনিময়ে দিরহাম দেওয়া যাবে। ইমাম আবু হানিফা রহ বলেন: কারো নিকট যদি একটি ছাগল যাকাত ফরজ হয় আর তার বিনিময়ে সে যদি মূল্য দেয় তাহলে তার জন্য যাকাত হয়ে যাবে।(নববী; শারহুল মুহাজ্জাব; খন্ড: ৫ পৃষ্ঠা:৪০২) তিনি এটাও বলেছেন,قد ذكرنا أنه لا يجوز عندنا إخراج القيمة في الزكاة. قال أصحابنا: هذا إذا لم تكن ضرورة . . كمن وجب عليه شاة في خمس من الإبل, ففقد الشاة ولم يمكنه تحصيلها، فإنه يخرج قيمتها دراهم ويجزئه, كمن لزمه بنت مخاض, فلم يجدها, ولا ابن لبون لا في ماله ولا بالثمن , فإنه يعدل إلى القيمة..”আমরা ইতিপূর্বে উল্লেখ করেছি অর্থ দিয়ে যাকাত দেওয়া জায়েজ নাই আমাদের বন্ধুরা বলেছেন তবে এটা তখনই জায়েজ যদি কোন খুব প্রয়োজন হয়। যেমন কোন ব্যক্তির উপর পাঁচটি উটের কারণে একটি ছাগল যাকাত ফরজ হয় আর ছাগলটি যদি তার কাছে না থাকে তাহলে সে ছাগলের বিনিময়ে অর্থ দিয়ে যাকাত প্রদান করতে পারবে।(নববী; শারহুল মুহাজ্জাব; খন্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ৪০২)
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেন:
لله: ” يرى أكثر العلماء أنه لا يجوز إخراج القيمة إلا فيما نص عليه الشرع، وهو الجبران في زكاة الإبل “شاتان أو عشرون درهما”، والصحيح أنه يجوز إذا كان لمصلحة، أو حاجة، سواء في بهيمة الأنعام، أو في الخارج من الأرض ”
“অধিকাংশ আলেমদের কথা হল (ফসলের যাকাত) অর্থ দিয়ে যাকাত দেওয়া জায়েজ নাই তবে যে ক্ষেত্রে শরীয়ত অনুমোদন দিয়েছেন সেগুলো ব্যতীত যেমন উটের যাকাতের ক্ষেত্রে দুটি ছাগল এবং ২০ দিরহাম দেওয়ার অনুমোদন রয়েছে। এটা তখনই সহিহ হবে যখন মাসলাহাতের কারন হবে কিংবা প্রয়োজনের খাতিরে হবে তখন সেটা পশু ক্ষেত্রে হোক কিংবা জমিন থেকে ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে হোক”।(উসাইমীন; আশ শারহুল মুমতে;খন্ড: ৬; পৃষ্ঠা: ১৪৮)
.
▪️একই শস্যার দুইবার যাকাত আদায় করা:
এক ফসলে যখন একবার উশর তথা এক-দশমাংশ যাকাত ওয়াজিব হয়, সেই ফসলে দ্বিতীয়বার উশর ওয়াজিব হবে না, তার ওপর দিয়ে যত বছর অতিক্রম করুক, তার উদাহরণ: জনৈক চাষির এক বছর থেকেও অধিক সময় ধরে একটি ফসল আছে, যার যাকাত সে একবার দিয়েছে, কিন্তু তার নিসাব কমে নি, দ্বিতীয়বার এই ফসলে যাকাত ওয়াজিব হবে না, তবে ফসলের কোনো অংশ যদি ব্যবসার জন্য নির্ধারিত করে, সে অংশ ব্যবসায়ী পণ্যের অন্তর্ভুক্ত হবে। তার ওপর বছর পূর্ণ হলে ব্যবসায়ী পণ্য হিসেবে যাকাত দিবে, যেমন পূর্বে আলোচনা করেছি।
ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেন: “কাউকে বলা হল, এই ক্ষেতের ফসল তুলো, বিনিময়ে তুমি এক তৃতীয়াংশ নিবে, আর তোমার মালিক নিবে দুই-তৃতীয়াংশ। যদি এই শর্তে সে ফসল তোলে তার এক-তৃতীয়াংশে যাকাত ওয়াজিব হবে না, যদিও তা পাঁচ ওসাক অর্থাৎ নিসাব পরিমাণ হয়। কারণ, যখন যাকাত ওয়াজিব হয়েছে তখন সে ফসলের মালিক ছিল না, মালিক হয়েছে ফসল তোলার পর।(উসাইমীন; আশ শারহুল মুমতে; খন্ড: ৬ পৃষ্ঠা:৭৯)
▪️যে সকল শস্যার যাকাত আদায় করতে হবে না:
.
ফলমূল, শাক-সবজি,(আলু, পটল, টমেটো, শসা, পেয়াজ, রসুন, আপেল, কমলা, তরমুজ, মাছ ইত্যাদি ও জাতীয় ফসলের ওপর যাকাত ফরয নয়। কেননা ‘উমার রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেছেন, ‘শাক-সবজিতে যাকাত নেই’। তেমনি আলী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেছেন, ‘আপেল বা এ জাতীয় ফলের ওপর যাকাত ফরয নয়। তাছাড়া যেহেতু এগুলো (নিত্যপ্রয়োজনীয়) খাবার জাতীয় শস্য বা ফল নয়, তাই এর ওপর যাকাত নেই। তবে যদি এসবের ব্যবসা করা বা এসব টাকার বিনিময়ে বিক্রি করা হয় তাহলে মূল্যের ওপর নিসাব পূর্ণ হয়ে এক বছর অতিক্রান্ত হবার পর যাকাত ফরয হবে।(বিস্তারিত জানতে দেখুন: ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩৫৯৩) আমরা আল্লাহ্র কাছে দোয়া করছি তিনি যেন আমাদের জীবিকায় প্রশস্ততা দান করেন এবং আমাদের উত্তম রিযিক দান করেন। আমীন।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_________________________
আপনাদের দ্বীনি ভাই:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।