প্রশ্ন: কাদের ছিয়াম কবুল হয় না? তাদের মধ্যে কি এমন কেউ আছে যারা মানুষের উপকার করে খোটা দেয়, যারা ভ্রান্ত দলের অনুসারী, যারা কেবল রমজানে হিজাব পরে এবং যারা কেবল রমজানে সালাত আদায় করে?
▬▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬▬
প্রথমত: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর: ইসলামি শরিয়তে ইবাদতের গ্রহণযোগ্যতা দুইভাবে বিবেচিত হয়:
.
(১️). ইবাদত সহীহ (সঠিক) ভাবে সম্পন্ন হওয়া – অর্থাৎ ইবাদত যদি শারঈ বিধি-বিধান অনুযায়ী ঠিকঠাক আদায় হয়, তবে তা শুদ্ধ বলে গণ্য হবে এবং পুনরায় তা আদায় করতে বলা হবে না।
.
(২️). এবং সম্পাদিত ইবাদতটি কবুল হওয়ার অর্থ হচ্ছে ইবাদতকারী এর পুরষ্কার (সওয়াব) পাবে।
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, আবুল ফাদল আহমাদ বিন আলি ইবনু হাজার আল-আসকালানি,(রাহিমাহুল্লাহ) [জন্ম: ৭৭৩ হি: মৃত: ৮৫২ হি:] বলেন:”
وحقيقة القبول ثمرة وقوع الطّاعة مجزئة، رافعة لما في الذّمّة… وأمّا القبول المنفيّ في مثل قوله صلى الله عليه وسلم: ( مَنْ أَتَى عَرَّافًا لَمْ تُقْبَلْ لَهُ صَلَاةٌ ): فهو الحقيقيّ؛ لأنّه قد يصحّ العمل ويتخلّف القبول لمانع، ولهذا كان بعض السّلف يقول: لأن تقبل لي صلاة واحدة أحبّ إليّ من جميع الدّنيا، قاله ابن عمر. قال: لأنّ اللّه تعالى قال: { إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللَّهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ }
“(ইবাদত) কবুল হওয়ার প্রকৃত অর্থ হলো আনুগত্যের মাধ্যমে পরিপূর্ণ প্রতিদান লাভ করা এবং চাহিদা পূরণ হওয়া। ইবাদত কবুল না হওয়ার প্রমাণ হিসেবে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদিস রয়েছে: “যে ব্যক্তি গণকের কাছে যায়, তার সালাত কবুল হয় না,” এর মূল অর্থ হলো, আমলটি যদিও শরিয়তের দৃষ্টিতে বৈধ হতে পারে, তবুও কোনো বিশেষ বাঁধার (প্রতিবন্ধকতা) কারণে তা গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। এ কারণেই ইবনু উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু ও কিছু সালাফ বলতেন: “আমার একটি নামাজ কবুল হওয়া আমার কাছে সমগ্র পৃথিবীর চেয়েও বেশি প্রিয়।আল্লাহ তাআলা বলেন: “নিশ্চয়ই আল্লাহ কেবল মুত্তাকীদের আমল গ্রহণ করেন।” (সূরা মায়িদা: ২৭; ফাতহুল বারী ফী শারহিল বুখারী, খন্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২৩৪)
.
অতএব ইবাদত কবুলের অর্থ বলতে যদি রোযার শুদ্ধতা এবং পুনরায় আদায় করতে না হওয়ার বিষয়টি বোঝানো হয়, তবে এর মানদণ্ড হলো রোযাটি যথাযথ নিয়তে রাখতে হবে এবং রোযা ভঙ্গকারী কাজ যেমন: খাওয়া, পান করা ও সহবাস থেকে বিরত থাকতে হবে।আর ইবাদত কবুল হওয়া দ্বারা যদি সওয়াব প্রাপ্তির অর্থ বোঝানো হয়, তাহলে রোযাকে কুরআন সুন্নাহ’র আলোকে যথাযথভাবে পালন করা জরুরি, কারণ এটি সওয়াব অর্জনের মাধ্যম। যেমন;ইবনু দাকীক আল-ঈদ (রহিমাহুল্লাহ) বলেন:القواعد الشرعية تقتضي: أن العبادة إذا أتي بها مطابقة للأمر، كانت سببا للثواب والدرجات والإجزاء.والظواهر في ذلك لا تنحصر”শরয়ী মূলনীতি অনুযায়ী, যদি কোন ইবাদত (আল্লাহর) আদেশ অনুসারে সম্পাদিত হয়, তাহলে তা পুরস্কার, মর্যাদা এবং প্রতিদানের কারণ হবে। এর দৃষ্টান্ত অনেক যা সীমাবদ্ধ নয়”।(ইহকামুল আহকাম; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ১৪)
.
দ্বিতীয়ত: সওয়াব অর্জনের জন্য শর্ত হলো: রোজাদারকে তার রোজার সময় পাপ (গুনাহ) এবং বিদআত থেকে বিরত থাকতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন:”নিশ্চয়ই আল্লাহ শুধু মুত্তাকীদের (পরহেজগারদের) পক্ষ থেকেই গ্রহণ করেন।”(সূরা মায়েদা: ২৭) উক্ত আয়াতের তাফসিরে ইমাম ইবনু কাসীর (রাহিমাহুল্লাহ) [জন্ম:৭০১ মৃত: ৭৭৪ হি.] বলেছেনومعنى قوله: رضي الله عنه أنه قال : لأن أستيقن أن الله قد تقبل مني صلاة واحدة أحب إلي من الدنيا وما فيها، إن الله يقول: ( إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ اللَّهُ مِنَ الْمُتَّقِينَ ).”
“তাঁর এই কথার অর্থ: (আল্লাহ কেবল সৎকর্মশীলদের কাছ থেকে কবুল করেন) হল: যারা আল্লাহকে তার কর্মে ভয় করে। তারপর তিনি আবু আল-দারদা (রহঃ) থেকে উল্লেখ করেন যে, তিনি বলেছেন: “আল্লাহ আমার এক ওয়াক্ত সলাত কবুল করেছেন বলে নিশ্চিত হওয়ার বিষয়টি আমার কাছে পৃথিবী এবং এর মধ্যে থাকা সবকিছুর চেয়েও বেশি প্রিয়, কারণ আল্লাহ বলেন: (আল্লাহ কেবল তাদের কাছ থেকে কবুল করেন যারা তাঁকে ভয় করে)।”(তাফসির ইবনে কাসির: খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা:৮৫)
.
যে রোজাদার পানাহার থেকে বিরত থাকে এবং তারপর শরীয়তের বিধান লঙ্ঘনে লিপ্ত হয়, সে সওয়াব পাওয়ার মতো প্রকৃত রোজা পালন করেনি। যেমন আবূ হুরাইরাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالْعَمَلَ بِهِ فَلَيْسَ للهِ حَاجَةٌ فِي أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ “যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলা ও সে অনুযায়ী কাজ করা পরিত্যাগ করেনি, তার খাবার ও পানীয় ত্যাগ করার (রোযা রাখার) কোনো প্রয়োজন আল্লাহর কাছে নেই।”(সহীহ বুখারী হা/১৯০৩) অপর বর্ননায় ইমাম ইবনে খুযায়মাহ তার সহীহ ইবনে খুযায়মাহ খণ্ড: ৩; পৃষ্ঠা: ২৪২ এ একটি অধ্যায়ের শিরোনাম দিয়েছেন:بَاب نَفْيِ ثَوَابِ الصَّوْمِ عَنِ الْمُمْسِكِ عَنِ الطَّعَامِ وَالشَّرَابِ، مَعَ ارْتِكَابِهِ مَا زُجِرَ عَنْهُ غَيْر الْأَكْلِ وَالشُّرْبِ””সিয়ামের সওয়াব সেই ব্যক্তির জন্য নেই, যে কেবলমাত্র খাবার ও পানীয় থেকে বিরত থাকে, কিন্তু অন্যান্য নিষিদ্ধ কাজ করে।” অতঃপর তিনি আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসটি উল্লেখ করেছেন:رُبَّ صَائِمٍ حَظُّهُ مِنْ صِيَامِهِ الْجُوعُ وَالْعَطَشُ، وَرُبَّ قَائِمٍ حَظُّهُ مِنْ قِيَامِهِ السَّهَرُ”অনেক রোযাদার আছে, যার একমাত্র প্রাপ্তি ক্ষুধা ও তৃষ্ণা। এবং অনেক কিয়ামকারী (তারাবিহ বা তাহাজ্জুদ পড়া ব্যক্তি) আছে, যার একমাত্র প্রাপ্তি রাত জাগা।” (মুসনাদে আহমাদ; খণ্ড: ১৪; পৃষ্ঠা: ৪৪৫ সনদ বিশুদ্ধ)
.
গুনাহ রোজার বরকত ও পূর্ণতা হ্রাস করে: গুনাহ রোজার সওয়াব কমিয়ে দেয় এবং যদি তা বেড়ে যায়, তবে তা সম্পূর্ণরূপে নষ্ট করে দিতে পারে। সাহাবায়ে কেরাম ও সালাফে সালেহীন তাঁদের রোজাকে আত্মশুদ্ধির মাধ্যম বানানোর জন্য এবং গুনাহ থেকে মুক্ত থাকার জন্য বিশেষ যত্নবান ছিলেন। প্রখ্যাত সাহাবী ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) [মৃত: ২৩ হি.] বলেন,ليس الصيام من الشراب والطعام وحده ، ولكنه من الكذب والباطل واللغو .””রোযা কেবল পানাহার থেকে বিরত থাকার নাম নয়, বরং মিথ্যা, বাতিল এবং অনর্থক কথা থেকে বিরত থাকাও রোযার অন্তর্ভুক্ত।” অপর বর্ননায় জাবির ইবনু আবদুল্লাহ (রা.) বলেন:إذا صمتَ فليصم سمعك وبصرك ولسانك عن الكذب ، والمأثم ، ودع أذى الخادم ، وليكن عليك وقار وسكينة يوم صومك ، ولا تجعل يوم فطرك ويوم صومك سواء .ذكر ذلك وغيره من الآثار:””যখন তুমি রোযা রাখো, তখন তোমার কান, চক্ষু ও জিহ্বা যেন মিথ্যা ও গুনাহ থেকে বিরত থাকে। তোমার দাস-খাদেমের প্রতি কষ্টকর আচরণ করো না। রোযার দিন তুমি শান্ত ও স্থির থাকো। তোমার রোযার দিন ও ইফতারের দিন যেন একই রকম না হয়।”(ইবন হাযম, আল মুহাল্লা; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৩০৮)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:
أما الذي يجب عنه الصوم : فلعلكم تستغربون إذا قلت : إن الذي يجب عنه الصوم هو: المعاصي , يجب أن يصوم الإنسان عن المعاصي ؛ لأن هذا هو المقصود الأول في الصوم ؛ لقول الله تبارك وتعالى : ( يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ ) البقرة/183 ، لم يقل : لعلكم تجوعون ! أو لعلكم تعطشون ! أو لعلكم تمسكون عن الأهل ! لا ، قال : ( لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ ) , هذا هو المقصود الأول من الصوم , وحقَّق النبي صلى الله عليه وسلم ذلك وأكده بقوله : (من لم يدع قول الزور والعمل به والجهل فليس لله حاجة في أن يدع طعامه وشرابه ) إذاً أن يصوم الإنسان عن معاصي الله عز وجل , هذا هو الصوم الحقيقي ، أما الصوم الظاهري : فهو الصيام عن المفطرات , الإمساك عن المفطرات تعبداً لله عز وجل من طلوع الفجر إلى غروب الشمس ؛ لقوله تعالى : ( فَالْآنَ بَاشِرُوهُنَّ وَابْتَغُوا مَا كَتَبَ اللَّهُ لَكُمْ وَكُلُوا وَاشْرَبُوا حَتَّى يَتَبَيَّنَ لَكُمُ الْخَيْطُ الْأَبْيَضُ مِنَ الْخَيْطِ الْأَسْوَدِ مِنَ الْفَجْرِ ثُمَّ أَتِمُّوا الصِّيَامَ إِلَى اللَّيْلِ ) البقرة/187 ، هذا صوم نسميه الصوم الظاهري، صوم البدن فقط , أما صوم القلب الذي هو المقصود الأول : فهو الصوم عن معاصي الله عز وجل .وعلى هذا : فمن صام صوماً ظاهريّاً جسديّاً ، ولكنه لم يصم صوماً قلبيّاً : فإنَّ صومه ناقص جدّاً جدّاً , لا نقول : إنه باطل ، لكن نقول : إنه ناقص , كما نقول في الصلاة , المقصود من الصلاة الخشوع والتذلل لله عز وجل , وصلاة القلب قبل صلاة الجوارح , لكن لو أن الإنسان صلّى بجوارحه ولم يصلِ بقلبه ، كأن يكون قلبه في كل وادٍ : فصلاته ناقصة جدّاً , لكنها مجزئة حسب الظاهر ، مجزئة لكنها ناقصة جدّاً , كذلك الصوم ناقص جدّاً إذا لم يصم الإنسان عن معصية الله , لكنه مجزئ ؛ لأن العبادات في الدنيا إنما تكون على الظاهر”
“যে জিনিস থেকে রোযা রাখা আবশ্যক, তা সম্পর্কে বলতে গেলে হয়তো তোমরা বিস্মিত হবে। সুতরাং আমি বলি: যে জিনিস থেকে রোযা রাখা আবশ্যক, তা হলো—গুনাহ (পাপসমূহ)। একজন ব্যক্তির অবশ্যই পাপ কাজ থেকে বিরত থাকা উচিত, কারণ এটিই রোযার প্রধান উদ্দেশ্য। আল্লাহ তাআলা বলেছেন: ‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোযা ফরজ করা হয়েছে, যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ (সূরা আল-বাকারা: ১৮৩) আল্লাহ বলেননি: ‘যেন তোমরা ক্ষুধার্ত হও’, বা ‘যেন তোমরা তৃষ্ণার্ত হও’, বা ‘যেন তোমরা পরিবার থেকে বিরত থাকো’। বরং তিনি বলেছেন: ‘যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।’ এটিই রোযার মূল উদ্দেশ্য। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এটিকে আরও সুস্পষ্ট করেছেন ও নিশ্চিত করেছেন এই বাণীর মাধ্যমে‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা বলা ও সে অনুযায়ী কাজ করা এবং অজ্ঞতাপূর্ণ কাজ পরিত্যাগ করে না, তাহলে তার খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দেওয়ার প্রতি আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।অতএব, একজন মানুষ যদি আল্লাহর অবাধ্যতা থেকে রোযা রাখে, সেটিই প্রকৃত রোযা। আর বাহ্যিক রোযা হলো—সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও অন্যান্য ক্ষুধা নষ্টকারী বস্তু থেকে বিরত থাকা। আল্লাহ তাআলা বলেন: ‘অতএব, এখন তোমরা তাদের (স্ত্রীদের) সাথে সহবাস কর এবং আল্লাহ তোমাদের জন্য যা লিখে দিয়েছেন তা কামনা কর। এবং পানাহার কর, যতক্ষণ না সুবহে সাদিকের শ্বেত রেখা কৃষ্ণ রেখা থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়। অতঃপর রাত পর্যন্ত রোযা পূর্ণ কর।’ (সূরা আল-বাকারা: ১৮৭) এটাকে বাহ্যিক রোযা বলা হয়, যা কেবল দেহের রোযা। কিন্তু অন্তরের রোযা, যা মূল উদ্দেশ্য, তা হলো আল্লাহর অবাধ্যতা থেকে বিরত থাকা। সুতরাং, যদি কেউ বাহ্যিকভাবে দেহের রোযা রাখে, কিন্তু অন্তরের রোযা না রাখে, তাহলে তার রোযা অত্যন্ত দুর্বল (অসম্পূর্ণ) হবে। আমরা এটিকে বাতিল বলি না, তবে বলি এটি অত্যন্ত দুর্বল যেমন সালাতের মূল উদ্দেশ্য হলো খুশু ও আল্লাহর সামনে বিনয় প্রকাশ করা। অন্তরের সালাত আগে আসে, তারপর দেহের সালাত। কিন্তু যদি কেউ কেবল দেহ দিয়ে সালাত আদায় করে, অথচ তার মন অন্য দিকে ব্যস্ত থাকে, তাহলে তার সালাতও দুর্বল হয়ে যাবে। তবে বাহ্যিকভাবে তা গ্রহণযোগ্য হবে, যদিও তা অসম্পূর্ণ। একইভাবে, যদি কেউ আল্লাহর অবাধ্যতা থেকে বিরত না থেকে শুধু বাহ্যিকভাবে রোযা রাখে, তবে তার রোযা দুর্বল হলেও তা গণ্য হবে, কারণ ইবাদতগুলো দুনিয়াতে বাহ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী বিবেচিত হয়।”(ইবনু উসামীন লিক্বাউল বাব আল-মাফতূহ, লিক্বা নং-১১৬/১)
.
তৃতীয়ত: সিয়াম কবুল হওয়ার কারণগুলির মধ্যে একটি হলো, রোজাদার ব্যক্তি রোজা রাখবে আল্লাহর কাছ থেকে সওয়াব পাওয়ার আশায়, এ ক্ষেত্রে প্রবল আগ্রহ থাকবে এবং তার ছিয়াম যেন না হয় মানুষের অনুকরণ করে বা তাদের থেকে লজ্জা পেয়ে। অতএব; যে ব্যক্তি অভ্যাস হিসেবে ছিয়াম রাখে, ইবাদত হিসেবে নয়, সে আসলে ছিয়াম রাখেনি। একই কথা প্রযোজ্য হবে তাদের ক্ষেত্রে যারা শুধু রমজানে সালাত পড়ে, হিজাব পরে, অথবা আল্লাহর আনুগত্য করে, তারপর রমজানের পরে আবার অবাধ্যতা ও অশ্লীলতার দিকে ফিরে যায়। সে কিছু সময়ে আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদত করে আর মনে মনে ভাবে যে হয়তো আল্লাহ তাআলা তাকে তার দয়ার বিনিময়ে পাকড়াও করবে না ফলে সে ফরজ কাজগুলো পরিত্যাগ করে এবং হারাম কাজে লিপ্ত হয়ে যায় যার ফলে সে মহাবিপদে পতিত হয়। তার দুর্বলতা হলো এমন একটি পাপ যার জন্য খারাপ পরিণতির ভয় থাকা আবশ্যক। আল্লাহ তাআলা আমাদের ক্ষমা করুন। আর যে ব্যক্তি ফযীলতপূর্ণ ও নফল কাজে অলস থাকে, অথচ ফরজ ও ওয়াজিব কাজগুলো পালন করে, বড় পাপ ও হারাম কাজগুলো এড়িয়ে চলে, কিন্তু জ্ঞান অর্জনে, রাতে সালাতে, অথবা কুরআন তেলাওয়াতে তার সময় কম থাকে, তাহলে আশা করা যায় যে, এ ধরনের পরিস্থিতি অস্থায়ী হবে, নির্দিষ্ট কিছু সময় যন্ত্রণা ভোগ করবে যা অল্প সময়ের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ কিন্তু এগুলো নিরময়ের ক্ষেত্রে কিছু বিচক্ষণ নিয়ম-নীতি প্রয়োজন। এমন অর্থে একটি হাদিস রয়েছে: আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত, আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, প্রত্যেক কর্মের উদ্যম আছে এবং প্রত্যেক উদ্যমের আছে নিরুদ্যমতা। সুতরাং যার নিরুদ্যমতা আমার সুন্নাহর গণ্ডির ভিতরেই থাকে, সে হেদায়াতপ্রাপ্ত হয় এবং যার নিরুদ্যমতা এ ছাড়া অন্য কিছুতে (সুন্নত বর্জনে) অতিক্রম করে, সে ধ্বংস হয়ে যায়।(মুসনাদে আহমাদ; ২/১৬৫, সিলসীলাতুস সহীহাহ হা/ ২৮৫০) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কথা: (فَلِأُمٍّ مَا هُوَ) অর্থাৎ তিনি তার জন্য একটি মহান উৎসে (সুন্নাহতে) ফিরে এসেছিলেন অথবা তিনি যতক্ষণ কোরআন ও সুন্নাহকে আঁকড়ে ধরে সরল পথে ছিলেন। অন্য বর্ণনায় রয়েছে (তারপর সে সফল হলো)।
.
জেনে রাখা ভাল যে, সালাত ত্যাগকারীর যাকাত, রোজা, হজ্জ ইত্যাদি কোনো আমলই কবুল হয় না। ইমাম বুখারী বুরাইদা (রাঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:( مَنْ تَرَكَ صَلاةَ الْعَصْرِ فَقَدْ حَبِطَ عَمَلُهُ )“যে ব্যক্তি আসরের সালাত ত্যাগ করে তার আমল নিষ্ফল হয়ে যায়।”(সহীহ বুখারী হা/৫২০) এখানে “তার আমল নিষ্ফল হয়ে যায়” এর অর্থ হল: তা বাতিল হয়ে যায় এবং তা তার কোনো কাজে আসবে না। এ হাদিস প্রমাণ করে যে, বেনামাযীর কোনো আমল আল্লাহ কবুল করেন না এবং সালাতে ত্যাগকারী তার আমল দ্বারা কোন ভাবে উপকৃত হবে না। তার কোনো আমল আল্লাহর কাছে উত্তোলন করা হবে না। ইবনুল কায়্যিম তাঁর ‘আস-স্বালাত’ নামক গ্রন্থে এ হাদিসের মর্মার্থ আলোচনা করতে গিয়ে বলেন – “এ হাদিস থেকে বোঝা যায় যে, সালাত ত্যাগ করা দুই প্রকার: (১) পুরোপুরিভাবে ত্যাগ করা। কোন সালাতই না-পড়া। এ ব্যক্তির সমস্ত আমল বিফলে যাবে। (২) বিশেষ কোন দিন বিশেষ কোন সালাত ত্যাগ করা। এক্ষেত্রে তার বিশেষ দিনের আমল বিফলে যাবে। অর্থাৎ সার্বিকভাবে সালাত ত্যাগ করলে তার সার্বিক আমল বিফলে যাবে। আর বিশেষ সালাত ত্যাগ করলে বিশেষ আমল বিফলে যাবে।”(ইবনুল কায়্যিম তাঁর ‘আস-স্বালাত’ পৃ-৬৫)
.
“ফাতাওয়াস সিয়াম” গ্রন্থে এসেছে শাইখ ইবনে উছাইমীনকে সালাত ত্যাগকারীর রোজা রাখার হুকুম সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিলো তিনি উত্তরে বলেন: সালাত ত্যাগকারীর রোজা শুদ্ধ নয় এবং তা কবুলযোগ্য নয়। কারণ সালাত ত্যাগকারী কাফের, মুরতাদ। এর সপক্ষে দলিল হচ্ছে-আল্লাহ্ তাআলার বাণী“আর যদি তারা তওবা করে, সালাত কায়েম করে ও যাকাত দেয় তবে তারা তোমাদের দ্বীনি ভাই।” [৯ সূরা আত্ তওবা: ১১] নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী:“কোন ব্যক্তির মাঝে এবং শির্ক ও কুফরের মাঝে সংযোগ হচ্ছে সালাত বর্জন।”[সহিহ মুসলিম হা/৮২) এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর বাণী “আমাদের ও তাদের মধ্যে চুক্তি হলো সালাতের। সুতরাং যে ব্যক্তি সালাত ত্যাগ করল, সে কুফরি করল।”[জামে তিরমিযী (২৬২১), আলবানী ‘সহীহ আত-তিরমিযী’ গ্রন্থে হাদিসটিকে সহিহ বলে চিহ্নিত করেছেন] এই মতের পক্ষে সাহাবায়ে কেরামের ‘ইজমা’ সংঘটিত না হলেও সর্বস্তরের সাহাবীগণ এই অভিমত পোষণ করতেন। প্রসিদ্ধ তাবেয়ী আব্দুল্লাহ ইবনে শাক্বিক রাহিমাহুমুল্লাহ বলেছেন: “নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সাহাবীগণ সালাত ছাড়া অন্য কোন আমল ত্যাগ করাকে কুফরি মনে করতেন না।”পূর্বোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে বলা যায়, যদি কোন ব্যক্তি রোজা রাখে; কিন্তু সালাত না পড়ে তবে তার রোজা প্রত্যাখ্যাত, গ্রহণযোগ্য নয় এবং তা কেয়ামতের দিন আল্লাহ্র কাছে কোন উপকারে আসবে না। আমরা এমন ব্যক্তিকে বলবো: আগে সালাত ধরুন, তারপর রোজা রাখুন। আপনি যদি সালাত না পড়েন, কিন্তু রোজা রাখেন তবে আপনার রোজা প্রত্যাখ্যাত হবে; কারণ কাফেরের কোন ইবাদত কবুল হয় না।”(ইবনু উসাইমীন; ফাতাওয়াস সিয়াম” পৃষ্ঠা:৮৭) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: উস্তায ইব্রাহিম বিন হাসান হাফি.
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি,সৌদি আরব।