আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা এর ফজিলত

প্রশ্ন: আম্মাজান আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)-এর ফজিলত কী? নারীরা তার উদাহরণ থেকে কী কী শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন?”
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: আম্মাজান আয়েশা বিনতু আবূ বাকর সিদ্দীক (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) [মৃত: ৫৭/৫৮ হি.] ইসলামের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ নারী। তিনি নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্ত্রী, অন্যতম প্রধান হাদিস বর্ণনাকারী এবং একজন জ্ঞানের বাতিঘর ছিলেন। তার ফজিলত সম্পর্কে আলোচনা শেষ হবে না, শেষ হবারও নয়, তিনি ছিলেন সিয়াম পালনকারী, রাত জাগরণকারী মহিয়ষী নারী, তিনি অনেক অনেক ভাল কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন, প্রচুর দান-সাদকা করেছেন। তার অধিক দান-সাদকার কারণে তার নিকট খুব কম অর্থ-সম্পদই বিদ্যমান থাকত। উরওয়া ইবনু জুবায়ের রদিয়াল্লহু আনহুর থেকে বর্নিত আছে যে, মুয়াবিয়া (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহাকে একলাখ দিরহাম পাঠিয়েছিলেন সেই পুরো একলাখ দিরহাম তিনি সাদকা করেন, এক দিরহামও অবশিষ্ট রাখেননি নিজের কাছে। রাসূল (ﷺ) তাকে নবুওয়তের দশম বছরের শাওয়াল মাসে বিবাহ করেন এবং তিনি নয় বছর বয়সে রাসূল ﷺ এর ঘরে আসেন, অতঃপর নবী ﷺ এর মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল আঠারো বছর। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহার ফজিলত সম্পর্কে কুরআন ও হাদিসে অসংখ্য বর্ণনা পাওয়া যায়। নিচে তাঁর ২১ টি ফজিলত দলিলসহ তুলে ধরা হল:
.
(১).তার অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে একটি হল রাসূল ﷺ) তাকে ছাড়া অন্য কোনও কুমারীকে বিয়ে করেননি।
.
ইবনু আবী মুলাইকাহ (রহ.) বলেনابْنُ عَبَّاسٍ لِعَائِشَةَ لَمْ يَنْكِحِ النَّبِيُّصلى الله عليه وسلم بِكْرًا غَيْرَكِ. “ইবনু ‘আব্বাস (রদিয়াল্লহু আনহু) ‘আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা)-কে বললেন, আপনাকে ছাড়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আর কোনো কুমারীকে বিয়ে করেননি।(সহীহ বুখারী হা/৫০৭৭) অপর বর্ননায় আয়েশা (রদিয়াল্লহু আনহা) থেকে বর্ণিতঃ নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন তাঁকে বিয়ে করেন তখন তার বয়স ছিল ৬ বছর এবং নয় বছর বয়সে রসূলুল্লাহ্‌ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁর সঙ্গে বাসর ঘর করেন এবং তিনি তাঁর সান্নিধ্যে নয় বছর কাল ছিলেন।(সহিহ বুখারী: ৫১৩৩; আধুনিক প্রকাশনী: ৪৭৫৪, ইসলামিক ফাউন্ডেশন: ৪৭৫৭)
.
(২).মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করেছেন:
.
তার অনন্য বৈশিষ্ট্যের মধ্যে রয়েছে আল্লাহ তাকে সেইসব অপবাদ থেকে নির্দোষ ঘোষণা করেছেন যার জন্য অপবাদদাতারা (আহলে আল-ইফক) তাকে অভিযুক্ত করেছিল এবং তার নির্দোষতা সম্পর্কে এমন কিছু বাক্য অবতীর্ণ করেছেন যা মুসলিমদের মসজিদে এবং কিয়ামত পর্যন্ত তাদের নামাজের সময় পাঠ করা হয়। আল্লাহ নিজেই সাক্ষ্য দিয়েছেন যে তিনি একজন সৎ নারী এবং তাকে ক্ষমা এবং উত্তম রিযিকের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।(বিস্তারিত জানতে দেখুন সূরা নূর: ২৪: ১১-২৬)
.
(৩).তার অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে একটি হল যখন আল্লাহ তা’আলা নবী (ﷺ) এর স্ত্রীদেরকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা দেওয়ার জন্য আয়াত নাজিল করলেন, তখন তিনি প্রথমে নিজ স্ত্রীদেরকে সেই অধিকার প্রয়োগের সুযোগ দিলেন। তিনি নিজ স্ত্রীদের মধ্যে সবার আগে তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা- কে বলেন। ঘটনাটি হচ্ছে ৫ম হিজরীতে খন্দক যুদ্ধের পর বনু কুরায়যার বিজয় এবং গণীমতের বিপুল মালামাল প্রাপ্তির ফলে মুসলমানদের মধ্যে স্বাচ্ছন্দ্য ফিরে আসে। এ প্রেক্ষিতে পবিত্রা স্ত্রীগণ রাসূল (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর নিকটে তাদের ভরণ-পোষণের পরিমাণ বৃদ্ধির আবেদন জানান। এতে আল্লাহর রাসূল (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মর্মাহত হন এবং তাদেরকে তালাক গ্রহণের এখতিয়ার প্রদান করেন। উক্ত মর্মে আয়াতে ‘তাখয়ীর’ (آية التخيير) নাযিল হয় (সূরা আহযাব ৩৩/২৮-২৯)। উক্ত আয়াত নাযিলের পর রাসূল (ﷺ) আয়েশাকে তার পিতা-মাতার সঙ্গে পরামর্শ করতে বললে তিনি বলে ওঠেন,এজন্য পিতা-মাতার সাথে পরামর্শের কি আছে? আমি তো আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এবং আখেরাতকে কবুল করে নিয়েছি’। তিনি বলেন, অতঃপর অন্যান্য স্ত্রীগণ সকলেই আমার পথ অনুসরণ করলেন’”(সহীহ বুখারী: ৪৭৮৫-৮৬; মুসলিম: ১৪৭৫; মিশকাত: ৩২৪৯; আহযাব ৩৩/২৮-২৯)
.
(৪).তিনি রাসূল (ﷺ) এর সর্বোত্তম স্ত্রীদের একজন:
.
“রাসূল ﷺ বলেছেন:” সকল নারীর উপর ‘আয়েশার মর্যাদা এমন, যেমন সকল খাদ্যের উপর সারীদের মর্যাদা।”(সহীহ বুখারী: ৩৪৩৩)
.
(৫). তিনি নবী (ﷺ) এর সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রী:
.
প্রখ্যাত সাহাবী আনাস ইবনু মালিক (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) [মৃত: ৯৩ হি.] বলেন, নবী (ﷺ)-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: “আপনার নিকট সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তি কে?” তিনি বললেন, “আয়েশা।” (সহিহ বুখারি: ৩৬৬২)
.
(৬).রাসূল (ﷺ) আম্মাজান আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহাকে ভীষণ ভালোবাসতেন:
.
আম্মাজান আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহাকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অত্যন্ত ভালোবাসতেন। আর ভালোবাসা ও আদরের বর্হিপ্রকাশ হিসেবে তিনি তাকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উপাধীতে ডাকতেন। হাদিসে এমন মোট ৬টি নাম বা উপাধী পাওয়া যায়। নিম্নে সেগুলো তুলে ধরা হল:(১) আয়েশ (আয়শা থেকে শেষ অক্ষর বিলুপ্ত করে): (২) হুমায়রা। (৩) ইবনাতুস সিদ্দীক (সিদ্দিক এর মেয়ে)। (৪) ইবনাতু আবি বকর (আবু বকরের মেয়ে)। (৫) মুওয়াফফাকা (আল্লাহর তওফিক প্রাপ্তা)। (৬) উম্মে আব্দুল্লাহ।(নাসাঈ, সুনানুল কুবরা, হা/৮৯০২; সিলসিলা সহীহাহ, হা/৩২৭৭)
.
(৭).ফেরেশতার মাধ্যমে নবী (ﷺ) কে তার সাথে বিবাহের সংবাদ দেওয়া হয়েছিল:

আয়িশাহ্ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন একদিন রাসূল (ﷺ) আমাকে বললেন, তোমাকে তিন রজনীতে স্বপ্নযোগে আমাকে দেখানো হয়েছে। একজন মালাক (ফেরেশতা) তোমাকে রেশমি কাপড়ে জড়িয়ে নিয়ে এসে আমাকে বলেন, ইনি আপনার স্ত্রী। তখন আমি তোমার চেহারার কাপড় খুললাম। তখন দেখতে পেলাম, তুমিই। অতঃপর আমি (মনে মনে) বললাম, এটা যদি আল্লাহর তরফ থেকে হয়ে থাকে, তাহলে অবশ্যই পূর্ণ হবে।”(সহীহ বুখারী: ৩৮৯৫, মুসনাদে আহমাদ: ২৪১৮৮, সহীহুল জামি: ৯১৫)

(৮).তিনি রাসূল (ﷺ) এর একমাত্র স্ত্রী যার সাথে একই বিছানায় শয়নকালে রাসূল (ﷺ) এর ওপর ওয়াহী অবতীর্ণ হয়েছে।
.
কিতাবুল খামিসে ‘আয়েশা (রদিয়াল্লহু আনহা) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর সাথে লেপের নিচে ছিলাম তখন এই আয়াত নাযিল হয়।(اِنَّکَ لَا تَهۡدِیۡ مَنۡ اَحۡبَبۡتَ) “নিশ্চয় আপনি যাকে চান তাকে হিদায়াত দান করতে পারেন না” (সূরাহ আল কাসাস ২৮: ৫৬)। এমনকি রাসূল (ﷺ) অপর স্ত্রী উম্মু সালামাহ্ রদিয়াল্লহু আনহাকে উদ্দেশ্য করে বলেন,”হে উম্মু সালামাহ্! আয়েশা’র সম্পর্কে তুমি আমাকে কষ্ট দিয়ো না। কেননা একমাত্র ‘আয়েশাহ্ ছাড়া আর কোন স্ত্রীর সাথে এক কাপড়ে থাকাকালে আমার কাছে ওয়াহী আসেনি।”(সহীহ বুখারী: ২৫৮১,নাসায়ী: ৩৯৫০)
.
(৯).তিনি কুরআন ও হাদিস সম্পর্কে গভীর জ্ঞানী ছিলেন:
.
ইমাম যুহরি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: “যদি আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) এর সমস্ত জ্ঞান অন্য সকল মহিলাদের জ্ঞানের সাথে তুলনা করা হয়, তবে আয়েশার জ্ঞানই বেশি হবে।”(ইমাম জুরকানি, আল-ইসাবাহ; খণ্ড: ৮; পৃষ্ঠা: ১০৩) আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা এর বিভিন্ন বিষয়ে ব্যাপক জ্ঞান সম্পর্কে তাঁর ছাত্র উরওয়া ইবন্ যুবায়র রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেছেন,‘‘আমি কুরআন, ইসলামের ফরযসমূহ, হালাল ও হারাম, কাব্য ও সাহিত্য, আরবদের ইতিহাস ও নসবনামা বিষয়ক জ্ঞানের ক্ষেত্রে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা-এর চেয়ে অধিক জ্ঞানী লোক আর দেখি নি।”(হাফিয যাহাবী তাযকিরাতুল হুফফাজ, ১ম খণ্ড, বৈরুতঃ দারু ইহ্ইয়ায়িত্ তুরাসিল আরাবী, তা. বি., পৃষ্ঠা: ২৭)
.
(১০) তিনি ছিলেন অন্যান্য সাহাবিদের শিক্ষক:
.
তার অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলির মধ্যে একটি হল: তিনি ছিলেন সাহাবীদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফকীহা, হাদিস ও সুন্নাহর প্রথম কর্তা এবং ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ মহিলা ফকীহা।সর্বশ্রেষ্ঠ সাহাবাগণ, যখন দ্বীনের কোনও বিষয়ে বিভ্রান্ত হতেন, তখন তার সাথে পরামর্শ করতেন এবং তার কাছ থেকে তাদের অন্বেষণ করা জ্ঞান খুঁজে পেতেন। তিনি শুধু নারীদের নয় পুরুষদেরও শিক্ষয়িত্রী ছিলেন, বড় বড় সাহাবী ও তাবিয়ী তাঁর নিকট হতে হাদীস, তাফসীর ও জরুরী মাসায়েল শিখতেন। হাদীসে এসেছে,আবূ মূসা আল আ’শআরী (রদিয়াল্লহু আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -এর সাহাবীগণ যখনই কোনো মাসআলায় সন্দেহ বা সমস্যায় পড়তাম, “আয়েশাহ্ (রদিয়াল্লহু আনহা)-কে প্রশ্ন করলে তার কাছে তার সঠিক উত্তর বা সমাধান পেয়ে যেতাম।”(তিরমিযী: ৩৮৮৩)
.
(১১).তিনি মহিলা সাহাবীদের মাঝে সর্বাধিক হাদিস বর্ণনাকারী ছিলেন:
.
তিনি কুরআন, হাদীস ইসলামী আইন প্রভৃতি বিষয়ে অত্যন্ত পারদর্শী ছিলেন। যে আট জন সাহাবী সর্বাধিক সংখ্যক হাদীস বর্ণনা করেছেন তাদের মধ্যে আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা ছিলেন তৃতীয়। অনেক বিশিষ্ট সাহাবী ও তাবিয়ী তার কাছে হাদিস শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। তিনি প্রায় ২,২১০টি হাদিস বর্ণনা করেছেন যা ইসলামি শরীয়তের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।”(মুসনাদ আহমদ হা/ (২৫৭৫৭) তন্মধ্যে ১৭৪টি মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ, ৫৪টি এককভাবে বুখারী ও ৯টি এককভাবে মুসলিম। বাকী ১৯৭৩টি মুসনাদে আহমাদ সহ অন্যান্য হাদীস গ্রন্থে।(আল-বিদায়াহ ৩/১২৮)
.
(১২).তিনি ছিলেন সবচেয়ে বিশুদ্ধ আরবীভাষী:

মূসা ইবনু ত্বলহাহ্ (রহিমাহুল্লাহ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, “আয়েশাহ্ (রদিয়াল্লহু আনহা) এর চেয়ে শুদ্ধভাষী আর কাউকে দেখিনি।”(তিরমিযী: ৩৮৮৪, আল মু’জামুল কাবীর লিত্ব তবারানী: ১৮৮১৩)
.
(১৩). তিনি দুনিয়াতেই জান্নাতের সুসংবাদ পেয়েছেন:

আয়েশাহ্ (রদিয়াল্লহু আনহা) হতে বর্ণিত, একদিন জিবরীল (আলায়হি ওয়া সালাম) তাঁর (আয়েশাহ্ রদিয়াল্লহু আনহার ) আকৃতির একটি জিনিসের উপর সবুজ বর্ণের রেশমি কাপড়ে পেঁচিয়ে এনে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) -কে বললেন, ইনি ইহকালের ও পরকালের আপনার স্ত্রী হবেন।(তিরমিযী: ৩৮৮০, সহীহ ইবনু হিব্বান: ৭০৯৪)
.
(১৪). আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহাকে সর্বশ্রেষ্ঠ ফেরেস্তা জিবরীল (আলাহিস ওয়া সালাম) রাসূল (ﷺ) এর মাধ্যমে সালাম পাঠিয়েছেন:
.
আয়েশাহ্ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বলেন, (একদিন) রাসূল (ﷺ) আমাকে বলেছেন, হে ‘আয়েশাহ্! এই যে জিবরীল (আলায়হি ওয়া সালাম) তোমাকে সালাম বলেছেন।”(সহীহ বুখারী: ৩৭৬৮,মুসনাদে আহমাদ: ২৪৬১৮; সহীহুল জামি: ৭৯১৫)
.
(১৫). তিনি ছিলেন অত্যন্ত ধৈর্যশীল ও আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুলকারী:

ষষ্ট হিজরীতে কতিপয় মুনাফিক উম্মুল মু’মিনীন আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু আনহার বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদ দেয়, তখন তিনি সবকিছু আল্লাহর ওপর ছেড়ে দেন। ঘটনাটির সারাংশ এমন যে,আয়েশা (রদিয়াল্লহু আনহা) বলেন, রাসূল (ﷺ) আমাকে অপবাদ নিয়ে কিছু না বলেই এক মাস অপেক্ষা করেছিলেন। পরে তিনি আমাকে বললেন, যদি তুমি পবিত্র হও, আল্লাহ তোমাকে মুক্ত করবেন; আর যদি গুনাহ হয়, তওবা করো। আমি তখন সবাইকে উদ্দেশ্য
বললাম, আমি জানি আপনারা এ অপবাদের ঘটনা শুনেছেন, আপনারা তা বিশ্বাস করেছেন এবং বিষয়টি আপনাদের মনে বদ্ধমূল হয়ে আছে। এখন যদি আমি বলি যে, এর থেকে আমি পবিত্র তাহ’লে আপনারা আমাকে বিশ্বাস করবেন না। আর যদি আমি এ অপরাধের কথা স্বীকার করে নেই, যে সম্পর্কে আল্লাহ জানেন যে, আমি এর থেকে পবিত্র, তাহ’লে আপনারা তা বিশ্বাস করবেন। আল্লাহর কসম! আমি ও আপনারা যে বিপাকে পড়েছি এর জন্য ইউসুফ (আলায়হি ওয়া সাল্লাম)-এর পিতার কথা ব্যতীত আমি কোন দৃষ্টান্ত খুঁজে পাচ্ছি না। তিনি বলেছিলেন, ‘পূর্ণ ধৈর্যই শ্রেয়। তোমরা যা বলছ, এ ব্যাপারে আল্লাহই একমাত্র আমার আশ্রয়স্থল।(বিস্তারিত সূরা নূর: ১১-২০; সহীহ আল-বুখারী, খণ্ড ২, পৃ. ৯৪৫ হা/৪১৪১)
.
(১৬).তিনি ছিলেন দানশীল এবং সহজ-সরল জীবন যাপন করতেন:

আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা এর নিকট আল্লাহর পক্ষ হতে রিযিক হিসেবে যা কিছু আসতো তা জমা না রেখে সদাকাহ করে দিতেন।”(সহীহ বুখারী: ৩৫০৫) আয়েশা (রদিয়াল্লহু আনহা) একবার ৭০,০০০ দিরহাম দান করে দিলেন, অথচ তাঁর নিজের জন্য কিছুই রাখলেন না।(সহিহ বুখারি: ২৪৩৪) দান-সদকার প্রতি তাঁর আগ্রহ এতটাই বেশি ছিল যে তাঁর বেশি দান-সদকা নিয়ে মন্তব্য করায় তিনি তাঁর প্রিয় বোনের ছেলে আবদুল্লাহ ইবনে জুবায়ের রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু এর সঙ্গে অভিমান করে বহুদিন কথা বলেননি।(সহীহ বুখারী: ৩৫০৫)
.
(১৭). রাসূল (ﷺ) তার ঘরে এবং তার কোলে মৃত্যু বরন করেছেন:

তার অনন্য বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি হলো: আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তার ঘরে, তার দিনে, তার কোলে ইন্তেকাল করেছিলেন এবং তাকে তার ঘরেই দাফন করা হয়েছিল।”(সহিহ বুখারি: ৪৪৪২)

(১৮).তার অনন্য বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি হল লোকেরা তার দিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে তাদের উপহার নিয়ে আসার চেষ্টা করত, যাতে তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নৈকট্য লাভ করতে পারে। তাই তারা তাঁর পছন্দের জিনিসপত্র নিয়ে আসত। আয়েশা (রদিয়াল্লহু আনহা) বলেন, লোকেরা আয়েশার পালার দিন ঠিক রাখত। ঐদিন তারা রাসূল (ﷺ) কে খুশী করার জন্য নানাবিধ হাদিয়া পাঠাতো। স্ত্রীগণ দু’দলে বিভক্ত ছিলেন। সওদা, আয়েশা, হাফসা. ও সাফিয়া এক দলে এবং উম্মে সালামাহ ও বাকীগণ আরেক দলে। শেষাক্ত দলের স্ত্রীগণের অনুরোধে উম্মে সালামাহ রাসূল (ﷺ) কে একদিন বললেন আপনি লোকদের বলে দিন, তারা যেন আপনি যেদিন যে স্ত্রীর কাছে থাকেন, সেদিন সেখানে হাদিয়া পাঠায়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বললেন, হে উম্মে সালামাহ! তুমি আমাকে আয়েশার ব্যাপারে কষ্ট দিয়ো না। উম্মে সালামাহ তওবা করলেন। পরে তারা উক্ত বিষয়ে ফাতেমাকে রাসূল (ﷺ) এর কাছে পাঠালেন। সেখানেও রাসূল (ﷺ) একই জবাব দিলেন এবং বললেন, ফাতেমা! আমি যা পসন্দ করি, তুমি কি তা পসন্দ করো না? তাহলে তুমি আয়েশাকে ভালোবাস।(বুখারী: ২৫৮১; মুসলিম: ২৬০৩; মিশকাত: ৬১৮০ ‘মর্যাদা সমূহ’ অধ্যায়-৩০, ‘নবীপত্নীগণের মর্যাদা’ অনুচ্ছেদ-১১।
.
(১৯). নবী (ﷺ) তাঁর প্রতি আল্লাহর ভালোবাসার দোয়া করেছিলেন:

আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসূল ﷺ দোয়া করলেন:”হে আল্লাহ! আয়েশার অতীত ও ভবিষ্যতের, গোপন ও প্রকাশ্য সকল গুনাহ ক্ষমা করে দাও।”তখন আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা এত হাসলেন যে, তার মাথা রাসূলের কোলে পড়ে গেল। রাসূল ﷺ বললেন, “তোমার কি আমার এই দোয়া ভালো লাগলো?”তিনি বললেন, “কেন আমার ভালো লাগবে না?”তখন রাসূল ﷺ বললেন, “আল্লাহর কসম! আমি এই দোয়া আমার উম্মতের জন্য প্রতি সালাতে করে থাকি।”(ইবনু হিব্বান: ৭১১১; সিলসিলা সহিহাহ: ৩৩৩৬)
.
(২০). রাসূল (ﷺ) তাঁর সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা করতেন, তাঁর মুখ থেকে খাবার গ্রহণ করতেন, তাঁর সাথে হাসি-ঠাট্টা করতেন।

আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বলেন, ‘একবার আমি রাসূূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সাথে এক অভিযানে বের হলাম, তখন আমি অল্প বয়সী ছিলাম, শরীর তেমন মোটা ছিল না।”আমি নবী (ﷺ)-এর সাথে দৌড় প্রতিযোগিতা করেছিলাম, প্রথমবার আমি জিতেছিলাম, পরে রাসূল (ﷺ) জিতেছিলেন।”(আবূ দাঊদ: ২৫৭৮; মুসনাদে আহমাদ: ২৬৩২০) অপর বর্ননায় আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি ঋতু অবস্থায় পানি পান করতাম, অতঃপর নবী করীম (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কে দিতাম। তিনি আমার মুখ লাগানো স্থানে মুখ রেখে পানি পান করতেন। আমি ঋতু অবস্থায় হাড়ের গোশত খেতাম। অতঃপর তা আমি তাকে দিতাম। তিনি আমার মুখ লাগানো স্থানে মুখ লাগিয়ে খেতেন’।(সহীহ মুসলিম: ৩০০; মিশকাত: ৫৪৭)
.
(২১).তাকে এমন ৯ টি বৈশিষ্ট দেয়া হয়েছে যা অন্য কোন স্ত্রীকে দেওয়া হয়নি:

আম্মাজান আয়েশা (রাদিয়াল্লাহু আনহা) বলেন: আমাকে নয়টি বৈশিষ্ট দেয়া হয়েছে, যা মারইয়াম বিনতে ইমরান ব্যতীত কোনো নারীকে দেয়া হয়নি। (১).আমার ছবি নিয়ে জিবরিল আলায়হি ওয়া সালাম অবতরণ করেন, অতঃপর আমাকে বিয়ে করার জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে নির্দেশ দেন।(২).তিনি শুধু আমাকেই কুমারী বিয়ে করেছেন, আমি ব্যতীত তিনি কোন কুমারী বিয়ে করেননি।(৩).যখন তার রূহ কব্জা করা হয়, তখন তার মাথা আমার কোলে ছিল। (৪).তাকে আমার ঘরেই কবর দিয়েছে। (৫).ফেরেশতারা আমার ঘর ঘিরে রেখেছিল। (৬).ফেরেশতারা যদি তার কাছে অহী নিয়ে আসত, আর তিনি তার স্ত্রীর সাথে থাকতেন তারা দূরে সরে যেত, যদিও ফেরেশতারা তখনও তার নিকট আসত, যখন আমি তার সাথে তার লেপের ভেতর থাকতাম। (৭).আমি তার খলীফা ও একনিষ্ঠ বন্ধুর মেয়ে। (৮).আমার পবিত্রতা আসমান থেকে নাযিল হয়েছে। (৯).আমি পবিত্র অবস্থায় পবিত্র ব্যক্তির নিকট জন্ম গ্রহণ করেছি। আমাকে আল্লাহর মাগফিরাত ও সম্মানিত রিযকের ওয়াদা করা হয়েছে”। {আবু ইয়ালা: ৪৬২৬ সনদ সহীহ জয়ীফ নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে)

পরিশেষে, উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিষ্কার যে আম্মাজান আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা ছিলেন ইলম, তাকওয়া ও ধৈর্যের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। তিনি কেবল নবী (ﷺ) এর স্ত্রীই নন, বরং একজন শিক্ষক, ফকিহা ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর জীবনী ও গুণাবলী আমাদের জন্য অনুসরণীয়। আল্লাহ আমাদের সবাইকে আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা এর শিক্ষা থেকে উপকৃত হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমীন! (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
_____________________________
✍️জুয়েল মাহমুদ সালাফি

Share: