অমুসলিম থেকে ইফতারির খাবার বা অর্থ গ্রহণ করা এবং তাদেরকে ইফতারের দাওয়াত দেওয়া কিংবা তাদের সাথে একত্রে ইফতার করার বিধান

প্রশ্ন: শারঈ দৃষ্টিকোণ থেকে কোন অমুসলিম থেকে ইফতারির খাবার বা অর্থ গ্রহণ করা এবং তাদেরকে ইফতারের দাওয়াত দেওয়া কিংবা তাদের সাথে একত্রে ইফতার করার বিধান কি?
▬▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: প্রথমত: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর মুসলিমদের জন্য অমুসলিমদের দেওয়া ইফতার গ্রহণ করা জায়েজ এতে কোনো আপত্তি নেই। একইভাবে ইফতার কেনার জন্য অমুসলিমদের দেওয়া অর্থ গ্রহণ করাও বৈধ। কারণ এ ধরনের খাবার মূলত হাদিয়া (উপহার) বা হেবা (অনুদান) হিসেবে গণ্য হয় যা ইসলামে অনুমোদিত। তবে শর্ত হলো এই খাবার বা অর্থ যেন কোনো হারাম উৎস থেকে না হয় এবং এতে কোনো ধর্মীয় বা আকিদাগত বিভ্রান্তির আশঙ্কা না থাকে। ইসলামের উদারতা ও সৌজন্যবোধের আলোকে অমুসলিমদের দেওয়া উপহার গ্রহণ করা নীতিগতভাবে বৈধ ও গ্রহণযোগ্য। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কিছু কিছু কাফেরের কাছ থেকে হাদিয়া গ্রহণ করেছেন। আবু হুমাইদ আল-সাঈদি বলেন: “غزونا مع النبي صلى الله عليه وسلم تبوك ، وأهدى ملك أيلة للنبي صلى الله عليه وسلم بغلة بيضاء ، وكساه بُرداً “আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সাথে তাবুক যুদ্ধ করেছি। ‘আয়লা’-র বাদশা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে একটি সাদা রঙের খচ্চর উপহার দিয়েছেন এবং তাকে একটি চাদর দিয়েছেন।(সহিহ বুখারী হা/২৯৯০) আল-আব্বাস বিন আব্দুল মোত্তালিব হুনাইনের দিন সম্পর্কে বলেন:وَرَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى بَغْلَةٍ لَهُ بَيْضَاءَ أَهْدَاهَا لَهُ فَرْوَةُ بْنُ نُفَاثَةَ الْجُذَامِيُّ “রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটি সাদা রঙের খচ্চরের উপর ছিলেন; যে খচ্চরটি ফারওয়া বিন নুফাছা আল-জুযামি তাঁকে হাদিয়া দিয়েছিলেন।(সহিহ মুসলিম হা/১৭৭৫) অপর এক বর্ননায় আলী বিন আবু তালেব (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ‘দুমাত’ (একটি স্থান) এর ‘উকাইদির’ (রাজা) একটি রেশমী কাপড় হাদিয়া দিয়েছেন। তখন তিনি সেটা আলী (রাঃ) কে দিয়ে বললেন: “এটাকে কেটে খিমার (নারীর অবগুণ্ঠন) বানিয়ে ফাতেমাদেরকে দাও।”(সহিহ বুখারী হা/২৪৭২; ও সহিহ মুসলিম হা/২০৭১)

উপরোক্ত হাদিসগুলোর আলোকে শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন:في هذا الحديث جواز قبول هدية الكافر “এ হাদিসে কাফেরের হাদিয়া গ্রহণ করা বৈধ হওয়ার পক্ষে দলিল রয়েছে।”(নববী, শারহু মুসলিম খণ্ড: ১৪; পৃষ্ঠা: ৫০) আরেক বর্ননায় আনাস বিন মালেক (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে: এক ইহুদী মহিলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে একটি বিষযুক্ত ভেড়া নিয়ে আসে এবং তিনি সে ভেড়া থেকে খেয়েছেন।(সহিহ বুখারী হা/২৪৭৪; ও সহিহ মুসলিম হা/২১৯০)
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেছেন:
يجوز أكل هذه الحلوى مما يقدمه غير المسلمين للمسلمين في المناسبات العادية لا الدينية كولادة طفل ونحو ذلك ؛ لأن هذا من باب قبول هدية الكافر ، وقد ثبت عن النبي صلى الله عليه وسلم أنه قبل هدايا المشركين ” ا
“অমুসলিমেরা সাধারণ উপলক্ষসমূহে যেমন নতুন শিশুর জন্ম ও অন্যান্য উপলক্ষে মুসলিমদেরকে যে সব মিষ্টান্ন প্রদান করে সেগুলো খাওয়া জায়েয; ধর্মীয় উপলক্ষকেন্দ্রিক নয়। কেননা এগুলো কাফেরের প্রদত্ত হাদিয়া গ্রহণের পর্যায়ভুক্ত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে সাব্যস্ত হয়েছে যে, তিনি মুশরিকদের থেকে হাদিয়া গ্রহণ করেছেন।”(ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খণ্ড: ১০; পৃষ্ঠা: ৪৭০)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে জিজ্ঞেস করা হয়: আমার একজন অমুসলিম প্রতিবেশী আছে। কখনও কখনও বিভিন্ন উপলক্ষে সে আমাকে খাবার ও মিষ্টান্ন পাঠায়। এ খাবার আমি খাওয়া ও আমাদের বাচ্চাদেরকে খাওয়ানো কি জায়েয হবে?

জবাবে তিনি বলেন:

” نعم ، يجوز لك أن تأكل من هدية الكافر إذا أمنته ؛ لأن النبي صلى الله عليه وآله وسلم قبل هدية المرأة اليهودية التي أهدت إليه الشاة ، وقبل دعوة اليهودي الذي دعاه إلى بيته فأكل منه عليه الصلاة والسلام .
فلا حرج في قبول هدية الكفار ، ولا في الأكل من بيوتهم ، لكن بشرط أن يكونوا مأمونين ، فإن خيف منهم فإنها لا تجاب دعوتهم . وكذلك أيضا يشترط أن لا تكون المناسبة مناسبة دينية كعيد الميلاد ونحوه ، فإنه في هذه الحال لا يقبل منهم الهدايا التي تكون بهذه المناسبة ” .

“হ্যাঁ। যদি আপনি নিরাপদ মনে করেন তাহলে কাফেরের দেওয়া হাদিয়া খাওয়া আপনার জন্য জায়েয। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে যে ইহুদী মহিলা ভেড়া হাদিয়া দিয়েছে তিনি সেটা গ্রহণ করেছেন এবং যে ইহুদী তাঁকে তার বাসায় দাওয়াত করেছে তিনি তার দাওয়াত গ্রহণ করেছেন এবং তার খাবার খেয়েছেন।

তাই কাফেরদের হাদিয়া গ্রহণ করতে ও তাদের বাসায় খেতে কোন আপত্তি নেই। কিন্তু শর্ত হচ্ছে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। যদি কোন আশংকা থাকে তাহলে তাদের দাওয়াত গ্রহণ করা যাবে না। অনুরূপভাবে আরেকটি শর্ত হচ্ছে তাদের ধর্মীয় উপলক্ষ না হওয়া। যেমন খ্রিস্টমাস পালন ও এ ধরণের কোন উপলক্ষ। এ ধরণের অবস্থায় এ উপলক্ষকেন্দ্রিক তাদের হাদিয়া গ্রহণ করা যাবে না।”(ইবনু উসাইমীন, ফাতাওয়া নূরুন ‘আলাদ দারব, পৃষ্ঠা: ২৪/২) সুতরাং উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে অমুসলিমদের দেওয়া হাদিয়া, ইফতার গ্রহণ করা বৈধ যতক্ষণ না শরীয়ত বিরোধী কোনো শর্ত পাওয়া যায়।(আরো বিস্তারিত জানতে দেখুন; ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-২২১৬২১)
.
দ্বিতীয়ত: অমুসলিমদের সাথে একত্রে ইফতার করা জায়েজ কি?
.
অমুসলিমকে খাবারের জন্য আমন্ত্রণ জানানো বৈধ, বিশেষ করে যদি এর উদ্দেশ্য হয় তাকে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছানো, তার হৃদয়কে আকৃষ্ট করা এবং তাকে সত্যের পথে আহ্বান করা। এটি নেক আমলের অন্তর্ভুক্ত, কারণ এর মাধ্যমে মানুষকে হিদায়াতের দিকে ডাকতে সহায়তা করা হয়। এছাড়াও যদি আমন্ত্রিত ব্যক্তি অতিথি হন বা অভাবগ্রস্ত হন তবে তাকে আপ্যায়ন করাও ইসলামীর শিষ্টাচারের অন্তর্ভুক্ত। ইসলাম সেই সব অমুসলিমদের প্রতি সদাচরণ ও ন্যায়বিচার করতে উৎসাহিত করে, যারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে শত্রুতা পোষণ করে না বা তাদের আবাসভূমি থেকে উৎখাত করার চেষ্টা করে না। মহান আল্লাহ সুবিচার ও দয়া করতে ভালোবাসেন, আর ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয় মানবিকতা ও সদাচরণের আলোকে সকল মানুষের সঙ্গে উত্তম আচরণ করতে। যেহেতু আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: “যারা দ্বীনের ব্যাপারে তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে তোমাদের ঘরবাড়ি থেকে বের করে দেয়নি, তাদের সাথে সদাচার করতে ও তাদের প্রতি ন্যায়-বিচার করতে আল্লাহ্‌ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। নিশ্চয় আল্লাহ্‌ ন্যায়বিচারকারীদের ভালোবাসেন”।[সূরা মুমতাহিনা, আয়াত: ৮] এই আয়াতে যেসব কাফের মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তাদেরকে দেশ থেকে বহিষ্কারেও অংশগ্রহণ করেনি, তাদের সাথে সদ্ব্যবহার করার ও ইনসাফ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ন্যায় ও সুবিচার তো প্রত্যেক কাফেরের সাথেও জরুরী। এতে যিম্মি কাফের, চুক্তিতে আবদ্ধ কাফের এবং শক্র কাফের সবাই সমান। কোন কোন বর্ণনায় এসেছে, আসমা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহার জননী আবু বকর সিদ্দীক রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু-এর স্ত্রী ‘কুতাইলা’ হুদায়বিয়া সন্ধির পর কাফের অবস্থায় মক্কা থেকে মদীনায় পৌছেন। তিনি কন্যা আসমার জন্যে কিছু উপঢৌকনও সাথে নিয়ে যান। কিন্তু আসমা রাদিয়াল্লাহু আনহা সেই উপঢৌকন গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর কাছে জিজ্ঞাসা করলেনঃ আমার জননী আমার সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছেন, কিন্তু তিনি কাফের। আমি তার সাথে কিরূপ ব্যবহার করব? রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেনঃ জননীর সাথে সদ্ব্যবহার কর।(বুখারী: ২৬২০, ৩১৮৩, মুসলিম: ১০০৩, আবু দাউদ: ১৬৬৮, মুসনাদে আহমাদ: ৬/৩৪৭, ইবনে হিব্বান: ৪৫২)
.
পক্ষান্তরে অমুসলিম ব্যক্তি যদি ইসলামের সাথে শত্রুতা করে এবং মুসলিমদের ক্ষতি করার চেষ্টা করে এবং অমুসলিমদেরকে যদি ইসলামের দিকে আহ্বান করার কোনো ইচ্ছা না থাকে এবং সে অভাবগ্রস্তও না হয়, তাহলে তাকে দাওয়াত না দেওয়াই শ্রেয়। বরং এই খাবার মুসলিম আত্মীয়স্বজন ও দরিদ্র প্রতিবেশীদের মধ্যে বিতরণ করাই উত্তম। হাদিসে এসেছে, আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘মু’মিন মানুষ ছাড়া অন্য কারো সঙ্গী হয়ো না এবং তোমার খাবার যেন পরহেযগার ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ না খায়।’’(তিরমিযী হস/২৩৯৫,আবূ দাউদ হা/৪৮৩২) আরো বিস্তারিত জানতে দেখুন ইসলাম ওয়েব ফাতওয়া নং-৭৭০১০)

অতএব, ইসলামের দাওয়াতের স্বার্থে বা অভাবগ্রস্তদের সাহায্যার্থে অমুসলিমদের আমন্ত্রণ দেওয়া বৈধ, তবে অহেতুক সম্পর্ক গড়া বা অগ্রাধিকার দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা বাঞ্ছনীয়।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Share: