প্রশ্ন: আমার দাদার বয়স ১০০+ তিনি পূর্বে নিয়মিত যথাসময়ে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করতেন কিন্তু বর্তমানে তিনি সালাত ভুলে গেছেন। আমরা উনাকে সালাত আদায়ের কথা বললে তিনি হা করে তাকিয়ে থাকেন। প্রশ্ন হলো আমার দাদার সালাতের বাধ্যবাধকতা কি এখনও আছে নাকি এটি তার থেকে উঠে গিয়েছে?
▬▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর আমাদের প্রসিদ্ধ সালাফদের থেকে বর্নিত একটি সাধারণ মূলনীতি হচ্ছে, personality disorders (ব্যক্তিত্বের ব্যাধি) কিংবা psychotic disorders (মানসিক বিকৃতি) গ্রস্ত ব্যক্তি: যতটুকুর বোধ ও বিবেক রাখেন ততটুকুর ক্ষেত্রে তিনি মুকাল্লাফ (শরয়ি দায়িত্বপ্রাপ্ত)। কেননা শরয়ি দায়িত্বারোপ ও নির্দেশ আরোপিত হওয়ার সম্পর্ক বিবেকের সাথে; অনুভূতির সাথে নয়। তাই প্রশ্নের উল্লেখিত বিষয়টি যদি আপনার বর্ণনার সঙ্গে মিলে যায়,এবং বার্ধক্যের কারণে যদি আপনার দাদা তার মানসিক স্থিতি হারিয়ে ফেলেন,তাহলে তিনি আর সালাত আদায়ের জন্য বাধ্য থাকবেন না। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:رُفِعَ الْقَلَمُ عَنْ ثَلَاثَةٍ : عَنْ النَّائِمِ حَتَّى يَسْتَيْقِظَ ، وَعَنْ الصَّبِيِّ حَتَّى يَحْتَلِمَ ، وَعَنْ الْمَجْنُونِ حَتَّى يَعْقِلَ)”তিন ব্যক্তি থেকে কলম তুলে নেয়া হয়েছে: ঘুমন্ত ব্যক্তি যতক্ষণ পর্যন্ত না সে না জাগে, নাবালগ যতক্ষণ পর্যন্ত না যুবক না হয় এবং জ্ঞানহারা ব্যক্তি যতক্ষণ পর্যন্ত না সে জ্ঞান ফিরে পায়”।[সুনানে তিরমিযি হা/১৪২৩), ইমাম আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) ‘সহিহুত তিরমিযি’ গ্রন্থে হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন]
.
বার্ধক্য বলতে এমন এক পর্যায় বোঝানো হয়েছে যখন একজন ব্যক্তি বয়সের ভারে তার মানসিক স্থিতি হারিয়ে ফেলেন। ‘আওনুল মাবুদ’-এ বলা হয়েছে, যদিও বার্ধক্যের প্রসঙ্গ উল্লেখকারী বর্ণনাটি সনদের দিক থেকে দুর্বল (দাঈফ), তবুও এর অর্থকে বৈধ মনে করা হয়েছে। শাইখ মাহমুদ খাত্তাব আস-সুবকী (রহঃ) বলেছেন: এই তিনটি অবস্থার সঙ্গে বার্ধক্যকেও যুক্ত করা যেতে পারে যা একটি গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা। এতে বোঝানো হয়েছে অত্যধিক বার্ধক্যের কারণে যিনি তার চিন্তা ও কার্যক্ষমতা হারিয়েছেন। প্রবীণ বয়সে বিভ্রান্তি দেখা দিতে পারে এবং এমন অবস্থায় তারা দায়িত্ব পালন করতে অপারগ/অসমর্থ হয়ে পড়েন। তবে তাদের ‘উন্মাদ’ (পাগল) বলা ঠিক নয়। কারণ উন্মাদনাকে চিকিৎসার মাধ্যমে উন্নত করা যায় কিন্তু বার্ধক্যজনিত সমস্যা সাধারণত করা যায় না। তাই এই ধরনের প্রবীণদের ক্ষেত্রে হাদীসে বলা হয়নি “যতক্ষণ না তিনি সুস্থ হন,” কারণ তাদের সুস্থ হওয়া প্রায় অসম্ভব। তবে যদি তারা কখনো তাদের পূর্ণ জ্ঞান ফিরে পান তখন তারা পুনরায় শরীয়তের মুকাল্লাফ (শরয়ি দায়িত্বাধীন) হবেন, এমনকি সে যদি তার অনুভূতিগুলো হারিয়ে ফেলে তবুও কিংবা কিছু অনুভূতি হারিয়ে ফেলে তবুও।(বিস্তারিত জানতে দেখুন ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৯০১৮৯)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:
بشروط : أولها : العقل. الثاني : البلوغ. الثالث : الإسلام. الرابع : القدرة. الخامس : الإقامة. السادس : الخلو من الحيض والنفاس بالنسبة للنساء.
– الأول : العقل وضده فقد العقل ، سواءً بجنون أو خرف يعني : هرم ، أو حادث أزال عقله وشعوره ، فهذا ليس عليه شيء ؛ لفقد العقل ، وعلى هذا فالكبير الذي وصل إلى حد الهذرمة ليس عليه صيام ولا إطعام ؛ لأنه لا عقل له ، وكذلك من أغمي عليه بحادث أو غيره فإنه ليس عليه صوم ولا إطعام ؛ لأنه ليس بعاقل ” ا
বার্ধক্যের কারণে একজন ব্যক্তি দায়িত্বমুক্ত বিবেচিত হতে পারেন। কিছু শর্ত পূরণ না হলে রোযা ফরজ নয়। যেমন ১. সুস্থ মস্তিষ্ক থাকা। ২. প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া। ৩. মুসলিম হওয়া। ৪. শারীরিকভাবে সক্ষম হওয়া। ৫. ভ্রমণকারী না হওয়া। ৬. নারীদের ক্ষেত্রে মাসিক বা নিফাস অবস্থায় না থাকা।
প্রথম শর্ত বুদ্ধি এর বিপরীত হলো বুদ্ধিহীনতা। এটি হতে পারে পাগলামি, বার্ধক্যজনিত ভ্রান্তি (যেমন: মস্তিষ্কের দুর্বলতা) বা কোনো দুর্ঘটনার কারণে মানসিক সচেতনতা হারানো। এমন অবস্থায় কেউই দায়বদ্ধ নয়, কারণ তার সচেতন বিবেচনাশক্তি নেই। যদি কোনো বৃদ্ধ ব্যক্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যান যেখানে তিনি সঠিকভাবে কথা বলতে পারেন না বা তার জ্ঞানবুদ্ধি কার্যকর থাকে না, তবে তার ওপর রোজা রাখার দায়িত্ব নেই। একইভাবে, তার ফিদইয়া (রোজার পরিবর্তে অভাবীদের খাওয়ানো) দেওয়াও বাধ্যতামূলক নয়। ঠিক তেমনই, যে ব্যক্তি কোনো দুর্ঘটনা বা অন্য কোনো কারণে অজ্ঞান অবস্থায় থাকে, তার ওপরও রোজা রাখা বা ফিদইয়া দেওয়ার দায়িত্ব বর্তায় না, কারণ তার বুদ্ধি সচল অবস্থায় নেই”। (ইবনু উসামীন লিক্বাউল বাব আল-মাফতূহ, লিক্বা নং-১২৩)
.
সৌদি আরবের ইমাম মুহাম্মাদ বিন সা‘ঊদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অনুষদ সদস্য ও অধ্যাপক, আকিদা ও ফিকহের প্রাজ্ঞ পণ্ডিত, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ ‘আব্দুর রহমান বিন নাসির আল-বাররাক (হাফিযাহুল্লাহ) [জন্ম: ১৩৫২ হি./১৯৩৩ খ্রি.]-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল “একজন বৃদ্ধ ব্যক্তি আছেন, যিনি কেবল অন্য কাউকে সালাত আদায় করতে দেখলে সালাতের কথা মনে রাখতে পারেন। তবে তিনি সালাতের অন্যান্য অংশ, যেমন তাকবির ও কোরআনের তেলাওয়াত, ঠিকঠাক মনে করতে পারেন। এই অবস্থায়, কি তাকে সালাত আদায়ের জন্য নির্দেশ দেওয়া হবে, নাকি বয়স ও অবস্থার কারণে তাকে এ দায়িত্ব থেকে মুক্ত রাখা হবে?”
জবাবে শাইখ বলেছেন:
بأنه لا يؤمر بالصلاة ، وهو يشبه الطفل الذي إذا رأى أباه يصلي قام بجانبه ، فليس عنده من التمييز والإدراك ما يكفي لبقاء التكليف عليه
“এমন ব্যক্তিকে সালাত আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হবে না, কারণ তার অবস্থা সেই ব্যক্তির মতো, যার মধ্যে প্রয়োজনীয় সচেতনতা বা বোধগম্যতা নেই, যেমন শিশুদের ক্ষেত্রে দেখা যায়। তাই তাকে শারিয়তের দৃষ্টিতে দায়িত্বশীল হিসেবে গণ্য করা হয় না। আর আল্লাহই সর্বজ্ঞ।(ইসলামি সওয়াল-জবাব, ফাতাওয়া নং: ১৩০৭৫৪)
.
অতএব, উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিষ্কার যে ব্যক্তি বার্ধক্যের কারণে তার জ্ঞান-বুদ্ধি হারিয়েছে এবং সালাত বা অন্যান্য ইবাদতের মধ্যে পার্থক্য করতে সক্ষম নয় তিনি আর সালাত আদায় করতে বাধ্য নন।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
___________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।