Site icon Tawheed Media

শরী‘আতসম্মত ঝাড়-ফুঁকের পদ্ধতি

❀শরী‘আতসম্মত ঝাড়-ফুঁকের পদ্ধতি❀

কুরআন-হাদীছের বহু দলীল প্রমাণ করে যে, নিজের জন্য নিজের ঝাড়-ফুঁক সবচেয়ে বেশী উপকারী, যদিও মানুষ এর বিপরীতটা মনে করে এবং ঝাড়-ফুঁক প্রদানকারীকে খুঁজে বেড়ায়। এক্ষেত্রে তারা এমনকি মূর্খ, ভেলকিবাজ বা জাদুকরের কাছে যেতেও কুণ্ঠা বোধ করে না। শার‘ঈ ঝাড়-ফুঁক চোখ লাগা, জাদু এবং নানাবিধ মানসিক ও শারীরিক অসুখ-বিসুখ দূরীকরণে ফলপ্রসূ। চিকিৎসা বিজ্ঞান পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অনুশীলনের উপর নির্ভরশীল। শরী‘আত সম্মত ঝাড়-ফুঁক যেহেতু অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি চিকিৎসা জগৎ, সেহেতু এখানেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অনুশীলনের গুরুত্ব কম নয়। অতএব, ঝাড়-ফুঁকের ক্ষেত্রে কোনো পদ্ধতি যদি পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে উপকারী প্রমাণিত হয় এবং তাতে শরী‘আত পরিপন্থী কোনো কিছু না থাকে, তবে তা বৈধ। যাহোক, বিভিন্নভাবে ঝাড়-ফুঁক করা যেতে পারে। যেমন:

১. রোগীর গায়ে ফুঁ এবং হাত দিয়ে স্পর্শ ছাড়াই আয়াত বা মাসনূন দু‘আ পড়া। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন,
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন কোনো রোগী দেখতে যেতেন বা তাঁর কাছে রোগী আনা হত, তখন তিনি বলতেন,
«أَذْهِبِ البَاسَ رَبَّ النَّاسِ، اشْفِ وَأَنْتَ الشَّافِي، لاَ شِفَاءَ إِلَّا شِفَاؤُكَ، شِفَاءً لاَ يُغَادِرُ سَقَمًا[1]

২. রোগীর গায়ে হাত দিয়ে স্পর্শসহ আয়াত বা মাসনূন দু‘আ পড়া। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন,
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম কারো ঝাড়-ফুঁক করলে তাকে ডান হাত দিয়ে স্পর্শ করে বলতেন,
«أَذْهِبِ البَاسَ رَبَّ النَّاسِ، اشْفِ وَأَنْتَ الشَّافِي، لاَ شِفَاءَ إِلَّا شِفَاؤُكَ، شِفَاءً لاَ يُغَادِرُ سَقَمًا[2]

৩. স্পর্শ এবং ফুঁসহ আয়াত বা মাসনূন দু‘আ পড়া। আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহা বলেন,
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন অসুস্থতা অনুভব করতেন, তখন সূরা ইখলাছ, নাস, ফালাক্ব পড়ে নিজের গায়ে ফুঁ দিতেন এবং হাত দিয়ে স্পর্শ করতেন[3]।

৪. পানিতে বা তেলে আয়াত বা মাসনূন দু‘আ পড়ে তা পান করা বা ব্যবহার করা। রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাবেত ইবনে ক্বায়েস ইবনে শাম্মাস রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু–এর জন্য পানি পড়ে তা তার গায়ে দিয়ে দেন[4]। আমাদের সালাফে ছালেহীন এই পদ্ধতি ব্যবহার করতেন।

• ঝাড়-ফুঁকের সময় পবিত্র কুরআনের অনেক সূরা ও আয়াত পড়া যায়, তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে,

সূরা ফাতেহা:
ঝাড়-ফুঁকের মাধ্যমে চিকিৎসার ক্ষেত্রে আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় সূরা ফাতিহা অত্যন্ত ফলপ্রসূ। আবূ সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত,
একদল ছাহাবায়ে কেরাম কোনো এক সফরে ছিলেন। একটি আরব গোত্রের গোত্র প্রধান দংশিত হলে একজন ছাহাবী সূরা ফাতিহার মাধ্যমে তাকে ঝাড়-ফুঁক করেন এবং আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় সে সুস্থ হয়ে উঠে। খবরটি রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর কাছে পৌঁছলে তিনি তা সমর্থন করেন[5]।

আয়াতুল কুরসী:
ঘুমের সময় এবং বাসা-বাড়ীতে আয়াতুল কুরসী পাঠ করলে তা আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় শয়তান ও অন্যদের থেকে রক্ষাকবচ হয়। আবূ হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
যখন তুমি তোমার বিছানায় ঘুমাতে যাবে, তখন আয়াতুল কুরসী পড়বে; তাহলে সকাল পর্যন্ত আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে তোমার জন্য একজন হেফাযতকারী রাখা হবে এবং শয়তান তোমার নিকটবর্তীও হতে পারবে না[6]।
অন্য বর্ণনায় এসেছে, আবূ আইয়ূব আনছারী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
বাসা-বাড়ীতে আয়াতুল কুরসী পড়বে, তাহলে শয়তান তোমার নিকটবর্তী হতে পারবে না[7]।
সকাল-সন্ধ্যায় আয়াতুল কুরসী পড়লে তা শয়তান থেকে বাঁচার কারণ হয়। কেউ তা সন্ধ্যায় পড়লে সকাল পর্যন্ত এবং সকালে পড়লে সন্ধ্যা পর্যন্ত তার হেফাযত করা হয়[8]।

সূরা ফালাক্ব ও সূরা নাস:
এ সূরাদ্বয় আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় জিন এবং চোখ লাগা বা বদনযর থেকে হেফাযতকারী। আবূ সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন,
রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিন ও বদনযর থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করতেন। যখন এই সূরা দু’টি নাযিল হল, তখন তিনি অন্য সবকিছু ছেড়ে এ দু’টি গ্রহণ করলেন[9]।
এ সূরা দু’টি বিভিন্ন বিপদাপদ, বালা-মুছীবত থেকে আল্লাহ্‌র নিকট আশ্রয় প্রার্থনার সর্বোত্তম হাতিয়ার[10]।

সূরা এখলাছ, ফালাক্ব ও নাস:
এ সূরা তিনটি সকাল-সন্ধ্যায় তিনবার করে পাঠ করলে আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় এগুলি যে কোনো বিপদাপদ থেকে মুক্তির জন্য যথেষ্ট হবে[11]।
এ সূরা তিনটি বিভিন্ন বিপদাপদ, বালা-মুছীবত থেকে আল্লাহ্‌র নিকট আশ্রয় প্রার্থনার সর্বোত্তম হাতিয়ার[12]।
অসুখ-বিসুখ হলে এই সূরাগুলি দিয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঝাড়-ফুঁক করতেন[13]।

সূরা কাফেরূন:
ঘুমের আগে এই সূরাটি পড়লে তা শির্ক থেকে মুক্তির কারণ হবে। ফারওয়া ইবনে নাওফাল তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেন,
তাঁর পিতা রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম–এর কাছে এসে বললেন, হে আল্লাহ্‌র রাসূল! আমাকে এমন কিছু শিক্ষা দিন, যা আমি ঘুমানোর সময় পড়তে পারি। তিনি বললেন, তুমি قُل يٰأَيُّهَا الكٰفِرونَ শেষ পর্যন্ত পড়ে ঘুমাবে, তাহলে তা শির্ক থেকে মুক্তির কারণ হবে[14]।
হাদীছটিতে শির্কের মত মারাত্মক রোগ থেকে মুক্তির পথ বাৎলে দেওয়া হয়েছে।

সূরা বাক্বারা:
কোনো বাড়ীতে সূরা বাক্বারা পাঠ করলে শয়তান সেই বাড়ী থেকে পালিয়ে যায়[15]।
এই সূরায় যেমন রয়েছে বরকত, তেমনি তা জাদুকরদের শক্তি খর্ব করতে পারে[16]।

সূরা বাক্বারার শেষ দুই আয়াত:
যে ব্যক্তি রাতে এই আয়াত দু’টি পড়বে, তার জন্য এ দু’টি বালা-মুছীবত, শয়তান ইত্যাদি থেকে বাঁচার ক্ষেত্রে যথেষ্ট হবে। আবূ মাসঊদ উক্ববা ইবনে আমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
যে ব্যক্তি রাতে সূরা বাক্বারার শেষ দুই আয়াত পড়বে, তার জন্য এ দু’টি যথেষ্ট হবে[17]।
কোনো গৃহে এই আয়াত দু’টি তিন রাত পড়লে শয়তান ঐ গৃহের নিকটবর্তীও হতে পারবে না[18]।
কোনো রোগীকে ঝাড়-ফুঁক করার সময় বলবে,
«بِسْمِ اللهِ أَرْقِيكَ، مِنْ كُلِّ شَيْءٍ يُؤْذِيكَ، مِنْ شَرِّ كُلِّ نَفْسٍ أَوْ عَيْنِ حَاسِدٍ، اللهُ يَشْفِيكَ بِسْمِ اللهِ أَرْقِيكَ»[19]
শরীরের কোথাও ব্যথা অনুভব করলে ব্যথার স্থানে হাত রেখে ৩ বার بِسْمِ اللهِ বলবে এবং ৭ বার নিম্নোক্ত দু‘আটি পড়বে:
«أَعُوذُ بِاللهِ وَقُدْرَتِهِ مِنْ شَرِّ مَا أَجِدُ وَأُحَاذِرُ»
এছাড়া আরো অনেক আয়াত ও দু‘আ রয়েছে, যেগুলি দিয়ে ঝাড়-ফুঁক করা যায়। অনুরূপভাবে সকাল ও সন্ধ্যায় পঠিতব্য যিকর-আযকার ও দু‘আসমূহ আল্লাহ্‌র ইচ্ছায় আমাদেরকে শয়তানের কুমন্ত্রণা এবং নানা শারীরিক ও মানসিক রোগ-ব্যাধি থেকে রক্ষা করতে পারে।

[1] (বুখারী, হা/৫৬৭৫)।
[2] (বুখারী, হা/৫৭৫০)।
[3] (বুখারী, হা/৫৭৫১; মুসলিম, হা/২১৯২)।
[4] (আবূ দাঊদ, হা/৩৮৮৫)।
[5] (বুখারী, হা/৫৭৪৯; মুসলিম, হা/২২০১)।
[6] (বুখারী, হা/২৩১১, ৫০১০)।
[7] (তিরমিযী, আহমাদ, শায়খ আলবানী হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন, ছহীহ তিরমিযী, হা/ ২৮৮০ ও ছহীহ তারগীব ওয়া তারহীব, হা/ ১৪৬৯ দ্র:)।
[8] (ছহীহ তারগীব, হা/ ৬৬২, ১৪৭০; সিলসিলা ছহীহাহ, হা/৩২৪৫)।
[9] (আলবানী, ছহীহ তিরমিযী, হা/২০৫৮; ছহীহ ইবনে মাজাহ, হা/২৮৪৬)।
[10] (আলবানী, ছহীহ আবূ দাঊদ, হা/১৪৬৩)।
[11] (ছহীহ আবূ দাঊদ, হা/৫০৮২; ছহীহ তিরমিযী, হা/৩৫৭৫)।
[12] (নাসাঈ, হা/৭৮৪৫; হায়ছামী, মাজমা‘উয-যাওয়ায়েদ, ৭/১৫২, তিনি বলেন, হাদীছটি বাযযার বর্ণনা করেন এবং এর বর্ণনাকারীগণ ছহীহ বুখারীর বর্ণনাকারী)।
[13] (বুখারী, হা/৫০১৬; মুসলিম, হা/২১৯২)।
[14] (ছহীহ তিরমিযী, হা/৩৪০৩; ছহীহ আবূ দাঊদ, হা/৫০৫৫)।
[15] (মুসলিম, হা/৭৮০; তিরমিযী, হা/২৮৭৭)।
[16] (মুসলিম, হা/৮০৪)।
[17] (বুখারী, হা/৫০০৮; মুসলিম, হা/৮০৮)।
[18] (ছহীহ তিরমিযী, হা/২৮৮২; হাকেম, ২/২৬০)।
[19] (ছহীহ মুসলিম, হা/২১৮৬)।।

Exit mobile version