Site icon Tawheed Media

শির্কের স্বরূপ ও এর প্রকার

প্রশ্ন: শির্কের স্বরূপ ও এর প্রকারগুলো কি কি? শিরকের পরিনতি এবং যে ব্যক্তি জেনেশুনে শির্ক করেছে আল্লাহ কি তাকে ক্ষমা করবেন?
(পোস্টটি একটু বড় তবে দশ মিনিট সময় নিয়ে পড়লে শিরক বুঝতে সহজ হবে এবং উপকৃত হবেন ইন শাহ আল্লাহ)
▬▬▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: অতি আবশ্যকীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বান্দা শির্কের অর্থ, এর ভয়াবহতা ও এর প্রকারগুলো অবগত হওয়া; যাতে করে তার তাওহীদ পরিপূর্ণতা লাভ করে, তার ইসলাম নিরাপদ থেকে এবং তার ঈমান আনা সহিহ হয়। আল্লাহ্‌র কাছে তাওফিক প্রার্থনা করে আমরা শুরু করছি:

শির্কের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে: কোন অংশীদার গ্রহণ করা। অর্থাৎ একজনকে অপরজনের অংশীদার বানানো। যেমন দুইজনের মাঝে যৌথভাবে করা হলে বলা হয়: أشرك بينهما কিংবা যখন কোন একটি বিষয়ে দুইজনকে অংশীদার করা হয় তখন বলা হয়أشرك في أمره غيره শিরকের সংজ্ঞায় আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন, الشرك هو أن يتخذ من دون الله ندا يحبه كما يحب الله- ‘শিরক হ’ল আললাহ তা‘আলার সাথে অন্য কাউকে আল্লাহর সমকক্ষ গ্রহণ করা এবং আল্লাহ তা‘আলার মত তাকে ভালবাসা’।(মাদারিজুস সালিকীন ১/৩৩৯)
.
পক্ষান্তরে, শরয়ি পরিভাষায় শির্ক হল: আল্লাহ্‌র সাথে অন্য কোন অংশীদার (شريك) বা সমকক্ষ (ند) নির্ধারণ করা; আল্লাহ্‌র রুবুবিয়্যতের ক্ষেত্রে কিংবা ইবাদতের ক্ষেত্রে কিংবা আসমা ও সিফাত তথা তাঁর নাম ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে। ند হলো: সমকক্ষ ও সাদৃশ্যপূর্ণ। এ কারণে আল্লাহ্‌ তাআলা ند (সমকক্ষ) গ্রহণ করা থেকে নিষেধ করেছেন এবং যারা আল্লাহ্‌কে বাদ দিয়ে অন্য কিছুকে তাঁর সমকক্ষ হিসেবে গ্রহণ করে কুরআনের অনেক,আয়াতে তাদের নিন্দা করেছেন। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন,তোমরা আল্লাহ্‌র সাথে সমকক্ষ নির্ধারণ করো না। অথচ তোমরা জান (আল্লাহ্‌ই স্রষ্টা, তিনিই রিজিকদাতা..)।”[সূরা বাক্বারা, আয়াত: ২২] আল্লাহ্‌ তাআলা আরও বলেন:তারা আল্লাহ্‌র পথ থেকে বিচ্যুত করার জন্য তাঁর বহু সমকক্ষ বানিয়ে নিয়েছে। আপনি বলুন, তোমরা উপভোগ করতে থাক। তোমাদের গন্তব্য হচ্ছে অগ্নি।)[সূরা ইব্রাহিম, আয়াত: ৩০] হাদিসে এসেছে যে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “যে ব্যক্তি এমতাবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে যে, সে আল্লাহ্‌র সাথে অপর কোন সমকক্ষকে ডাকে সে অগ্নিতে প্রবেশ করবে।”
(সহিহ বুখারী হা/৪৪৯৭ ও সহিহ মুসলিম হা/ ৯২)

▪️শির্কের প্রকারভেদ: কুরআন-সুন্নাহ্‌র দ্ব্যর্থহীন দলিলগুলো প্রমাণ করে যে, শির্ক কখনও কখনও ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়। আবার কখনও কখনও ইসলাম থেকে খারিজ করে না। তাই আলেমগণ শির্ককে দুইভাগে ভাগ করার পরিভাষা গ্রহণ করেছেন: যথা (১) বড় শির্ক ও (২) ছোট শির্ক। এখন আমরা প্রতিটি প্রকারের পরিচয় তুলে ধরব।

▪️এক: বড় শির্ক: যেটি নিরেট আল্লাহ্‌র অধিকার এমন কোন অধিকার আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্যকে প্রদান করা; সেটা আল্লাহ্‌র রুবুবিয়্যত (প্রভুত্ব)-র ক্ষেত্রে হোক, কিংবা উলুহিয়্যত (উপাসত্ব)-এ হোক, কিংবা তাঁর নাম ও গুণাবলীর ক্ষেত্রে হোক। এ প্রকারের শির্ক কখনও প্রকাশ্য হতে পারে: যেমন- মূর্তি ও প্রতিমাপূজারীদের শির্ক কিংবা কবর, মৃতব্যক্তি ও অনুপস্থিত ব্যক্তি-পূজারীদের শির্ক।আবার কখনও কখনও অপ্রকাশ্যও হতে পারে: যেমন, আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য সব উপাস্যের উপরে যারা তাওয়াক্কুল করে, কিংবা মুনাফিকদের শির্ক ও কুফরের মত। কেননা মুনাফিকদের শির্ক যদিও বড় শির্ক, ইসলাম থেকে খারিজ কারী শির্ক, এই শির্ককারী স্থায়ী জাহান্নামী; কিন্তু এটি গোপন। যেহেতু তারা বাহ্যতঃ ইসলাম প্রকাশ করে এবং কুফর ও শির্ক গোপন রাখে। তাই তারা গোপনে মুশরিক; প্রকাশ্যে নয়।

এই শির্ক কখনও কখনও বিশ্বাসগত বিষয়গুলোতে হতে পারে: যেমন ঐ সব লোকদের বিশ্বাস যারা বিশ্বাস করে যে, এমন কিছু সত্তা রয়েছে যারা আল্লাহ্‌র সাথে সৃষ্টি করে, জীবন দেয়, মৃত্যু দেয়, মালিকানা লাভ করে এবং এ বিশ্ব পরিচালনা করে। কিংবা এমন বিশ্বাস যারা করে যে, এমন কিছু ব্যক্তি রয়েছে যারা আল্লাহ্‌র মত নিঃশর্ত আনুগত্য প্রাপ্য। ফলে তারা সেসব ব্যক্তি যা হালাল করে ও যা হারাম করে সেক্ষেত্রে তাদের আনুগত্য করে; এমনকি সেগুলো যদি রাসূলদের শরিয়তের বিপরীত হয় তবুও। কিংবা আল্লাহ্‌র ভালবাসা ও আল্লাহ্‌কে সম্মান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে শির্ক: অর্থাৎ আল্লাহ্‌কে যেভাবে ভালোবাসে কোন মাখলুককে ঠিক সেইভাবে ভালোবাসা। এটি এমন শির্ক যা আল্লাহ্‌ ক্ষমা করবেন না। এই শির্ক সম্পর্কে আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: “মানুষের মধ্যে এমন কিছু মানুষ রয়েছে যারা আল্লাহ্‌ ব্যতীত অন্য শরীকদেরকে আল্লাহ্‌র মত ভালোবাসে”।[সূরা বাক্বারা, আয়াত: ১৬৫] কিংবা এমন বিশ্বাস যে,আল্লাহ্‌র সাথে আরও এমন কিছু মানুষ আছে যারা গায়েব জানে। কিছু কিছু পথভ্রষ্ট ফিরকার মধ্যে এ শির্কটি অধিক বিদ্যমান; যেমন- রাফেযিদের মধ্যে, চরমপন্থী সুফিদের মধ্যে, চরমপন্থী বাতেনীদের মধ্যে। যেহেতু রাফেযিরা তাদের ইমামদের ব্যাপারে বিশ্বাস করে যে, তারা গায়েব জানে। অনুরূপ বিশ্বাস বাতেনীরা ও সুফিরা তাদের আউলিয়াদের ব্যাপারে বিশ্বাস করে। কিংবা এমন বিশ্বাস করা যে, এমন কিছু ব্যক্তি রয়েছে যারা এমন অনুগ্রহ করেন; যে অনুগ্রহ কেবল আল্লাহ্‌ই করতে পারেন। অর্থাৎ তারাও আল্লাহ্‌র মত অনুগ্রহ করে— গুনাহ মাফ করার মাধ্যমে, বান্দাদেরকে ক্ষমা করে দেয়ার মাধ্যমে, তাদের গুনাহগুলোকে উপেক্ষা করার মাধ্যমে।
.
এই শির্ক কখনও কখনও বাচনিকও হতে পারে: যেমন যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্যসত্তার কাছে প্রার্থনা করল, অন্যসত্তার কাছে বিপদমুক্তির দোয়া করল, অন্যসত্তার কাছে সাহায্য চাইল, অন্যসত্তার কাছে আশ্রয় চাইল; যেগুলোর ক্ষমতা আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্য কারো নেই; এই অন্যসত্তা নবী হোক, ওলি হোক, ফেরেশতা হোক, জ্বিন হোক কিংবা অন্য কোন মাখলুক হোক। নিশ্চয় এটি বড় শির্ক ও ইসলাম থেকে খারিজকারী। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি ইসলামকে নিয়ে ঠাট্টা করল কিংবা আল্লাহ্‌কে তার সৃষ্টির সাথে তুলনা দিল কিংবা আল্লাহ্‌র সাথে অন্য কোন স্রষ্টা, জীবিকাদাতা বা পরিচালনাকারী সাব্যস্ত করল—এ সবগুলো বড় শির্ক ও জঘন্য গুনাহ; যা ক্ষমা করা হবে না।আবার এ শির্ক কখনও কখনও কর্মে হয়ে থাকে: যেমন যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্যসত্তার জন্য জবাই করে, নামায পড়ে কিংবা সেজদা দেয়, কিংবা আল্লাহ্‌র বিধানের বিপরীত বিধান দেয় এবং মানুষের জন্য সেগুলোকে আইন হিসেবে জারী করে, সে সব আইনের কাছে বিচার চাওয়ার জন্য মানুষকে বাধ্য করে। অনুরূপভাবে যারা মুমিনদের বিরুদ্ধে কাফেরদেরকে ও তাদের মিত্রদেরকে সহযোগিতা করে। অনুরূপ আরও যে সব কর্ম মূল ঈমানের সাথে সাংঘর্ষিক এবং সে সব কর্মে লিপ্ত হওয়া ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়। আমরা আল্লাহ্‌র কাছে ক্ষমা ও নিরাপত্তা প্রার্থনা করছি।

▪️দুই: ছোট শির্ক: প্রত্যেক এমন সব বিষয় যা বড় শির্কের মাধ্যম কিংবা শরিয়তের দলিলে যে বিষয়গুলোকে শির্ক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে; কিন্তু সেগুলো বড় শির্কের গণ্ডিভুক্ত নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই শির্ক দুই দিক থেকে সংঘটিত হয়ে থাকে:

(১)। এমন কিছু উপায়-উপকরণের সাথে সম্পৃক্ত হওয়ার দিক থেকে আল্লাহ্‌ তাআলা যে সব উপায়-উপকরণের অনুমতি দেননি। যেমন- হাতের কব্জি, পুতি বা এ ধরণের কিছু এ বিশ্বাস নিয়ে লটকানো যে, এগুলো সুরক্ষার উপকরণ কিংবা এগুলো বদনজরকে প্রতিহত করে। অথচ আল্লাহ্‌ তাআলা এগুলোকে এসবের উপকরণ বানাননি; না শরিয়তের বিধান হিসেবে; আর না তাকদীরের নিয়ম হিসেবে।

(২)। কিছু কিছু জিনিসকে এমন সম্মান প্রদর্শন করার দিক থেকে; তবে এমন সম্মান যেটা ঐ জিনিসকে রুবুবিয়্যতের পর্যায়ে পৌঁছায় না। যেমন- আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্যসত্তার নামে কসম করা কিংবা ‘যদি আল্লাহ্‌ ও অমুক না হত’ এভাবে বলা এবং এ ধরণের অন্যান্য কথা। আলেমগণ শরিয়তের দলিল-প্রমাণে উদ্ধৃত বড় শির্ক থেকে ছোট শির্ককে আলাদা করার জন্য কিছু নীতিমালা নির্ধারণ করেছেন। এই নীতিমালার মধ্যে রয়েছে:

(১).নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পরিস্কারভাবে উল্লেখ করা যে, এই কর্মটি ছোট শির্ক। যেমন মুসনাদে আহমাদে হা/২৭৭৪২ এসেছে: মাহমুদ বিন লাবিদ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “আমি তোমাদের জন্য সবচেয়ে বেশি ভয় করি ছোট শির্কের। সাহাবায়ে কেরাম বললেন: ছোট শির্ক কি? তিনি বললেন: রিয়া (প্রদর্শনেচ্ছা)। নিশ্চয় আল্লাহ্‌ তাআলা যে দিন তার বান্দাদেরকে তাদের আমলের প্রতিদান দিবেন সেই দিন বলবেন: তোমরা দুনিয়াতে যাদেরকে প্রদর্শন করার জন্য আমল করতে তাদের কাছে যাও। গিয়ে দেখ তাদের কাছে কোন প্রতিদান পাও কিনা?”[আলবানী আস-সিলসিলাতুস সাহিহা গ্রন্থে (৯৫১) হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন]

(২). কুরআন-হাদিসে شرك (শির্ক) শব্দটি أل বিহীন نكرة হিসেবে উদ্ধৃত হওয়া। এ ধরণের প্রকাশভঙ্গির মাধ্যমে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ছোট শির্ক উদ্দেশ্য করা হয়। এর অনেক উদাহরণ রয়েছে। যেমন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের বাণী: إن الرقى والتمائم والتِّوَلَة شرك “নিশ্চয় ঝাড়ফুঁক, তামীমা (তাবিজ-কবচ-মাদুলি), তিওয়ালা (বশীকরণ ও বিদ্বেষন মন্ত্র) শির্ক”।[সুনানে আবু দাউদ হা/৩৮৮৩), আলবানী সিলসিলাতু সাহিহা হা/৩৩১) হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন] এ হাদিসে শির্ক দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে- ছোট শির্ক; বড় শির্ক নয়। তামীমা (তাবিজ-কবচ-মাদুলি): এমন কিছু যা বাচ্চাদের গায়ে ঝুলানো হয়; যেমন- পুতি বা এ জাতীয় অন্য কিছু। তারা ধারণা করে যে, এটি বাচ্চাকে বদনজর থেকে রক্ষা করবে। তিওয়ালা: এমন কিছু যা তৈরী করা হয় এ ধারণা থেকে যে, এটি স্বামীর কাছে স্ত্রীকে ও স্ত্রীর কাছে স্বামীকে প্রিয়ভাজন করবে।

(৩). সাহাবায়ে কেরাম শরিয়তের দলিলগুলো এই বুঝ বুঝা যে, এখানে শির্ক দ্বারা ছোট শির্ক উদ্দেশ্য; বড় শির্ক নয়। নিঃসন্দেহে সাহাবায়ে কেরামের বোধ ধর্তব্য। কারণ তারা আল্লাহ্‌র দ্বীন সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত এবং শরিয়ত প্রণেতার উদ্দেশ্য সম্পর্কে অধিক অবহিত। এর উদাহরণ হচ্ছে যা আবু দাউদ বর্ণনা করেছেন (হাদিস নং ৩৯১০) ইবনে মাসউদ (রাঃ) থেকে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে; “তিনি বলেন: কুলক্ষণে বিশ্বাস করা শির্ক। কুলক্ষণে বিশ্বাস করা শির্ক। তিনবার বলেছেন। আমাদের মধ্যে যে কেউই এতে লিপ্ত হয়। কিন্তু তাওয়াক্কুলের মাধ্যমে আল্লাহ্‌ এটাকে দূর করে দেন।” এই হাদিসে: “আমাদের মধ্যে যে কেউই এতে লিপ্ত হয়…” এটি ইবনে মাসউদ (রাঃ) এর কথা; যেমনটি উল্লেখ করেছেন বড় বড় মুহাদ্দিসগণ। এতে প্রমাণিত হয় যে, ইবনে মাসউদ (রাঃ) বুঝেছেন যে, এটি ছোট শির্ক। কেননা “আমাদের মধ্যে যে কেউই বড় শির্কে লিপ্ত হয়” তিনি এমনটি উদ্দেশ্য করতে পারেন না। তাছাড়া বড় শির্ক আল্লাহ্‌র উপর তাওয়াক্কুল দ্বারা দূরীভুত হয় না; বরং তাওবা দ্বারা দূরীভুত হয়।

(৪). নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শির্ক বা কুফর শব্দকে এমন কিছু দিয়ে তাফসির করা যার থেকে প্রমাণিত হয় যে, এর দ্বারা উদ্দেশ্য হচ্ছে- ছোট শির্ক; বড় শির্ক নয়। যেমনটি যায়েদ বিন খালেদ আল-জুহানী থেকে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন: রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতে বৃষ্টিপাতের পর হুদায়বিয়াতে আমাদের নিয়ে ফজরের নামায আদায় করলেন। নামায শেষ করে তিনি লোকদের দিকে ফিরে বললেন: তোমরা কি জানো, তোমাদের প্রভু কী বলেছেন? তাঁরা বললেন: আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই ভাল জানেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তিনি বলেছেন: আমার বান্দাদের মধ্যে কেউ কেউ আমার প্রতি মু’মিন হয়ে ভোরে উপনীত হয়েছে। আর কেউ কেউ কাফের হয়ে ভোরে উপনীত হয়েছে। যে বলেছে: مُطِرْنَا بِفَضْلِ اللَّهِ وَرَحْمَتِهِ (আমরা আল্লাহর করুণা ও রহমতে বৃষ্টি লাভ করেছি) সে আমার প্রতি মু’মিন (বিশ্বাসী) ও নক্ষত্রের প্রতি কাফের (অবিশ্বাসী)। আর যে বলেছে, অমুক অমুক নক্ষত্রের প্রভাবে আমাদের উপর বৃষ্টিপাত হয়েছে, সে আমার প্রতি কাফের (অবিশ্বাসী) ও নক্ষত্রের প্রতি মু’মিন (বিশ্বাসী)।”[সহিহ বুখারী হা/১০৩৮ ও সহিহ মুসলিম হা/৭১)]

এই হাদিসে কুফরের তাফসির কী সেটা অন্য একটি রেওয়ায়েতে এসেছে। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: তোমরা কি জানো না তোমাদের রব কি বলেছেন? তিনি বলেছেন: আমি যখনই আমার বান্দাদের উপর কোন নেয়ামত নাযিল করি, তখনই তাদের একদল এই নেয়ামতকে কুফুরী (অস্বীকৃতি) করে এবং বলে যে, নক্ষত্র ও নক্ষত্রের প্রভাবে আমরা নেয়ামত পেয়েছি।” এখানে স্পষ্ট করে দেয়া হল যে ব্যক্তি বৃষ্টিপাতকে নক্ষত্রের দিকে এই দিক থেকে সম্পৃক্ত করে যে, নক্ষত্রগুলো বৃষ্টিপাতের কারণ অথচ প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্‌ তাআলা নক্ষত্রগুলোকে এর কারণ বানাননি সেক্ষেত্রে এই ব্যক্তির এ কুফুরীটি হচ্ছে আল্লাহ্‌র নেয়ামতের কুফুরী (অস্বীকৃতি)। আর এটি সুবিদিত যে, কোন নেয়ামতকে অস্বীকার করাটা ছোট শির্ক। পক্ষান্তরে, যে ব্যক্তি বিশ্বাস করে যে, নক্ষত্রগুলোই বিশ্বজাহান নিয়ন্ত্রণ করে, এগুলোই বৃষ্টিপাত করে তাহলে সেটা বড় শির্ক।

ছোট শির্ক কখনও কখনও প্রকাশ্য হতে পারে; যেমন- চুড়ি, সুতা, তাবিজ-কবচ-মাদুলি ইত্যাদি পরা। আবার অপ্রকাশ্যও হতে পারে; যেমন- সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম রিয়া (প্রদর্শনেচ্ছা)।তেমনিভাবে ছোট শির্ক বিশ্বাসশ্রেণীয় বিষয়ে হতে পারে: যেমন কেউ কোন কিছু ব্যাপারে এই বিশ্বাস করল যে, এটি কল্যাণ আনয়ন করে ও অকল্যাণ দূর করে; অথচ আল্লাহ্‌ তাআলা এর মধ্যে এমন কোন উপকরণ রাখেননি। কিংবা কোন কিছুতে বরকত আছে বলে বিশ্বাস করা; অথচ আল্লাহ্‌ তাতে বরকত রাখেননি।

ছোট শির্ক কখনও কখনও কথাবার্তায়ও হতে পারে: যেমন যারা বলেছিল যে, আমরা অমুক অমুক নক্ষত্রের প্রভাবে বৃষ্টি লাভ করেছি; তবে তারা এমন বিশ্বাস করেনি যে, নক্ষত্রগুলো নিজেরা স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে বৃষ্টি নাযিল করে। কিংবা যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌ ছাড়া অন্য কোন সত্তার নামে কসম করেছে; তবে সেই সত্তা আল্লাহ্‌র সম মর্যাদাবান এমন বিশ্বাস ব্যতিরেকে। কিংবা যে ব্যক্তি বলল: আল্লাহ্‌ যা চান এবং আপনি যা চান; ইত্যাদি।

ছোট শির্ক কখনও কখনও কর্মের মাধ্যমেও হতে পারে: উদাহরণত যে ব্যক্তি কোন রোগমুক্তির জন্য কিংবা রোগ থেকে দূরে থাকার জন্য তাবিজ-কবচ লটকায় কিংবা চুড়ি পরে কিংবা সুতা পরে। কারণ প্রত্যেক যে ব্যক্তি কোন কিছুকে অন্য কিছু জিনিসের কারণ হিসেবে সাব্যস্ত করল; অথচ আল্লাহ্‌ তাআলা সেটাকে ঐ জিনিসের কারণ বানাননি; না শরয়ি বিধান হিসেবে; আর না তাকদীরের নিয়ম হিসেবে— সেই শির্ক করল। অনুরূপভাবে যে ব্যক্তি বরকত লাভের আশায় এমন কিছুকে স্পর্শ করল আল্লাহ্‌ যাতে বরকত রাখেননি; যেমন- মসজিদের দরজাগুলোকে চুম্বন করা, কিংবা মসজিদের চৌকাঠ স্পর্শ করা, কিংবা মসজিদের মাটিকে ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করা, ইত্যাদি অন্যান্য কর্ম।এটি শির্কের দুটো প্রকার ছোট শির্ক ও বড় শির্ক সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা। এই সংক্ষিপ্ত জবাবে বিস্তারিত আলোচনা করা সম্ভবপর নয়।

▪️শিরকের পরিনতি :

শিরক একটি জঘন্য অপরাধ। যদি উক্ত পাপ হতে তওবা না করে কেউ মারা যায়, তাহলে আল্লাহ তাকে জাহান্নামের আগুনে পুড়িয়ে চিরস্থায়ী শাস্তি দিবেন। যেমন আল্লাহ বলেন, নিশ্চয় যে আল্লাহর সঙ্গে শিরক করবে আল্লাহ তার জন্য জান্নাতকে হারাম করে দিবেন। আর তার স্থান হবে জাহান্নামে। আর সীমালংঘনকারীদের জন্য আখেরাতে কোন সাহায্যকারী থাকবে না।(মায়েদাহ ৭২)। আল্লাহ আরো বলেন:إِنَّ اللَّهَ لا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدِ افْتَرَى إِثْمًا عَظِيمًا ‘আল্লাহ তাঁর সাথে শরীক করার অপরাধ ক্ষমা করেন না। তা ছাড়া অন্যান্য অপরাধ যাকে ইচ্ছ ক্ষমা করেন। এবং যে কেউ আল্লার সাথে শরীক করে সে এক মহাপাপ করে।(সূরা নিসা: ৪৮)এ আয়াতে বলা হয়েছে যে, তিনি তার সাথে শির্ক করাকে ক্ষমা করবেন না। এর বাইরে যত গোনাহ আছে সবই তিনি যার জন্যে ইচ্ছে ক্ষমা করে দিবেন। আর যে তার সাথে কাউকে শরীক করে সে অবশ্যই এক বড় মিথ্যা অপবাদ রটনা করল। এমনকি তিনি রাসূল ﷺ কে উদ্দেশ্য করে বলেন,তিনি আরো বলেন,وَ لَقَدۡ اُوۡحِیَ اِلَیۡکَ وَ اِلَی الَّذِیۡنَ مِنۡ قَبۡلِکَ ۚ لَئِنۡ اَشۡرَکۡتَ لَیَحۡبَطَنَّ عَمَلُکَ وَ لَتَکُوۡنَنَّ مِنَ الۡخٰسِرِیۡنَ
“আর আপনার প্রতি ও আপনার পূর্ববর্তীদের প্রতি অবশ্যই ওহী হয়েছে যে, যদি আপনি শির্ক করেন তবে আপনার সমস্ত আমল তো নিস্ফল হবে এবং অবশ্যই আপনি হবেন ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত।(সূরা যুমার:৩৯/৬৫)
.
হাদীসে এসেছে, আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন:أَكْبَرُ الْكَبَائِرِ الإِشْرَاكُ بِاللَّهِ وَقَتْلُ النَّفْسِ وَعُقُوقُ الْوَالِدَيْنِ وَقَوْلُ الزُّورِ أَوْ قَالَ وَشَهَادَةُ الزُّورِ‘‘সবচেয়ে বড় কবীরা গোনাহ হলো আল্লাহর সাথে শিরক করা, মানুষ হত্যা করা, পিতামাতার অবাধ্যতা করা এবং মিথ্যা কথা বলা বা মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়া।(সহীহ বুখারী হা/৬৮৭১)। অপর বর্ননায় মুআবিয়াহ বিন হায়দাহ বিন মুআবিয়াহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃরাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‏ “‏ لاَ يَقْبَلُ اللَّهُ مِنْ مُشْرِكٍ أَشْرَكَ بَعْدَ مَا أَسْلَمَ عَمَلاً حَتَّى يُفَارِقَ الْمُشْرِكِينَ إِلَى الْمُسْلِمِينَ ‏”‏ ‏.‏ কোন ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করার পর মুশরিক হয়ে শিরকে লিপ্ত হলে আল্লাহ তার কোন আমলই গ্রহণ করেন না, যাবত না সে মুশরিকদের থেকে পৃথক হয়ে মুসলমানের মধ্যে প্রত্যাবর্তন করে।(মুসনাদে আহমাদ হা/ ১৯৫৩৩ সিলসিলা সহীহাহ হা/ ৩৬৯) আরেক বর্ননায় আবদুল্লাহ্ ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ مَنْ ماتَ يُشْرِكُ بِاللهِ شَيْئًا دَخَلَ النَّارَ وَقُلْتُ أَنا: مَنْ ماتَ لا يُشْرِكُ بِاللهِ شَيْئًا دَخَلَ الْجَنَّةَ, “যে আল্লাহ্‌র সঙ্গে শিরক করা অবস্থায় মারা যায়, সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে। এবং আমি বললাম, যে আল্লাহ্‌র সঙ্গে কোন কিছুকে শিরক না করা অবস্থায় মারা যায়, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। (সহীহ বুখারী পর্ব ২৩ : অধ্যায় ১ হা/১২৩৮,আল লু’লু ওয়াল মারজান,হা/ ৫৮)
.
▪️যে ব্যক্তি জেনেশুনে শির্ক করেছে আল্লাহ্‌ কি তাকে ক্ষমা করবেন?
.
আল্লাহ্‌ তাআলা জানিয়েছেন যে, তিনি তওবাকারীর ও তার দিকে প্রত্যাবর্তনকারীর সকল গুনাহ মাফ করে দিবেন। তিনি বলেন, বলুন, হে আমার বান্দাগণ! তোমরা যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছ আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ হতে নিরাশ হয়ো না; নিশ্চয় আল্লাহ্‌ সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দিবেন। নিশ্চয় তিনি ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।”[সূরা যুমার, আয়াত: ৫৩] বিশেষভাবে শির্ক থেকে তওবা করা ও সে তওবা কবুল হওয়ার প্রসঙ্গে এসেছে, আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: “এবং তারা আল্লাহ্‌র সাথে কোন উপাস্যকে ডাকে না। আর আল্লাহ্‌ যাকে হত্যা করা নিষেধ করেছেন, যথার্থ কারণ ছাড়া তাকে হত্যা করে না। আর তারা ব্যভিচার করে না; যে ব্যক্তি এগুলো করবে, সে শাস্তি ভোগ করবে। কিয়ামতের দিন তার শাস্তি বর্ধিতভাবে প্রদান করা হবে এবং সেখানে সে স্থায়ী হবে হীন অবস্থায়। তবে যে তওবা করে, ঈমান আনে ও সৎকাজ করে, ফলে আল্লাহ্‌ তার গুনাহসমূহ নেক দ্বারা পরিবর্তন করে দিবেন। আর আল্লাহ্‌ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”[সূরা ফুরকান, আয়াত: ৬৮-৭০]

আল্লাহ্‌ তাআলা খ্রিস্টানদের শির্ক ও কুফরের কথা উল্লেখ করার পর তাদেরকে তওবা করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন: “তারা অবশ্যই কুফরী করেছে যারা বলে, ‘আল্লাহ্‌ তো তিনের মধ্যে তৃতীয়। অথচ এক ইলাহ্‌ ছাড়া আর কোন ইলাহ্‌ নেই। আর তারা যা বলে তা থেকে বিরত না হলে তাদের মধ্যে যারা কুফরীর উপর অটল থাকবে তাদেরকে কষ্টদায়ক শাস্তি স্পর্শ করবে। তবে কি তারা আল্লাহ্‌র দিকে ফিরে আসবে না ও তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে না? আল্লাহ্‌ তো ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”[সূরা মায়িদা, আয়াত: ৭৩-৭৪] গুনাহ্‌ যত বড় হোক না কেন আল্লাহ্‌র ক্ষমা, মহানুভবতা ও অনুগ্রহ তার চেয়ে বড়। অতএব, আপনার কর্তব্য হচ্ছে– আল্লাহ্‌ অভিমুখী হওয়া। কৃত কর্মের জন্য অনুতপ্ত হওয়া। পুনরায় সেসব কর্মে লিপ্ত না হওয়ার দৃঢ় সিদ্ধান্ত নেয়া। তবে, আপনি আল্লাহ্‌র অনুগ্রহ, রহমত ও তাওফিকপ্রাপ্তির সুসংবাদ গ্রহণ করুন। কারণ ইসলাম পূর্বের সকল গুনাহ্‌ ধ্বংস করে দেয়। যেমনটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমর বিন আস (রাঃ) কে বলেছিলেন: “হে আমর! তুমি কি জান না যে, ইসলাম পূর্বের সকল গুনাহ্‌ মাফ করে দেয়।”[সহিহ মুসলিম (১২১) ও মুসনাদে আহমাদ হা/১৭৮৬১) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরও বলেন: “গুনাহ্‌ থেকে তওবাকারী ঐ ব্যক্তির মত যার গুনাহ্‌ই নাই।”[সুনানে তিরমিযি, আলবানী হাদিসটিকে ‘হাসান’ বলেছেন]

বান্দা যদি তওবা করে আল্লাহ্‌ তার তওবা কবুল করেন, তাকে ক্ষমা করে দেন। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: “আর তিনিই তাঁর বান্দাদের তওবা কবুল করেন ও পাপসমূহ মোচন করেন।”[সূরা শুরা, আয়াত: ২৫] তিনি আরও বলেন: “আর আমি অবশ্যই ক্ষমাশীল তার প্রতি যে তওবা করে ঈমান আনে এবং সৎকাজ করে তারপর সৎপথে অবিচল থাকে।”[সূরা ত্বাহা, আয়াত: ৮২] তাই বান্দার কর্তব্য হচ্ছে– আল্লাহ্‌র প্রতি ভাল ধারণা পোষণ করা, তওবা কবুল হওয়ার আশা রাখা। কারণ আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন: ‘আমার বান্দা আমার প্রতি যেমন ধারণা করে আমি তেমন।”[সহিহ বুখারী হা/৭০৫৫ ও সহিহ মুসলিম (২৬৭৫)] মুসনাদে আহমাদ এ সহিহ সনদে এসেছে– “আমার বান্দা আমার প্রতি যেমন ধারণা করে আমি তেমন। অতএব, বান্দা আমার প্রতি যেমন ইচ্ছা তেমন ধারণা পোষণ করুক।”(মুসনাদে আহমাদ হা/১৬০৫৯)
.
পরিশেষে সন্মানিত পাঠকবৃন্দ,একজন মুসলিমের উপর কর্তব্য ছোট শির্ক বা বড় শির্ক সকল শির্কের ব্যাপারে সাবধান থাকা। কেননা শির্ক হচ্ছে- আল্লাহ্‌র সবচেয়ে বড় অবাধ্যতা, তাঁর অধিকারে সীমালঙ্ঘন করা। আল্লাহ্‌র অধিকার হচ্ছে- নিরঙ্কুশভাবে তার ইবাদত করা।আল্লাহ্‌ তাআলা মুশরিকদের জন্য স্থায়ীভাবে জাহান্নামে থাকাকে আবশ্যক করেছেন এবং জানিয়েছেন যে, তিনি তাদেরকে ক্ষমা করবেন না। তাদের জন্য জান্নাতকে হারাম করে দিয়েছেন। আল্লাহ্‌ তাআলা বলেন:إِنَّ اللَّهَ لا يَغْفِرُ أَنْ يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَنْ يَشَاءُ وَمَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدِ افْتَرَى إِثْماً عَظِيماً (নিশ্চয় আল্লাহ্‌ তাঁর সাথে শির্ক করাকে ক্ষমা করবেন না। এর চেয়ে লঘু গুনাহ যার জন্য ইচ্ছা ক্ষমা করে দিবেন। যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র সাথে শির্ক করে সে মহা পাপে লিপ্ত হয়।)[সূরা নিসা, আয়াত: ৪৮] তিনি আরও বলেন:إِنَّهُ مَنْ يُشْرِكْ بِاللَّهِ فَقَدْ حَرَّمَ اللَّهُ عَلَيْهِ الْجَنَّةَ وَمَأْوَاهُ النَّارُ وَمَا لِلظَّالِمِينَ مِنْ أَنْصَارٍ (নিশ্চয় যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র সাথে শির্ক করে আল্লাহ্‌ তার জন্য জান্নাতকে হারাম করে দিয়েছেন। জাহান্নামই তার আবাসস্থল। আর জালিমদের কোন সাহায্যকারী নেই।)[সূরা মায়িদা, আয়াত: ৭২] তাই প্রত্যেক আকলবান ও দ্বীনদার ব্যক্তির উপর আবশ্যক নিজের ব্যাপারে শির্কে লিপ্ত হওয়াকে ভয় করা এবং নিজের প্রভুর কাছে শির্ক থেকে মুক্ত থাকার জন্য দোয়া করা যেমনিভাবে ইব্রাহিম (আঃ) দোয়া করে বলেছেন:وَاجْنُبْنِي وَبَنِيَّ أَنْ نَعْبُدَ الأَصْنَامَ আমাকে এবং আমার সন্তানদেরকে মূর্তিপূজা থেকে বাঁচান)[সূরা ইব্রাহিম, আয়াত: ৩৫] এজন্য জনৈক সলফে সালেহীন বলতেন: “ইব্রাহিম আলাইহি সালামের পর আর কোন ব্যক্তি নিজেকে নিরাপদ ভাবতে পারে।” তাই একজন বিশ্বস্ত বান্দা শির্ককে ভয় করা ছাড়া গত্যন্তর নেই এবং তার প্রভুর কাছে তার তীব্র আগ্রহ হবে তিনি যেন তাকে শির্ক থেকে মুক্ত রাখেন। বান্দা ঐ সুমহান দোয়াটি করতে থাকবে যে দোয়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিখিয়েছেন: اللهم إني أعوذ بك أن أشرك بك وأنا أعلم، وأستغفرك لما لا أعلم‏ (হে আল্লাহ্‌! জ্ঞাতসারে আপনার সাথে শির্ক করা থেকে আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাচ্ছি এবং অজ্ঞাতসারে করে ফেললে ক্ষমা চাচ্ছি।)[আলবানী ‘সহিহুল জামে’ গ্রন্থে হা/ ৩৭৩১) হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন। আরো বিস্তারিত জানতে দেখুন ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩৪৮১৭)
.
পূর্বে যা আলোচিত হয়েছে সেটি বড় শির্ক ও ছোট শির্কের স্বরূপগত পার্থক্য, প্রত্যেক প্রকারের সংজ্ঞা ও প্রকারভেদ। পক্ষান্তরে, এ দুটোর হুকুমগত পার্থক্য হচ্ছে:বড় শির্ক ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়। বড় শির্কে লিপ্ত ব্যক্তির উপর ইসলাম ত্যাগ ও মুরতাদ হয়ে যাওয়ার হুকুম দেয়া হয় এবং সে কাফের ও মুরতাদ হয়ে যায়। পক্ষান্তরে, ছোট শির্ক ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয় না। বরং কখনও কখনও কোন মুসলিম ছোট শির্কে লিপ্ত হয়ে যেতে পারে। তবুও সে ইসলামের উপরেই থাকবে। তবে ছোট শির্কে লিপ্ত ব্যক্তি ভয়াবহ শংকার মধ্যে রয়েছে। কেননা ছোট শির্ক কবিরা গুনাহ। ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেন: “আমি আল্লাহ্‌র নামে মিথ্যা শপথ করা আমার কাছে অন্য কোন সত্তার নামে সত্য শপথ করার চেয়ে অধিক প্রিয়।” তিনি অন্য কোন সত্তার নামে শপথ করাকে (যেটা হচ্ছে ছোট শির্ক) আল্লাহ্‌র নামে মিথ্যা শপথ করার চেয়ে জঘন্য নির্ধারণ করেছেন। অথচ এটি সুবিদিত যে, আল্লাহ্‌র নামে মিথ্যা শপথ করা কবিরা গুনাহ। আমরা আল্লাহ্‌র কাছে দোয়া করছি তিনি যেন আমাদের অন্তরগুলোকে তাঁর দ্বীনের উপর অবিচল রাখেন যতক্ষণ পর্যন্ত না আমরা তাঁর সাথে সাক্ষাত করি। আমরা মহান আল্লাহ্‌র ইজ্জতের ওসিলা দিয়ে তাঁর কাছে আশ্রয় চাচ্ছি তিনি যেন, আমাদেরকে পথভ্রষ্ট না করেন। নিশ্চয় তিনি চিরঞ্জীব; যিনি মৃত্যুবরণ করবেন না; জ্বিন ও ইনসান মৃত্যুবরণ করবে। আল্লাহ্‌ই সর্বজ্ঞ ও সবচেয়ে প্রজ্ঞাবান এবং তাঁর কাছেই প্রত্যাবর্তন।
________________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Exit mobile version