Site icon Tawheed Media

বিবাহ বহির্ভূত নারী-পুরুষের প্রেম ভালোবাসা অতঃপর অভিভাবকের অনুমতি ব্যতীত পালিয়ে বিবাহ করা সম্পর্কে ইসলামের বিধান

ভূমিকা: নবী-রাসূলগণের সময় থেকে এখন পর্যন্ত ইসলামের দৃষ্টিতে বিবাহ বহির্ভূত তথাকথিত রিলেশনশিপ বা প্রেমের সম্পর্ক সম্পূর্ণ হারাম। একে অপরের সঙ্গে কামনা-বাসনা সহকারে কথাবার্তা, নির্জনে দেখা-সাক্ষাৎ, ডেটিং, চ্যাটিং, স্পর্শ, হাসাহাসি, দুষ্টুমি সবই ইসলামে নিষিদ্ধ। এসব রিলেশনশিপ মূলত শয়তানের ফাঁদ। এই ফাঁদে পড়ে নারী-পুরুষ উভয়ে যেনার দিকে ধাবিত হয়, যার পরিণতি খুবই ভয়াবহ। নারী-পুরুষ পরস্পরের প্রতি দৃষ্টি বিনিময়েও রয়েছে সুস্পষ্ট হুকুম। এ প্রসঙ্গে কুরআনে পাকে আল্লাহ তা‘আলা সুস্পষ্ট নীতিমালা ঘোষণা করেছেন। পুরুষদেরকে উদ্দেশ্য করে আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা করেন, ‘হে রাসূল! (আপনি) মুমিনদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাযত করে। এতে তাদের জন্য খুব পবিত্রতা রয়েছে। নিশ্চয় তারা যা করে আল্লাহ তা‘আলা সে ব্যাপারে খবর রাখেন।’ (সূরা আন-নূর: ৩০)। আবার নারীদের উদ্দেশ্য করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘,হে রাসূল! (আপনি) ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের যৌনাঙ্গের হেফাযত করে। সাধারণত প্রকাশমান ছাড়া তাদের সৌন্দর্য প্রদর্শন না করে এবং তারা যেন তাদের মাথার ওড়না বুকের ওপরে ফেলে রাখে। আর তারা যেন তাদের স্বামী, বাবা, শ্বশুর, ছেলে, স্বামীর ছেলে, ভাই, ভাইয়ের ছেলে, বোনের ছেলে, স্ত্রীলোক অধিকারভুক্ত বাদী, যৌনকামনামুক্ত পুরুষ ও (এমন) বালক- যারা নারীদের গোপন অঙ্গ সম্পর্কে অজ্ঞ, তাদের ব্যতীত অন্য কারো সামনে সৌন্দর্য প্রকাশ না করে। (এমনকি) তারা যেন তাদের গোপন সাজ-সজ্জা প্রকাশ করার জন্য জোরে পদচারণা না করে। মুমিনগণ! তোমরা সবাই আল্লাহর কাছে তাওবা কর; যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার।’ (সূরা আন-নূর: ৩১)।
.
মহান আল্লাহ আমাদেরকে যেনার নিকটবর্তী হতেও নিষেধ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আর যেনার কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ।’ (সূরা বানী ইসরাঈল: ৩২)। নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘‘নিঃসন্দেহে দু’চোখের ব্যভিচার হলো তাকানো, দু’কানের ব্যভিচার হলো (কামনার সাথে) শোনা, জিহ্বার ব্যভিচার হলো (কামনামিশ্রিত) কথোপকথন করা, হাতের ব্যভিচার হলো স্পর্শ করা, পায়ের ব্যভিচার হলো (কামনা চরিতার্থে) হেঁটে যাওয়া, অন্তরের ব্যভিচার হলো কামনা-বাসনা করা। আর লজ্জাস্থান একে সত্য করে বা মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। (অর্থাৎ, ফাইনালি লজ্জাস্থানের মাধ্যমেই চূড়ান্ত ঘটনা ঘটে)।’(ইমাম মুসলিম, আস-সহিহ: ৬৬৪৭)অন্য হাদীসে রাসূল ﷺ বলেছেন, কোনো পুরুষ যেনো কোনো (বেগানা) নারীর সাথে মাহরাম ব্যতীত এককিত্তে না থাকে (সহীহ বুখারী, হা/৪৯৩৫)। উমার রা, হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী ﷺ বলেছেন, ‘কোন পুরুষ অপর মোহরাম তথা বিবাহ বৈধ এমন) নারীর সাথে নিঃসঙ্গে দেখা হলেই শয়তান সেখানে তৃতীয় জন হিসাবে উপস্থিত হয়’ (তিরমিযী, হা/১১৭১; মিশকাত, হা/৩১১৮)।
.
তবে দয়াময় আল্লাহ বৈধ উপায়ে বিয়ের মাধ্যমে নিজেদের ভালোবাসা প্রকাশ ও জৈবিক চাহিদা মেটানোর সুযোগ দিয়েছেন। সুতরাং মানুষের কর্তব্য, বিয়ের পূর্বে হারাম সম্পর্কের দিকে পা না বাড়িয়ে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী বিয়ে করা। কেননা হারাম রিলেশন (অবৈধ প্রেম) কাবীরা গুনাহের কারণ। সুতরাং যারা হারাম ভালোবাসায় লিপ্ত হয়েছে তাদের জন্য করণীয় হলো, অনতিবিলম্বে তওবা করে এ পথ থেকে ফিরে আসা। আল্লাহ আমাদেরকে পাপাচার থেকে তওবায়ে নাসূহা করার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ তা‘আলার কাছে আন্তরিক তওবা করো। আশা করা যায়, তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের মন্দ কর্মসমূহ মোচন করে দেবেন এবং তোমাদেরকে দাখিল করবেন জান্নাতে, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত।’ (সূরা আত-তাহরীম: ৮)। তওবায়ে নাসূহা অর্থ খাঁটি, নির্ভেজাল, একনিষ্ঠতা ও আন্তরিকতাপূর্ণ তওবা। অর্থাৎ এমন আন্তরিকতা ও দৃঢ় প্রত্যয় সহকারে তওবা করা যে, তওবাকারী আর কখনো জেনে-বুঝে ওই গুনাহে লিপ্ত হবে না। কুরআন-সুন্নাহর সুস্পষ্ট দিক-নির্দেশনা হলো, মুসলিম নারী-পুরুষ উভয়ে অবৈধ সংস্পর্শ, কথা-বার্তা ও দেখা-সাক্ষাৎ, আসক্তি ও সাজ-সজ্জা থেকে বেঁচে থাকবে। নিজেদের দ্বীন ও আত্মসম্মান রক্ষা করবে।
.
প্রেম হলো রোগ আর চিকিৎসা হলো বিয়ে! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘‘একে অপরের প্রতি ভালোবাসা পোষণকারী দুজনের মাঝে বিবাহের মতো (উত্তম) আর কিছু নেই।’’ (ইমাম ইবনু মাজাহ, আস-সুনান: ১৮৪৭; হাদিসটি সহিহ)। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বিবাহবহির্ভূত হারাম সম্পর্কের ব্যাপারে আমরা অনেকে লোকদের সতর্ক করলেও এই হাদিসটির আলোকে সমাধানের কথা তেমন বলি না। অথচ এটি একটি বিশুদ্ধ ও যথার্থ সমাধানমূলক হাদিস। এক বাক্যে ব্রেকআপ করাকেই একমাত্র সমাধান হিসেবে প্রচার করি। এটি দুঃখজনক।
.
যে সকল নারী-পুরুষ বিবাহ বহির্ভূত তথাকথিত রিলেশনশিপে রয়েছে তাদের উচিত অনতিবিলম্বে হারাম রিলেশন থেকে ফিরে আসা, আল্লাহর দেওয়া সীমারেখা লঙ্ঘন না করা। অতঃপর হারাম কাজ থেকে
একনিষ্ঠ ভাবে তওবা করে নারীদের ক্ষেত্রে অভিবাবকের অনুমতি নিয়ে বিবাহ করা। কেননা অভিবাবকের অনুমতি ছাড়া নারীদের বিবাহ জায়েজ নয়। রাসূল (ﷺ) এরশাদ করেন, ‘অলী ছাড়া বিবাহ সিদ্ধ নয়।’ (আবু দাঊদ, মিশকাত হা/৩১৩০)। অপর বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘কোন নারী অলী ছাড়া বিবাহ করলে তা বাতিল, বাতিল, বাতিল।’ (আবু দাঊদ, হা/২০৮৫; তিরমিযী, হা/১১০১; ইবনু মাজাহ, হা/১৮৮০-১৮৮১; মিশকাত, হা/৩১৩০; সনদ সহীহ,সহীহুল জামে‘, হা/৭৫৫৫)। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম আরো বলেন, ‘কোন মহিলা অপর কোন মহিলাকে বিবাহ দিতে পারে না এবং নিজেকেও (ওলী ব্যতীত) বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করতে পারবে না।’ (ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/৩১৩৬;সহীহুল জামে‘ হা/৭২৯৮)।
.
সুতরাং, কোন নারী যদি তার অবিভাবকের অনুমতি ছাড়া পালিয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় তাহলে শরীয়তের দৃষ্টিতে তার বিবাহ বৈধ নয়। এভাবে বিবাহ করলে তা বাতিল বলে গণ্য হবে এবং তাদেরকে পুনরায় বৈধভাবে বিয়ে করতে হবে। বিবাহের পূর্ব পর্যন্ত বর-কনের একত্রে বসবাস অবৈধ ও ব্যভিচারের অন্তর্ভুক্ত হবে। সঠিক পন্থায় বিবাহ সম্পাদনের পর তাদের এই ঘৃণ্য অপকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর দরবারে খালেছ অন্তরে তওবা ও ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। বৈধ বিবাহের জন্য মেয়ে ও অলী উভয়ের সম্মতি এবং দুজন ন্যায়পরায়ণ ঈমানদার সাক্ষী আবশ্যক।ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, ‘দু’জন পুরুষ সাক্ষী এবং একজন ন্যায়নিষ্ঠ অলী ব্যতীত বিবাহ হয় না।’(সুনানুল বায়হাকী ৭/১১২, ইরওয়াউল গালীল হা/১৮৪৪)। জেনে রাখা ভাল,নারীদের ক্ষেত্রে অভিভাবকের (পিতা) অনুমতির পাশাপাশি নারীর অনুমতিও লাগবে। কেননা পিতা কিংবা অন্য কোন অভিভাবক সাবালিকা মেয়ের সম্মতি ব্যতীত জোরপূর্বক বিয়ে দিতে পারবে না। নবী করীম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, ‘বিধবাকে তার মতামত ব্যতীত বিয়ে দেয়া যাবে না এবং কুমারীকে তার অনুমতি ব্যতীত বিয়ে দেয়া যাবে না। লোকেরা জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)! তার অনুমতি কেমন করে নেয়া হবে। তিনি বললেন, তার চুপ থাকাটাই হচ্ছে তার অনুমতি।’(সহীহ বুখারী, হা/৫১৩৬, ৬৯৬৮, ৬৯৭০; সহীহ মুসলিম, হা/১৪১৯; আবু দাঊদ, হা/২০৯২)। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেন, ‘পূর্ব বিবাহিতা তার নিজের (বিবাহের) ব্যপারে তার অভিভাবকের তুলনায় অধিক কর্তৃত্বসম্পন্ন এবং কুমারী কন্যার নিজের ব্যাপারে পিতা তার সম্মতি নিবে। নীরবতাই তার সম্মতি। কখনও তিনি বলেছেন, তার নীরবতাই তার স্বীকৃতি।’ (সহীহ মুসলিম, হা/১৪২১; নাসাঈ, হা/৩২৬০-৩১৬১, ৩২৬৪)। খানসাআ বিনতু খিযাম আল-আনছারিয়্যাহ (রাযিয়াল্লাহু আনহা)-এর সূত্রে বর্ণিত। তার পিতা তাকে বিয়ে দেন তখন তিনি বিবাহিতা (সাবালিকা)। তিনি এ বিয়ে অপছন্দ করলেন। অতঃপর তিনি রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কাছে অভিযোগ করলে তিনি তার এ বিয়ে বাতিল করে দেন।’(সহীহ বুখারী, হা/৬৯৪৫, ৫১৩৮; আবু দাঊদ, হা/২১০১)।আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে ইসলামের সঠিক বুঝ দান করুন। আমীন!! (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
____________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Exit mobile version