Site icon Tawheed Media

রোজাদারের জন্য যে সকল বিধিনিষেধ মানা অপরিহার্য

প্রশ্ন: হাদীসে বর্ণিত সিয়ামের পুরস্কার পেতে চাইলে রোজার কোন কোন হক আদায় করে রোজা রাখতে হবে? অর্থাৎ রোজাদারের জন্য যে সকল বিধিনিষেধ মানা অপরিহার্য।
▬▬▬▬▬▬▬◖◉◗▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: বছরে ১২ মাসের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি মাস রামাদান মাস। এটি রহমতের মাস। এই মাসে যে রহমত পেল, সে সত্যিকারের সৌভাগ্যবান। আর যে বঞ্চিত হলো, সে চরম পর্যায়ের হতভাগ্য। রামাদানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) সিয়ামের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন, সিয়ামের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষকে তার পাশবিক ইচ্ছা ও জৈবিক অভ্যাস থেকে মুক্ত করা এবং জৈবিক চাহিদাসমূহের মধ্যে সুস্থতা ও স্বাভাবিকতা প্রতিষ্ঠিত করা। সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মানুষ আত্মশুদ্ধি ও পবিত্রতা অর্জন করে, চিরন্তন জীবনের অনন্ত সফলতার স্বর্ণ শিখরে আরোহণ করে। পশুত্ব নিস্তেজ হয়ে মনুষ্যত্ব জাগ্রত হয়। দারিদ্র পীড়িত মানুষের প্রতি সহানুভূতির উদ্রেক করে। সিয়াম মানুষের শারীরিক ও আত্মিক শক্তির উন্নতি সাধন করে। পাশবিক চাহিদার প্রাবল্য, যা মানুষের স্বাস্থ্য ধ্বংস করে তা থেকে মুক্তি দান করে। ক্বলবের ইসলাহ ও চরিত্র সংশোধনের ক্ষেত্রে সিয়াম কার্যকর ভূমিকা পালন করে। (ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মা‘আদ, ৪র্থ খণ্ড পৃষ্ঠা ২২)। সুতরাং, রামাযান মাস ক্ষমা চাওয়ার মাস, ক্ষমা পাওয়ার মাস। তবুও যারা আলস্যে দিন কাটিয়ে দিল, ইবাদত, যিকির-আযকার, কুরআন তেলাওয়াতে রত থাকতে পারল না, কেঁদে-কেটে মহান রবের কাছে কৃত পাপের ক্ষমা ভিক্ষা নিতে পারল না তারা কতই না হতভাগ্য!
.
আবু হুরায়রা (রা:) বলেন, রাসূল (ﷺ) বললেন, ‘ঐ লোকের নাক ধুলায় ধূসরিত হোক, যার কাছে রামাযান আসলো, আবার শেষও হয়ে গেল; কিন্তু নিজের গুনাহ-খাতা মাফ করিয়ে নিতে পারল না।’ (সুনানে তিরমিযী, হা/৩৫৪৫; মিশকাত, হা/৯২৭)। রাসূল (ﷺ) খুৎবার মিম্বারে ওঠার সময় বললেন, আমীন! সাহাবীগণ কারণ জানতে চাইলে তিনি বললেন, জিবরীল আলাইহিস সালাম এসে বললেন, যে ব্যক্তি রামাদান পেল, অথচ নিজের পাপ ক্ষমা করিয়ে নিতে পারল না, সে ধ্বংস হোক! বলুন, আমীন! তাই আমি বললাম, আমীন! (সহীহ ইবনু খুযায়মা, হা/১৮৮৮)। জাবের ইবনু সামুরা (রা:) বলেন, রাসূল (ﷺ) মিম্বারে ওঠার সময় জিবরীল আ: এসে বললেন, ‘যে রামাদান মাস পাওয়ার পর মারা গেল, কিন্তু নিজের পাপের ক্ষমা পেল না, ফলে তাকে জাহান্নামে যেতে হলো, আল্লাহ যেন তাকে আরো দূরে ঠেলে দেন; বলুন, আমীন! রাসূল (ﷺ) তখন বললেন, আমীন! (আল মু‘জামুল কাবীর, হা/২০২২; সহীহ তারগীব, হা/২৪৯১)। প্রিয় পাঠক! একটু চিন্তা করুন, সর্বশ্রেষ্ঠ ফেরেশতার দু‘আতে যদি সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষটি আমীন বলেন, তাহলে সেই দু‘আ ব্যর্থ হওয়ার কি কোনো সুযোগ আছে?
.
সিয়ামের পুরস্কার পেতে চাইলে অবশ্যই রোজার হক আদায় করে রোজা রাখতে হবে। রোজাদারের উপর কিছু বিধিনিষেধ:
___________________________________
(১). মিথ্যা এবং মূর্খতা বর্জন করতে হবে।
.
সিয়ামের মূল লক্ষ্য ও কাঙ্ক্ষিত ফলাফল হল- সব ধরনের পাপ থেকে তাকে দূরে রাখে। আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন ‘‘যে ব্যক্তি মিথ্যা কথা, সে অনুসারে কাজ করা এবং মূর্খতা পরিহার করলো না, আল্লাহর নিকট তার পানাহার বর্জনের কোনো প্রয়োজন নেই।’’ (সহীহ বুখারী হা/১৯০৩, ৬০৫৭; আবু দাঊদ হা/২৩৬২; ইবনু মাজাহ হা/১৬৮৯; তিরমিযী হা/৭০৭; মিশকাত হা/১৯৯৯)। ‘মূর্খতা’ বলতে কী বুঝানো হয়েছে, এ ব্যাপারে সহীহ বুখারীর শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যাকার ইমাম ইবনু হাজার আসকালানি (রাহ.) বলেন, এর মানে হলো, চিৎকার-চেঁচামেচি করা, বোকার মতো কাজ করা। অর্থাৎ হৈ-হুল্লোড় করা, মূর্খের মতো আচরণ করা। অপর বর্ণনায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘‘রোজা জাহান্নামের আগুন থেকে ঢালস্বরূপ। তাই, যে ব্যক্তি রোজা রেখে ভোর করে, সে মূর্খতা দেখাবে না। অন্য কেউ যদি তার সাথে মূর্খের ন্যায় আচরণ করে, তবে সে তার সাথে অশ্লীল কথা বলবে না এবং গালি দেবে না। বরং সে যেন বলে, ‘‘আমি রোজাদার।’’ (ইমাম নাসায়ি, আস-সুনান: ২২৩৪; হাদিসটি সহিহ)
.
(২). অনর্থক ও অশ্লীল কথা বলা যাবে না।
.
আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “কেবল পানাহার থেকে বিরত থাকাই রোজা নয়। রোজা হল, অনর্থক ও অশ্লীল কথা থেকে বিরত থাকা।’’ (ইমাম হাকিম, আল-মুসতাদরাক: ১৫৭০; শায়খ আলবানি, সহীহুত তারগিব: ১০৮২; হাদিসটি সহীহ)
.
(৩). গালি দেওয়া যাবে না, ঝগড়া করা যাবে না।
.
আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘রোজা ঢালস্বরূপ। তোমাদের কেউ যেন রোজা পালনের দিন অশ্লীল কথা না বলে এবং চিৎকার-চেঁচামেচি না করে। কেউ যদি তাকে গালি দেয় অথবা তার সাথে লড়াই করতে চায়, তাহলে সে যেন বলে, ‘আমি একজন রোজাদার মানুষ।’’ (সহীহুল বুখারী হা/১৮৯৪, ১৯০৪ মুসলিম হা/১১৫১, তিরমিযী হা/৭৬৪, নাসায়ী ২২১৬, ২২১৭, আহমাদ ৭৬৩৬, ৯৬৭৩, বায়হাকী ৪/২৭৫, সহীহ আবী দাউদ হা/২০৪৫)
.
(৪). কামনা-বাসনা থেকে দূরে থাকতে হবে।
.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘‘আদম সন্তানের প্রতিটি (ভালো) কাজের প্রতিদান ১০ গুণ থেকে ৭০০ গুণ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়া হয়।’’ মহান আল্লাহ বলেন, “কিন্তু রোজা ব্যতীত। কেননা, এটি আমার জন্য এবং আমিই এর প্রতিদান দেবো। বান্দা আমার জন্যই তার কামনা-বাসনা এবং পানাহার থেকে বিরত থেকেছে।’’ (ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ২৫৯৭ ইসলামি ফাউন্ডেশন হা/২৫৭৩)। অপর বর্ণনায়, আবু হুরায়রা(রাযিয়াল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এরশাদ করেছেন; আল্লাহ তা‘আলা বলেন, আদম সন্তানের প্রত্যেক আমল তার জন্য কিন্তু সিয়াম শুধু আমার জন্য, আমিই এর প্রতিদান দিব। সিয়াম ঢালস্বরূপ, যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সাথে লড়াই-ঝগড়া করতে চায়, তবে সে তাকে বলবে, আমি সেয়েম তথা সিয়াম পালনকারী।’ (সহীহ বুখারী, হা/১৯০৪; সহীহ মুসলিম, হা/১১৫১; মুসনাদে আহমাদ, হা/৭৬৭৯)
.
(৫). এগুলোর পাশাপাশি গিবত, পরচর্চা থেকে দূরে থাকতে হবে। চোখ এবং কানের হেফাজত করতে হবে। তাহলেই আমাদের রোজা পরিপূর্ণতা পাবে, ইনশাআল্লাহ।
.
ইবনুল মুনকাদির (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, الصَّائِمُ إِذَا اغْتَابَ خُرِقَ، وَإِذَا اسْتَغْفَرَ رُقِّعَ، সায়েম যখন গীবত করে, তখন তার সিয়াম ছিন্ন হয়ে যায়। আর যখন ক্ষমা প্রার্থনা করে, তখন (তার ছিন্নভিন্ন সিয়ামকে) জোড়া দেওয়া হয়।’ (জামে‘উল উলূম ওয়াল হিকাম খন্ড:২ পৃষ্ঠা:৮০৩) ওমর বিন আব্দুল আযীয (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, দিনভর সিয়াম পালন করা এবং রাত জেগে সালাত আদায় করার পর হালাল-হারামকে মিশিয়ে ফেলার নাম তাক্বওয়া নয়। বরং আল্লাহ যা হারাম করেছেন তা পরিত্যাগ করা এবং যা ফরয করেছেন তা যথাযথভাবে আদায় করার নামই হলো তাক্বওয়া। এরপর যাকে সৎকর্ম সম্পাদনের তাওফীক দেওয়া হয়েছে, সেটা তার জন্য সোনায় সোহাগা।’ (ইবনু রজব, জামে‘উল ‘উলূম ওয়াল হিকাম, খন্ড:১ পৃষ্ঠা:৪০০)
.
রোজাদার ব্যক্তিদের জন্য অত্যন্ত এলার্মিং একটি হাদীস হল- আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেন; রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, কত রোযাদার আছে যাদের রোযার বিনিময়ে ক্ষুধা ছাড়া আর কিছুই জোটে না। (ইবাদতের জন্য) কতো রাত্রিজাগরণকারী আছে, যাদের রাতে জেগে থাকা ছাড়া আর কিছুই জোটে না!’ (মুসনাদে আহমাদ হা/ ৮৬৩৯, ৯৩৯২, ইবনু মাজাহ হা/১৬৯০, সুনানে দারেমী হা/২৭২০, বায়হাকী ৪/২৭০, মিশকাত হা/২০১৪) অতএব রামাযান শেষ হয়ে গেল, অথচ আমার গুনাহ-খাতা ক্ষমা করিয়ে নিতে পারলাম না; এমন হতভাগ্য যেন আমরা না হই, সে প্রত্যাশায় শেষ হোক এবারের রামাযান। আল্লাহ কবুল করুন। আমীন!
(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Exit mobile version