Site icon Tawheed Media

যদি কোন এক দেশের লোকেরা চাঁদ দেখতে পায়, তবে সে ক্ষেত্রে বাকি সকল দেশের উপর রোজা রাখা কি ফরজ হবে?

অনুবাদঃ আবু হাযম মুহাম্মাদ সাকিব চৌধুরী বিন শামস আদ দীন আশ শাতকানী

 

বিষয়ঃ যদি কোন এক দেশের লোকেরা চাঁদ দেখতে পায়, তবে সে ক্ষেত্রে বাকি সকল দেশের উপর রোজা রাখা কি ফরজ হবে?

এই মাসআলাতে এত বেশী ইখতিলাফ হয়েছে যে শেষ মেষ এতে প্রায় আটটি মত প্রকাশ পেয়েছে, যেভাবে সিদ্দিক হাসান খান উল্লেখ করেছেন আর রাওদাহ আন নাদিয়্যাহ গ্রন্থে। (১/২২৪)

ইমাম আশ শাওকানী এ বিষয়ের উপর একটি রিসালাহ লিখেছেন, যাকে তিনি নাম দিয়েছেন, ‘ইতলা’ আরবাব আল কামাল ‘আলা মা ফি রাসালাতিল জালাল ফিল হিলালি মিনাল ইখতিলাল’ আর এ তিন মাযহাবকে সবচাইতে শক্তিশালী হিসেবে উপস্থাপন করেছেনঃ

 

প্রথম মাযহাবঃ

বাকি সকল দেশের জন্যে রোজা রাখা ফরজ। আর তা মালিক, আশ শাফিয়ি, আহমাদ, আল লাইথ ও অন্যান্যদের মত। আর তা অধিকতর শক্তিশালী মত হিসেবে বেছে নেওয়া গবেষকবৃন্দ হতে যাদের মধ্যে রয়েছেন শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ যেভাবে এসেছে মাজমু’ আল ফাতাওয়াতে, আল ইমাম আশ শাওকানী, সিদ্দিক হাসান খান, আল ‘আল্লামাহ আল আলবানী ও আল্লামাহ ইবনু বায। আল্লাহর রহমত তাঁদের সকলের উপর বর্ষিত হোক। এবং তাঁরা এ দ্বারা দলিল দিয়েছেন, (এটি রাসুলুল্লাহﷺ এর  হাদিস)

রোজা রাখ (চাঁদ) দেখবার দ্বারা, আর ভাঙ (চাঁদ) দেখবার দ্বারা।

আশ শাওকানী বলেন, এটি কেবলমাত্র কোন এলাকার অধিবাসীদের জন্যে খাস নয় শুধুমাত্র তাদের উপর প্রযোজ্য এ দৃষ্টিকোণ থেকে। বরং তা সে সকল প্রত্যেকের জন্যে প্রযোজ্য যে নিজেকে মুসলিমদের অন্ত্ররভুক্ত করবে। সুতরাং এর দ্বারা কোন দেশের অধিবাসীর চাঁদ দেখবার কারণে বাকি সকল দেশের উপর ফরজ হওয়ার দলিল দেওয়া অন্য কোন দেশের জন্যে ফরজ না হওয়ার দলিল দেওয়া থেকে এগিয়ে। কেননা যদি শুধু কোন দেশের অধিবাসী তা দেখে, তবে নিশ্চিতভাবে মুসলিমেরা তা দেখেছে। সুতরাং তাদের উপর যা ফরজ, অপরের জন্যেও তা ফরজ। (নাইলুল আওতার হতে)

 

দ্বিতীয় মাযহাবঃ

এ বিষয়টি তখনই অন্য কোন দেশের জন্যে ফরজ হবে, যারা চাঁদ দেখেছে তাদের সাথে এ বিষয়ে একমত হবে। এটি শাফিয়ী মাযহাব, আহমাদের একটি মত। একে বেছে নিয়েছেন ইবনু আবদুল বার তাঁর তামহীদ গ্রন্থে, শাইখুল ইসলাম ও বেছে নিয়েছেন যেভাবে এসেছে ইখতিয়ারাত গ্রন্থে। আর এটি আমাদের শাইখ মুকবিল বিন হাদী আল ওয়াদি’ইয়ীরও মত,শাইখ ইবনু উথাইমীন এবং অন্যান্য বিজ্ঞ উলামাবৃন্দ, তাঁরা দলিল দিয়েছেনঃ

১। আল্লাহর বাণীঃ

তোমাদের মধ্য হতে যারা এ মাসের সাক্ষী হবে, তারা যেন রোজা রাখে। (সুরাতুল বাকারা, আয়াত ১৮৫)

তাঁরা বলেন, আর যে চাঁদ ওঠার সাক্ষী হয়েছে তার সাথে যারা একমত হয়নি, তাদের ব্যাপারে বলা যাবে না যে তারাও তা সাক্ষ্য করেছে। না বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে না হুকুমের দৃষ্টিকোণ হতে। আর আল্লাহ তার উপর রোজা রাখা ফরজ করেছেন যে তা সাক্ষ্য করেছে।

২। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালামের বক্তব্যঃ ((রোজা রাখ (চাঁদ) দেখবার দ্বারা, আর ভাঙ (চাঁদ) দেখবার দ্বারা।)) সুতরাং তিনি রোজার রাখবার সাথে চাঁদ দেখবার সম্পর্ক করেছেন। আর যে চাঁদ উঠবার বিষয়ে অন্য কারুর সাথে দ্বিমত পোষণ করবে, তার ক্ষেত্রে বলা যায় না যে সে চাঁদ দেখেছে। না বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে না হুকুমের দৃষ্টিকোণ হতে।

৩। ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু এর হাদিস, যা সাহীহ মুসলিমে রয়েছে (১০৮৭), তিনি জিজ্ঞেস করেছেন কুরাইবাকে, “কখন চাঁদ দেখেছে?”, আর তখন তিনি (কুরাইবা) শামে ছিলেন। তিনি বললেন, “আমরা তা জুমু’আর রাতে দেখেছি।” ইবন আব্বাস বললেন, “কিন্তু আমরা তা শনিবার রাতে দেখেছি, সুতরাং আমরা রোজা রাখতে থাকব যতক্ষণ না পর্যন্ত আমরা চাঁদ দেখব। অথবা ইদ্দাহ সম্পূর্ণ করব।” কুরাইব বললেন, “আপনার জন্যে মু’আউয়িয়ার চাঁদ দেখা যথেষ্ট নয়?”। তিনি বললেন, “না, আমাদের রাসুলুল্লাহﷺ এভাবেই আদেশ করেছেন।”

 

তৃতীয় মাযহাবঃ

এক দেশের জন্যে অন্য দেশের চাঁদ দেখা অনুযায়ী চলা বাধ্যতামূলক নয়। যদি না তা প্রধান নেতার দ্বারা সাব্যস্ত হয়। তখন সকল লোকের জন্যে বাধ্যতামূলক। কেননা সকল রাষ্ট্রসমূহ সত্যিকার অর্থে এক রাষ্ট্র স্বরূপ। সুতরাং তার হুকুম সকল ব্যক্তির জন্যে পালন করা বাধ্যতামূলক। আর তা ইবন মাজিশুনের বক্তব্য।

আল্লামাহ ইবন উথাইমীন রাহিমাহুল্লাহ বলেন, আজকের দিনের লোকেদের আমল এরূপই। আর তা এলাকার ঐক্যবদ্ধতার বিষয়ে অত্যন্ত শক্তিশালী বক্তব্য।

 

আমি বলি, প্রথম দুই মতই সবচাইতে শক্তিশালী, আর যা সত্যিকার অর্থে প্রকাশিত – আর আল্লাহই ভালো জানেন – প্রথম মতই সবচাইতে শক্তিশালী। যে ‘আম দলিল যা দ্বারা দলিল স্থাপন করা হয়েছে তার কারণে। আর শরিয়াহ ‘আম, যদিও হুকুম অন্য কিছুর / কারো উপর হয়, নবী ﷺ অবশ্যই তা বর্ণনা করে যেতেন।

 

দ্বিতীয় মতকে নিম্নের বর্ণনা অনুযায়ী রদ করা হয়ঃ

১। নিশ্চিতভাবে চাঁদ উঠবার বিষয়টিই মূল আদেশ, যা পরিসীমার গণ্ডী দ্বারা নির্ধারিত নয়। সুতরাং সেটি কোন বিষয় যা আরেক স্থানে (জায়গায়) চাঁদ উঠবার সাথে পার্থক্য নির্ধারণ করবে ?

২। আল্লামাহ আল আলবানী রাহিমাহুল্লাহ বলেন “তামামুল মান্নাহ” তে, “আর চাঁদ উঠবার বিষয়টি সত্যিকার অর্থে একটি সম্পর্কযুক্ত বিষয়, এর কোন বিভক্তকারী সীমা নেই যা মানুষকে পার্থক্য নির্ধারন করতে পারঙ্গম করবে।

শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন মাজমু’ আল ফাতাওয়াতেঃ “যদি আমরা এর সীমাকে খুব ক্ষুদ্র দূরত্ব বা এলাকার সীমা দ্বারা বর্ণনা করি, সে ক্ষেত্রে প্রত্যেক ব্যক্তি যে অপর ক্ষুদ্র দূরত্ব বা এলাকায় রয়েছে তার জন্যে উচিত রোজা রাখা, ভাঙ্গা ও কুরবানী দেওয়া। অথচ আরেক ব্যক্তি যার সাথে তার দূরত্ব তীর ছুড়বার দূরত্ব সে এ সকল কাজের কোনটিই করবে না। আর তা মুসলিমদের দীন হতে নয়!!

৩। যে সকল আয়াত আর হাদিস দ্বারা দ্বিতীয় মত দলিল পেশ করে থাকে, সেসব রমজান মাস শুরু হওয়া বিষয়ক জ্ঞান। আর তা হাসিল হয় কোন নির্দিষ্ট দেশের লোকেদের চাঁদ দেখবার মাধ্যমে। আবার কোন একটি দেশের লোকেদের জন্যে রোজা রাখা বাধ্যতামূলক সেই দেশের কতিপয় লোকের চাঁদ দর্শনের মাধ্যমে। ঠিক তেমনিভাবে অন্য দেশের লোকেদের উপরও রোজা রাখা বাধ্যতামূলক হবে এই দেশের লোকেদের চাঁদ দর্শনের ফলে।

 

ইবন আব্বাসের হাদিস দ্বারা তাদের দলিল দেওয়ার বিষয়টির জবাব সমূহঃ

প্রথমঃ ইবন আব্বাস এ কথা পরিষ্কার করেননি যে নবী ﷺ তাঁদের একই মহাদেশের অন্যের দর্শন অনুযায়ী আমল করতে মানা করেছেন। বরং ইবন আব্বাস এ উদ্দেশ্য করেছেন যে তিনি তাঁদের আদেশ করেছেন ত্রিশ দিন পূর্ণ করবার বিষয়ে। অথবা আদেশ করেছেন সেভাবে যেভাবে অন্য হাদিসে এসেছে।

শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ বলেন কিতাবুস সিয়ামে (১/১৭৪) : এরূপ হওয়া জায়েয। কেননা নবী ﷺ তাঁদের আদেশ করেছেন চাঁদ দেখবার দ্বারা আর ভাঙতে চাঁদ দেখবার দ্বারা। আর, ততক্ষণ পর্যন্ত কোন ভাঙ্গা নেই, যতক্ষণ পর্যন্ত দর্শন না করা হবে, অথবা এর ইদ্দত পূর্ণ করা হবে – যেভাবে ইবনু আব্বাস সহ অন্যান্যরা বর্ণনা করেছেন এর তাফসীর স্বরূপ। সুতরাং ইবন আব্বাস এ বিশ্বাস করেছিলেন যে প্রত্যেক দেশের লোকেরা রোজা রাখবে, যতক্ষণ না পর্যন্ত তারা চাঁদ দেখবে অথবা ইদ্দত পূর্ণ করবে। আর তাঁর ব্যাপারে ইতিপূর্বে বর্ণিত হয়েছে যে তিনি এক স্থানে উম্মাতের কিয়দাংশের দর্শন উদ্দেশ্য করেছেন, তাদের উপর শারিয়াতের লেখার কারণে। আর এই কাজটি অন্য স্থানের লোকেদের দর্শন দ্বারা।

এ জবাব দ্বারাই আরও জবাব দিয়েছেন ইবন দাকীক আল ‘ঈদ, আশ শাওকানী তাঁর ‘নাইল আল আওতার’ গ্রন্থে ও সিদ্দীক হাসান খান তাঁর ‘আর রাওদাতুন নাদিয়্যাহ’ গ্রন্থে।

দ্বিতীয়ঃ আল আল্লামাহ আল আলবানী রাহিমাহুল্লাহ বলেন ‘তামাম আল মান্নাহ’ গ্রন্থে, ইবনু আব্বাসের হাদিসটি পাওয়া যায় তাদের মাঝে যারা রোজা রেখেছিল তাদের দেশের চাঁদ দেখার উপর ভিত্তি করে। এর পর রমজানের মাঝে তাঁর নিকট এ খবর পৌঁছে যে আরেক দেশে তারা তাঁর একদিন পূর্বেই চাঁদ দেখতে পেয়েছে। এ অবস্থায় তিনি রোজা রাখা চালিয়ে যান তাঁর নিজের দেশের লোকেদের সাথে যতক্ষণ না পর্যন্ত ত্রিশ দিনের ইদ্দাত পূর্ণ না হয়, অথবা তাঁরা চাঁদ দর্শন করেন।

শাইখুল ইসলাম ইবনু তাইমিয়্যাহ রাহিমাহুল্লাহ এ জবাবের মতই জবাব দিয়েছেন যা পূর্বে বর্ণিত হয়েছে, যা পাওয়া যায় ‘মাজমু’ আল ফাতাওয়া’ তে। (২৫/১০৯)

তৃতীয়ঃ কুরাইবের যে চাঁদ দর্শনের বিষয়টি সেটি একজনের দর্শন। কিন্তু নবী ﷺ তাঁদের আদেশ করেছেন তাঁরা যেন ভাঙ্গেন দুজনের সাক্ষ্য অর্থাৎ দর্শন দ্বারা। যদি তাঁরা তাঁর খবর দ্বারাই আমল করতেন, তাহলে একজনের সাক্ষ্য দ্বারা ভাঙতেন। এভাবেই জবাব দিয়েছেন শাইখুল ইসলাম রাহিমাহুল্লাহ ‘শারহুল ‘উমদাহ’ গ্রন্থে আর এ জবাবের দিকেই নির্দেশ করেছেন ইমাম আন নাওয়াওয়ী ‘শারহু মুসলিম’ গ্রন্থে। আর আল্লাহই ভালো জানেন।

আমি বলিঃ আর যেখান হতে বর্ণনা করা হয় যে এই হাদিসের অন্য কোন দিক হওয়া সম্ভব নয়, তাঁরা এই দলিল দেন যে শাম আর মাদীনা নাবাউইয়াহতে চাঁদ উঠা পৃথক নয়, বরং তা একই চাঁদের উঠা। আর আল্লাহই ভালো জানেন।

 

প্রাসঙ্গিক সূত্রঃ

আল মাজমু’ (২/ ২৭৩-২৭৪), শারহ কিতাবিস সিয়াম ফিল উ’মদাহ (১/১৮০-১৮৫), আল মুঘনী (৪/৩২৮), আল মুফহিম (৩/১৪২), আল ফাতহ (১৯০৬), শারহু মুসলিম (৭/১৯৭), নাইলুল আওতার (১৬৩৬), মাজমু’ আল ফাতাওয়া (২৫/১০৩ – ), আর রাওদাতুন নাদিয়্যাহ (১/২২৪ – ), তামামুল মান্নাহ (৩৯৮), আশ শারহুল মুমতি’ (২/ ৩২০ – ৩২৩), তাওদীহুল আহকাম (৩/১৪০ – )

(ফাতহুল ‘আল্লাম ফি দিরাসাতি আহাদিথি বুলুঘিল মারাম, আবু ‘আব্দুল্লাহ মুহাম্মাদ বিন ‘আলী বিন হিযাম আল ফাদলী আল বা’দানী, পৃষ্ঠা ৫৫৮-৫৬১)

 

পাদটীকা

 

বিঃদ্রঃ শাইখ ইয়েমেনের দাম্মাজের বড় আলেমদের একজন এবং বিখ্যাত হাদিস বিশারদ শাইখ মুকবিল বিন হাদী আল ওয়াদি’য়ী এর ছাত্রদের একজন। উনার সাইটঃ http://www.sh-ibnhizam.com/

স্বত্বাধিকারী © www.darhadith.com।

Exit mobile version