Site icon Tawheed Media

নারীদের ইদ্দতের মধ্যে হজ্বে যাওয়া কি জায়েজ

প্রশ্ন: একজন মহিলার হজ্বে যাওয়ার মত আর্থিক সামর্থ্য রয়েছে। কিন্তু তার স্বামী মারা গেছে। তিনি ইদ্দতের মধ্যে হজ্বে যেতে চান। এটা কি তার জন্য জায়েজ?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: যে মহিলার স্বামী মারা গেছে, তাকে অবশ্যই চার মাস দশ দিন ইদ্দত পালন করতে হবে। তার জন্য এই অবস্থায় হজ্বে যাওয়া জায়েজ নয়। কারণ, আল্লাহ তাআলা বলেন; আর তোমাদের মধ্যে যারা স্ত্রী রেখে মারা যায়, তারা (স্ত্রীগণ) নিজেরা চার মাস দশ দিন অপেক্ষায় থাকবে। (সূরা বাক্বারা; আয়াত: ২৩৪)। ইদ্দতের সময় তাকে তার স্বামীর জন্য শোক করতে হবে। হানাফী,শাফাঈ ও হাম্বলী ফুকাহাদের অধিকাংশের অভিমত যে- স্বামীর মৃত্যুর পর ইদ্দত পালনকারী মহিলার জন্য হজ্বের জন্য বের হওয়া জায়েয নয়, কেননা পরবর্তীতে আবার হজ্বের সুযোগ আসবে। কিন্তু ইদ্দত একটি একক ঘটনা। এর কোন বিকল্প নেই। (আল-মাওসুআহ আল-ফিকহিয়্যাহ; ২৯/৩৫২)।
.
নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর স্ত্রী উম্মে হাবীবা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন; আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে মিম্বরের উপর (খুতবা দান কালে) এ কথা বলতে শুনেছি যে, ‘‘যে স্ত্রীলোক আল্লাহ ও কিয়ামতের প্রতি ঈমান রাখে, তার পক্ষে স্বামী ছাড়া অন্য কোন মৃত ব্যক্তির জন্য তিন দিনের বেশী শোক পালন করা জায়েয নয়। অবশ্য তার স্বামীর জন্য সে চার মাস দশদিন শোক পালন করবে…। (সহীহুল বুখারী হা/১২৮০, ১২৮১, ১২৮২, ৫৩৩৫, ৫৩৪৫, সহীহ মুসলিম হা/১৪৮৬, তিরমিযী হা/ ১১৯৫, ইবনু মাজাহ হা/২০৮৪)
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ, শাইখুল ইসলাম, ইমাম আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন; যে মহিলা তার স্বামীর মৃত্যুর পর ইদ্দত পালন করছে তার হজ্জ বা অন্য কোন উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হওয়ার অধিকার নেই। এটি উমর ও উসমান (রাঃ), সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব, আল-কাসিম, ইমাম মালিক, ইমাম শাফাঈ, আবু উবায়দ, আসহাব আল-রায়ি এবং ইমাম সুফিয়ান সাওরি (রাহিমাহুল্লাহ) -এর মত। যদি সে নারী স্বামীর সাথে বাইরে যায় এবং তার স্বামী রাস্তায় মারা যায় এবং সে যদি এখনও বাড়ির কাছাকাছি থাকে তবে তার বাড়িত ফিরে যাওয়া উচিত। কারণ, এমন অবস্থায় সে সফর করতে পারবেনা এমন হুকুমের অধীনে আছে। কিন্তু সে বাড়ি থেকে অনেক দূরে মুসাফির অবস্থায় থাকে তবে সে তার যাত্রা চালিয়ে যেতে পারে। ইমাম মালিক বলেন; যতদিন সে ইহরাম বাঁধেনি ততদিন তার ফিরে যাওয়া উচিত। বাড়ির কাছাকাছি থাকলে তাকে ফিরে যেতে হবে এই বিষয়টি সাঈদ ইবনুল মুসাইয়্যিব থেকে সাঈদ ইবনে মনসুর বর্ননা করেছেন। যিনি বলেছেন: কারো স্বামী মারা গেছে, যাদের স্ত্রীরা হজ্ব বা ওমরা পালন করছিল এবং উমর (রাঃ) তাদেরকে যুল-হুলায়ফা থেকে ফেরত পাঠালেন যাতে তারা তাদের ঘরে ইদ্দত পালন করতে পারে। এমনকি যদি কোনো মহিলা এখনও ফরজ হজ্ব না করে থাকে এবং তার স্বামী মারা যায়, তবে সে হজ্ব মিস করলেও তার গৃহে ইদ্দত পালন করা বাধ্যতামূলক। কেননা ‘ঘরে ইদ্দত একটি একক ঘটনা’ যার জন্য কোনো বিকল্প নেই, অথচ হজ্ব আরেক বছর করা যেতে পারে। (ইবনে কুদামাহ আল-মুগনী খন্ড:১১ পৃষ্ঠা: ৩০৩-৩০৫)।

শাইখ আল-ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮] কে এমন একজন মহিলা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে তার স্বামীর সাথে হজ্ব করার সংকল্প করেছিল, তারপর তার স্বামী শা’বান মাসে মারা যায়; তার জন্য কি হজ্ব করা জায়েজ? তিনি উত্তরে বলেন: চার ইমামের মত অনুসারে স্বামীর মৃত্যুর পর ইদ্দাতে তার হজ্বের সফর করা উচিত নয়। (মাজমূঊল ফাতাওয়া ইবনু তাইমিয়্যাহ খন্ড:৩৪ পৃষ্ঠা:২৯)
.
সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে একজন মহিলা যার স্বামী মারা গেছে এবং ফরয হজ্ব করার সুযোগ এসেছিল তখন সে যখনও শোকের মধ্যে ছিল, কিন্তু সে এর জন্য সক্ষম ছিল এবং সামর্থ্য ছিল এবং তার মাহরাম ছিল। তার হজ্ব করা উচিত কি না ?
.
তিনি জবাব দিলেন; তার হজ্ব করা উচিত নয়, বরং তার ঘরে থাকা উচিত। এমতাবস্থায় তার জন্য হজ্ব ফরজ নয়। কারণ আল্লাহ তাআলা বলেন, আর মানুষের মধ্যে যার সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে, আল্লাহর উদ্দেশ্যে ঐ ঘরের হজ্ব করা তার জন্য অবশ্য কর্তব্য। (সূরা আলে-ইমরান ৩:৯৭)। এই মহিলা মাহরাম থাকা সত্ত্বেও শরী‘আত অনুযায়ী তা করতে সক্ষম নয়, তাই তার সামর্থ্য অনুযায়ী এক বা দুই বছর দেরি করা উচিত। (উসাইমীন, মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল, খন্ড:২১ পৃষ্ঠা:৬৮)
.
পরিশেষে, প্রশ্নকারী বোনের উদ্দেশ্যে বলবো উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে, যে বাড়ীতে তার স্বামী মারা গেছে তার উচিত ইদ্দত শেষ হওয়া পর্যন্ত সে বাড়ীতে অবস্থান করা। ইদ্দত শেষ হবে চার মাস দশদিনে। তবে যদি গর্ভবতী হন তাহলে সন্তান প্রসব করার মাধ্যমে তার ইদ্দত শেষ হবে। যেমনটি আল্লাহ্‌ তাআলা বলেছেন; “আর গর্ভধারিনীদের ইদ্দতকাল সন্তান প্রসব পর্যন্ত।” (সূরা ত্বালাক, আয়াত: ৪)। কোন প্রয়োজন কিংবা জরুরী অবস্থা ব্যতীত ঘর থেকে বের হবেন না। যেমন:
.
(১). অসুস্থ হলে হাসপাতালে যাওয়া, প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য ও এ জাতীয় অন্য কিছু কেনার জন্য কাউকে না পেলে বাজারে যাওয়া, অনুরূপভাবে ঘরটি যদি ধ্বসে পড়ে তাহলে তিনি এ ঘর ছেড়ে অন্য ঘরে চলে যাবেন, কিংবা তাকে সঙ্গ দেয়ার মত যদি কেউ না থাকে এবং তিনি নিজের উপর আশংকা করেন এ রকম প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে আপত্তি নেই।
.
(২). তিনি সুন্দর কাপড়-চোপড় পরবেন না; সেটা হলুদ হোক বা সবুজ হোক বা অন্য কোন রঙের হোক। বরং অসুন্দর কাপড়-চোপড় পরবেন; সেটা কালো বা সবুজ হোক বা অন্য কোন রঙের হোক। মোটকথা হলো, অসুন্দর কাপড় হওয়া। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এভাবেই নির্দেশ দিয়েছেন।
.
(৩). স্বর্ণ, রৌপ্য, ডায়মন্ড, মুক্তা কিংবা এসব ধাতুর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ অন্য কোন ধাতু দিয়ে তৈরী অলংকার পরবেন না; সেটা গলার হার হোক, হাতের চুড়ি হোক, আংটি হোক কিংবা এ ধরণের অন্য কোন অলংকার হোক না কেন; ইদ্দত শেষ হওয়া পর্যন্ত পরবেন না।
.
(৪). সুগন্ধি পরিহার করবেন। সেটা ধূপধুনার মাধ্যমে সুগন্ধি গ্রহণ হোক কিংবা অন্য কোন সুগন্ধি হোক না কেন। তবে, হায়েয থেকে পবিত্র হলে কিছু ধূপ দিয়ে ধূপধুনা করতে কোন অসুবিধা নেই।
.
(৫). সুরমা লাগানো বর্জন করবেন। তিনি সুরমা লাগাবেন না এবং সুরমার মত অন্য যা কিছু চেহারার রূপ চর্চায় ব্যবহৃত হয় সেগুলোও ব্যবহার করবেন না। অর্থাৎ যে বিশেষ রূপচর্চা দ্বারা মানুষ আকৃষ্ট হয় সেটা বর্জন করবেন। পক্ষান্তরে, সাবান ও পানি দিয়ে সাধারণ রূপচর্চা করতে কোন বাধা নেই। কিন্তু, সুরমা যা দিয়ে চক্ষুদ্বয়কে সুন্দর করা হয় কিংবা সুরমার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ অন্য যে সকল জিনিস নারীরা চেহারাতে ব্যবহার করে থাকে; সেগুলো ব্যবহার করবেন না। যে নারীর স্বামী মারা গেছে তার এই পাঁচটি বিষয় মেনে চলতে হবে।
.
পক্ষান্তরে, সাধারণ মানুষ যেসব ধারণা করে থাকে কিংবা বানিয়ে বানিয়ে বলে থাকে, যেমন- কারো সাথে কথা বলতে পারবে না, টেলিফোনে কথা বলতে পারবে না, সপ্তাহে একবারের বেশি গোসল করতে পারবে না, খালি পায়ে ঘরে হাঁটতে পারবে না, চাঁদের আলোতে বের হতে পারবে না ইত্যাদি এগুলো কুসংস্কার; এগুলোর কোন ভিত্তি নেই। বরং তিনি খালি পায়ে ও জুতা পায়ে নিজ ঘরে হাঁটতে পারবেন। নিজের প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারবেন। নিজের জন্য ও মেহমানের জন্য খাদ্য রান্না করতে পারবেন। বাড়ীর ছাদে কিংবা বাগানে চাঁদের আলোতে হাঁটতে পারবেন। যখন ইচ্ছা তখন গোসল করতে পারবেন। সন্দেহের উদ্রেক সৃষ্টি করে না এমন কথাবার্তা যে কারো সাথে বলতে পারবেন। নারীদের সাথে ও মাহরামদের সাথে মোসাফাহা করতে পারবেন; গায়রে মাহরামদের সাথে নয়। তার কাছে মাহরাম ছাড়া অপর কেউ না থাকলে মাথার ওড়না খুলে রাখতে পারবেন। মেহেদি, জাফরান ও সুগন্ধি ব্যবহার করবেন না। পোশাকাদিতেও না, কফিতেও না। কেননা জাফরান এক ধরণের সুগন্ধি। বিয়ের প্রস্তাব দিবেন না; তবে ইঙ্গিত দিতে অসুবিধা নাই। কিন্তু, স্পষ্ট বিয়ের প্রস্তাব দিবেন না। আল্লাহ্‌ই তাওফিকদাতা। (শাইখ বিন বায ফাতাওয়া ইসলামিয়্যা খণ্ড-৩,পৃষ্ঠা-৩১৫-৩১৬)(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Exit mobile version