Site icon Tawheed Media

জুমআর দিনে বা রাতে মৃত্যুবরণকারী কবরের ফিতনা থেকে সুরক্ষিত থাকবে মর্মে হাদীসটি কি সহীহ

জুম‘আর দিন সারা পৃথিবীতর মুসলিমদের সাপ্তাহিক ঈদ। এটি সপ্তাহের শ্রেষ্ঠ দিন। এই দিনটির তাৎপর্য অত্যাধিক কেননা এ দিনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের সমাধান করা হয়েছে। এ দিনে আদম (আঃ)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে। এ দিনে তাঁকে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয়েছে এবং এ দিনেই তাঁকে জান্নাত থেকে বের করে (দুনিয়ায় পাঠিয়ে) দেয়া হয়েছে। আর ক্বিয়ামতও সংঘটিত হবে জুম‘আর দিনেই। এই দিনটি সম্পর্কে রাসূল ﷺ বলেন, তোমাদের দিনগুলির মধ্যে সর্বোত্তম দিন হচ্ছে জুম‘আর দিন। সুতরাং ঐ দিন তোমরা আমার উপর অধিক মাত্রায় দরূদ পড়। কেননা তোমাদের দরূদ আমার কাছে পেশ করা হয়।(আবূদাউদ হা/১০৪৭; নাসাঈ হা/১৩৭৪; সহীহুত তারগীব হা/১৬৭৪ হাদীসটি বিশুদ্ধ) সুতরাং জুম’আর দিন গুরুত্বপূর্ণ হলেও জুম’আর রাতে বা দিনে মৃত্যুবরণ করার বিশেষ ফজিলত সম্পর্কে যে হাদীসটি বর্নিত হয়েছে সেটি সহীহ-জয়ীফ নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে। হাদীসটি বর্ননা করেছেন রাসূল ﷺ এর প্রখ্যাত সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) তিনি বলেন,রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

مَا مِنْ مُسْلِمٍ يَمُوتُ يَوْمَ الْجُمُعَةِ أَوْ لَيْلَةَ الْجُمُعَةِ إِلَّا وَقَاهُ اللَّهُ فِتْنَةَ الْقَبْرِ

“যদি কোন মুসলিম জুমু‘আর দিন অথবা জুমু‘আর রাতে মৃত্যুবরণ করে, তাহলে আল্লাহ তা‘আলা তাকে কবরের ফিতনা থেকে রক্ষা করবেন”।(মুসনাদে আহমাদ হা/৬৫৪৬, জামে তিরমিযি হা/১০৭৪, মিশকাত হা/১৩৬৭) কাছাকাছি শব্দে হাদীসটি আরো কয়েকটি সূত্রে বর্ণিত হয়েছে,
.
তাহক্বীক: হাদীসটি সহীহ-জয়ীফ নিয়ে মতানৈক্য রয়েছে।

(১).হাদীসটি সুনানে তিরমিজির প্রণেতা ইমাম আবু ঈসা মুহাম্মাদ ইবনু ঈসা ইবনু সাওরা ইবনু মূসা ইবনু যাহহাক আস-সুলামী আল-বুগী আত-তিরমিযী (রাহিমাহুল্লাহ) তার কিতাবে বর্ননা করে বলেন,

هَذَا حَدِيثٌ غَرِيبٌ وَلَيْسَ إِسْنَادُهُ بِمُتَّصِلٍ ‏.‏ رَبِيعَةُ بْنُ سَيْفٍ إِنَّمَا يَرْوِي عَنْ أَبِي عَبْدِ الرَّحْمَنِ الْحُبُلِيِّ عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو وَلاَ نَعْرِفُ لِرَبِيعَةَ بْنِ سَيْفٍ سَمَاعًا مِنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو ‏.‏

“এ হাদীসটি গরীব। এর সানাদ মুত্তাসিল অর্থাৎ পরস্পর সংযুক্ত নয়। কেননা আবদুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ)-এর নিকট হতে রাবীআ ইবনু সাইফ সরাসরি কোন হাদীস শুনেছেন বলে আমাদের জানা নেই। মূলতঃ তিনি আবদুর রাহমান আল-হুবুল্লীর সূত্রে আব্দুল্লাহ ইবনু আমর হতে হাদীস বর্ণনা করেন”। (তিরমিজি হা/১০৭৪; এর টীকা দ্রষ্টব্য:)
.
(২).হাদীসটি বিভিন্ন সূত্রে বর্ণিত হওয়ার কারণে সবগুলো বর্ণনা পর্যালোচনা করে বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী আদ-দিমাশক্বী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন,হাদিসটি সহীহ লি গাইরিহ বা হাসান স্তরের।(আলবানী সহীহুল জামে‘ হা/৫৭৭৩,, সহীহ আত তারগীব হা/ ৩৫৬২)
.
(৩).মুসনাদে আহমদের ভাষ্যকার শাইখ শু‘আইব আরনাঊত্ব এবং শাইখ হুসাইন সালীম আসাদ হাদীসটি যঈফ সাব্যস্ত করেছেন।(তাহকীক:মুসনাদে আহমাদ হা/৬৫৮২; তাহকীক মুসনাদে আবু ইয়া‘লা হা/৪১১৩)।
.
(৪).শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ,হাফিজ ইবনু হাজার আসকালানী (রাহিমাহুল্লাহ) [জন্ম: ৭৭৩ হি: মৃত: ৮৫২ হি:] ও এবিষয়ে বর্ণিত সকল হাদীস সমূহকে যঈফ বলেছেন।(ফাতহুল বারী ফী শারহিল বুখারী, খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ২৫৩
.
(৫).বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম ইমাম আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, জুম’আর দিন বা রাতে মৃত্যুর ফজিলত সংক্রান্ত যতগুলো বর্ণনা রয়েছে সবগুলোই দুর্বল অর্থাৎ জয়ীফ। (বিন বায অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ফাতওয়া নং-৯১৯১)
.
(৬).বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ)-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে ব্যক্তি জুমার দিনের মৃত্যুবরণ করবে তার নাকি শেষটা ভাল হয় একথা কতটুকু সঠিক? জবাবে শাইখ বলেন, না এমন কোন কথা নেই,বরং মুসলিম যেকোন দিনে মৃত্যুবরন সবই সমান,কারণ রাসূল ﷺ সোমবার দিন মৃত্যুবরন করেছেন।তারপর শাইখ বলেন এ সংক্রান্ত (জুম’আর দিন মৃত্যুবরনের ফজিলত সংক্রান্ত) হাদিসগুলো সহীহ নয়।(দেখুন https://youtu.be/D92cwWTot2E?si=6ysApXTsH4XaLY7R
.
(৭).সৌদি আরবের সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের প্রবীণ সদস্য, যুগশ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম সালিহ বিন ফাওযান আল-ফাওযান (হাফিযাহুল্লাহ)-কে হাদীসটি সঠিক কিনা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, জুম’আর দিন অবশ্যই ফজিলতপূর্ণ তাতে মুসলিমদের উচিত দু’আ খাইর করা, কিন্তু জুমআ’র দিনে বা রাতে মৃত্যুবরণকারী কবরের ফিতনা থেকে সুরক্ষিত থাকবে; এ হাদিসটি সম্পর্কে আমার জানা নেই ! অর্থাৎ হাদিসটি বিশুদ্ধ নয়; শাইখ এটিই বুঝাতে চেয়েছেন।(দেখুন https://youtu.be/dQ9mVJccBO4?si=fnfnMvPjREbhyCtR
.
পরিশেষে, প্রিয় পাঠক! উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে, অধিক বিশুদ্ধ কথা হচ্ছে- হাদীসটি বিশুদ্ধ সনদে প্রমাণিত নয়। অর্থাৎ হাদীসটির সনদ জয়ীফ। তাছাড়া রাসূল (ﷺ)-এর কোন সাহাবী শুক্রবারে মৃত্যুর জন্য আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছেন বলেও কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং প্রখ্যাত সাহাবী আবু বকর (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) রাসূল (ﷺ)-এর মৃত্যুর দিন তথা সোমবারে মৃত্যুর জন্য আকাঙ্ক্ষা করেছেন।(সহীহ বুখারী হা/১৩৮৭)। মোদ্দাকথা কবরের আযাব এটি গায়েবি বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত,আর এরূপ গায়েবের বিষয় কুরআন-সুন্নাহর সহীহ দলিল ছাড়া কোন জয়ীফ বা ত্রুটিপূর্ণ দলীল দ্বারা সাব্যস্ত হয়না। অপরদিকে হাদীসটির সনদ হাসান ধরা হলেও এর অর্থ এই নয় যে, জু’মআর দিন বা রাতে কোন মুশরিক, মুনাফিক,কিংবা ইচ্ছাকৃত ফরজ সালাত পরিত্যাগকারী মৃত্যুবরণ করলেও উক্ত ফজিলত পাবে কিংবা স্থায়ীভাবে কবরের আযাব হতে মুক্তি পাবে। বরং যাদের ঈমান আক্বীদা বিশুদ্ধ হবে এবং আমলে সলেহ তথ বিশুদ্ধ নেক আমলরত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে; তারা জুম’আর দিন বা অন্য যেকোন দিন মৃত্যুবরণ করলেও ইনশাআল্লাহ আশা করা যায় এই মৃত্যু তাদের জন্য কল্যাণকর হবে।যেমন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ বলল এবং এ অবস্থায় তার মৃত্যু হলো সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। যে ব্যক্তি কোন একটি সাদাকাহ করল এবং এ অবস্থায় তার মৃত্যু হলো সেও জান্নাতে প্রবেশ করবে।”(মুসনাদে আহমাদ হা/২২৮১৩ সনদ বিশুদ্ধ)।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
_________________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Exit mobile version