Site icon Tawheed Media

টিকটিকি নাকি গিরগিটি

প্রশ্ন: রাসূল (ﷺ) টিকটিকি নাকি গিরগিটি কোনটি হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন? রাসূল (ﷺ) কেন এটি হত্যা করতে বলেছেন?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬
উত্তর: “টিকটিকি হত্যা করতে হবে নাকি গিরগিটি হত্যা করতে হবে” এই সংশয় মূলত হাদীসের ভুল অনুবাদের কারণে তৈরি হয়েছে। কেননা কয়েকটি হাদীসের অনুবাদে টিকটিকি না করে গিরগিটি করা হয়েছে। অথচ বিশুদ্ধ অনুবাদ হবে টিকটিকি। কারণ টিকটিকি মারার ফযীলত সংক্রান্ত যে সকল হাদীস রয়েছে সবগুলো হাদীসেই (الوزغ) আল ওয়াজাগ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। যার অর্থ টিকটিকি। শব্দটির বহুবচন হলো أَوْزَاغٌ وَوِزْغَانٌ। আল-ওয়াযাগ (اَلْوَزَغُ) শব্দের উর্দু অনুবাদ সিপকলী, বাংলা অর্থ টিকটিকি। (ফ‘রহঙ্গ-ই-রববানী,পৃষ্ঠা: ২৬০ মিসবাহুল লুগাত (আরবী-উর্দূ অভিধান), পৃঃ ৯৪৩; আল-মুনজিদ (আরবী-উর্দূ) পৃষ্ঠা: ১০৮২)।
.
অপরদিকে আরবি ‘আল-হিরবাউ’ (اَلْحِرْبَاءُ )-এর উর্দূ অর্থ গিরগিটি। যার বাংলা গিরগিটি বা কাকলাস ব্যবহৃত হয়। আর গিরগিটি মারার নির্দেশ হাদীসে নেই।) (মিসবাহুল লুগাত পৃষ্ঠা: ১৪৪; আল-মুনজিদ পৃষ্ঠা: ১৯৮, ফরহঙ্গ-এ-জাদীদ,পৃষ্ঠা: ৬৯১; ফ‘রহঙ্গ-ই -রববানী, পৃষ্ঠা: ৫০৭-৮)। তাছাড়া টিকটিকি এবং গিরগিটির মধ্যে একটি পার্থক্য হলো; গিরগিটি মুহূর্তের মধ্যে গায়ের রং পরিবর্তন করতে পারে, কিন্তু টিকটিকি তা পারে না। ফলে গিরগিটির গায়ের পরিবর্তিত রং দেখেই আমাদের দেশের লোকজন এটি মারতে বেশী উদ্যত হয়। (বিস্তারিত দেখুন; আল-ক্বামূস; আল-মু‘জামুল ওয়াসীত্ব পৃঃ ১০২৯; আরবী-বাংলা অভিধান, ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ৩/২৫৫৪)
.
ফাক্বিহ ইবনুল মুগীরার মুক্তদাসী সাইবাহ (মাকবূলাহ) থেকে বর্ণিত; তিনি আয়িশাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহা)-এর নিকট প্রবেশ করে তার ঘরে একটি বর্শা রক্ষিত দেখতে পান। তিনি জিজ্ঞেস করেন, হে উম্মুল মুমিনীন! আপনারা এটা দিয়ে কী করেন? তিনি বলেন, نَقْتُلُ بِهِ هَذِهِ الأَوْزَاغَ আমরা এই বর্শা দিয়ে টিকটিকিগুলোকে হত্যা করি। (ইবনু মাজাহ, হা/৩২৩১; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৪৫৭৮; সিলসিলা সহীহাহ, হা/১৫৮১, তালীকুর রাগীব ৪/৩৭ সনদ সহীহ)। সুতরাং, এই হাদীস থেকেও বুঝা যাচ্ছে, এটি ঘরে থাকা টিকটিকি। গাছ-গাছালি বা বন-জঙ্গলে থাকা গিরগিটি, কাঁকলাস নয়‌।
.
অপর বর্ননায় সাদ ইবনু আবু ওয়াক্কাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম টিকটিকি মেরে ফেলার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন এবং তাকে ক্ষুদ্র ফাসিক বলে অভিহিত করেছেন। (সহীহ মুসলিম হা/৫৯৮১, সহীহ ইবনু হিব্বান হা/৫৬৩৫, আবু দাঊদ হা/৫২৬২, মুসনাদে আহমাদ হা/১৫২৩)। আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; যে ব্যক্তি টিকটিকিকে প্রথম আঘাতে বধ করবে, তার জন্য (আমলনামায়) একশত নেকি লিখা হবে। আর দ্বিতীয় আঘাতে মারলে (তার জন্য) তার চাইতে কম এবং তৃতীয় আঘাতে মারলে (তার জন্য) তা অপেক্ষা কম লিখা হবে। (সহীহ মুসলিম হা/৫৯৮৪, ইবনু মাজাহ হা/৩২২৯, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত তারহীব হা/ ২৯৭৮, সহীহুল জামি‘ হা/৬৪৬০)
.
আল-মুল্লা আলী ক্বারী হানাফি (রহিমাহুল্লাহ)
এই হাদিসটির মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন- আল্লাহর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) ওয়াজাগ অর্থাৎ টিকটিকি হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন। এটি একটি ছোট এবং ক্ষতিকারক প্রাণী। (মিরকাত আল-মাফাতিহ (৭/২৬৭১ ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-২৮৯০৫৫)। শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন, উলামাগণ এ মর্মে একমত যে- গিরগিটি ক্ষতিকারক প্রাণীর অন্তর্ভুক্ত। وَزَغِ শব্দটির বহুবচন হলো أَوْزَاغٌ وَوِزْغَانٌ ইত্যাদি। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ প্রাণীর হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছেন এবং হত্যার প্রতি উৎসাহ প্রদান করেছেন। কারণ তা মারাত্মক ক্ষতিকারক প্রাণী। (শারহুন নাবাবী ১৪শ খন্ড, হাঃ ২২৩৭/১৪২)
.
আল্লামা ইয্যুদ্দীন (রহিমাহুল্লাহ) বলেন; প্রথম প্রহারে গিরগিটি হত্যার সাওয়াবের আধিক্যের কারণ হলো, হতে পারে প্রথম প্রহারে মারলে প্রাণীর প্রতি ইহসান করা হয়, বিধায় সাওয়াব বেশি। কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; আল্লাহ তা‘আলা প্রত্যেক বস্তুর প্রতি ইহসান ফরয করেছেন, কাজেই যখন তোমরা হত্যা করবে তখন উত্তমরূপে হত্যা করবে। অথবা ভালো কাজ দ্রুত সমাধার জন্যও সাওয়াব বেশি হতে পারে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, وَسَارِعُوا إِلٰى مَغْفِرَةٍ مِّنْ رَبِّكُمْ ‘‘তোমরা কল্যাণে অগ্রগামী হও’’- (সূরাহ্ আ-লি ইমরান; ৩/১৩৩)। আর এ উভয় কারণই সাপ কিংবা বিচ্ছুর ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারযোগ্য। কারণ উভয় প্রাণীর মধ্যে বিপর্যয়ের আধিক্য রয়েছে। (আওনুল মা‘বূদ ৮ম খন্ড, হাঃ ৫২৫৪)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.]-কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ‘ওয়াজাগ’ [এক প্রকার টিকটিকি] হত্যা করার জন্য উৎসাহিত করেছেন এবং বলেছেন যে “যে ব্যক্তি প্রথম আঘাতে একে মেরে ফেলবে তার আমলনামায় একশত নেকি লিখা হবে।ওয়াজঘর হত্যার হুকুম কি এবং ব্যাঙ হত্যার হুকুম কি?

শাইখ উত্তরে বলেন, ওয়াযযাকে হত্যা করা সুন্নত এবং এতে রয়েছে বিরাট সওয়াব। রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ ইবরাহীম (আঃ)-কে আগুনে নিক্ষেপ করা হলে এটি অর্থাৎ টিকটিকি আগুনে ফুঁ দিত। তদুপরি, এটি ক্ষতিকারক এবং এর কণ্ঠস্বর কুশ্রী ও অপ্রীতিকর। ব্যাঙের ব্যাপারে,বিশুদ্ধ কথা হল তাদের হত্যা করা যাবে না,যদি না তারা ক্ষতিকর হয়; যদি তারা ক্ষতিকারক হয়, তবে তাদের হত্যা করায় কোন দোষ নেই, কারণ ক্ষতিকারক সবকিছুই হত্যা করা যেতে পারে, যেমন ফুকাহারা বলেছেন, প্রতিটি ক্ষতিকারক প্রাণীকে হত্যা করা সুন্নাতে নির্দেশিত।(উসাইমীন, ফাতাওয়া নূরুন ‘আলাদ দারব,ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-২৫৮৯৮৮)
.
▪️রাসূল (ﷺ) কেন এটি হত্যা করতে বলেছেন?
.
মুমিনের জন্য মহান আল্লাহর হুকুম এবং তাঁর রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর আদেশ পালন করা ওয়াজিব, যদিও তা তার ইচ্ছা ও পছন্দের বিরুদ্ধে যায়। তাছাড়া আল্লাহর প্রতি ঈমানের দাবী হচ্ছে- তাঁর বিধিবিধান ও শরীয়তকে মেনে নেওয়া। কারণ, আল্লাহ তাআলা ভালো জানেন কোনটি মানুষের জন্য কল্যাণকর। তাছাড়া সবার জানা উচিত যে, ইসলামী শরীআতের কোন বিধানের কারণ তালাশ করা অন্যায়। বরং নির্বিবাদে মেনে নেওয়ার মধ্যেই বান্দার কল্যাণ নিহিত রয়েছে, মুমিন তো তারাই যারা বলে আমরা শুনেছি ও মেনে নিয়েছি। (সূরা বাকারা; ২/২৮৫)
.
🔸টিকটিকি হত্যার অন্যতম কয়েকটি কারণের মধ্যে কয়েকটি হলো:
.
(১). টিকটিকি হত্যা করতে রাসূল (ﷺ) নির্দেশ
দিয়েছেন। সাদ ইবনু আবু ওয়াক্কাস (রাঃ) হতে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম টিকটিকি মেরে ফেলার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন এবং তাকে ক্ষুদ্র ফাসিক বলে অভিহিত করেছেন। (সহীহ মুসলিম হা/৫৯৮১, সহীহ ইবনু হিব্বান হা/৫৬৩৫, আবু দাঊদ হা/৫২৬২, মুসনাদে আহমাদ হা/১৫২৩)
.
(২). দ্বিতীয়ত কারন হলো: আল্লাহর খলিল নবী ইব্রাহীম (আঃ)-কে সেই সময়ের নমরুদ অন্যায় ভাবে আগুনে নিক্ষেপ করলে তখন সেই আগুনকে প্রজ্বলিত করার জন্য এই টিকটিকি ইব্রাহিম (আঃ)-এর বিরুদ্ধে আগুনে ফুঁক দিয়েছিল। (সহীহ বুখারী হা/৩৩৫৯, মিশকাত হা/৪১১৯)। অন্য বর্ণনায় রয়েছে যখন সকল প্রাণী আগুন নিভানোর চেষ্টায় লিপ্ত ছিল, তখন টিকটিকি তাতে ফুঁক দিয়েছিল। (আগুন আরও প্রজ্বলিত করার জন্য)। (ইবনু মাজাহ হা/৩২৩১; সিলসিলা সহীহাহ হা/১৫৮১)।
.
(৩). তৃতীয়ত কারন হলো: টিকটিকি ক্ষতিকর প্রাণী।টিকটিকির লেজের মধ্যে ক্ষতিকর মাদকতা রয়েছে।ইবনুল মালেক (রহিমাহুল্লাহ) বলেন, টিকটিকি একটি কষ্টদানকারী ও বিষাক্ত প্রাণী। শয়তান একে ইব্রাহীমের অগ্নিকুন্ডে ফুঁক দেওয়া ছাড়াও অন্যান্য পাপের কাজে ব্যবহার করে থাকে। (মিরক্বাত হা/৪১১৯-এর ব্যাখ্যা ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-২৮৯০৫৫)

(৪). চতুর্থ কারন হলো: টিকটিকি মারতে পারলে নেকি রয়েছে, মহান আল্লাহ মানুষকে নেকির কাজে প্রতিযোগিতা করতে বলেছেন।(সূরা মায়েদাহ৫/৪৮) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন; যে ব্যক্তি টিকটিকি কে প্রথম আঘাতে বধ করবে, তার জন্য (আমলনামায়) একশত নেকি লিখা হবে। আর দ্বিতীয় আঘাতে মারলে (তার জন্য) তার চাইতে কম এবং তৃতীয় আঘাতে মারলে (তার জন্য) তা অপেক্ষা কম লিখা হবে। (সহীহ মুসলিম হা/৫৯৮৪, ইবনু মাজাহ হা/৩২২৯, সহীহ আত্ তারগীব ওয়াত তারহীব হা/ ২৯৭৮, সহীহুল জামি‘ হা/৬৪৬০)

(৫). পঞ্চম ও সর্বশেষ কথা হল, টিকটিকি হত্যা করা এটি ইসলামের নির্দেশ। সবার জানা উচিত যে, ইসলামী শরীআতের কোন বিধানের কারণ তালাশ করা অন্যায়। বরং নির্বিবাদে মেনে নেওয়ার মধ্যেই বান্দার কল্যাণ নিহিত রয়েছে, মুমিন তো তারাই যারা বলে আমরা শুনেছি ও মেনে নিয়েছি। (সূরা বাকারা; ২/২৮৫)। সুতরাং প্রত্যেক মুমিনকে এটা বিশ্বাস করতে হবে যে, আল্লাহ তাআলার প্রত্যেকটি কাজে বিরাট হিকমত এবং প্রশংসনীয় উদ্দেশ্য রয়েছে। আর প্রত্যেক মানুষের জন্য তা স্পষ্ট হওয়া জরূরী নয়। এটি এক প্রকার পরীক্ষা। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘যাতে তিনি তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে পারেন যে, কে তোমাদের মধ্যে আমলের দিক থেকে উত্তম।’(সূরা মূলক; ৬৭/২)। সুতরাং সর্ববস্থায় আল্লাহর বিধানকে বিনা প্রশ্নে মানার মধ্যে রয়েছে মানবজাতির কল্যাণ।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_______________________
উপস্থাপনায়,
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Exit mobile version