Site icon Tawheed Media

মৃতব্যক্তির পরিবারের কান্নার কারণে তাকে শাস্তি দেয়া হয়

প্রশ্ন: কিছু হাদীসে এসেছে মৃতব্যক্তির পরিবারের কান্নার কারণে তাকে শাস্তি দেয়া হয়।আবার অন্য হাদীসে এসেছে রাসূল ﷺ নিজেও মৃতের জন্য কেঁদেছেন। দুই রকম হাদীসের ব্যাখ্যা কী?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর:নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে একাধিক হাদিসে উদ্ধৃত হয়েছে যে, মৃতব্যক্তির পরিবারের কান্নার কারণে তাকে শাস্তি দেয়া হয়। এ হাদিসগুলোর মধ্যে রয়েছে সহিহ মুসলিম সংকলিত ইবনে উমর (রাঃ) এর হাদিস; ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃহাফসাহ্‌ (রাঃ) ‘উমারের জন্য (ঘাতক কর্তৃক আহত হলে) কাঁদছিলেন। তখন ‘উমার (রাঃ) বললেন, হে স্নেহের কন্যা! তুমি কি জান না রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, মৃত ব্যক্তিকে তার স্বজনদের কান্নাকাটির দরুন শাস্তি দেয়া হয়। (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং ২০২৭ ই.ফা. ২০১১, ই.সে. ২০১৮)
.
অপর বর্ননায় আবূ মালিক আল আশ‘আরী (রাঃ)বলেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমার উম্মাতের মধ্যে জাহিলিয়্যাত যুগের চারটি বিষয় রয়ে গেছে যা তারা ছাড়ছে না, (১) নিজের গুণের গর্ব, (২) কারো বংশের নিন্দা, (৩) গ্রহ-নক্ষত্র যোগে বৃষ্টি চাওয়া এবং (৪) বিলাপ করা। অতঃপর তিনি বলেন, বিলাপকারিণী যদি তার মৃত্যুর পূর্বে তওবা্ না করে, কিয়ামতের (কিয়ামতের) দিন তাকে উঠানো হবে- তখন তার গায়ে থাকবে আলকাতরার জামা ও ক্ষতের পিরান
(সহীহ মুসলিম হা/৯৩৪, আহমাদ ২২৯০৩, ইবনু হিব্বান ৩১৪৩,সিলসিলা সহীহাহ হা/৭৩৪ মিশকাত, হা/১৭২৭)
.
আরেক বর্ননায় মুগীরাহ্ ইবনু শু‘বাহ্ (রাঃ)হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি যে, মৃত ব্যক্তির জন্য মাতম করা হয় কিয়ামতের দিন সে মৃতকে এ মাতমের জন্য শাস্তি দেয়া হবে (সহীহ বুখারী হা/১২৯১, সহীহ মুসলিম হা/৯৩৩ তিরমিযী হা/১০০০)
.
অন্য এক বর্ননায় আমর ইবনুল ‘আস (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃআম্‌র ইবনুল ‘আস (রাঃ) মৃত্যুর সময় তাঁর ছেলে ‘আবদুল্লাহকে ওয়াসিয়্যাত করেছিলেন যে, যখন আমি মারা যাব তখন আমার জানাযার সাথে যেন মাতম করার জন্য কোন রমণী না থাকে। আর না থাকে কোন আগুন। আমাকে দাফন করার সময় আমার উপর আস্তে আস্তে মাটি ঢালবে। দাফনের পরে দু’আ ও মাগফিরাতের জন্য এতটা সময় (আমার ক্ববরের কাছে) অপেক্ষা করবে, যতটা সময় একটি উট যবেহ করে তার গোশ্‌ত বণ্টন করতে লাগে। তাহলে আমি তোমাদের সাথে একটু পরিচিত থাকবো এবং (নির্ভয়ে) জেনে নেব, আমি আমার রবের ফেরেশতাগণের নিকট কি জবাব দিবো (সহীহ মুসলিম হা:১২১ মিশকাত হা/১৭১৬) উপরোক্ত চারটি হাদীস মৃত ব্যক্তির জন্য ক্রন্দন না করতে উৎসাহিত করা হয়েছে। আলোচ্য হাদীস থেকে এ কথা বুঝা যাচ্ছে যে, মৃত ব্যক্তির যে কেউ কাঁদলে মৃত ব্যক্তিকে শাস্তি দেয়া হয়। চাই সে মৃত ব্যক্তির পরিবারের সদস্য হোক বা না হোক।
.
অপরদিকে একাধিক ঘটনায় সাব্যস্ত হয়েছে যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মৃতব্যক্তির জন্য নিজে কেঁদেছেন সাহাবীরাও কেঁদেছেন। যেমন: নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজে তাঁর ছেলে ইবরাহীমের মৃত্যুতে তিনি কেঁদেছেন। রাসূল (ﷺ) বলেছেন, চক্ষু অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে, মন ভারাক্রান্ত। তবে আমরা শুধু সেটাই উচ্চারণ করব যা আমাদের প্রতিপালককে সন্তুষ্ট করে। ইবরাহীম! তোমার মৃত্যুতে আমরা দুঃখে ভারাক্রান্ত’। (সহীহ বুখারী, হা/১৩০৩; সহীহ মুসলিম, হা/২৩১৫; মিশকাত, হা/১৭২২)
.
অপর বর্ননায় আবদুল্লাহ ইবনু উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা) হতে বর্ণিত। তিনি বলে, সা‘দ ইবনু উবাদাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহু) রোগাক্রান্ত হলেন। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আব্দুর রাহমান ইবনু আওফ, সা‘দ ইবনু আবূ ওয়াক্কাস এবং আবদুল্লাহ ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা)-কে সঙ্গে নিয়ে তাঁকে দেখতে আসলেন। তিনি তাঁর ঘরে প্রবেশ করে তাঁকে পরিজনের মাঝে দেখতে পেলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, তার কি মৃত্যু হয়েছে? তাঁরা বললেন, না। হে আল্লাহর রাসূল! তখন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কেঁদে ফেললেন। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কান্না দেখে উপস্থিত লোকেরা কাঁদতে লাগলেন। তখন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বললেন, শুনে রাখো! নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলা চোখের পানি ও অন্তরের শোক-ব্যথার কারণে আযাব দিবেন না। তিনি আযাব দিবেন এর কারণে (এ বলে) জিহ্বার দিকে ইঙ্গিত করলেন। অথবা এর কারণেই তিনি রহম করে থাকেন। আর নিশ্চয় মৃত ব্যক্তিকে তার পরিজনের বিলাপের কারণে আযাব দেওয়া হয়। উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এ (ধরনের কান্নার) কারণে লাঠি দ্বারা আঘাত করতেন, কঙ্কর নিক্ষেপ করতেন বা মুখে মাটি পুরে দিতেন (সহীহ বুখারী, হা/১৩০৪;সহীহ মুসলিম, হা/৯২৪) অনুরূপভাবে তাঁর এক মেয়েকে দাফন করার সময় তিনি কেঁদেছেন; যেমনটি সহিহ বুখারীতে আনাস (রাঃ)-এর হাদিসে এসেছে।আবার তাঁর কোন এক নাতীর মৃত্যুতেও তিনি কেঁদেছেন; হাদীসটি দেখুন সহীহ বুখারী হা/১২৮৪) ও সহিহ মুসলিম হা/৯২৩)
.
এই হাদীসগুলো প্রমান করে মৃতের জন্য স্বয়ং রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কান্না করেছেন। এখন যদি প্রশ্ন করা হয়: আমরা কিভাবে এ হাদিসগুলোর মাঝে সমন্বয় করব? যে হাদিসগুলো মৃতব্যক্তির জন্য কাঁদতে বারণ করে; আবার অন্য হাদিসগুলো সেটার অনুমতি দেয়? এই কথার জবাব সরাসরি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজেই সেটা ব্যাখ্যা করেছেন; উসামা বিন যায়েদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত একবার নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর জনৈক মেয়ের ঘরের নাতির মৃত্যুতে কাঁদছিলেন। তখন সাদ বিন উবাদা (রাঃ) বললেন: ইয়া রাসূলুল্লাহ্‌! এটি কী? তখন রাসূল ﷺ বললেনঃ এটিই রহম-দয়ামায়া, যা আল্লাহ্ তাঁর বান্দাদের অন্তরে সৃষ্টি করে দিয়েছেন। আল্লাহ্ তাঁর রহম-দিল বান্দাদের উপরই দয়া করে থাকেন। (সহীহ বুখারী হা/৭৩৭৭ আধুনিক প্রকাশনী- ৬৮৬১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৮৭৩)
.
এই হাদীসটির ব্যাখ্যায় শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন,এ হাদিসের মর্ম হলো: সাদ (রাঃ) ধারণা করেছিলেন যে, সব ধরণের কান্নাই হারাম এবং চোখে পানি আসা হারাম এবং ধারণা করেছিলেন যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা ভুলে গেছেন; তাই তিনি তার কাছে সেটা উল্লেখ করেছেন। তখন নবী সাল্লাল্লাহু্ আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাকে জানিয়েছেন যে, নিছক কান্না ও চোখে পানি আসা হারাম নয়; মাকরুহও নয়। বরঞ্চ সেটি রহমত ও মর্যাদা। হারাম হলো: খেদোক্তি ও বিলাপ; এবং এ দুটো মিশ্রিত কান্না কিংবা এর কোন একটি মিশ্রিত কান্না। যেমনটি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “নিশ্চয় আল্লাহ্‌ চোখের পানি ও মন ভারাক্রান্ত হওয়ার কারণে শাস্তি দেন না। কিন্তু তিনি এইটির কারণে শাস্তি দেন কিংবা দয়া করেন। তিনি হাত দিয়ে জিহ্বার দিকে ইশারা করেন।(ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-৩৩৮৬৬)
.
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ মৃতব্যক্তির জন্য মা ও ভাইদের কান্নাতে কি কোন আপত্তি আছে কি না এ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হলে তিনি বলেন: “চোখের পানি ও মন ভারাক্রান্ত হওয়াতে কোন গুনাহ নেই। কিন্তু আক্ষেপ ও বিলাপ হলো নিষিদ্ধ। (মাজমূঊল ফাতাওয়া ইবনু তাইমিয়্যাহ,খন্ড: ২৪ পৃষ্ঠা: ৩৮০)
.
পরিশেষে উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে, কোন নিকটাত্মীয়ের মৃত্যু সংবাদে কোন প্রকার চিৎকার, চেঁচামেচি অথবা আল্লাহর প্রতি অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে বিলাপসহ উচ্চৈঃস্বরে কান্না করা হারাম। যদি মৃত্যুর পূর্বে মৃত ব্যক্তি তার জন্য এমন কান্নাকাটি করতে নিষেধ করে না যায়, কিংবা তার পক্ষ থেকে কান্নাকাটি করার ইশারা-ইঙ্গিত বা অনুমোদন থাকে তাহলে উপরে চিৎকার করে কান্নাকাটি করার কারণে তার কবরে শাস্তি হবে। তবে কেউ যদি কারো মৃত্যুতে দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে শুধু চোখের পানি ছেড়ে বিনা আওয়াজে কাঁদে তাহলে কোন সমস্যা নেই ইনশাআল্লাহ এমনকি এই কান্না যদি দীর্ঘদীন করা হয় তাহলেও এর জন্য মৃত ব্যক্তিকে শাস্তি দেয়া হয় না। কেননা মৃতের জন্য বিলাফ না করে দুঃখে ভারাক্রান্ত হওয়া, কান্নাকাটি করা দোষের নয়, যদি কান্না প্রকৃতিগত হয়ে থাকে। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
_________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Exit mobile version