অপারেশনের মাধ্যমে জরায়ু অপসারণ করার হুকুম

প্রশ্ন: অপারেশনের মাধ্যমে জরায়ু অপসারণ করার হুকুম কি? যদি কোনো নারীর গর্ভাশয়ে (জরায়ু) অস্ত্রোপচার করা হয় এবং এর ফলে যদি পরবর্তীতে রক্তপাত হয় তাহলে কি সেই রক্ত হায়েজ হিসেবে বিবেচিত হবে?
▬▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর:

প্রথমত: পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর অপারেশনের মাধ্যমে জরায়ু অপসারণের হুকুম ইসলামিক শরিয়তের দৃষ্টিতে নির্ভর করে এর কারণ এবং পরিস্থিতির ওপর। শারঈ দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তা ভাবনা করলে অপারেশনের মাধ্যমে জরায়ু অপসারণ করার দুটি অবস্থা হতে পারে।

(১). অপারেশনের মাধ্যমে জরায়ু অপসারণের উদ্দেশ্য যদি শুধু জন্ম নিয়ন্ত্রণ বা দারিদ্রতার ভয় কিংবা অন্য কোনো সামাজিক বা মানসিক কারণে হয় তাহলে ইসলামিক শরিয়তের দৃষ্টিতে এটি জায়েজ নয় বরং হারাম কারন শরীয়তের মূলনীতি হলো জীবনের স্বাভাবিক চলাচল এবং প্রকৃতির প্রতি সম্মান। তাছাড়া জন্মনিয়ন্ত্রণ ও জনসংখ্যা হ্রাস করার প্রচারণা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশের সাথে সাংঘর্ষিক।কারন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নির্দেশ হচ্ছে: “তোমরা প্রেমময়ী ও অধিক সন্তানপ্রসবা নারীকে বিয়ে করো। কেননা আমি তোমাদের সংখ্যাধিক্য নিয়ে অন্যান্য উম্মতের ওপর গর্ব করবো।(সুনানে আবু দাউদ, হা/২০৫০),ইমাম আলবানী ‘ইরওয়াউল গালিল’ গ্রন্থে হ /১৭৮৪) হাদিসটিকে সহিহ আখ্যায়িত করেছেন। তাছাড়া আল্লাহ তাআলা সকল মাখলুকের রিযিক নিশ্চয়তা দানকারী। তিনি বলেন: “আর পৃথিবীতে বিচরণশীল যে কারো রিযিক আল্লাহর উপর” [সূরা হুদ, আয়াত: ৬]
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেন:
“وأما القول بتحديد النسل فهذا لا شك أنه من دسائس أعداء المسلمين يريدون من المسلمين ألا يكثروا ؛ لأنهم إذا كثروا أرعبوهم ، واستغنوا بأنفسهم عنهم : حرثوا الأرض ، وشغَّلوا التجارة ، وحصل بذلك ارتفاع للاقتصاد ، وغير ذلك من المصالح ؛ فإذا بقوا مستحسرين قليلين صاروا أذلة ، وصاروا محتاجين لغيرهم في كل شيء
“জন্ম-নিয়ন্ত্রণকে সমর্থন দেয়া নিঃসন্দেহে এটি মুসলমানদের শত্রুদের চক্রান্ত। শত্রুরা চায় মুসলমানদের সংখ্যা না বাড়ুক। কারণ মুসলমানদের সংখ্যা বাড়লে শত্রুরা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে এবং মুসলমানেরা নিজেরা স্বয়ং সম্পূর্ণ হয়ে যেতে পারে: নিজেরা চাষাবাদ করবে, ব্যবসা বাণিজ্য করবে- এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটবে ও আরও নানামুখি কল্যাণ অর্জিত হবে। আর যদি তারা সংখ্যায় অল্প হয়ে থাকে তাহলে লাঞ্ছিত হয়ে থাকবে এবং সবকিছুতে অন্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকবে।”(ইবনু উসাইমীন, তাফসিরে সূরা আল বাকারাহ খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৮৮)
.
(২).”যদি কোনো চিকিৎসাগত কারণে জরায়ু অপসারণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়, যেমন জীবাণু সংক্রমণ বা অন্য কোনো রোগের কারণে মা অথবা শিশুর জীবন সংকটে পড়তে পারে, অথবা ক্যান্সার, সিস্ট, কিংবা গুরুতর শারীরিক সমস্যার জন্য এটি প্রয়োজন হয় এবং চিকিৎসার অন্যান্য বিকল্প পদ্ধতি ব্যর্থ হলে, একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শে নারীর জীবন রক্ষা বা গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা নিরসনের জন্য জরায়ু অপসারণ অনুমোদিত।”বরং এমন পরিস্থিতিতে করাটাই অপরিহার্য।কারন ইসলামী শরীয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি হলো,أن درء المفسدة مقدم على جلب المصلحة، وأن الضرورات تبيح المحظورات ” কল্যাণ অর্জনের আগে অকল্যাণ প্রতিরোধের বিষয়টি প্রাধান্য দিতে হবে এবং (জরুরি) প্রয়োজনীয়তা হারামকে বৈধ করে দেয়।”(ইসলাম ওয়েব ফাতওয়া নং-৫৪৫৭৩

শায়খ ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,”যদি সৎ ও ন্যায়পরায়ণ ডাক্তার বিপদের আশঙ্কা করেন, তবে তাদের পরামর্শ অনুযায়ী এবং স্বামীর অনুমতি সাপেক্ষে এমন পদক্ষেপ গ্রহণ করা দোষনীয় নয় (ফাতাওয়া আল-মার’আতুল মুসলিমাহ, ৫ম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৯৭৮)। সঊদী আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটিকে একই প্রশ্ন করা হলে উত্তরে তাঁরা বলেন, ‘প্রশ্নে উল্লেখিত বর্ণনা অনুযায়ী ঝুঁকি প্রতিরোধে ও আগত বিপদ দূরীকরণার্থে জরায়ু অপসারণ করা বা বন্ধ্যাত্বকরণ অনুমোদিত। আল্লাহই সর্ব শক্তিমান ও সাফল্য দানকারী’ (ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়েমাহ, ১৯তম খণ্ড, পৃষ্টা: ৩১৬-৩১৭)। ‘ইসলাম ওয়েব’ এর আলেমগণ বলেন, ‘বিশেষ প্রয়োজন ও শরী‘আতসম্মত কারণ ব্যতীত অপারেশনের মাধ্যমে চিরতরের জন্য সন্তান ধারণের ক্ষমতা বিনষ্ট করা বা বন্ধ্যাত্বকরণ হারাম। ক্ষতি ও প্রাণহানির আশঙ্কা থাকলে এবং জরায়ু অপসারণ ব্যতীত অন্য কোন পদ্ধতিতে চিকিৎসা সম্ভবপর না হলে বিশ্বস্ত ও ঈমানদার ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী জরায়ু অপসারণ করা বৈধ’ (মাজাল্লাতুল মাজমা‘আ, সমাবেশ নং-৪, ১ম খণ্ড, পৃ. ৭৩; ইসলাম ওয়েব, ফৎওয়া নং-৫৪৫৭৩, ৩৬৭৬৮, ১৭৫৫৩)।
.
দ্বিতীয়ত: যদি কোনো নারীর গর্ভাশয়ে (জরায়ু) অস্ত্রোপচার করা হয় এবং এর ফলে যদি পরবর্তীতে রক্তপাত হয়,তাহলে কি সেই রক্ত হায়েজ হিসেবে বিবেচিত হবে?
.
এ বিষয়ে বিশুদ্ধ কথা হচ্ছে গর্ভাশয়ে (জরায়ু) অস্ত্রোপচারজনিত রক্তপাত হায়েজ (ঋতুস্রাব) হিসেবে গণ্য হবে কি না তা নির্ভর করে নারীর ঋতুস্রাব বন্ধ হওয়ার পরিস্থিতি ও সম্ভাবনার ওপর। যদি নিশ্চিতভাবে জানা যায় যে অস্ত্রোপচারের পর নারীর ঋতুস্রাব স্থায়ীভাবে বন্ধ হয়ে গেছে (যেমন, সম্পূর্ণ জরায়ু অপসারণ করা হয়েছে বা এমনভাবে বন্ধ করা হয়েছে যে রক্তপাত আর হবে না), তাহলে পরবর্তীতে রক্ত আসলে সেই রক্ত হায়েজের নয়,বরং সাধারণ শিরার রক্ত ধরা হবে।এবং এতে তিনি নামাজ, রোযা এবং সহবাস থেকে বিরত থাকবেন না। তবে নামাজ পড়ার জন্য রক্ত পরিষ্কার করা, লজ্জস্থানে কাপড় ব্যবহার করা এবং প্রত্যেক ফরজ নামাজের সময় নতুন করে অজু করা আবশ্যক। অপরদিকে যদি নিশ্চিতভাবে জানা না যায় যে অস্ত্রোপচারের পর ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে গেছে কিনা কিংবা ভবিষ্যতে হায়েজ হতে পারে কিনা,তাহলে তার রক্তস্রাব ইস্তিহাযার (অস্বাভাবিক রক্তপাত) বিধানে পড়বে। অর্থাৎ,তিনি স্বাভাবিক নিয়মে ইস্তিহাযাগ্রস্ত নারীদের মতো আচরণ করবেন এই সময় যাবতীয় ইবাদত পালন করবেন অতঃপর পরে তার হায়েজ শুরু হলে তখন সালাত ও সিয়াম থেকে বিরত থাকবেন।
.
আমাদের ইমাম সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল প্রশ্ন:যদি কোনো নারীর গর্ভাশয়ে (জরায়ু) অস্ত্রোপচার করা হয় এবং এর ফলে রক্তপাত হয়, তাহলে কি সেই রক্ত হায়েজ হিসেবে বিবেচিত হবে?

উত্তর শাইখ বলেন:

قد يحدث للمرأة سبب يوجب نزيف الدم من فرجها كعملية في الرحم أو فيما دونه وهذه على نوعين :

النوع الأول : أن يعلم أنها لا يمكن أن تحيض بعد العملية مثل أن تكون العملية استئصال الرحم بالكلية أو سده بحيث لا ينزل منه دم ، فهذه المرأة لا يثبت لها أحكام المستحاضة ، وإنما حكمها حكم من ترى صفرة أو كدرة أو رطوبة بعد الطهر ، فلا تترك الصلاة ولا الصيام ولا يمتنع جماعها ولا يجب غسل من هذا الدم ، ولكن يلزمها عند الصلاة غسل الدم وأن تعصب على الفرج خرقة ، ونحوها ، لتمنع خروج الدم ، ثم تتوضأ للصلاة , ولا تتوضأ لها إلا بعد دخول وقتها ، إن كان لها وقت كالصلوات الخمس ، وإلا فعند إرادة فعل الصلاة كالنوافل المطلقة .

النوع الثاني : ألا يعلم امتناع حيضها بعد العملية بل يمكن أن تحيض ، فهذه حكمها حكم المستحاضة . ويدل لما ذكر قوله صلى الله عليه وسلم لفاطمة بنت أبي حبيش : ( إنما ذلك عرق وليس بالحيضة , فإذا أقبلت الحيضة فاتركي الصلاة ) . فإن قوله : ( فإذا أقبلت الحيضة ) يفيد أن حكم المستحاضة فيمن لها حيض ممكن ذو إقبال وإدبار ، أما من ليس لها حيض ممكن فدمها دم عرق بكل حال

“মহিলাদের জন্য গর্ভাশয়ে অপারেশন বা অন্য কোনো কারণে রক্তপাত হওয়ার দুই ধরনের পরিস্থিতি হতে পারে:

(১). প্রথম প্রকার: যদি নিশ্চিতভাবে জানা যায় যে কোনো মহিলার অপারেশনের পর আর ঋতুস্রাব (মাসিক) হওয়ার সম্ভাবনা নেই যেমন সম্পূর্ণভাবে জরায়ু অপসারণ করা হয়েছে বা এমনভাবে বন্ধ করা হয়েছে, যার ফলে আর রক্তপাত হয় না তাহলে তাকে আর মাসিকের (ঋতুস্রাবের) বিধানের আওতায় গণ্য করা হবে না। বরং তার অবস্থা সেই নারীদের মতো হবে, যারা পবিত্র হওয়ার পর হালকা হলুদ বা ময়লাযুক্ত স্রাব অথবা স্বাভাবিক আর্দ্রতা দেখতে পান। এমন পরিস্থিতিতে তিনি সালাত ও সিয়াম পরিত্যাগ করবেন না। তার স্বামীর সঙ্গে সহবাসে কোনো বাধা থাকবে না। এবং এই রক্তের কারণে তার ওপর গোসল আবশ্যক (ফরজ) হবে না। তবে যখন তিনি সালাত আদায় করবেন, তখন শরীর থেকে রক্ত পরিষ্কার করবেন। রক্ত প্রবাহ বন্ধ রাখতে সহায়ক কিছু ব্যবহার করবেন (যেমন: তুলো বা কাপড়)। নির্দিষ্ট (ফরজ) সালাতের সময় প্রবেশ করার পর অজু করবেন। প্রতি ওয়াক্ত সলতের জন্য নতুন করে অজু করবেন, তবে সেটি তখনই করবেন, যখন সেই সালাতের সময় শুরু হবে (যেমন: পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ সালাতের জন্য)। আর যদি তিনি কোনো নফল সালাত আদায় করতে চান, তাহলে যখনই তিনি সালাত পড়ার ইচ্ছা করবেন তখনই ওজু করবেন।
.
(২). দ্বিতীয় প্রকার: যদি নিশ্চিতভাবে জানা না যায় যে, অস্ত্রোপচারের পর তার ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে গেছে, বরং তার এখনও ঋতুস্রাব হতে পারে, তাহলে তার বিধান হবে ইস্তিহাযার (অস্বাভাবিক রক্তস্রাব) মতো। এ বিষয়ে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফাতিমা বিনতু আবূ হুবায়শ (রাদিয়াল্লাহু আনহা)-কে বলেছিলেন: এ হলো এক ধরনের বিশেষ রক্ত, হায়েযের রক্ত নয়। যখন তোমার হায়েয শুরু হয় তখন তুমি সালাত ছেড়ে দাও।”(সহীহ বুখারী হা/৩০৩) এখানে নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর এই উক্তি “যখন তোমার ঋতুস্রাব শুরু হবে” এটি নির্দেশ করে যে, ইস্তিহাযার বিধান তাদের জন্য প্রযোজ্য, যাদের ক্ষেত্রে ঋতুস্রাব আসা এবং বন্ধ হওয়া সম্ভব। কিন্তু যাদের ঋতুস্রাব সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে গেছে, তাদের রক্তস্রাব যেকোনো অবস্থাতেই শিরার রক্তস্রাব হিসেবে গণ্য হবে।”(সূত্র: ইবনু উসাইমিন কর্তৃক রচিত ‘নারীদের স্বাভাবিক ঋতু সংক্রান্ত পুস্তিকা’ এবং ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩৫৮২৯) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Share: