Site icon Tawheed Media

সূরা নিসার ৫৯ নং আয়াতে উলুল আমর বলতে কাদেরকে বুঝানো হয়েছে এবং উলুল আমরের সঠিক ব্যাখ্যা

আল্লাহ তাআলা বলেন: يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ، ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর এবং আনুগত্য কর রাসূলের ও তোমাদের নেতৃবৃন্দের।’ (সূরা নিসা ৪/৫৯)
.
উক্ত আয়াত নাজিলের শানে নুযূল: সহীহ বুখারীর কিতাবুত তাফসীর ও মাগাযী এবং তাফসীর ইবনে কাসীর, কুরতুবী, ত্বাবারী সহ অধিকাংশ তাফসীরে এসেছে যে, আয়াতটি আব্দুল্লাহ বিন হুযাফাহ বিন ক্বায়েস সাহমী সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। ঘটনাটি ছিল নিম্নরূপ:
.
আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী করীম (ﷺ) একটি সেনাদল প্রেরণ করেন এবং আনসারদের এক ব্যক্তিকে তার সেনাপতি নিযুক্ত করে তিনি তাদেরকে তাঁর আনুগত্য করার নির্দেশ দেন। (কোন কারণে) আমীর রাগান্বিত হয়ে যান। তিনি বললেন, রাসূল (ﷺ) কি তোমাদেরকে আমার আনুগত্য করতে নির্দেশ দেননি? তাঁরা বললেন, অবশ্যই। তিনি বললেন, তাহলে তোমরা কিছু কাঠ সংগ্রহ করে আনো। তাঁরা কাঠ সংগ্রহ করলেন। তিনি বললেন, এগুলোতে আগুন লাগিয়ে দাও। তাঁরা ওতে আগুন লাগালেন। তখন তিনি বললেন, এবার তোমরা সকলে এ আগুনে প্রবেশ কর। তারা আগুনে প্রবেশ করতে সংকল্প করে ফেললেন। কিন্তু তাদের কয়েকজন অন্যদের বাধা দিয়ে বললেন, আগুন থেকেই তো আমরা পালিয়ে গিয়ে নবী করীম (ﷺ)-এর কাছে আশ্রয় নিয়েছিলাম। এভাবে ইতস্তত করতে করতে আগুন নিভে গেল এবং তার রাগও প্রশমিত হলো। এরপর এ সংবাদ নবী করীম (ﷺ)-এর কাছে পৌঁছলে তিনি বললেন, যদি তারা আগুনে ঝাঁপ দিত, তাহলে ক্বিয়ামতের দিন পর্যন্ত আর এ আগুন থেকে বের হতে পারত না। আনুগত্য (করতে হবে) কেবল সৎ কাজে। (সহীহ বুখারী হা/৭১৪৫)। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, ঐ সময় সেনাপতি বলেন, أَمْسِكُوا عَلَى أَنْفُسِكُمْ فَإِنَّمَا كُنْتُ أَمْزَحُ مَعَكُمْ ‘তোমরা থাম। আমি তোমাদের সাথে স্রেফ হাসি-ঠাট্টা করতে চেয়েছিলাম মাত্র।’ (ইবনু মাজাহ হা/২৮৬৩)। ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, নিসা ৫৯ আয়াতটি অত্র ঘটনার প্রেক্ষিতে নাযিল হয়।’ (সহীহ বুখারী হা/৪৫৮৪ ‘তাফসীর’ অধ্যায়, সূরা নিসা ৫৯ আয়াত)
.
অত্র আয়াতে বর্ণিত (أُولُوا الْأَمْرِ) উলুল আমর বলতে কি বুঝানো হয়েছে সে বিষয়ে আলোচনা করা যাক ইনশাআল্লাহ্।

জগদ্বিখ্যাত মুফাসসির ইবনু কাসীর (রাহিমাহুল্লাহ) তার তাফসীরে ‘উলুল আমর’-এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, فِيمَا أَمَرُوكُمْ بِهِ مِنْ طَاعَةِ اللهِ لَا فِي مَعْصِيَةِ اللهِ، فَإِنَّهُ لَا طَاعَةَ لِمَخْلُوقٍ فِي مَعْصِيَةِ اللهِ، ‘উলুল আমর তারাই, যারা তোমাদেরকে আল্লাহর আনুগত্যের নির্দেশ দেয়, অবাধ্যতার নির্দেশ দেয় না। কেননা আল্লাহর অবাধ্যতায় কোন সৃষ্টির আনুগত্য নেই।’ (তাফসীরে ইবন কাসীর, ২/৩৪৬)।
.
প্রখ্যাত সাহাবী আবু হুরায়রাহ (রাঃ) বলেন, هم الأمراء ‘তারা হলেন রাষ্ট্রনায়কগণ।’ (সিলসিলাতুল আছার আহ-সহীহাহ, আবু আব্দুল্লাহ দানী আলে যুহরী হা/৪৪৩, সনদ সহীহ)
.
আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাস (রাঃ) বলেন, তারা হলেন,أَهْلُ الْفِقْهِ وَالدِّيْنِ، وَأَهْلُ طَاعَةِ اللهِ الَّذِينَ يُعَلِّمُوْنَ النَّاسَ مَعَالِيَ دِينِهِمْ وَيَأْمُرُونَهُمْ بِالْمَعْرُوفِ، وَيَنْهَوْنَهُمْ عَنِ الْمُنْكَرِ، فَأَوْجَبَ اللهُ طَاعَتَهُمْ، ‘(তারা হলেন) তাওহীদ ও ফিক্বহের অনুসারী এবং আল্লাহর আনুগত্যের অনুসারী, যারা মানুষকে তাদের দ্বীনের মর্যাদা সম্পর্কে শিক্ষা দেয়। আর মানুষকে সৎ কাজের আদেশ করে এবং অসৎ কাজ থেকে নিষেধ করে। আল্লাহ তা‘আলা তাদের আনুগত্য করা বান্দার উপর ওয়াজিব করেছেন।’ (মুস্তাদরাক হাকেম হা/৪২৩; দুররুল মানছূর, উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য)
.
মুজাহিদ (রহঃ) বলেন, তারা হলেন الفقهاء والعلماء ‘ফক্বীহ ও ওলামায়ে কেরাম।’ (মুস্তাদরাক হাকেম হা/২০, সনদ সহীহ
.
জাবের ইবনু আব্দিল্লাহ (রাঃ) বলেন, أولوا الفقه والخير، ‘তারা হলেন ফক্বীহ ও কল্যাণকারীগণ।’ (মুস্তাদরাক হাকেম হা/১৯ সনদ সহীহ)
.
নাসাফী (রহঃ) বলেন, أُولُوا الْأَمْرِ হলেন রাষ্ট্রনায়ক বা আলেমগণ। কারণ তাদের নির্দেশ অধীনস্ত নেতাদের উপর বিজয়ী হয়। আয়াতটি প্রমাণ করে যে শাসকদের কথা তখন মানা আবশ্যক, যখন তারা সত্যের উপর থাকেন। কিন্তু যদি তারা সত্যের বিরোধিতা করেন, তাহলে তাদের কথা মানা যাবে না। কারণ রাসূল (ﷺ) বলেছেন, لاَ طَاعَةَ لِمَخْلُوْقٍ فِىْ مَعْصِيَةِ الْخَالِقِ ‘স্রষ্টার অবাধ্যতায় সৃষ্টির প্রতি কোন আনুগত্য নেই।’ (নাসাফী, সূরা নিসার ৫৯ নং আয়াতের তাফসির)।
.
আলূসী (রহঃ) বলেন, ‘উলুল আমর’-এর ব্যাখ্যায় মতভেদ আছে। কেউ বলেন, ‘উলুল আমর’ হলেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর যুগে ও তাঁর পরে মুসলমানদের শাসকগণ। তাঁদের সাথে খলীফাগণ এবং বাদশাহ ও বিচারপতিগণও শামিল। কারো মতে যুদ্ধের নেতাগণ ও কারো মতে বিদ্বানগণ। (রূহুল মাআনী, সূরা নিসার ৫৯ নং আয়াতের তাফসির)
.
বাগাভী (রহঃ) বলেন, ‘উলুল আমর’-এর ব্যাখ্যায় মতভেদ আছে। বিখ্যাত সাহাবী ইবনু আব্বাস ও জাবির (রাঃ) বলেন, তাঁরা হলেন সেসব ফক্বীহ ও আলিমগণ যাঁরা লোকদেরকে দ্বীন শিক্ষা দেন। আলী (রাঃ) বলেন, একজন নেতার জন্য অপরিহার্য হচ্ছে আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তদনুযায়ী ফায়সালা দেওয়া এবং আমানত আদায় করা। যখন তাঁরা এরূপ করবেন, তখন তাঁদের প্রজাদের কর্তব্য হচ্ছে তাঁদের কথা শোনা ও মানা। (তাফসীর বাগাভী, সূরা নিসার ৫৯ নং আয়াতের তাফসির)
.
সানাউল্লাহ পানিপথী বলেন, ‘উলুল আমর’ হলেন, ফক্বীহ ও আলেমগণ এবং শিক্ষাগুরুগণ। তাঁদের হুকুম তখনই মানা অপরিহার্য হবে, যখন তা শরীআতসম্মত হবে। (তাফসীর মাযহারী, সূরা নিসার ৫৯ নং আয়াতের তাফসির)
.
মুফতী মুহাম্মাদ শফী বলেন, ‘উলুল আমর’ আভিধানিক অর্থে সে সমস্ত লোককে বলা হয়, যাদের হাতে কোন বিষয়ের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্পিত থাকে। সে কারণেই ইবনে আব্বাস, মুজাহিদ ও হাসান বসরী প্রমুখ মুফাসসিরগণ ওলামা ও ফুক্বাহা সম্প্রদায়কে ‘উলুল আমর’ সাব্যস্ত করেছেন। তাঁরাই হচ্ছেন মহানবী (ﷺ)-এর নায়েব বা প্রতিনিধি। তাঁদের হাতেই দ্বীনী ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অর্পিত।
.
সম্মানিত পাঠক! উপরোক্ত মুফাসসিরগণের তাফসীরের সারাংশ এই যে, ‘উলুল আমর’ হচ্ছেন ইসলামী রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনায়ক, দেশের শাসক, বাদশাহ এবং মুত্তাক্বী আলিম ও ফিক্বহবীদগণকে বুঝানো হয়েছে। নির্দিষ্ট কোন আলেম বা ফক্বীহকে নয়। কেননা সাধারণত কোন আলেম বা ফক্বীহ আদেশ দানের ক্ষমতা রাখেন না। যেমন মদীনায় রাষ্ট্র ক্ষমতা লাভের পূর্বে মাক্কী জীবনে আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় রাসূলকে উদ্দেশ্য করে বলেন, فَذَكِّرْ إِنَّمَا أَنْتَ مُذَكِّرٌ، لَسْتَ عَلَيْهِمْ بِمُصَيْطِرٍ ‘অতএব তুমি উপদেশ দাও, তুমি একজন উপদেশদাতা মাত্র। তুমি তাদের উপর শাসক নও।’ (সূরা গাশিয়া ৮৮/২১-২২)। মোটকথা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য হবে নিঃশর্তভাবে এবং أُولِى الأَمْرِ বা শাসকের আনুগত্য হবে শর্তসাপেক্ষে। যেমন রাসূল (ﷺ) বলেছেন, يَقُوْدُكُمْ بِكِتَابِ اللهِ فَاسْمَعُوْا لَهُ وَأَطِيْعُوْا ‘যদি তিনি তোমাদেরকে আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী পরিচালনা করেন, তাহলে তোমরা তার কথা শোন ও তার আনুগত্য কর।’ (সহীহ মুসলিম হা/১২৯৮; মিশকাত হা/৩৬৬২)।
.
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আলোচিত ‘উলুল আমর’ কথাটি বর্তমানে মাযহাব পন্থী ও পীর পন্থী বিদআতিদের মূল পুঁজি। এই আয়াতাংশটির কল্পিত ব্যাখ্যা করেই মূলতঃ মাযহাব তথা নির্দিষ্ট ইমামের তাক্বলীদ অপরিহার্য করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, চার মাযহাবকে ‘চার ফরয’ ঘোষণা করা হয়েছে। যা আল্লাহ তাআলার উপর মিথ্যা অপবাদ মাত্র । আল্লাহ বলেন, وَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللهِ الْكَذِبَ ‘তার চেয়ে অধিক যালিম আর কে আছে, যে আল্লাহর প্রতি মিথ্যারোপ করে।’ (সূরা ছফ-৬১/৭)। আল্লাহ আমাদেরকে সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন! (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
___________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Exit mobile version