অমুসলিম দ্বারা জুলুম নির্যাতনে ক্ষতিগ্রস্ত মুসলিম ভাই-বোনদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য

প্রশ্ন: ফি-লি-স্তি-নে ই-হু-দি দ্বারা জুলুম নির্যাতনে ক্ষতিগ্রস্ত মুসলিম ভাই-বোনদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য কী?”
▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬

উত্তর: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। সমস্ত প্রশংসা বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্য। আমাদের নবী মুহাম্মদের প্রতি, তাঁর পরিবার-পরিজন ও সাহাবীগণের প্রতি আল্লাহর রহমত ও শান্তি বর্ষিত হোক। অতঃপর ইসলামের দৃষ্টিতে ফি-লি-স্তী-নে-র মর্যাদা অপরিসীম। মসজিদুল আকসা মুসলিমদের তৃতীয় পবিত্র ও সম্মানিত স্থান। এটি হাজার হাজার নবী-রাসূল [আলাইহিমুস সালাম]-এর আগমনের পুণ্যভূমি। সকল মুসলিমের প্রাণের কেন্দ্রস্থল বাইতুল মাকদিস। আল্লাহ তা‘আলা এই স্থানকে বিশেষভাবে বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত করেছেন। প্রতিটি মুসলিমের সাথে এই মসজিদের রয়েছে এক গভীর সম্পর্ক, যা আমাদের আধ্যাত্মিক ঐক্য ও বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু। ফি-লি-স্তী-নে-র সাথে প্রতিটি মুসলিমের সম্পর্ক হচ্ছে ঈমানী সম্পর্ক, ইসলামী সম্পর্ক ও আক্বীদা-বিশ্বাসের সম্পর্ক। এক কথায় ধর্মীয় বা দ্বীনি সম্পর্ক। ফি-লি-স্তী-ন সম্পর্কে অধিকাংশ মুসলিম জানেন না। অথচ এ বিষয়টি জানা প্রত্যেক মুসলিমের ঈমানী দায়িত্ব ও ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তাই এ সম্পর্কে যদি জ্ঞান না থাকে তাহলে জ্ঞান অর্জন করা উচিত। অনেকেই মনে করেন যে, ফি-লি-স্তী-নে-র যে সমস্যা নিতান্তই কেবল তাদেরই সমস্যা কিন্তু এই ধারণা ভুল বরং ফি-লি-স্তি-নি-দে-র বর্তমান সংকট শুধু তাদের একার নয়; এটি পুরো মুসলিম উম্মাহর হৃদয়ের রক্তক্ষরণ। এ সংকটের ভার বহনের দায়িত্ব সকল মুসলিম রাষ্ট্র ও জনগণের সম্মিলিত দায়িত্ব। সুতরাং ফি-লি-স্তি-নে-র মুসলিমদের জন্য আমাদের বিভিন্ন ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব, যা তাদের সাহায্য করতে এবং তাদের সংগ্রামে সমর্থন প্রদান করতে সাহায্য করতে পারে। কিছু সম্ভাব্য পদক্ষেপ হতে পারে:
.
(১). সর্বপ্রথম কাজ হচ্ছে নিজেকে পরিশুদ্ধ করা। দুঃখজনক হলেও সত্যি আজকের এই সময়ে মানুষের মধ্যে আল্লাহভীতির বড়ই অভাব। অথচ পরকালীন সফলতা অর্জন করার জন্য দু’টি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত, নিজের আত্মা ও চরিত্রকে পরিশুদ্ধ করা এবং দ্বিতীয়ত, আল্লাহ পাককে যথাযথভাবে ভয় করা (সূরা বাকারাহ: ১৮৯, সূরা আ‘লা: ১৪; সূরা শামস: ৯)। নিজের আত্মশুদ্ধি লাভের জন্য অন্তরে আল্লাহভীতির উপস্থিতি অপরিহার্য। আসলে এই দুই বিষয় একে অপরের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। যখন অন্তরে আল্লাহভীতি থাকে তখন মানুষ যাবতীয় পাপাচার থেকে বিরত থাকে এবং এই বিরতির পরিণতিই তাকে আত্মিক পরিশুদ্ধতার দিকে নিয়ে যায়।
.
(২). প্রত্যেক মুসলিমের জানা উচিত যে ফি-লি-স্তি-নি-দে-র বর্তমান সংকট শুধু তাদের একার নয়; এটি সমগ্র মুসলিম উম্মাহর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ। এই সংকটের সমাধান ও তার ভার বহনের দায়িত্ব আমাদের সকলের, ঠিক যেমন এক দেহের কোনো অঙ্গ আঘাতপ্রাপ্ত হলে সারা দেহে যন্ত্রণার অনুভূতি হয়। তাই ফি-লি-স্তি-নে-র পক্ষে আমাদের ঐক্যবদ্ধ ও আন্তরিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা অত্যন্ত জরুরি।”
.
(৩). জুলুম নির্যাতনে ক্ষতিগ্রস্ত মুসলিম ভাই-বোনদের জন্য দু’আ এবং তাতে মনোযোগী হওয়া। দু’আর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রূপ হলো সালাতের সিজদায়, দোয়া কবুলের সময় গুলোতে দু’আ করা, কুনুত পাঠ করা। দু’আ এমন এক শক্তিশালী মাধ্যম যার দ্বারা আল্লাহ তাআলা মুমিনদেরকে শত্রুদের উপর বিজয় দান করেন।” হাদিসে এসেছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:”তোমাদের দুর্বলদের কারণেই তোমাদেরকে সাহায্য করা হয় এবং রুযী দেওয়া হয়।’’(তিরমিযী হা/১৭০২, আবূ দাউদ হা/২৫৯৪: রিয়াদুস সলেহিন হা/২৭৭) অপর বর্ননায় আল্লাহ্‌র নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন: আল্লাহ্ তা‘আলা এ উম্মতকে সাহায্য করেন তার দুর্বলদের দ্বারা, তাদের দু‘আ, সালাত এবং ইখলাসের কারণে।”(সুনানে নাসাঈ হা/৩১৭৮)
.
(৪). নির্যাতিত অসহায় মুসলিম ভাই-বোনদের জন্য যাকাতের অর্থ সাধারণ দান সদকা সংগ্রহ করুন এবং বিশ্বস্ত মাধ্যমে তাদের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করা। অভাবীদেরকে সাহায্য করা, গরীব-মিসকীনকে দান করা উত্তম নেক আমল ও ইবাদতের অন্তর্ভুক্ত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন: “সর্বোত্তম আমল হচ্ছে একজন মুমিনের মনে খুশি প্রবেশ করানো: আপনি তার লজ্জাস্থান আবৃত করলেন, তার ক্ষুধা দূর করলেন কিংবা তার কোন প্রয়োজন পূরণ করলেন।”(আল-মুজাম আত্‌-তাবারানী; ৫/২০২: ইমাম আলবানী ‘সহিহুত তারগীব’ হা/২০৯০)
.
(৫). ইসলামী দাতব্য সংস্থাগুলোর কার্যক্রমকে আরও সংগঠিত, কার্যকর ও টেকসই করে গড়ে তোলা প্রয়োজন যাতে তারা দরিদ্র-নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে এবং মানবতার কল্যাণে বাস্তব ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়।”
.
(৬). দুর্বলদের পাশে দাঁড়ানো শুধু মানবতা নয় বরং এটি ঈমানের দাবিও। এই সাহায্য এবং দুর্বলদের পাশে দাঁড়ানোর উপায়ের মধ্যে গণমাধ্যম একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম, যার মাধ্যমে সত্যকে তুলে ধরা যায় এবং বিশ্ববাসীর সামনে ফিলিস্তিনসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মুসলিমদের ওপর চলমান জুলুম, নিপীড়ন ও আগ্রাসনের নির্মম চিত্র স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করা যায়। এই চেতনা জাগ্রত করাই আজকের সময়ের এক অপরিহার্য দায়িত্ব।”
.
(৭). কুরআন সুন্নাহ সম্পর্কে জ্ঞানী, দাঈ, খতীব ও লেখকদের প্রতি আমাদের আহ্বান তারা যেন সাহসিকতার সঙ্গে বর্তমান সময়ের জুলুম ও অবিচারের চিত্র তুলে ধরেন, আমাদের দায়িত্বে গাফিলতির বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেন এবং উম্মতকে পবিত্র স্থানসমূহ রক্ষা ও পুনরুদ্ধারের জন্য জাগ্রত ও উজ্জীবিত করেন।”
.
(৮). মুমিনের অন্তরে সর্বদা জিহাদের প্রতি এক গভীর আকাঙ্ক্ষা ও প্রস্তুতি থাকা আবশ্যক যেন মুসলিম শাসকের পক্ষ থেকে আহ্বান এলেই সে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে আল্লাহর রাস্তায়। কেননা জিহাদে অংশগ্রহণের বাস্তব সামর্থ্য না থাকলেও অন্তরে তার প্রতি আকাঙ্ক্ষা থাকা আবশ্যক। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন:”যে ব্যক্তি মারা গেল অথচ সে কখনো জিহাদে অংশগ্রহণ করেনি এবং অন্তরেও জিহাদের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেনি, সে এক প্রকার নিফাকের (কপটতার) মধ্যে মৃত্যুবরণ করল।”(সহীহ মুসলিম হা/৩৫৩৩)
.
(৯). মুসলিম সন্তানদের এমনভাবে গড়ে তোলা যেন তারা দ্বীন-বিদ্বেষী ও ই-হু-দি শত্রুদের চক্রান্ত সম্পর্কে সচেতন হয় এবং তাদের বিরুদ্ধে জিহাদের জন্য ঈমানি চেতনা ও বীরত্বের সাথে প্রস্তুত থাকে।”
.
(১০). ইন্টারনেটের মাধ্যমে ই-হু-দি-দে-র বিরুদ্ধে চলমান মিডিয়া ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের জবাবে সক্রিয় অংশগ্রহণ করা, তাদের সংঘটিত অপরাধের বাস্তবতা বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরা এবং মিথ্যা ও অপপ্রচারের বিপরীতে সত্যের দীপ্ত কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠা।”
.
(১১). সম্মানিত সাংবাদিক ও মিডিয়া কর্মীদের সাথে যোগাযোগ রাখা এবং তাদের উৎসাহিত করা যেন তারা ন্যায় ও সত্যের পক্ষে দৃঢ়ভাবে কথা বলেন এবং অন্যদেরকে সেই পথে পরিচালিত করতে পারেন।
.
(১২). ই-স-রা-ই-লে-র তৈরী যাবতীয় পণ্য বয়কট করা। কেননা ই-স-রা-ই-লি পণ্যের বয়কট একটি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অন্যতম কার্যকর মাধ্যম। এর মাধ্যমে আমরা নিপীড়িত ফি-লি-স্তি-নি-দে-র প্রতি আমাদের সংহতি জানাতে পারি এবং দখলদারিত্ব ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে স্পষ্টভাবে অবস্থান নিতে পারি। প্রতিটি বর্জনই একটি বার্তা অন্যায়ের সাথে কোনও আপস নয়।”
.
(১৩). আন্তর্জাতিক মঞ্চে ফি-লি-স্তি-নে-র অধিকার ও স্বাধীনতার পক্ষে সক্রিয়ভাবে সমর্থন জানানো। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা, যেমন জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আঞ্চলিক সংগঠনগুলির মাঝে চিঠি পাঠিয়ে বর্বর ই-হু-দি-দে-র অপরাধ উন্মোচন করা।এবং
ফিলিস্তিনের অধিকার ও স্বাধীনতার বিষয়টি গুরুত্বসহকারে উত্থাপন করা।”
.
(১৪). পশ্চিমা দেশে বসবাসরত সকল মুসলিম ভাই ও বোনদের প্রতি আমাদের আহ্বান আপনারা নিজ নিজ দেশের নীতিনির্ধারকদের কাছে ন্যায়বিচারের দাবি তুলুন যেন তারা ই-হু-দি-বা-দী নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা গ্রহণ করে এবং ফি-লি-স্তি-ন-সহ বিশ্বের কোথাও যেন মানবাধিকারের লঙ্ঘন না ঘটে, সে বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে।”
.
(১৫). ফি-লি-স্তি-নে-র পরিস্থিতি সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা: সামাজিক মাধ্যম, সংবাদ মাধ্যম, এবং ব্যক্তিগত আলাপচারিতার মাধ্যমে বিশ্ববাসীর মধ্যে ফিলিস্তিনের সমস্যাগুলো তুলে ধরা এবং যুদ্ধবিরোধী প্রচারণাকে শক্তিশালী করা।
.
পরিশেষে,”হে বিশ্ব মুসলিম সম্প্রদায়! আপনারা কেন চুপ রয়েছেন? কতদিন পর্যন্ত আপনারা এই পৃথিবীজুড়ে হায়েনা রূপী কিছু পশুর দ্বৈত আচরণ সহ্য করবেন? কোথায় সেই বিশ্বশান্তি সংস্থা? কোথায় মানবাধিকার সংস্থা? কোথায় জাতিসংঘ? তারা কি নিজেদের প্রতিশ্রুতি ভুলে গেছে যা জাতিসংঘ সনদে দেওয়া হয়েছিল, যাতে প্রতিটি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এবং সীমানা সম্পর্কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে? অথচ, ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত অবৈধ ই-হু-দি রাষ্ট্র যার সীমানা এখনও আন্তর্জাতিকভাবে নির্ধারিত হয়নি, অবৈধভাবে ফি-লি-স্তি-নি-দে-র জমি দখল করে এবং নিরীহ মানুষদের হত্যা করে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করছে। এটি একটি চরম অমানবিকতা, যা শুধু ফি-লি-স্তি-ন নয় বরং পুরো আরব বিশ্বের প্রতি একটি ভয়াবহ আক্রমণ। জা-য়-ন-বা-দী ই-স-রা-ই-লে-র উদ্দেশ্য হল একসময় ইউফ্রেতিস থেকে নীলনদ, লোহিত সাগর থেকে তুর্কির সীমান্ত পর্যন্ত বিশাল অঞ্চল দখল করে বৃহত্তর ই-স-রা-ই-ল প্রতিষ্ঠা করা। তারা এখনো তাদের পরিকল্পনার চূড়ান্ত রূপ দেয়নি, কিন্তু যা কিছু হচ্ছে তা একটি ভয়ানক বাস্তবতা। জাতিসংঘ, ইউরোপ, এবং অন্যান্য পরাশক্তির দেশগুলো তাদের চুপ থাকতে বললেও, ইতিহাস সাক্ষী থাকবে তাদের এই নীরবতা কখনও ক্ষমা করবে না। ধিক, জাতিসংঘ! ধিক, ইউরোপ!” মহান আল্লাহ আমাদের নির্যাতিত ভাই-বোনদের সাহায্য করুন। আমীন!!
▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Share: