Site icon Tawheed Media

কোন বিদআতীর সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন সম্পর্কে ইসলাম কি বলে

ভূমিকা: মহান আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করার সাথে সাথে তার জীবন ধারণের জন্য কিছু চাহিদা দিয়েছেন এবং চাহিদা মিটানোর পদ্ধতিও বলে দিয়েছেন। মানব জীবনে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার ন্যায় জৈবিক চাহিদাও গুরুত্বপূর্ণ। এই চাহিদা পূরণের জন্য ইসলাম বিবাহের বিধান দিয়েছে। নারী-পুরুষের মাঝে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য বিবাহ হচ্ছে একমাত্র বৈধ, বিধিবদ্ধ, সর্বজনীন এবং পবিত্র ব্যবস্থা। ঈমানদার নারী-পুরুষের মাঝে বৈবাহিক সম্পর্ক হয় স্থায়ী এবং দাম্পত্য জীবন হয় সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের।এখন প্রশ্ন অনুযায়ী শরীয়তী বিধান হল, বিদ‘আতীদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টির দু’টি অবস্থা হতে পারে। যথা: (ক) বিদ‘আত কুফরী কিংবা শিরকী পর্যায়ের হওয়া এবং (খ) বিদ‘আত কুফরী কিংবা শিরকী পর্যায়ের না হওয়া। নিম্নে বিস্তারিত আলোচনা উপস্থাপন করা হল:
.
(ক) বিদ‘আত কুফরী কিংবা শিরকী পর্যায়ের হওয়া: কোন ব্যক্তির বিদ‘আত যদি সুস্পষ্ট কুফরী হয় অর্থাৎ কেউ যদি কুরআনকে মাখলূক্ব বা সৃষ্ট বলে,আল্লাহর গুণাবলীকে অস্বীকার করে, আল্লাহ ব্যতীত অন্যের নিকট দু‘আ-প্রার্থনা করে, নবী বা অলিরা অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে সব কিছু জানেন বিশ্বাস করে, খুলাফায়ে রাশিদ্বীনের অর্থাৎ সাহাবীদেরকে গালাগালি করে (যেমন শী’আরা করে থাকে), তারপর মৃত অলীদের উদ্দেশ্যে কুরবানী করে, মানত করে, কবর-মাযার-খানকা পূজা করে ইত্যাদি বিভিন্ন বিদ‘আতে বিশ্বাসী হয়,যা তাকে দ্বীন থেকে বহিষ্কার করে দেয়, তাহলে সাধারণত এমন ব্যক্তিদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করা হারাম। সুতরাং এমন আক্বীদা পোষণকারী নারীদের সাথে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদা পোষণকারী পুরুষের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করা বৈধ নয়। ঠিক অনুরূপভাবে আহলে সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদা পোষণকারী কোন নারীকে বিদ‘আতী আক্বীদা পোষণকারী কোন পুরুষের সাথে বিবাহ প্রদান করাও বৈধ নয়। ইসলাম আহলে কিতাব ব্যতীত কাফির ও মুশরিকদের সাথে মুসলিমগণের উপর যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করা হারাম ঘোষণা করেছে এ ক্ষেত্রে সেই দলীলগুলো সাব্যস্ত হবে। (বিস্তারিত দেখুন, মাওক্বিফু আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আতি মিন আহলিল হাওয়া ওয়াল বিদাঈ, ১ম খণ্ড, পৃ. ৩৭৩)
.
(খ) বিদ‘আত কুফরী কিংবা শিরকী পর্যায়ের না হওয়া:
কারো বিদ‘আত যদি কুফরী কিংবা শিরকী পর্যায়ের না হয়,তাহলে তার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া যাবে এবং যথাসম্ভব পরবর্তীতে তাকে সংশোধনেরে চেষ্টা করতে হবে। যেমন- কোন ব্যক্তি ফরজ সালাতের পরে সম্মিলিত মুনাজাত, মুখে উচ্চারণ করে নিয়ত বলা, মৃত ব্যক্তির উদ্দেশ্যে কুরআন খতম বা খানার আয়োজন করে, ঈদে মীলাদুন্নবি উদযাপন করা, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে নূরের সৃষ্টি মনে করে, রাসূল (ﷺ) এর নাম শুনে আঙ্গুলে চুমু খাওয়া ইত্যাদি। এগুলো কুফুরী পর্যায়ের বিদআত নয়। শরীয়ত সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান না থাকা, অজ্ঞতা, কুরআন-হাদিসের ভুল ব্যাখ্যার শিকার ইত্যাদি কারণে অনেক মানুষ ধরণের বিদআতি কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকে।তাই এ ধরনের পাত্র-পাত্রীর সাথে বিবাহের বিষয়টি (الكفاءة في الزواج) ‘বিবাহে কুফু বা সমতা’-এর মাসয়ালার সাথে সম্পর্কিত।যদিও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিয়েতে বংশীয় কুফুর গুরুত্ব সম্পর্কে মতবিরোধ রয়েছে। যেমন অধিকাংশ আলেম বংশকে কুফুর অন্তর্ভুক্ত গণ্য করেছেন। তবে অন্যদল বিরোধিতা করে বলেছেন যে, দ্বীনি কুফু ছাড়া কোন কুফু নেই। এই মতের অনুসারীগণ হলেন উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু), ইবনু মাসঊদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুমা), মুহাম্মাদ ইবনু সীরীন, উমার ইবনু আব্দুল আযীয, ইমাম মালিক, ইমাম আহমাদ, শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ ও ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুমুল্লাহ) প্রমুখ। (শায়খ মুহাম্মাদ সালিহ আল-মুনাজ্জিদ, ফাতাওয়া সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৬৫৫১০)
.
সুখী, সুন্দর ও মধুর দাম্পত্য জীবনের জন্য পাত্র-পাত্রীর মাঝে কিছু বিষয়ে সমতা থাকা জরুরি।কেননা সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের দু’জনের মাঝে দাম্পত্য সম্পর্ক কিছুতেই মধুর হতে পারে না। যেমন একজন নেককার অন্যজন বদকার, একজন মুত্তাকী পরহেযগার, অন্যজন দুর্বৃত্ত ব্যভিচারী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,ব্যভিচারী পুরুষ কেবল ব্যভিচারিণী অথবা মুশরিক রমণীকেই বিবাহ করবে এবং ব্যভিচারিণী নারীকে বিয়ে করবে কেবল ব্যভিচারী পুরুষ কিংবা মুশরিক পুরুষ। মুমিনদের পক্ষ এদের বিবাহ করা বৈধ নয়।’(সূরা আন-নূর: ৩)। উক্ত আয়াতে স্পষ্ট হলো যে, ব্যভিচারী নর-নারী নেককার নরনারীর জন্য ‘কুফু’ নয়। কেননা কাজে-কর্মে, স্বভাবে-চরিত্রে তাদের মাঝে বিস্তর পার্থক্য। এত ব্যবধান নিয়ে পরস্পর মহব্বত, প্রীতি-সম্প্রীতি তৈরি হওয়া অসম্ভব ব্যাপার। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন, اَفَمَنۡ کَانَ مُؤۡمِنًا کَمَنۡ کَانَ فَاسِقًا ؕؔ لَا یَسۡتَوٗنَ ‘ঈমানদার ব্যক্তি কি নাফরমান ব্যক্তির মত? তারা কখনো সমান নয়।’(সূরা আস-সাজদাহ: ১৮)।
.
ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [৬৩১-৬৭৬ হি.] কুফু সম্পর্কে বলেন, وَعِفَّةٌ فَلَيْسَ فَاسِقٌ كُفْءَ عَفِيْفَةٍ ‘চারিত্রিক নিষ্কলুষতার সাথে নাফরমানীর কোন কুফু নেই।’ (যাকারিয়া মুহাম্মাদ ইবনু যাকারিয়া আল-আনছারী আশ-শাফেঈ, মাবহাজুত তুল্লাবি ফী ফিক্বহি ইমাম আশ-শাফেঈ; বৈরূত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ, ১ম সংস্করণ, ১৪১৭ হি./১৯৯৭ খ্রি., পৃ. ১৮৩)। কুফুর আলোচনায় অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, وَالْمُبْتَدِعُ مَعَ السُّنِّيَّةِ كَالْفَاسِقِ مَعَ الْعَفِيْفَةِ ‘চারিত্রিক নিষ্কলুষতার সাথে নাফরমানীর যেমন কোন কুফু নেই। অনুরূপভাবে সুন্নাহপন্থীদের সাথে বিদ‘আতীদের কোন কুফু নেই।’(মুগনীউল মুহতাজ,৩য় খন্ড, পৃ. ১৬৬; গৃহীত: মাওক্বিফু আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আতি মিন আহলিল হাওয়া ওয়াল বিদাঈ, ১ম খ-, পৃ. ৩৮৪)। ইবনু কুদামা (রাহিমাহুল্লাহ) [৫৪১-৬২০ হি./১১৪৭-১২২৩ খ্রি.] বলেন, والكفء ذو الدين والمنصب ‘কুফু হল দ্বীন ও সম্মান-মর্যাদার।’(মাওক্বিফু আহলিস সুন্নাতি ওয়াল জামা‘আতি মিন আহলিল হাওয়া ওয়াল বিদাঈ, ১ম খ-, পৃ. ৩৮৫)
.
ইবনুল ক্বাইয়িম (রাহিমাহুল্লাহ) [৬৯১-৭৫১ হি./১২৯২-১৩৫০ খি.] তাঁর বিখ্যাত ‘যাদুল মা‘আদ’ গ্রন্থে الكفاءة في النكاح ‘বিবাহের ক্ষেত্রে সমতা’-এর বিধানাবলী সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন, বিবাহের ক্ষেত্রে দ্বীনই মূলত কুফু বা সমতার মূল কেন্দ্রবিন্দু। সুতরাং দ্বীনদারিতার উপর ভিত্তি করে মুসলিম নারী-পুরুষের মাঝে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। কেননা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের আক্বীদাপন্থী যদি বিদ‘আতী কোন ছেলে বা মেয়ের সাথে বিবাহ সম্পন্ন হয়, তাহলে দ্বীন মানার ক্ষেত্রে উভয়ের মাঝে বিস্তর পার্থক্য পরিলক্ষিত হবে। যা পারিবারিক সুখ-শান্তি ও দাম্পত্যময় জীবনের জন্য চরম অন্তরায়। অনুরূপভাবে দ্বীন মানার ক্ষেত্রে ব্যাপক সমস্যার সৃষ্টি হবে। মূলত তাক্বওয়া, পরহেযগারিতা তথা দ্বীনদারিতাই হলো বিবাহের ক্ষেত্রে কুফু বা সমতা। অতঃপর তিনি নিন্মোক্ত দলীল উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, হে মানুষ! আমরা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি এক পুরুষ ও এক নারী হতে। পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করেছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে, যাতে তোমরা একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হতে পার। তোমাদের মধ্যে আল্লাহ‌র নিকট সেই ব্যক্তিই অধিক মর্যাদাসম্পন্ন, যে তোমাদের মধ্যে অধিক মুত্তাকী। নিশ্চয় আল্লাহ‌ সবকিছু জানেন, সমস্ত খবর রাখেন।’(সূরা আল-হুজুরাত: ১৩)। (ইবনুল ক্বাইয়িম আল-জাওযিয়্যাহ, যাদুল মা‘আদ ফী হাদই খায়রিল ইবাদ; বৈরূত: মুওয়াসসাসাতুর রিসালাহ, ২৭শ সংস্করণ, ১৪১৫ হি./১৯৯৪ খ্রি., ৫ম খন্ড, পৃ. ১৫৯)
.
অতএব বিবাহের কুফু মূলত দ্বীনদারিতাই। সুতরাং কাফির মুশরিকদের সাথে মুসলিম নারী-পুরুষের বিবাহ করা জায়েয নয়, জায়েয নয় চারিত্রিক নিষ্ককলুষ কোন নারীর সাথে নাফরমান কোন পুরুষের বিবাহ করা। এটা ব্যতীত কুফু বিষয়ে আল-কুরআন ও সুন্নাহতে কোন কিছু বর্ণিত হয়নি। তাই অপবিত্র ও ব্যাভিচারীকে বিবাহ করা মুসলিম নারী-পুরুষের জন্য হারাম। এছাড়া বিয়ের ক্ষেত্রে বংশ মর্যাদা, চাকুরী-বাকুরী, সম্পদশালী ও স্বাধীন হওয়াও শর্ত নয়। সুতরাং দাসের জন্য উচ্চবংশীয় সম্পদশালী স্বাধীন মেয়েকে বিয়ে করা জাযেয, যদি সে মুসলিম হয় ও চারিত্রিক নিষ্কলুষের অধিকারী হয়। এমনকি কুরাইশ ও কুরাইশ নয় এবং হাশেমী ও হাশেমী নয় এমন ছেলে-মেয়ে পরস্পর বিবাহ করতে পারবে এবং ফক্বীর ধনাঢ্যশীলকেও বিবাহ করতে পারবে। (যাদুল মা‘আদ ফী হাদই খায়রিল ‘ইবাদ, ৫ম খ-, পৃ. ১৫৯-১৬০)
.
পরিশেষে, বিবাহের ক্ষেত্রে প্রথমে সহীহ আক্বীদার পাত্র-পাত্রী খোঁজ করতে হবে। কারণ সহীহ আক্বীদার কাউকে পাওয়া গেলে সাধারণ বিদআতির সাথেও বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া উচিত নয়। কেননা বিদ‘আতীদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের ব্যাপারে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামা‘আতের ইমামগণ কঠোরভাবে নিষেধ করেছেন। যেমন, ইমাম মালিক (রাহিমাহুল্লাহ) [৯৩-১৭৯ হি./৭১১-৭৯৫ খ্রি.] বলেন, لَا يُنْكَحُ أَهْلُ الْبِدَعِ وَلَا يُنْكَحُ إلَيْهِمْ وَلَا يُسَلَّمُ عَلَيْهِمْ وَلَا يُصَلَّى خَلْفَهُمْ وَلَا تُشْهَدُ جَنَائِزُهُمْ ‘বিদ‘আতীকে বিয়ে করা যাবে না। তাদের সাথে কাউকে বিয়ে দেয়া যাবে না, তাদেরকে সালাম দেয়া যাবে না, তাদের পিছনে সালাত আদায় করা যাবে না এবং তাদের জানাযায় অংশগ্রহণ করবে না‌।’(মালিক ইবনু আনাস, আল-মুদাওয়ানাতু; বৈরূত: দারুল কুতুবিল ‘ইলমিয়্যাহ, ১ম সংস্করণ, ১৪১৫ হি./১৯৯৪ খ্রি., ১ম খন্ড, পৃ. ১৭৭)

ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বাল (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, مَنْ لَمْ يَرْبَعْ بِعَلِّي ابْنِ أَبِي الطَّالِبِ فِي الخِلَافَةِ فَلَا تُكَلِّمُوْهُ وَلَا تَنَاكِحُوُهْ ‘যারা আলী ইবনু আবী তালিব (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-এর খেলাফতকালে তাঁর সাথে থাকেনি তার সাথে তোমরা কথা বলবে না এবং তার সাথে বিবাহ করবে না।’(আবুল হুসাইন ইবনু আবু ই‘আলা, মুহাম্মাদ ইবনু মুহাম্মাদ, ত্বাবাক্বাতুল হানাবালাহ; বৈরূত: দারুল মা‘আরিফাহ, তাবি, ১ম খন্ড, পৃ. ৪৫)। কিন্তু যদি সহীহ আকিদাধারি কোন বিবাহযোগ্য পাত্র/পাত্রী না পাওয়া যায় তাহলে উপরোক্ত বিদআতি আকীদায় বিশ্বাসী ব্যক্তিকে বিবাহ করা জায়েয। তবে বিবাহের পর যথাসাধ্য তাকে দ্বীনের সঠিক জ্ঞান দান করার চেষ্টা করতে হবে। আল্লাহ তাওফিক দান করুন। আমীন। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
__________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Exit mobile version