ঈমান ও আক্বীদার সংজ্ঞা এবং তাদের মধ্যে পার্থক্য

প্রশ্ন: ঈমান ও আক্বীদার সংজ্ঞা কি? ঈমান ও আক্বীদার মধ্যে পার্থক্য কি?
▬▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি।অতঃপর ঈমান এবং আক্বীদার সংজ্ঞা:

ঈমান: আল-ঈমান’ (الإيمان) শব্দটি বাবেإفعال এর মাছদার। অভিধানিক অর্থ- নিরাপত্তা, আশংকামুক্তি স্বীকৃতি ইত্যাদি। শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহিমাহুল্লাহ) বলেন,”ঈমানের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে স্বীকারোক্তি এবং আত্মার প্রশান্তি। আর সেটা অর্জিত হবে অন্তরে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ ও আমলের মাধ্যমে।”(আস-সারেম আল-মাসলূল পৃষ্ঠা:৫১৯) আর ইসলামি পরিভাষায় আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের নিকট ঈমান হল:-الْإِيْمَانُ هُوَ التَّصْدِيْقُ بِالْجَنَانِ وَالْإِقْرَارُ بِاللِّسَانِ وَالْعَمَلُ بِالْأَرْكَانِ، يَزِيْدُ بِالطَّاعَةِ وَيَنْقُصُ بِالْمَعْصِيَّةِ، اَلْإِيْمَانُ هُوَ الْأَصْلُ وَالْعَمَلُ هُوَ الْفَرْعُ، “হৃদয়ে দৃঢ় বিশ্বাস, মুখে স্বীকৃতি, এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে তার প্রতিফলন। এটি আনুগত্যের মাধ্যমে বৃদ্ধি পায় এবং পাপের কারণে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়। বিশ্বাস ও স্বীকৃতি হলো মূলভিত্তি, আর কর্ম হলো এর শাখা।হাদিসে বর্ণিত ঈমানের সংজ্ঞা: যখন জিবরাঈল (আঃ) রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে ঈমান সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি বললেন,أَنْ تُؤْمِنَ بِاللهِ وَمَلَائِكَتِهِ وَكُتُبِهِ وَرُسُلِهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ وَتُؤْمِنَ بِالْقَدَرِ خَيْرِهِ وَشَرِّهِ “ঈমান হচ্ছে আল্লাহ তা‘আলা, তাঁর ফেরেশতাগণ, তাঁর কিতাবসমূহ, তাঁর রাসূলগণ, পরকালকে সত্য বলে বিশ্বাস করা এবং এছাড়া তাক্বদীরের ভাল-মন্দের উপর বিশ্বাস করা” (সহিহ মুসলিমহা/৮; আবু দাউদ হা/৪৬৯৫)
.
ইসলামের মূল ভিত্তি হচ্ছে ‘ঈমান’। প্রত্যেক নবী-রাসূলের প্রথম দাওয়াত ছিল ঈমানের দাওয়াত। ঈমান ব্যতীত বান্দার কোন আমল আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না। ঈমানের উপর নির্ভর করেই বান্দার জান্নাত-জাহান্নাম ও পরকালীন মুক্তি।শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়া (রহিমাহুল্লাহ) বলেছেন:الإيمان – مركّب من أصل لا يتم بدونه، ومن واجب ينقص بفواته نقصا يستحق صاحبه العقوبة، ومن مستحب يفوت بفواته علو الدرجة، فالناس فيه : ظالم لنفسه، ومقتصد، وسابق”ঈমান একটি সমন্বিত বিষয়, যার একটি মূলভিত্তি রয়েছে যা ছাড়া তা সম্পূর্ণ হয় না। এছাড়া এতে এমন কিছু আবশ্যকীয় অংশ রয়েছে, যা অনুপস্থিত হলে ঈমানের অপূর্ণতা ঘটে এবং যার ফলে ব্যক্তি শাস্তির উপযুক্ত হয়। পাশাপাশি এতে কিছু মুস্তাহাব (সুন্নত) অংশও রয়েছে, যা না থাকলে ঈমানের উচ্চস্তর থেকে বঞ্চিত হতে হয়। সুতরাং ঈমানের ক্ষেত্রে মানুষ তিন প্রকারের হয়ে থাকে। (১) যে নিজেই নিজের প্রতি জুলুম করে (অপরাধী), (২) যে মধ্যপন্থা অবলম্বন করে (সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে চলে), (৩) এবং যে অগ্রগামী হয় (সর্বোত্তম স্তরে পৌঁছে যায়)।(ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড: ৭; পৃষ্ঠা: ৬৩৭) ঈমানের রুকন ছয়টি এবং ঈমানের শাখা-প্রশাখা সত্তরটিরও অধিক: এর সর্বোচ্চ শাখা হলো: ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলা। আর সর্ব নিকটস্থ শাখা হলো, পথ থেকে কষ্টদায়ক বস্তু দূরে সরিয়ে দেওয়া। আর লজ্জা হলো ঈমানের শাখাসমূহের একটি।
.
ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, সত্তর জন তাবেঈ, মুসলিমদের ইমামগণ এবং পূর্ববর্তী ফক্বীহগণ সকলেই ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, الإيمان قول وعمل يزيد بالطاعة وينقص بالمعصية ‘ঈমান হল স্বীকারোক্তি ও আমলের নাম। আনুগত্যে ঈমান বাড়ে এবং পাপাচারে ঈমান কমে’। ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, পূর্ববর্তী আলেমদের মধ্য থেকে এক হাজারের অধিক আলেমের সাথে সাক্ষাৎ করেছি। তারা সকলেই বলেছেন, ‘ঈমান হল স্বীকারোক্তি ও আমলের নাম’। ইবনু আবূ হাতিম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, আমি আমার পিতা এবং আবূ যুর‘আ-কে ‘আহলুস সুন্নাহ’ এর মাযহাব, তাদের যুগের আলেমগণ এবং তাদের বিশ্বাস সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তারা বলেছেন, আমরা হিজাজ, ইরাক, মিশর, শাম এবং ইয়ামানের আলেমদের পেয়েছি, তাদের মাযহাব হল, ‘ঈমান হল স্বীকারোক্তি ও আমলের নাম। সৎ আমলের মাধ্যমে ঈমান বাড়ে এবং পাপাচারের কারণে ঈমান কমে’। ইমাম বাগাবী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,সাহাবী, তাবেঈ এবং তাদের পরবর্তী আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আলেমগণ ঐকমত্য পোষণ করেছেন যে, أن الأعمال من الإيمان ‘আমল ঈমানের অংশ”।(দ্রষ্টব্য: মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুর রহমান আল-খামীস, উসূলুদ দ্বীন ঈনদাল ইমাম আবী হানীফা (সঊদী আরব: দারুস সামীঈ, তাবি.), পৃষ্ঠা: ৩৮৬)
.
আক্বীদা: ‘عقيدة (আক্বীদা) শব্দটি আরবী عقدة (উক্বদাতুন) শব্দ থেকে উদ্গত। যার শাব্দিক অর্থ হচ্ছে গিরা বা বাঁধন, মজবুতকরণ, দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা ইত্যাদি”।যেমন বলা হয়, عقد الحبل يعقده ‘রশিতে গিরা/গিট দিয়েছে বা দিবে’। আরো বলা হয়, عقد العهدَ والبيع ‘চুক্তি ও ক্রয়-বিক্রয় সুদৃঢ়ভাবে সংঘটিত হয়েছে। আরবরা আরো বলে “عقد الإزار”,অর্থাৎ কেউ শক্তভাবে লুঙ্গি বেঁধেছে। ‘عقد’ শব্দটি, প্রকৃতপক্ষে, ‘حل’ (মুক্ত) এর বিপরীত। এইভাবে, শব্দটি ঐক্য, দৃঢ়তা এবং দৃঢ় বন্ধনের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়,যা একটি সম্পর্ক বা চুক্তিকে শক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করে।এভাবে, আক্বীদা শব্দটি এমন একটি ধারণাকে সূচিত করে যা একে অপরের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস এবং সম্পর্কের মজবুত বন্ধনকে বোঝায়। আক্বীদার পারিভাষিক অর্থ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে শাইখ ড. নাসের আল-আকল বলেন:العقيدة تطلق على الإيمان الجازم والحكم القاطع الذي لا يتطرق إليه شكٌّ، وهي ما يؤمن به الإنسانُ ويعقد عليه قلبه وضميره، ويتخذه مذهباً وديناً يدين به؛ فإن كان هذا الإيمان الجازم والحكم القاطع صحيحاً كانت العقيدة صحيحة كاعتقاد أهل السنة والجماعة، وإن كان باطلاً كانت العقيدة باطلة كاعتقاد فرق الضلالة “আক্বীদা এমন এক দৃঢ় ঈমান এবং চূড়ান্ত সিদ্ধান্তকে বলা হয়, যার মধ্যে কোনো সন্দেহের স্থান থাকে না। এটি সেই বিশ্বাস যা একজন মানুষ তার অন্তরে গভীরভাবে ধারণ করে এবং তা তার জীবনধারা ও ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করে। যদি এই বিশ্বাসটি সঠিক হয়,তবে আক্বীদাও সঠিক হবে, যেমনটি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ এর আক্বীদা। আর যদি এই বিশ্বাসটি ভ্রান্ত হয়, তবে আক্বীদাও ভুল এবং বাতিল বলে গণ্য হবে, যেমনটি বিভিন্ন বিভ্রান্ত পথের অনুসারীদের আক্বীদা।”(মাবাহিছু ফী আক্বীদাতি আহলিস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আহ, পৃষ্ঠা: ৯-১০)
.
আক্বীদার গুরুত্ব সম্পর্কে বলতে গিয়ে ইমাম ফিস সুন্নাহ, ‘আল্লামাহ ড. রাবী‘ বিন হাদী ‘উমাইর আল-মাদখালী (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫১ হি./১৯৩২ খ্রি.] বলেন;والله لا قيمة للفقه ولا لغيره ؛ إذا ضيعنا العقيدة وضيعنا التوحيد ، ووقعنا في الشرك بالله ؛ لا فائدة لأي علم أبداً، ولو حفظنا القرآن، وحفظنا الحديث، وحفظنا كتب الفقه، ونحن واقعون في ظلمات الشرك، لا قيمة لنا ولن نستفيد من هذا العلم”
“আল্লাহর কসম,ফিকহ বা অন্য কোনো বিষয়ে জ্ঞান অর্জনের কোনো মূল্য নেই, যদি আমরা আক্বীদা এবং তাওহীদকে নষ্ট করি এবং আল্লাহর সাথে শিরক করি। সুতরাং, এমন জ্ঞানে কোনো উপকারিতা নেই, যদিও আমরা কোরআনের হাফেজ হই, হাদিস মুখস্ত করি এবং ফিকহের বইগুলো মুখস্থ করি। কারণ, আমরা শিরকের অন্ধকারে নিমজ্জিত, আমাদের কোনো মূল্য নেই এবং কখনোই আমরা এই জ্ঞান থেকে উপকৃত হতে পারব না।”
(মারহাবান ইয়া ত্বালিবে ইলম; পৃষ্ঠা: ১১১)
.
সৌদি ফতোয়া বোর্ড এবং সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের প্রবীণ সদস্য, যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫৪ হি./১৯৩৫ খ্রি.] বলেনঃما دام الناس على الشرك وعلى البدع والمحدثات ، فلن تصلح أمورهم ، ولن تحل مشاكلهم ، بل تزيد مشاكلهم كما كانوا في الجاهلية ، فأولاً يجب إصلاح العقيدة ، ولهذا فالرسل كلهم وخاتمهم محمد ﷺ أول ما يبدؤون الدعوة بإصلاح العقيدة
“যতদিন মানুষ শিরক, বিদআত এবং নব উদ্ভূত বিষয়গুলোর মধ্যে লিপ্ত থাকবে, ততদিন তাদের অবস্থা কখনোই সঠিক হবে না এবং তাদের সমস্যাগুলোর সমাধানও হবে না; বরং তাদের সমস্যাগুলো আরও বৃদ্ধি পাবে, যেমনটি জাহিলিয়াতের যুগে ছিল। তাই সর্বপ্রথম আকিদা (বিশ্বাস) শুদ্ধ করা অপরিহার্য। এ কারণেই সমস্ত নবী-রাসূলগণ, এবং সর্বশেষ নবী মুহাম্মাদ ﷺ তাঁদের দাওয়াতের সূচনা করেছেন আক্বীদা সংশোধনের মাধ্যমে।”(ইত্তিফাকুল কালিমা”, পৃষ্ঠা: ২৩)
.
ঈমান এবং আক্বীদার মধ্যে পার্থক্য:
.
আক্বীদা ও ঈমান শরীয়তের দুটি গুরুত্বপূর্ণ পরিভাষা। এই শব্দ দু’টির মাঝে পার্থক্য আছে কিনা এই বিষয়ে একদল আলেমদের মতামত হচ্ছে, শাব্দিক অর্থে ঈমান ও আক্বীদার মধ্যে পার্থক্য থাকলেও পারিভাষিক অর্থে কোন পার্থক্য নেই। অর্থাৎ ঈমান হল মুখে স্বীকৃতি, হৃদয়ে বিশ্বাস এবং কর্মে বাস্তবায়নের নাম। আর আক্বীদা হল অন্তরের অভিপ্রায়, ইচ্ছা ও সংকল্পের নাম। মূলত ঈমান হলো ব্যাপক অর্থে (আম), আর আক্বীদা হলো নির্দিষ্ট (খাশ)। ঈমান সমগ্র দ্বীনকে শামিল করে।আর আক্বীদা দ্বীনের মৌলিক বিশ্বাসের নাম। সুতরাং ঈমানের দু’টি অংশ। একটি হ’ল- হৃদয়ে স্বচ্ছ আক্বীদা পোষণ। আরেকটি হল বাহ্যিক কর্মে তার প্রকাশ। এ দু’টি পরস্পরের সঙ্গে এমনভাবে যুক্ত যে, কোন একটির অনুপস্থিতি ঈমানকে বিনষ্ট করে দেয়। আক্বীদা হ’ল ঈমানের মূলভিত্তি। আক্বীদা ব্যতীত ঈমানের উপস্থিতি তেমনি অসম্ভব, যেমনিভাবে ভিত্তি ব্যতীত কাঠামো অসম্ভব। ইসলাম ঈমান আক্বীদার মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল প্রশ্ন: ঈমান, তাওহিদ ও আক্বীদা এগুলো কি ভিন্ন অর্থ বহন করে?

উত্তরে শাইখ বলেন:

نعم، تختلف بعض الاختلاف، ولكنها ترجع إلى شيء واحد. التوحيد هو إفراد الله بالعبادة، والإيمان هو الإيمان بأنه مستحق للعبادة، والإيمان بكل ما أخبر به سبحانه، فهو أشمل من كلمة التوحيد، التي هي مصدر وحد يوحد، يعني أفرد الله بالعبادة وخصه بها؛ لإيمانه بأنه سبحانه هو المستحق لها؛ لأنه الخلاق؛ لأنه الرزاق؛ ولأنه الكامل في أسمائه وصفاته وأفعاله؛ ولأنه مدبر الأمور والمتصرف فيها، فهو المستحق للعبادة، فالتوحيد هو إفراده بالعبادة ونفيها عما سواه، والإيمان أوسع من ذلك يدخل فيه توحيده والإخلاص له، ويدخل فيه تصديقه في كل ما أخبر به رسوله عليه الصلاة والسلام، والعقيدة تشمل الأمرين، فالعقيدة تشمل التوحيد، وتشمل الإيمان بالله وبما أخبر به سبحانه أو أخبر به رسوله صلى الله عليه وسلم، والإيمان بأسمائه وصفاته.والعقيدة : هي ما يعتقده الإنسان بقلبه ويراه عقيدة يدين الله بها ويتعبده بها، فيدخل فيها كل ما يعتقده من توحيد الله والإيمان بأنه الخلاق الرزاق وبأنه له الأسماء الحسنى والصفات العلى، والإيمان بأنه لا يصلح للعبادة سواه، والإيمان بأنه حرم كذا وأوجب كذا وشرع كذا ونهى عن كذا، فهي أشمل.

হ্যাঁ, কিছুটা পার্থক্য রয়েছে, তবে সবকিছুই মূলত এক উদ্দেশ্যের দিকে ইঙ্গিত করে।

তাওহিদ হলো আল্লাহকে ইবাদতে একক করা, অর্থাৎ একমাত্র তাঁকেই ইবাদতের উপযুক্ত বলে গ্রহণ করা এবং এই ইবাদত থেকে সব ধরনের অংশীদারিত্ব অস্বীকার করা। “তাওহিদ” শব্দটি وَحَّدَ يُوَحِّدُ ধাতু থেকে উদ্ভূত, যার অর্থ কাউকে একক, অদ্বিতীয় ও অনন্য হিসেবে সাব্যস্ত করা। প্রকৃতপক্ষে, তাওহিদ মানে হলো আল্লাহকে তাঁর প্রতিটি বিষয়ে একক বলে মেনে নেওয়া—তিনি একমাত্র সৃষ্টিকর্তা, রিজিকদাতা এবং সকল বিষয়ে নিয়ন্ত্রণকারী। তিনি তাঁর নাম, গুণাবলী ও কর্মসমূহে পরিপূর্ণ, অনন্য ও অতুলনীয়। যেহেতু তিনিই সমগ্র সৃষ্টির পরিচালক, তাই একমাত্র তিনিই ইবাদতের যোগ্য। অর্থাৎ, তাওহিদ হলো আল্লাহকে ইবাদতের জন্য এককভাবে সাব্যস্ত করা এবং তাঁর সঙ্গে অন্য কাউকে শরিক না করা।

ঈমান হলো আল্লাহর একত্বের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করা। অর্থাৎ তাওহিদকে অন্তরে দৃঢ়ভাবে ধারণ করা এবং আল্লাহ যা কিছু আমাদের জানিয়েছেন তার প্রতি অকুণ্ঠ বিশ্বাস রাখা। এটি তাওহিদের চেয়েও বিস্তৃত একটি বিষয়। ঈমানের মধ্যে তাওহিদ, আন্তরিকতা (ইখলাস) এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা কিছু জানিয়েছেন তার প্রতি অকুণ্ঠ ও নিরঙ্কুশ বিশ্বাস অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

আক্বীদা হলো একজন ব্যক্তি যে বিশ্বাস অন্তরে ধারণ করে এবং যার ভিত্তিতে সে আল্লাহর ইবাদত করে। আক্বীদার মধ্যে তাওহিদ ও ঈমান উভয়ই অন্তর্ভুক্ত। এর অর্থ হলো আল্লাহর একত্বের প্রতি বিশ্বাস, তাঁর নাম ও গুণাবলীর প্রতি বিশ্বাস, এবং রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা কিছু সংবাদ দিয়েছেন তা সম্পূর্ণরূপে মেনে নেওয়া। একই সঙ্গে, আক্বীদা হলো এই দৃঢ় বিশ্বাস যে একমাত্র আল্লাহই ইবাদতের যোগ্য, তিনিই সৃষ্টিকর্তা, রিজিকদাতা, সকল বিষয়ের বিধানদাতা, হালাল-হারামের নির্ধারক এবং একমাত্র তাঁরই বিধান ও নির্দেশ মেনে চলা অপরিহার্য।

সংক্ষেপে: তাওহিদ হলো আল্লাহকে একক ও অদ্বিতীয় হিসেবে সাব্যস্ত করা এবং কেবল তাঁকেই ইবাদতের যোগ্য মনে করা। ঈমান হলো এ বিশ্বাস অন্তরে দৃঢ়ভাবে স্থাপন করা এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যা কিছু জানিয়েছেন, তার প্রতি নিরঙ্কুশ বিশ্বাস রাখা। আক্বীদা হলো এই বিশ্বাসকে অন্তরে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করা এবং তার ওপর অটল থাকা। (মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড; ৬; পৃষ্ঠা:২৭৭; এবং ইমাম ইবনে বায (রাহিমাহুল্লাহ) এর অফিসিয়াল ওয়েবসাইট, ১৪৩৮ হিজরি)
.
সৌদি ফতোয়া বোর্ড এবং সৌদি আরবের সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের প্রবীণ সদস্য, যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫৪ হি./১৯৩৫ খ্রি.]কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল;ইসলামী শরিয়তে আক্বীদা ও ঈমানের মধ্যে কী পার্থক্য?

উত্তরে শাইখ বলেন :

العقيدة هي الإيمان وهو ما يعتقده القلب ويؤمن به، فالعقيدة والإيمان شيء واحد، وهما من أعمال القلوب، وهي الأصل والأساس لهذا الدين، فلا دين بدون عقيدة صحيحة، ولا دون اعتقاد صحيح على موجب الكتاب والسنة، عقيدة أهل السنة والجماعة، وهي الإيمان بالله وملائكته وكتبه ورسله واليوم الآخر والإيمان بالقدر خيره وشره، كذلك الإيمان بالله – سبحانه وتعالى – وبأسمائه وصفاته، فنثبت ما أثبته الله لنفسه أو أثبته له رسوله من الأسماء والصفات من غير تشبيه ولا تمثيل ومن غير تحريف ولا تعطيل.
আক্বীদা হল ঈমান অর্থাৎ যা অন্তর দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে এবং স্বীকৃতি দেয়। সুতরাং আক্বীদা ও ঈমান এক ও অভিন্ন; উভয়ই অন্তরের কর্ম। এটি দ্বীনের মূল ভিত্তি ও মেরুদণ্ড। সঠিক আক্বীদা ছাড়া প্রকৃত দ্বীন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। এবং কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী বিশুদ্ধ বিশ্বাস ছাড়া ইসলামের কোনো ভিত্তি থাকতে পারে না।আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা’আতের আক্বীদা হলো আল্লাহ তাআলার প্রতি ঈমান রাখা। ফেরেশতাদের প্রতি ঈমান রাখা।কিতাবসমূহের প্রতি ঈমান রাখা। নবী ও রাসূলগণের প্রতি ঈমান রাখা। কিয়ামতের দিনের প্রতি ঈমান রাখা। তাকদিরের প্রতি ঈমান রাখা তা ভালো হোক বা মন্দ হোক। এছাড়াও, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলার অস্তিত্ব, তাঁর সুন্দর নামসমূহ ও মহান গুণাবলীতে ঈমান রাখা এবং যা কিছু তিনি নিজ সম্পর্কে প্রমাণ করেছেন কিংবা তাঁর রাসূল ﷺ প্রমাণ করেছেন, তা নির্দ্বিধায় মেনে নেওয়া। তবে, কোনো উপমা বা তুলনার আশ্রয় না নিয়ে, কোনো বিকৃতি বা পরিবর্তন না করে এবং কোনো অস্বীকৃতি বা বাতিলকরণ ছাড়াই বিশ্বাস করতে হবে।”(সংক্ষেপিত সম্মানিত শায়খ ড. সালেহ বিন ফাওজান আল-ফাওজানের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট থেকে)
.
▪️আক্বীদা ও ঈমানের মধ্যে কয়েকটি পার্থক্য উল্লেখ করা হলো:

(১). “আক্বীদা” এবং “ঈমান” শব্দদ্বয়ের মধ্যে আভিধানিক এবং পারিভাষিক অর্থে পার্থক্য রয়েছে। যেমন আক্বীদা শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো: দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস স্থাপন করা, শক্তিশালী করা, আবদ্ধ করা এবং নিশ্চিত করা।(মু’জামুল মাকায়িসিল লুগাত; খণ্ড: ৪; পৃষ্ঠা: ৮৬-৮৭, লিসানুল আরব; খণ্ড: ৯; পৃষ্ঠা:৩০৯, কামুসুল মুহিত্ব; পৃষ্ঠা: ৩৮৩-৩৮৪)
পারিভাষিক অর্থে এটি এমন একটি বিশ্বাস যা একজন ব্যক্তি তার অন্তর ও বিবেকের মাধ্যমে নিশ্চিত করে এবং এতে কোনো সন্দেহের স্থান রাখে না। সঠিক আক্বীদা হলো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আক্বীদা যা নবী ﷺ)-এর সুন্নাহ এবং আল্লাহর কিতাবের নির্দেশনা অনুসরণে মুমিনদের অন্তরকে সুরক্ষিত রাখে।
.
অপরদিকে ঈমান শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো স্বীকৃতি দেওয়া, নিরাপত্তা প্রদান, আস্থা স্থাপন, ইত্যাদি। পারিভাষিক অর্থে ঈমান হলো অন্তরে বিশ্বাস স্থাপন, মুখে স্বীকৃতি এবং তা কাজের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা। (শারহুত ত্বাহাবী; পৃষ্ঠা: ৩৩২)। ঈমান একটি ব্যাপক ধারণা, যা আক্বীদা, কথা এবং কাজ সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত করে। এটি অন্তরের অনুভূতি, মুখের উচ্চারণ এবং শরীরের কার্যকলাপের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়।(আত তামহীদ; খণ্ড: ৯; পৃষ্ঠা: ২৪৮, ইবনু তাইমিয়্যাহ মাজমুউ ফাতাওয়া, খণ্ড:৭; পৃষ্ঠা: ৩০৮) সুতরাং উভয় সংজ্ঞার মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে ঈমান আক্বীদার তুলনায় বিস্তৃত এবং সমন্বিত একটি ধারণা। কারণ এটি অন্তরে স্বীকৃতি, মুখে উচ্চারণ ও কার্যকলাপে বাস্তবায়ন তিনটিকেই অন্তর্ভুক্ত করে।
.
(২). বিশুদ্ধ আক্বীদা হলো ঈমানের মুল ভিত্তি ও রূপরেখা। এটি হৃদয়ের গভীরে বিশ্বাস ও অনুভূতির প্রতিফলন। যা শুধু বিশ্বাসই নয়, বরং চিন্তা ও কর্মের মাধ্যমে প্রকাশ পায়। আর সে কারণেই এটি ঈমানের মূল ভিত্তি। একে অক্ষুন্ন রেখে ঈমান রক্ষা করতে হয়,কেননা সঠিক আক্বীদা ছাড়া ঈমানের কোনো অস্তিত্ব নেই, ঈমানের অন্যান্য অঙ্গগুলি যেমন ইবাদত, আমল বা পরিপালন সবই আক্বীদার উপর নির্ভরশীল। কেননা যখন একজন ব্যক্তি তার অন্তরে সঠিক আক্বীদা স্থাপন করে, তখন তার কাজও সঠিক হবে। উদাহরণস্বরূপ ধরুন, একটি বড় ভবন তৈরি করার জন্য যেমন মজবুত ভিত্তি প্রয়োজন, তেমনি ঈমানের জন্যও মজবুত আক্বীদা দরকার। যদি বাড়ির ভিত্তিটি দুর্বল হয়,তাহলে যেমন পুরো ভবন ভেঙে পড়বে। তেমনি যদি আক্বীদা সঠিক না হয়, তাহলে ঈমানের অন্যান্য অংশও দুর্বল হয়ে পড়বে এবং ব্যক্তি নিজেও সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে ভুল পথে চলে যাবে। তাই আক্বীদা হল ঈমানের মৌলিক ভিত্তি, যা আমাদের সঠিক পথে পরিচালিত করে।
.
(৩). বিশুদ্ধ আক্বীদার দৃঢ়তা ঈমানকে শক্তিশালী করে, আর আক্বীদার দুর্বলতা ঈমানের ভিত্তিকে নড়বড়ে করে দেয়। ঈমানের শক্তি ও স্থায়িত্ব পুরোপুরি আক্বীদার সুসংহততার ওপর নির্ভরশীল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন:”জেনে রাখো! মানুষের দেহে একটি মাংসপিণ্ড আছে, যদি তা সুস্থ থাকে, তবে পুরো দেহ সুস্থ থাকে; আর যদি তা কলুষিত হয়ে যায়, তবে পুরো দেহ নষ্ট হয়ে যায়। জেনে রাখো! সেটিই হলো কলব (অন্তর)।”(সহীহ বুখারী হা/ ৫২, ২০৫১) এটি এমন এক অবিসংবাদিত সত্য, যা অতীত ও বর্তমানের সকল ইতিহাস বিখ্যাত বিদ্বান সর্বসম্মতভাবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাই একজন মুমিনের জন্য অপরিহার্য হলো তার আক্বীদা বিশুদ্ধ ও সুদৃঢ় রাখা যেন তার ঈমানও অটল ও প্রগাঢ় হয়। কেননা শুদ্ধ আক্বীদাই হলো শক্তিশালী ঈমানের মূল ভিত্তি।
.
(৪). বিশুদ্ধ আক্বীদা (বিশ্বাস) জিহ্বা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ঈমানকে দৃঢ় ও সহিহ করে তোলে, আর ভ্রান্ত আক্বীদা ঈমানকে দুর্বল করে বা বিপথগামী করে দেয়। সাহাবায়ে কিরাম ও তাবিঈনরা কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে বিশুদ্ধ আক্বীদা ধারণ করতেন যার ফলে তাদের ঈমান ছিল সুদৃঢ় ও নির্ভেজাল। এ কারণেই তারা মানবজাতির মধ্যে সর্বোত্তম ছিলেন। অন্যদিকে আমরা যদি বিভ্রান্ত মতবাদ অনুসারীদের দিকে লক্ষ্য করি তাহলে বুঝতে পারবো আক্বীদার বিচ্যুতি কীভাবে ঈমানকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। যেমন মুরজি’আহ সম্প্রদায় বিশ্বাস করে যে ঈমান কেবল অন্তরের স্বীকৃতি মাত্র; আমলের (কর্মের) সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। ফলে তাদের মতে কেউ যদি কবিরা গুনাহ করেও অন্তরে বিশ্বাস ধরে রাখে, তবে সে পূর্ণ ঈমানদার ও অনুগত ব্যক্তির সমতুল্য। এমনকি তাদের নিকট একজন নবীর ঈমান ও ইবলিসের ঈমান এক সমান। তাদের এই ‘আকীদাহ কুরআন ও সুন্নাহ বিরোধী এবং এটি সুস্পষ্ট আক্বীদার বিচ্যুতি। অন্যদিকে খারেজিরা মনে করে যে ঈমান একটি অবিভাজ্য সত্তা; অর্থাৎ, ঈমানের কোনো অংশ হারিয়ে গেলে সম্পূর্ণ ঈমানই নষ্ট হয়ে যায়। এই চরমপন্থী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তারা কবিরা গুনাহগার ব্যক্তিকে কাফের বলে ঘোষণা করে, এমনকি তাদের রক্তপাত অর্থাৎ হত্যাকেও বৈধ মনে করে। এই সমস্ত ভ্রান্ত বিশ্বাস প্রমাণ করে যে বিশুদ্ধ আক্বীদাই ঈমানকে সংরক্ষণ ও শক্তিশালী করে, আর আক্বীদার বিচ্যুতি ঈমানকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেয়।যেমন শিকড় পচলে বৃক্ষ মরে যায়, তেমনি আক্বীদার বিচ্যুতি হলে ঈমান ও আমল উভয় দুর্বল হয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে আক্বীদা শুদ্ধ
হলে ঈমান আমলও শুদ্ধতার দিকে ধাবিত হয়।”
.
(৫). আক্বীদার সাথে সম্পর্কিত পাপ অত্যন্ত গুরুতর। যদি কেউ এমন পাপে লিপ্ত থেকে তওবা ব্যতীত মৃত্যুবরণ করে তাহলে আল্লাহ তা কখনো ক্ষমা করবেন না। আর এটি আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনে স্পষ্টভাবে বলেছেন: “নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সাথে অংশীদারত্ব (শিরক) ক্ষমা করেন না, তবে এর নিচে যা কিছু আছে, তা যার জন্য ইচ্ছা ক্ষমা করেন”।(সূরা আন-নিসা: ৪৮) অপর আয়াতে আরো বলেন: “নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমা করেন না তাঁর সাথে শরীক করাকে এবং এ ছাড়া যাকে চান ক্ষমা করেন। আর যে আল্লাহর সাথে শরীক করে সে তো ঘোর পথভ্রষ্টতায় পথভ্রষ্ট হল”।(সূরা নিসা:১১৬)। শিরক হলো সর্ববৃহৎ গুনাহ যা প্রত্যক্ষভাবে ঈমান ও আক্বীদার ওপর আঘাত হানে। এটি মানুষের সমস্ত নেক আমল বিনষ্ট করে দেয় এবং যদি কেউ শিরকের ওপর স্থির থেকে মৃত্যুবরণ করে তবে সে জান্নাত থেকে চিরতরে বঞ্চিত হবে। তবে যে পাপ আক্বীদার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত নয়। যেমন কোন খারাপ কথা বা কাজ যদি কেউ এ ধরনের পাপে লিপ্ত থেকে মৃত্যুবরণ করে এবং তওবা না করে, তবে এর বিচার একান্তই আল্লাহর ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। তিনি চাইলে ব্যক্তিকে ক্ষমা করতে পারেন, চাইলে শাস্তিও দিতে পারেন। সুতরাং আমাদের কর্তব্য হলো আক্বীদাকে বিশুদ্ধ রাখা, শিরক ও কুফর থেকে দূরে থাকা এবং সর্বদা আল্লাহর নিকট তওবা করে গুনাহমুক্ত থাকার চেষ্টা করা।
.
(৬). ঈমান বা স্বীকৃতি প্রদান ইসলামের কেন্দ্রবিন্দু যা মানুষের অন্তর, ভাষা এবং কর্মে প্রতিফলিত হয়। এটি মূলত আল্লাহ, তাঁর রাসূল, ধর্মগ্রন্থ, ফেরেশতা, আখিরাত, এবং তাকদীরের ওপর দৃঢ় বিশ্বাসের সমষ্টি। ঈমানের প্রভাব একদিকে মানুষের অন্তরকে আলোকিত করে, অন্যদিকে তার আচরণ, কাজ ও নৈতিকতা সঠিক পথে পরিচালিত করে।অপরদিকে আক্বীদা,যা ঈমানের মূল ভিত্তি, এটি মানুষের অন্তরে প্রতিষ্ঠিত বিশ্বাস ও স্বীকারোক্তির ওপর নির্ভর করে। অর্থাৎ ঈমান হল মানুষের অন্তরের গভীরে আল্লাহর প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস ও আস্থা স্থাপন যা তার ধর্মবিশ্বাসের পূর্ণতা প্রদান করে। আর আক্বীদা হলো সেই দৃঢ় ভিত্তি, যা বিশ্বাসের মূল নির্মাণ করে এবং মানুষকে আল্লাহর প্রতি গভীর আনুগত্য ও বিশ্বাসের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক দৃঢ়তার দিকে পরিচালিত করে।
.
(৭). বিশুদ্ধ আক্বীদা হলো আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের আক্বীদা। যেসব ব্যক্তির এই আক্বীদা থাকবে তারা অবশ্যই জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি পাবেন যদিও তা কিছু সময় পর হলেও হতে পারে। এর প্রমাণ হলো সহীহ বুখারীর একটি হাদীসে (নম্বর: ৬৪৮০) বর্ণিত একটি ঘটনা, যেখানে নবী সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এক ব্যক্তির কথা জানিয়েছেন, যে কখনো কোনো ভালো কাজ করেনি। মৃত্যুর পর তিনি তার সন্তানদের নির্দেশ দিয়েছিল যে তাকে পুড়িয়ে ছড়িয়ে দেয়া হোক যেন আল্লাহর শাস্তি থেকে রক্ষা পায়। সে ভেবেছিল এই কাজের মাধ্যমে আল্লাহর শাস্তি এড়ানো সম্ভব। কিন্তু আল্লাহ তাকে পুনরায় একত্রিত করে এবং তার কাজের কারণ জানার পর তাকে জান্নাতে প্রবেশ করান। কারণ তার আক্বীদা ছিল সঠিক এবং সে আল্লাহর ক্ষমতা ও ভয় বিশ্বাস করেছিল। এছাড়াও তিরমিযীসহ অন্যান্য হাদীস গ্রন্থে (তিরমিজি হা/ ২৬৩৯) নিরানব্বইটি আমলনামার খাতা সংক্রান্ত ঘটনা হাদিসটি ইমাম আলবানী (সহিহুল জামি’হা/১৭৭৬) এতে সহিহ বলেছেন। এই হাদিসে বর্ণিত আছে,এমন একজন ব্যক্তি যিনি কোনো সৎকর্ম করেননি, তবে তার কাছে একটি কার্ড ছিল, যার উপর লেখা ছিল ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ (আল্লাহ ছাড়া হক কোনো মা’বুদ নেই)। সেই কার্ডটি মিযানের এক পাল্লায় রাখা হবে এবং তার গুনাহের খাতাগুলো অপর পাল্লায় রাখা হবে এবং লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’র টুকরাটি যে পাল্লায় রাখা হবে সেটি নিরানব্বইটি পাপের খাতার চেয়েও ভারী হবে। আর আল্লাহ তা’আলার নামের বিপরীতে কোন কিছুই ভারী হতে পারে না। ফলে তার সমস্ত পাপ মুছে দেওয়া হবে এবং সে তাওহিদের দ্বারা জান্নাতে প্রবেশ করতে সক্ষম হবে। এমনকি সহীহ মুসলিমের আরেকটি হাদিস (নং ৩০৪) অনুযায়ী যার অন্তরে অণু পরিমাণ নেকি থাকবে তাকে জাহান্নাম থেকে বের করে আনা হবে। এর মাধ্যমে আমরা প্রমাণ পাই যে বিশুদ্ধ আক্বীদা পোষণকারীরা তাদের সৎকর্মের পরিপূর্ণতা যাই হোক না কেন একদিন জান্নাতে প্রবেশ করবেন যদিও সেটা কিছু সময় পর হয়। তারা চিরকাল জাহান্নামে থাকবে না। এই সব ঘটনা সঠিক আক্বীদার গুরুত্ব এবং আল্লাহর অসীম করুণার প্রমাণ।
.
(৮). ভালোবাসা, ঘৃণা, বন্ধুত্ব ও শত্রুতা মূলত মানুষের আক্বীদা (বিশ্বাস) অনুযায়ী নির্ধারিত হয়। কুফর ও ভ্রান্ত আক্বীদার কারণে একজন কাফের বা মুনাফিকের প্রতি আমরা সম্পূর্ণরূপে বিরোধিতা ও ঘৃণা পোষণ করব। অপরদিকে ঈমান ও সঠিক আক্বীদার কারণে আমরা একজন মুমিনকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসব। আর যদি কোনো মুসলিম পাপাচারে লিপ্ত হয় তবে আমরা তার সঠিক আক্বীদার পরিমাণ অনুযায়ী তাকে ভালোবাসব এবং তার প্রতি সহানুভূতিশীল থাকব। এ প্রসঙ্গে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা রয়েছে: এক ব্যক্তি মদ পান করতেন এবং বারবার মদপানের কারণে নবী ﷺ-এর সামনে আনা হতো, আর নবী (ﷺ) তার ওপর শাস্তি কার্যকর করতেন। একবার যখন তাকে আবারও আনা হলো, তখন কিছু সাহাবি বললেন, “হে আল্লাহ! এ লোককে অভিশাপ দিন, সে তো বারবার একই অপরাধ করছে!”এ কথা শুনে নবী ﷺ বললেন, “তোমরা তাকে অভিশাপ দিও না, কারণ সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসে।”(বর্ণনা করেছেন ইমাম বাযজার হা/২৬৯) এর সনদ সহিহ, এবং এর বর্ণনাকারীরা সহিহ বুখারির বর্ণনাকারীদের মতো নির্ভরযোগ্য।) এই ঘটনায় নবী (ﷺ) তাকে অভিশাপ দেওয়া থেকে নিষেধ করেছেন, কারণ তার আক্বীদা সহীহ ছিল সে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে ভালোবাসত।
.
পরিশেষে আমরা আল্লাহ্‌র কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাদেরকে সত্য ঈমান ও আক্বীদা দান করেন যাতে কোন সন্দেহ নেই। আল্লাহ্‌ই তাওফিকদাতা এবং তিনিই সর্বজ্ঞ।
___________________________
আপনাদের দ্বীনি ভাই:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Share: