প্রয়োজন

প্রয়োজন

আবু উমামা (রা) থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, হে আদম সন্তান! তোমরা প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদ যদি সৎ কাজে খরচ কর, তাহলে তোমাদের কল্যাণ হবে। আর যদি তা আটকে রাখ, তাহলে তোমাদের অমঙ্গল হবে। তবে তোমাদের প্রয়োজন পরিমাণ সম্পদ রেখে দিলে তুমি তিরস্কৃত হবে না। সর্বপ্রথম তোমরা প্রতিপাল্যদের থেকে খরচ করা শুরু করো। [সহীহ মুসলিম ১০৩৬ , আত-তিরমিযী ২৩৪৩ ]
যেদিন প্রথম এই হাদিসটা আমি পড়লাম, একটু চমকে উঠলাম। দম বন্ধ করে কয়েকবার পড়লাম একই হাদিস। বোঝার চেষ্টা করলাম এখানে কি বলা হচ্ছে। সুবহানাল্লাহ! প্রয়োজনের অতিরিক্ত জিনিস রাখলে সেটা আখিরাতের জন্য অকল্যাণ বয়ে আনবে আর আখিরাতে এর জন্য তিরস্কার করা হবে !!! কি ভয়ানক কথা! আমি ভয়ে ভয়ে আমার রুমের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। আমার আত্মা কেঁপে উঠল। একি! রুম ভর্তি দুনিয়ার অপ্রয়োজনীয় জিনিস! এই রুমের কয়টা জিনিস আমার দরকারে লাগছে? কত জামা-কাপড়, জুতা, বই-খাতা যেগুলোর অনেকগুলোই অযথাই পড়ে আছে, অনেকদিন পর পর ব্যবহার করা হয় অথবা ব্যবহারই হয়ত করা হয়না এরকম জিনিসের অভাব নেই। পরিচিত এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়েছিলাম। এক রুমের বাসা, একটা পর্দা দিয়ে ঐ রুমটাকেই ভাগ করা হয়েছে যেন বাইরের লোকজন আসলে ঘরের মেয়েরা পর্দার ওপাশে আড়ালে থাকতে পারে। সেদিন আমি অবাক হয়ে উপলব্ধি করেছিলাম, একটা মানুষের বেঁচে থাকতে খুব বেশি কিছুর প্রয়োজন নেই!
“প্রয়োজন” এর সংজ্ঞাটা ইসলাম কিভাবে দিয়েছে? আবূ ‘আমর ‘উসমান ইবনু আফ্ফান (রা) থেকে বর্ণিত, নাবী (সা) বলেছেন: আদম সন্তানের তিনটি বস্তু ব্যতীত কোন বস্তুর অধিকার নেই। তা হলো: তার বসবাস করার জন্য একটি ঘর, শরীর ঢাকার জন্য কিছু কাপড় এবং কিছু রুটি ও পানি।[ তিরমিযী ৪০৬ / ২৩৪১, মিশকাত ৫১৮৬ ] এই যদি হয় আমাদের দুনিয়াবী “প্রয়োজন”, তাহলে এর পিছনে এত কেন ছোটা? আসলে আমরা কি শুধুই আমাদের প্রয়োজন পূরণ করতে চাই? নাকি আরও বেশি কিছু চাই? দ্বীনদার মেয়েদের মুখে আজকে শোনা যায়, ইসলাম “প্রয়োজনে” মেয়েদের ঘরের বাইরে গিয়ে কাজ করা সমর্থন করে। সুবহানাল্লাহ! কয়জন মেয়ে উপরের তিনটা জিনিস থাকার অভাবে বাইরে গিয়ে চাকরি করছে? আয়িশাহ (রা) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, মুহাম্মাদ (সা) এর ইন্তিকালের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর পরিবার কোনদিন একটানা দু’দিন পেট ভরে যবের রুটিও খেতে পায়নি। [বুখারী ৫৪১৬ , মুসলিম ২৯৭০] উমার ইবনুল খাত্তাব (রা) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা) কে দেখেছি, দিনভর তাঁর নাড়িভুঁড়ি পেঁচিয়ে থাকত, অথচ তাঁর পেটে দেয়ার মত নিকৃষ্ট খেজুরও জুটতো না। [মুসলিম ২৯৭৮]
রাসূলুল্লাহ (সা) এর কলিজার টুকরা কন্যা ফাতিমা (রা) এর হাতে ফোস্কা পড়ে গিয়েছিল যব পিষতে পিষতে, যিনি হলেন জান্নাতের নারীদের সর্দারনী। আমাদের অভাব কি এর চেয়েও বেশি? রাসূলুল্লাহ (সা) এত অভাব থাকার পরেও তো তাঁর স্ত্রী-কন্যাদের বাইরে গিয়ে কাজ করতে বলেননি! সত্য কথা হচ্ছে, আমাদের চাওয়াটা শুধু থাকা-খাওয়া-পরার চাওয়া না। আমাদের চাওয়া আরও বেশি কিছু। এক রুমের বাসাতে আমাদের চলবে না। কয়েক রুম থাকা লাগবে। সাজানো সংসার লাগবে। সন্তানদের ভবিষ্যতের জন্য বাড়তি ইনকাম লাগবে। মাঝে মাঝে অবকাশ যাপনের জন্য ঘুরতে যাওয়া লাগবে – প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখতে বা কোন দর্শনীয় স্থান! সিলেট-কক্সবাজার-রাঙ্গামাটি-বান্দরবান-পারলে দেশের বাইরে!!! কয়েক পদের তরকারি ছাড়া আমাদের চলে না। মাছ-গোশত-সবজি-ডাল-ডিম-দুধ সব আমাদের প্রতিদিনের খাবারের লিস্টে থাকতে হবে। মাঝে মাঝে স্বামী-সন্তান নিয়ে বাইরে দামী রেস্টুরেন্টে, কেএফসি, পিৎজা-হাটে খেতে যাওয়া লাগবে। এন্ড্রয়েড না হলে আমাদের চলেই না। ঘরে ডেস্কটপ দিয়ে যাবতীয় কাজ হয়ে গেলেও ট্যাব-ল্যাপটপও থাকা চাই। আল্লাহর অশেষ করুণায় আমরা যারা দ্বীনের পথে এসেছি, তারা একটু নিজেদের কাপড়ের ড্রয়ারটা খুলে দেখি তো, কয়টা বোরকা আছে আমাদের? ভিন্ন ভিন্ন ডিজাইনের, কালারের বোরকা! একেক অনুষ্ঠানে পরে যাওয়ার জন্য একেকটা বোরকা, স্কার্ফ, খিমার, কাফতান, ফ্রক আবায়া, গাউন আবায়া, বাটারফ্লাই আবায়া — সবই একসাথে থাকা চাই! আমাদের একেকজনের বিয়েতে আমরা কি এলাহী কান্ড করি একবার ভেবে দেখি তো! পাত্র পক্ষের কাছে কনে পক্ষের ডিমান্ডের কথা একবার ভাবুন। হাই স্যালারির জব, সাজানো ফ্ল্যাট, রুমের সাথে অ্যাটাচড বাথ, গাড়ি থাকা লাগবে। ২০-৩০ লাখ টাকা দেন-মোহর। বিয়ে ঠিক হলে চার-পাঁচদিন ব্যাপী অনুষ্ঠান, শাড়ি-অলংকার থেকে শুরু করে গাড়ি সাজানো, বাসর ঘর সাজানো কিচ্ছু বাদ রাখি না! বিলাসিতার সাগরে ডুব দিয়ে আমরা এই আমাদেরকে দিয়েই আল্লাহর দ্বীন কায়েমের স্বপ্ন দেখি, শাহাদাতও লাভ করতে চাই, জান্নাতও পেতে চাই!!! নিজেদের সাথে কি নির্মম উপহাস! আমার কথায় রাগ করছেন? ওয়াল্লাহি, এইসব আমার কথা না। কুরআন-হাদিসের কথা। “ঐশ্বর্য, প্রাচুর্য ও অহংকার তোমাদের মোহাচ্ছন্ন করে রেখেছে, তোমরা যতক্ষণ পর্যন্ত না কবরে পৌঁছে যাও” [সূরা আত-তাকাসুরঃ ১] আমর ইবনু আওফ আনসারী (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেন, আল্লাহর শপথ! আমি তোমাদের জন্য দারিদ্রের ভয় করছি না, বরং এই ভয় করছি যে, দুনিয়ার প্রাচুর্য তোমাদের সামনে প্রসারিত করা হবে, তোমাদের পূর্ববর্তীদের জন্য যেমন প্রসারিত করা হয়েছিল। তারপর তারা যেমন লালসা ও মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল, তোমরাও তেমন লালসাগ্রস্ত হয়ে পড়বে এবং এই দুনিয়াবী প্রাচুর্য তাদেরকে যেমন ধ্বংস করেছে, তেমনি তোমাদেরকেও ধ্বংস করবে। [বুখারী ৩১৫৮, মুসলিম ২৯৬১] আবূ হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সা) কে বলতে শুনেছি, জেনে রাখো, দুনিয়া ও তার মধ্যকার সবকিছুই অভিশপ্ত। কিন্তু, আল্লাহ তায়ালার যিকির ও তিনি যা পছন্দ করেন এবং জ্ঞানী ও জ্ঞানার্জনকারী (অভিশপ্ত নয়)। [তিরমিযী ১৮৯১/২৩২২, মিশকাত ২১৭৬] কা’ব ইবনু ইয়ায (রা) হতে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেন, প্রত্যেক জাতির জন্য একটা ফিতনা (পরীক্ষার বস্তু) আছে। আমার উম্মতের ফিতনা হল সম্পদ। [তিরমিযী ১৯০৫/২৩৩৬] কা’ব ইবনু মালিক (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা) বলেন, সম্পদ ও আভিজাত্যের প্রতি মানুষের লোভ তার দ্বীনের যে মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে, বকরীর পালে ছেড়ে দেয়া দু’টি ক্ষুধার্ত নেকড়েও বকরীর পালকে তত ক্ষতি করতে পারে না [তিরমিযী ১৯৩৫/২৩৭৬, মিশকাত ৫১৮২] উসামাহ ইবনু যায়িদ (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী (সা) বলেছেন, আমি জান্নাতের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখেছি, এতে প্রবেশকারীদের বেশিরভাগই নিঃস্ব-দরিদ্র আর সম্পদশালীদেরকে আটকে রাখা হয়েছে (জান্নাতে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না)। [বুখারী ৫১৯৬, মুসলিম ২৭৩৬] এখন দেখি তো আমাদের সালাফদের জীবনযাত্রা কেমন ছিল? আল্লাহর রাসূল (সা) ও তাঁর সাহাবা (রা) রা তাঁদের স্ত্রীদের দেনমোহর দিয়েছিলেন মাত্র চারশ দিরহাম, এর থেকে কমও ছিল। প্রিয় রাসূল (সা) তাঁর স্ত্রীদের এত ছোট ছোট ঘরে রাখতেন যে তিনি যখন তাঁর কোন একজন স্ত্রীর ঘরে সালাতে দাঁড়াতেন, সিজদাহ করার সময় তাঁর সেই স্ত্রীকে পা ভাঁজ করে রাখতে হত। সামান্য যবের বিনিময়ে রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর বর্মটি দিনের পর দিন বন্ধক রাখতেন। তাঁর পরিবারের জন্য সকাল-সন্ধ্যায় এক সা’ গমও জুটতো না। রাসূল (সা) চাটাইয়ের উপর শুয়ে ঘুমাতেন যার কারণে তাঁর শরীরে চাটাইয়ের দাগ পড়ে যেত। সালমান ফারসী (রা) একজন কিন্দি মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন। শ্বশুরালয়ে সাজানো বাসর ঘর তিনি পছন্দ করলেন না। তাঁর আদেশে সব সাজ-সজ্জা খুলে ফেলা হল। বাসর ঘরে বহু জিনিসপত্র দেখে তিনি বললেন, আমার বন্ধু মুহাম্মাদ (সা) আমাকে ওসিয়ত করেছিলেন, দুনিয়ায় তোমার জিনিসপত্র যেন একজন মুসাফিরের সাজ সরঞ্জামের মত হয়। আবু দারদা (রা) এর কন্যা দারদাকে ইয়াজিদ ইবনে আবু মাবিয়া বিয়ের প্রস্তাব পাঠালে আবু দারদা অত্যন্ত বিনয়ের সাথে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে একজন অত্যন্ত দরিদ্র দ্বীনদার যুবকের সাথে কন্যার বিয়ে দেন। তিনি কেন এই কাজ করলেন জিজ্ঞাসিত হলে আবু দারদা (রা) উত্তর দেন, আমি আমার মেয়ের দ্বীনদারীর কথা চিন্তা করেছি। ইয়াজিদের সংসারে মাথার কাছে থাকবে গোলাম, চোখের সামনে থাকবে জৌলুস। সেই সময় আমার মেয়ের দ্বীনদারী কোথায় থাকবে? আবু যার গিফারী (রা) এর বাড়িতে এক লোক এসে তার ঘরের চারদিকে চোখ বুলিয়ে দেখল, ঘরে কোন আসবাবপত্র নেই। লোকটি জিজ্ঞেস করলো,“আবু যার, আপনার সামান পত্র কোথায়?” আবু যার (রা) উত্তর দিলেন, ‘আখিরাতে আমার একটি বাড়ী আছে। আমার সব উৎকৃষ্ট সামগ্রী সেখানেই পাঠিয়ে দিই’। আমীরুল মুমিনীন হযরত আবু বকর (রাঃ) এর স্ত্রীর মিষ্টি খাওয়ার খুব ইচ্ছে হল। তিনি স্বামীকে মিষ্টি কিনে আনতে বললেন। সারা মুসলিম জাহানের আমীর আবু বকর (রা) জানালেন তার মিষ্টি কেনার সামর্থ নেই। আমীরুল মুমিনীনের স্ত্রী এরপর প্রত্যেক দিনের খরচ থেকে টাকা বাঁচিয়ে জমা করা শুরু করলেন। কিছু অর্থ জমা হওয়ার পর তা স্বামীকে দিয়ে বললেন মিষ্টি কিনে আনতে। আবু বকর (রা) জিজ্ঞেস করলেন, এই অর্থ কোথা থেকে এসেছে? স্ত্রী বললেন প্রতিদিনের খরচ থেকে বাঁচিয়ে তিনি এই অর্থ জমা করেছেন। আবু বকর (রাঃ) তখন বললেন, এটার তো তাহলে আমার আর দরকার নেই! এই পরিমাণ অর্থ তাহলে আমি রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে অতিরিক্ত নিচ্ছি। এরপর তিনি সেই অর্থ স্ত্রীর জন্য মিষ্টি কেনার বদলে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়ে আসেন। উমার (রাঃ) এর পুত্র আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) পিতাকে একবার দাওয়াত দিলেন। উমার (রাঃ) খেতে বসে দেখলেন। আইটেম আছে মাংস, রুটি আর ঘি। উমার (রাঃ) উঠে পড়লেন এবং বললেন, আমি খাব না। তিনি বললেন, মাংস থাকার পরও তুমি ঘি আনলে কেন? আব্দুল্লাহ ইবনে উমার বললেন, আমি আপনার জন্য যে টাকা নিয়ে মাংস কিনতে গিয়েছিলাম সেইটা খরচ করেছি। মাংস সস্তায় পেয়ে যাওয়ায় বাকি টাকা দিয়ে ঘি কিনে এনেছি। তখন উমার (রাঃ) বললেন, “ওয়াল্লাহি। আমি রাসূল (সঃ) কে কোনদিন এক তরকারীর বেশী দিয়ে খেতে দেখিনি।”এই আব্দুল্লাহ ইবনে উমার (রাঃ) আর্থিকভাবে বেশ স্বচ্ছল থাকার পরেও জীবনে কোনদিন পেট ভরে আহার করেননি রাসূল (সঃ) এবং তার পিতা উমার (রাঃ) এর ক্ষুধার কষ্টের কথা স্মরণ করে। আব্দুল্লাহ ইবনে উমার রাসূল (সঃ) কে এত কঠোরভাবে অনুসরণ করতেন যে মা আয়িশা (রাঃ) তার সম্পর্কে বলেছিলেন, ইবনে উমারের মত আর কেউ রাসুলুল্লাহর (সঃ) পদাঙ্ক অনুসরণ করে না। আসহাবে সুফফার সাহাবা রা (রা) এত ক্ষুধার্ত থাকতেন যে সালাতে দাঁড়িয়ে তারা অজ্ঞান হয়ে মাটিতে ঢলে পড়তেন। সালাত শেষে রাসূলুল্লাহ (সা) তাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলতেনঃ যদি তোমরা জানতে পারতে যে, তোমাদের জন্য আল্লাহর নিকট কি মর্যাদা ও সম্পদ সঞ্চিত আছে, তাহলে ক্ষুধা ও অভাব আরো বৃদ্ধি পাওয়াই তোমরা পছন্দ করতে। [তিরমিযী ১৯৩০/২৩৬৮] সালাফদের দুনিয়াবিমুখ জীবন নিয়ে আলোচনা করতে গেলেই কেউ কেউ ধনী সাহাবা (রা) দের কথা বলা শুরু করে। তাদের বক্তব্য হচ্ছে, ধনী হওয়া কি পাপ তাহলে? উসমান বিন আফফান (রা), খাব্বাব বিন আরাত (রা),আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রা) তো ধনী ছিলেন! এই কথা বলে যারা বিলাসিতাকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করেন, তাদের জন্য নিচের হাদিসগুলোঃ আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রা) এর সামনে ইফতারের সময় খাদ্য পরিবেশন করা হল। তিনি বললেনঃ মুস‘আব ইবনে উমাইর (রা) শহীদ হয়েছেন এবং তিনি আমার চাইতেও ভাল লোক ছিলেন। তাঁকে কাফন দেয়ার মত একটি চাদর ছাড়া কোন কাপড়ের ব্যবস্থাই ছিল না। তা দিয়ে তাঁর মাথা আবৃত হলে পা দু’টি অনাবৃত হয়ে যেত এবং পা আবৃত হলে তাঁর মাথা অনাবৃত হয়ে যেত। তারপর আমাদেরকে পর্যাপ্ত পরিমাণ দুনিয়ার সম্পদ দেয়া হল। ফলে আমরা আতংকিত হয়ে পড়লাম যে, আমাদের সৎ কাজের বিনিময় দুনিয়াতেই দেয়া হচ্ছে নাকি। তারপর তিনি কেঁদে ফেললেন, এমনকি খাদ্য ত্যাগ করলেন। [বুখারী ১২৭৫] খাব্বাব বিন আরাত হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, আমরা রাসূলুল্লাহ (সা) এর সাথে হিজরত করেছি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। কাজেই এর সওয়াব আমরা আল্লাহর কাছেই পাব। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ এর বিনিময় ভোগ না করেই মারা গেছেন। মুস’আব ইবনে উমাইর (রা) তার মধ্যে একজন। উহূদ যুদ্ধে তিনি শাহাদাত বরণ করেন। তার সম্পদের মধ্যে রেখে যান মাত্র একটি রঙ্গিন পশমী চাদর। আমরা (কাফন দেয়ার জন্য চাদরটি দিয়ে) তাঁর মাথা ঢাকতে চাইলে পা অনাবৃত হয়ে যেত, আর পা ঢাকতে চাইলে তার মাথা অনাবৃত হয়ে যেত। তারপর রাসূলুল্লাহ (সা) তাঁর মাথা ঢেকে দিতে এবং তাঁর পায়ে ‘ইযখির’ ঘাস রেখে দিতে আমাদেরকে আদেশ করেন। এখন আমাদের কারো কারো অবস্থা এমন যে, তার ফল পেকে আছে এবং তিনি তা কেটে ভোগ করছেন (অর্থাৎ ঐশ্বর্য ও প্রাচুর্যের মধ্যে জীবনযাপন করছেন)। [বুখারী ১২৭৬, মুসলিম ৯৪০] উম্মতের শ্রেষ্ঠ মানুষগুলো ধনী হওয়ার কারণে সবসময় ভীত-সন্ত্রস্ত থাকতেন এই ভেবে যে তাদের সমস্ত আমলের প্রতিদান দুনিয়াতেই দিয়ে দেওয়া হচ্ছে কিনা। সেখানে আমরা উম্মতের তুচ্ছ কিছু মানুষ ধনবান হওয়ার ব্যাপারে কোন আতংক অনুভব করি না। উল্টো ধনী সাহাবী (রা) দের কথা বলে আমাদের ভোগ-বিলাসিতাকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করি। সুবহানাল্লাহ! ধনবান হয়ে সেই ধন-মাল উপভোগ করতেন না আল্লাহর রাসূলের সাহাবীরা। সারাক্ষণ ধান্দায় থাকতেন কিভাবে আল্লাহর দেয়া সেই সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় দান-সাদাকাহ করে দেওয়া যায়। আবূ হুরাইরা (রা) থেকে বর্ণিত আছে, রাসূল (সা) বলেন, আমার নিকট উহূদ পাহাড় পরিমাণ স্বর্ণও যদি থাকে এবং আমার ঋণ পরিশোধের সম-পরিমাণ ছাড়া তিনদিন অতিক্রম হতে না হতেই আমার নিকট এর কিছুই অবশিষ্ট না থাকে, তাহলে এতেই আমি সন্তুষ্ট হবো। [বুখারী ২৩৮৯, মুসলিম ৯৯১] আসমা বিন আবু বকরের পুত্র আব্দুল্লাহ বলেন, “আমি আমার মা আসমা ও খালা আয়িশা থেকে অধিক দানশীলা কোন নারী দেখিনি। তবে তাঁদের দু’জনের দান প্রকৃতির মধ্যে প্রভেদ ছিল। আমার খালার স্বভাব ছিল, প্রথমতঃ তিনি বিভিন্ন জিনিস একত্র করতেন। যখন দেখতেন, যে যথেষ্ট পরিমাণ জমা হয়ে গেছে, তখন হঠাৎ করে একদিন তা সবই গরীব মিসকীনদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। কিন্তু আমার মা’র স্বভাব ছিল ভিন্নরূপ। তিনি আগামীকাল পর্যন্ত কোন জিনিস নিজের কাছে জমা করে রাখতেন না।” আবূ সাঈদ আল-খুদরী (রা) হতে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, একদিন নবী (সা) এর সাথে আমরা এক সফরে ছিলাম। তখন জনৈক ব্যক্তি তার বাহনে চড়ে এসে ডানে ও বামে তাকাতে লাগল। রাসূলুল্লাহ (সা) বললেন, যার নিকট অতিরিক্ত বাহন আছে, সে যেন তা এমন ব্যক্তিকে দান করে যার বাহন নেই। যার নিকট অতিরিক্ত সরঞ্জাম আছে, সে যেন তা এমন ব্যক্তিকে দান করে, যার কাছে কোন সরঞ্জাম নেই। তিনি এভাবে বিভিন্ন প্রকার জিনিসের নাম উল্লেখ করলেন। আমাদের তাতে মনে হলো যে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত কোন সম্পদ রাখার কারো অধিকার নেই। [মুসলিম ১৭২৮] যুগে যুগে মুসলিমদের এই দুনিয়া বিমুখ জীবনের কারণেই তারা আল্লাহর দ্বীনকে এই জমিনে ছড়াতে পেরেছিলেন। আর রাসুল (সা) মু’মিনের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করতে গিয়ে এই সরলতা আর সাদামাটা জীবনের কথাই বলেছেন। রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, “মুমিনেরা অতি সাধারণ এবং অনুগত উটের মত সহজ, যখন তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তখন অনুসরণ করে, আর যখন শক্ত পাথরের ওপর বসানো হয় তখনও তা বসে পড়ে।” [তিরমিযি ৫০৮৬] দ্বীনের পথে আসা আমার প্রিয় মুসলিম ভাই-বোনেরা! আমার নিজের এই আত্ম-উপলব্ধিটা আপনাদের সাথে শেয়ার করার কারণঃ আমি জানি, আপনারা অন্তর দিয়ে আল্লাহর দ্বীনকে কত ভালবাসেন, আপনারা আল্লাহর দ্বীনকে আল্লাহর যমীনে কায়েম করতে চান, খিলাফাহ প্রতিষ্ঠার বিশাল দায়িত্ব পালনে নিজেকে কুরবানী করতে চান, মাশাআল্লাহ! আপনারা আল্লাহর সৈনিক হতে চান! সুবহানাল্লাহ! আল্লাহর সৈনিক!!! যেমন তেমন বিষয় না! অনেক বড় কিছু। আল্লাহর সৈনিকেরা তো আর দশটা সাধারণ মুসলিমের মত হতে পারে না। তাদের জীবন হবে অন্যরকম। হ্যাঁ, একদম অন্যরকম। আমরা ভোগ-বিলাসিতাকে দুই হাতে ঠেলে সরিয়ে দিব। বেঁচে থাকতে যতটুকু আসলেই “প্রয়োজন” এর বেশি কিছু আমরা কখনো পেতে চাইব না। না আমরা প্রাধান্য দিব আমাদের কোন শখ-আহ্লাদকে। হতে পারে আমাদের কারো ভাল ভাল খাওয়ার শখ, কারো শখ ঘুমানোর, কারো সুন্দর সুন্দর ডিজাইনের কাপড়-চোপড় আর গয়নাগাটির শখ, কারো শখ ঘর সাজানোর কিংবা কারো দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানোর শখ ইত্যাদি। কোনদিন শুনেছেন কোন সাহাবী (রা) তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে শুধুমাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করার উদ্দেশ্যে দেশে/বিদেশে ঘুরতে গিয়েছেন? এটা বললাম এই কারনে আমার নিজের শখ হচ্ছে, ঘুরে বেড়ানো। আমরা আমাদের এইসব শখ-আহ্লাদকে পা দিয়ে মাড়িয়ে নিজেকে প্রস্তুত করব আল্লাহর সৈনিক হিসেবে। এভাবে, হ্যাঁ ঠিক এভাবেই দুনিয়ার প্রতি ভালবাসা (আল-ওয়াহান) কে পায়ে মাড়ালেই ক্বিতালের প্রতি আমাদের অন্তরে তৃষ্ণা জেগে উঠবে। তখনই আমরা আল্লাহর যোগ্য বান্দার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হতে পারব – যাদের আল্লাহ কবুল করে নিয়েছেন আল্লাহর শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদের ময়দানে। শেষ করব আর একটা হাদিস দিয়েঃ আবু উমামা ইয়াস ইবনে সালাবা আল-আনসারী আল-হারিসী (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, “রাসূলুল্লাহ (সা) এর সাহাবীগণ তাঁর কাছে দুনিয়া সম্পর্কে আলোচনা করলেন। রাসূলুল্লাহ (সা) বলেনঃ তোমরা কি শুনছো না, তোমরা কি শুনছো না? আরাম-আয়েশ ও বিলাসিতা ত্যাগ করা ঈমানের লক্ষণ, আরাম-আয়েশ ও বিলাসিতা ত্যাগ করা ঈমানের নিদর্শন (অর্থাৎ সাদাসিধা ও অনাড়ম্বর জীবন যাপন)”। [আবু দাউদ ৪১৬১, ইবনে মাজাহ ৩৩২৪/৪১১৮]
Share: