Site icon Tawheed Media

হাদীস ও সুন্নতের সংজ্ঞা এবং এই দুটির মধ্যে পার্থক্য

প্রশ্ন: হাদীস এবং সুন্নতের সংজ্ঞা কী? ❝হাদীস❞ এবং ❝সুন্নাহ❞ এই দু’টির মধ্যে কোন পার্থক্য আছে কী?
▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬
ভূমিকা: হাদীস শব্দটিক শাব্দিক অর্থ হলো- নতুন, প্রাচীন ও পুরাতন এর বিপরীত বিষয়। এ অর্থে যে সব কথা, কাজ ও বস্ত্ত পূর্বে ছিল না, এখন অস্তিত্ব লাভ করেছে তাই হাদীস। এর আরেক অর্থ হলো- কথা। ফক্বীহগণের পরিভাষায় নাবী কারীম (ﷺ) আল্লাহ্‌র রাসূল হিসেবে যা কিছু বলেছেন, যা কিছু করেছেন এবং যা কিছু বলার বা করার অনুমতি দিয়েছেন অথবা সমর্থন জানিয়েছেন তাকে হাদীস বলা হয়। কিন্তু মুহাদ্দিসগণ এর সঙ্গে রাসুলুল্লাহ (ﷺ) সম্পর্কিত বর্ণনা ও তার গুণাবলী সম্পর্কিত বিবরণকেও হাদীসের অন্তর্ভুক্ত করেন।
.
অপরদিকে সুন্নাহ হাদীসের অপর নাম। সুন্নাত শব্দের অর্থ চলার পথ, কর্মের নীতি ও পদ্ধতি। যে পন্থা ও রীতি নাবী কারীম (ﷺ) অবলম্বন করতেন তাকে সুন্নাত বলা হয়। অন্য কথায় রাসুলুল্লাহ (ﷺ) প্রচারিত উচ্চতম আদর্শই সুন্নাত। কুরআন মাজিদে মহত্তম ও সুন্দরতম আদর্শ বলতে এই সুন্নাতকেই বুঝানো হয়েছে। শারঈ পরিভাষায় সুন্নাত হলো রাসূল (ﷺ)-এর ঐ সকল বাণী, যা দ্বারা তিনি কোন বিষয়ে আদেশ-নিষেধ, বিশ্লেষণ, মৌন সম্মতি ও সমর্থন দিয়েছেন এবং কথা ও কর্মের মাধ্যমে অনুমোদন করেছেন, যা সঠিকভাবে জানা যায় তাকে সুন্নাহ বলা হয়। অনুরূপভাবে সাহাবী, তাবিঈ ও তাবে-তাবিঈদের আছার ও ফাতওয়াসমূহ অর্থাৎ তাদের ইজতেহাদ ও যেসব বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করেছেন, তাকেও সুন্নাহ বলে অভিহিত করা হয়। যেমন; রাসূল (ﷺ) বলেন, فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِىْ وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ الْمَهْدِيِّيْنَ ‘তোমাদের উপরে অবশ্য পালনীয় হলো আমার সুন্নাত ও সুপথ প্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত। (তিরমিযী হা/২৬৭৬; ইবনু মাজাহ হা/৪৩; মিশকাত হা/১৬৫)
.
শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, “সুন্নাত হলো ঐ সকল আমল, যা পালনে আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ﷺ)-এর অনুগত হওয়ার ব্যাপারে দলীল রয়েছে। চাই তা রাসূল (ﷺ) নিজে পালন করেছেন বা তাঁর যুগে পালন করা হয়েছে অথবা চাহিদা না থাকায় কিংবা অসুবিধার কারণে সে যুগে তিনি নিজে করেনি ও অন্যরাও করেননি। এসবই সুন্নাতের অন্তর্ভুক্ত। (ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ, মাজমূঊল ফাতাওয়া, ২১তম খণ্ড, পৃষ্ঠা: ৩১৭)
.
▪️হাদীস এবং সুন্নাহ শব্দের মধ্যে পার্থক্য আছে কি?
.
সুন্নাহ এবং হাদিস পরিভাষাগুলির মধ্যে পার্থক্যের ব্যাপারে আমরা বলবো, এই দুটি পরিভাষা কিছু কিছু জায়গায় একই এবং কিছু জায়গায় ভিন্ন।
.
▪️প্রথমত: হাদীস এবং সুন্নাহ একই হওয়ার স্থান:
.
(১). রাসূল (ﷺ)-এর কথা, কাজ এবং মৌনসম্মতি থেকে যা কিছু বর্ণিত হয়েছে, সাধারণভাবে সেগুলোকে হাদিস বলে। অনুরূপভাবে একে সুন্নাহ ও বলা হয়।
.
(২). হাদীসের ভিত্তিতে মুক্তিপ্রাপ্ত দল এবং আল্লাহর আনুগত্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত হলো আহলুল হাদীস।আবার তাদেরকে আহলুস সুন্নাহ ও বলা হয়। যেমন,
.
বড় পীর’ বলে খ্যাত শাইখ আব্দুল কাদের জীলানী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত:৫৬১ হিঃ] বলেন,

وَأَمَّا الْفِرْقَةُ النَّاجِيَةُ فَهِيَ أَهْلُ السُّنَّةِ وَالْجَمَاعَةِ قَالَ: وَأَهْلُ السُّنَّةِ لاَ إِسْمٌ لَهُمْ إِلاَّ إِسْمٌ وَّاحِدٌ وَّهُوَ أَصْحَابُ الْحَدِيْثِ–

“অতঃপর ফির্কা নাজিয়া হ’ল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত। আর আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের অন্য কোন নাম নেই একটি নাম ব্যতীত। সেটি হ’ল ‘আহলুল হাদীস”(আব্দুল ক্বাদির জীলানী, কিতাবুল গুনিয়াহ ওরফে গুনিয়াতুত ত্বালেবীন (মিসর: ১৩৪৬ হিঃ) খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ৯০)
.
ইমাম আবু উসমান আব্দুর রহমান বিন ইসমাঈল সাবূনী,(রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,ولا يلحق أهل السنة إلا اسم واحد وهو أهل الحديث- “আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের একটি নাম ব্যতীত অন্য কোন নাম নেই। আর তাহ’ল ‘আহলেহাদীস”।(ইমাম সাবূনী আক্বীদাতুস সালাফ তাহক্বীক্ব: বদর আল-বদর (কুয়েত : দারুস সালাফিইয়্যাহ, ১ম সংস্করণ ১৪০৪ হিঃ/১৯৮৪ ইং), পৃষ্ঠা: ১০৬)
.
(৩). যে কিতাবগুলোতে মারুফু, মাওকুফ আসার, এবং সালফে-সালেহীনদের উক্তি বর্ণনা করা হয়েছে; সে কিতাবগুলোর নাম রাখা হয়েছে “কিতাবুল হাদীস” অনুরুপ ভাবে “কিতাবুস সুন্নাহ” নামকরণ করা হয়েছে।
.
▪️দ্বিতীয়ত: হাদীস এবং সুন্নাহ ভিন্ন হওয়ার স্থান:
.
(১)। “সুন্নাহ” শব্দটি রাসূল (ﷺ)-এর নির্দেশনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, যা তাঁর সমস্ত বিষয়ে একটি সাধারণ অর্থে সুপ্রতিষ্ঠিত, অর্থাৎ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সমস্ত দেখানো পথকে সুন্নাহ বলা হয়, হাদিস বলা হয় না। মোটকথা তিনি যে পথে চলতে বলেছেন; যে পথকে আঁকড়ে ধরতে বলেছেন, সেটাকে বলা হয় সুন্নাহ। আলেমগণ এটাকে “হাদীস” হিসেবে ব্যবহার করেননি।
.
আল্লামা সাইয়েদ সুলাইমান নদভী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: হাদিস হলো এমন জিনিস যেটা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সম্পৃক্ত করা হয়, এমনকি যদিও সেটা তিনি তার জীবদ্দশায় মাত্র একবার করেন অথবা তার আমলের কথা যদিও যেকোনো একজন ব্যক্তি বর্ণনা করেন। অপরদিকে সুন্নাহ শব্দটি বাস্তবে তার কাজের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। আমি বলতে চাচ্ছি যে, সুন্নাহ হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে কিভাবে কাজটি বর্ণিত হয়েছে সেটা আমাদের কাছে মুতাওয়াতির বর্ণনার মাধ্যমে পৌঁছেছে, এই অর্থে যে- রাসূল (ﷺ) তা করেছেন, তারপর সাহাবায়ে কেরাম তাঁর পরে করেছেন, তারপর তাবেঈগণ তাদের পরে করেছেন এবং এখন পর্যন্ত সবাই করে আসছে। এর অর্থ এই নয় যে, সেই কর্মটির একটি বর্ণনা আছে; বরং এটি বোঝায় যেভাবে একটি নির্দিষ্ট কাজ সম্পাদিত হয়েছিল তারপর যুগ যুগ ধরে আমলের ধারাবাহিকতা‌ প্রজন্মের মধ্যে প্রেরণ করা হয়েছিল। আর এটাকে সুন্নাহ বলা হয়। আর সেটা কুরআনের সাথে হাদীস উল্লেখ করা হয়েছে যেখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; আমি তোমাদের মাঝে দুইটি জিনিস রেখে যাচ্ছি তোমরা যদি তা আঁকড়ে ধরো তাহলে কখনোই পথভ্রষ্ট হবে না। তা হলো: আল্লাহর কিতাব (কুরআনুল কারীম) ও রাসূল (ﷺ) এর সুন্নাহ (হাদিস)। কোন মুসলমানের এর বিরোধিতা করা কিংবা এটাকে পরিত্যাগ করা জায়েজ নাই। যদি কেউ বিরোধিতা করে বা পরিত্যাগ করে তাহলে সে ইসলাম থেকে বের হয়ে যাবে। (মুজাল্লাতুল মানার,খন্ড:৩০ পৃষ্ঠা: ৬৭৩)
.
(২)। শরীয়তে যে সমস্ত জিনিস বর্ণিত হয়েছে সেগুলোকে আঁকড়ে ধরা এবং অতিরিক্ত বা নব আবিষ্কৃত জিনিস থেকে বিরত থাকাকে আলেমগণ সুন্নাহ বলেছেন, এটাকে হাদীস নামে নামকরণ করেননি। যেমনভাবে আব্দুর রহমান ইবনে মাহদী বলেছেন: সুফিয়ান আস-সাওরী হাদীসের ইমাম কিন্তু সুন্নাহ-এর ইমাম নন। ইমাম আওযায়ী সুন্নাহ এর ইমাম কিন্তু হাদীসের ইমাম নন। আর ইমাম মালেক ইবনে আনাস (হাদীস এবং সুন্নাহ) সবকিছুর ইমাম। (ইবনে আসাকির “তারিখ দামেস্ক” ৩৫/১৮৩)
.
হাফিজ আবু আমর বিন সালাহকে জিজ্ঞেসা করা হয়েছিলো: কোনো‌ কোনো আলেম ইমাম মালেকের বর্ণনা দিয়ে বলেন; তিনি (ইমাম মালেক রহ.) হাদিস ও সুন্নাহকে একত্রিত করে দিয়েছেন। তাহলে কি সুন্নাহ এবং হাদিসের মাঝে কোন পার্থক্য নাই?
.
তিনি উত্তরে বলেছেন; এখানে তিনি সুন্নাহকে বিদআতের বিপরীত ব্যবহার করেছেন। একজন ব্যক্তি আহলুল হাদীসের অন্তর্ভুক্ত হয়েও বিদআতি হতে পারে। ইমাম মালিক সুন্নাহকে একত্রিত করেছেন। তিনি ছিলেন সুন্নাতের ইমাম অর্থাৎ হাদীস এবং সুন্নাত বিষয়ে অনেক জ্ঞানী। তিনি সুন্নাতের ব্যাপারে বিশ্বাস রাখতেন যে, কোন হকপন্থী লোক বিদআত ছাড়াই হক পন্থী হতে পারবে। (ফাতাওয়ায়ে ইবনে সালাহ; ১/১৩৯, ১৪০ )
.
(৩). ফকিহগণ একটি নিদিষ্ট কর্ম সম্পাদনের হুকুমকে মুস্তাহাব বলে বর্ণনা করতে গিয়ে “সুন্নাহ” শব্দটিকে উল্লেখ করেছেন; কিন্তু সেই ক্ষেত্রে হাদীস শব্দটি উল্লেখ করেননি।
.
(৪). আলেমগণ যখন কোন বর্ণনাকে সহীহ-জয়ীফ বলেন, তখন সে ক্ষেত্রে হাদীস শব্দটি ব্যবহার করে থাকেন। অর্থাৎ হাদীসের ক্ষেত্রে সহিহ-জয়ীফ বর্ণনা করা হয়ে থাকে। কিন্তু সুন্নাহর ক্ষেত্রে সহীহ-যয়ীফ বর্ণনা করা হয় না। তারা বলেন; এই হাদীসটি সহিহ বা এই হাদীসটি জয়ীফ। কিন্তু তারা এটা বলেন না যে- এই সুন্নাহটি জয়ীফ, এ সুন্নাহটি সহীহ। হাদীস থেকে যা প্রমাণিত সেটাকে বলা হয় সুন্নাহ। এজন্যই ফক্বিহগণ বলেছেন, এই হাদীসটি কিয়াস, সুন্নাহ ও ইজমাহ বিরোধী। (বিস্তারিত জানতে ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৪৫৫২০) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_______________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Exit mobile version