Site icon Tawheed Media

আল্লাহ আমাদের বিপদে কেনো ফেলেন?

আল্লাহ আমাদের বিপদে কেনো ফেলেন???
____________________________
ঈমানের ছয় নাম্বার রোকন হলো “ওয়াল ক্বাদরি খাইরিহি ওয়া শাররিহি” – অর্থাৎ আমাদের জীবনে ভালো-মন্দ যাই ঘটুকনা কেনো তা আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত।
মানুষ ঈমানদার হোক আর কাফের হোক, নেককার হোক আর পাপী হোক, সবার জীবনে বিপদ-আপদ আসে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যদিও আমরা অপছন্দ করি, তারপরেও কেনো আমাদের জীবনে এইরকম বিপদ-আপদ আসে বা আল্লাহ কেনো আমাদের পরীক্ষায় ফেলেন?
____________________________
কোরান হাদীস থেকে এর যে কারণগুলো জানা যায় তার মধ্যে রয়েছেঃ
১. মানুষকে পরীক্ষা করাঃ প্রকৃতপক্ষে কে ঈমানদার কে মুনাফেক, কে সত্যবাদী আর কে মিথ্যাবাদী তা জেনে নেয়া।
মুনাফেক ও দুর্বল ঈমানদারেরা অনেক সময় সুখ–স্বাচ্ছন্দের সময় আল্লাহকে মনে রাখে, তাঁর প্রতি অনুগত ও সন্তুষ্ট থাকে। কিন্তু, যখন কোনো বিপদ-আপদ আসে তখন আল্লাহকে ভুলে যায়, কুফুরী করে বা তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়। আবার অনেক সময় এর বিপরীতও হয়। যখন কোনো বিপদে পড়ে, তখন অনেক কাফের মুশরেককেও আল্লাহর কাছে মনে প্রাণে দুয়া করতে দেখা যায়। আর যখন আল্লাহ তাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন, তখন আল্লাহকে ভুলে যায়, তাঁর নিয়ামতকে অস্বীকার করে অহংকার প্রদর্শন করে, বলে এতো আমার প্রাপ্য। আবার কখনো আল্লাহর সাথে শরীক করে বসে, আল্লাহর পরিবর্তে অন্য কাউকে বিপদ-মুক্তির কারণ মনে করে।
(এই সবগুলো বিষয় নিয়ে কোরানে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে, পোস্ট বড় হয়ে যাওয়ার আশংকায় সবগুলো আয়াত দেয়া হলোনা।)
এই বিষয়গুলো পরীক্ষা করার জন্য, অর্থাৎ একনিষ্ঠভাবে কে আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছে তা পরীক্ষা করার জন্য আল্লাহ তাঁর বান্দাদের পরীক্ষা করেন। আল্লাহ বলেন,
“মানুষ কি মনে করে যে “আমরা ঈমান এনেছি” – এ কথা বলেই অব্যহতি পেয়ে যাবে, আর তাদেরকে পরীক্ষা করা হবেনা? আমি অবশ্যই তাদের পূর্বে যারা ছিলো তাদেরকে পরীক্ষা করেছি। আর আল্লাহ অবশ্যই জেনে নিবেন কারা সত্যবাদী আর কারা মিথ্যাবাদী।” [সুরা আনকাবুত, আয়াত ২-৩]
এছাড়া অন্য জায়গায় আল্লাহ বলেন,
“মানুষের মধ্যে কেউ কেউ দ্বিধা-দ্বন্দে জড়িত হয়ে আল্লাহর ইবাদত করে। যদি সে কল্যানপ্রাপ্ত হয়, তাহলে ইবাদতের উপর কায়েম থাকে। আর যদি কোনো পরীক্ষায় পড়ে তাহলে সে পূর্বাবস্থায় (কুফুরীতে) ফিরে যায়। সে ইহকাল ও পরকালে ক্ষতিগ্রস্থ, এটাই সুস্পষ্ট ক্ষতি। [সুরা হাজ্জ, আয়াত ১১]
.
২. দুনিয়াতেই পাপের সামান্য শাস্তি দেওয়া, যাতে করে সে আল্লাহর দিকে ফিরে আসে ও নিজেকে পরকালের কঠিন শাস্তি থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে।
অনেক সময় মানুষ আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেও ঈমানের দুর্বলতার কারণে বা পার্থিব জীবনের লোভ-লালসার কারণে আল্লাহর অবাধ্য হয়। আল্লাহ তখন বিপদ-আপদ দিয়ে তাকে অসহায় করে দেন, যাতে করে সে আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করে আর পরকালের কথা স্মরণ করে। আল্লাহ বলেন,
“কঠিন শাস্তির পূর্বে আমি তাদেরকে হালকা শাস্তি আস্বাদন করাবো, যাতে তারা প্রত্যাবর্তন করে।” [সুরা সাজদাহ, আয়াত ২১]
এই আয়াতে “হালকা শাস্তি” দ্বারা পার্থিব জীবনের বিপদ-আপদ, দুঃখ-কষ্ট, ব্যথা-বেদনা, রোগ-শোক ইত্যাদিকে বোঝানো হয়েছে। এ ছাড়া সুনানে নাসায়ীতে রয়েছে, হালকা শাস্তির অর্থ হলো দুর্ভিক্ষ।
(তাফসীর ইবনে কাসীর থেকে নেওয়া)
.
৩. এছাড়া আল্লাহ তাঁর কিছু প্রিয় বান্দাকে পরীক্ষায় ফেলেন, যাতে করে পরকালে তার মর্যাদা ও জান্নাতের নেয়ামত বৃদ্ধি করেন। অনেক সময় আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে যে মর্যাদা দিতে চান তা ঐ বান্দা তার আমল দ্বারা অর্জন করার মতো হয়না। তখন আল্লাহ তাকে পরীক্ষায় ফেলেন, যদি সে এতে ধৈর্যধারণ করে তাহলে আল্লাহ তাকে ঐ মর্যাদায় উন্নীত করেন।
____________________________
এবার আসি, ব্যক্তিগত পর্যায়ের কিছু নিয়ে।
আমরা নিজেরা যখন বিপদ আপদে পড়ি তখন আমরা পাপী হই আর নেককার হই, কেউই কিন্তু নিশ্চিত করে বলতে পারবোনা, কেনো আল্লাহ আমাদের বিপদে ফেলেছেন। এটা অদৃশ্যের জ্ঞান, যা আল্লাহ ছাড়া আর কেউই বলতে পারেনা। তাই আমরা বিপদে পড়লে কখনোই এই প্রশ্ন করবোনা, হায় আল্লাহ! আমি কি পাপ করেছিলাম? আর যদিও করি, তা বেকার, কারণ আমরা যতই নেককার হয় আমরা কেউই পাপমুক্ত নয়। আমরা জেনে না জেনে দিন-রাত অসংখ্য পাপ কাজ করছি। তাই আমরা এই প্রশ্ন করবোনা, বা হতাশ হবোনা। তবে অবশ্যই সতর্ক হবো, অতীতের যে ভুল হয়েছে তা তোওবা করে সংশোধন করার জন্য আর ভবিষ্যতের জীবনকে আরো সুন্দর করার জন্য। আর মহান আল্লাহর উদ্দেশ্য এটাই, আমাদেরকে বিপদে ফেলে আমাদের সংশোধন করা।
বিপদে পড়ে হতাশ হবোনা বা মনে করবোনা আমার বিপদটাই সবচাইতে বড়।
আমরা যদি আমাদের রাসুল (সাঃ) এর জীবনের দিকে তাকাই, তাহলে তা হবে আমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ। অতীত থেকে ভবিষ্যত পর্যন্ত সমস্ত মানুষের মধ্যে সর্বোত্তম হয়েও, কোরানে আল্লাহ যাকে “রাহমাতুল্লিল আলামীন” বা জগত সমূহের জন্য রহমত বলে আখ্যায়িত করেছেন, তাঁকে একজন মানুষ হিসেবে কি পরিমাণ দুঃখ কষ্টের মাঝে পার করতে হয়েছে?
____________________________
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম কে যে দুঃখ কষ্টের মধ্যে জীবন অতিবাহিত করতে হয়েছে তার কিছু বর্ণনাঃ
১. তাঁর জীবনে তিনি তাঁর তিন মেয়ে ও দুই ছেলেকে হারিয়েছেন। আমাদের মধ্যে কয়জন ৫টা সন্তান হারিয়েছে? তিনি কি তাঁর ছেলে-মেয়েদের ভালোবাসতেন না? তাঁর কি পরিমাণ কষ্ট হতো একেকটা সন্তানকে মৃত্যুর মুখে পড়তে দেখে?
২. তায়েফের ময়দানে কাফের-মুশরেকদের নির্মম আচরণ সকলেরই জানা। রক্তের ধারা তাঁর মাথা থেকে পায়ের জুতা পর্যন্ত পৌছে যায়। এছাড়া উহুদের যুদ্ধে তিনি আঘাতপ্রাপ্ত হন। শত্রুদের তরবারির আঘাতে তাঁর মাথার বর্ম ভেঙ্গে মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত হন, তাঁর দাঁত ভেঙ্গে যায়।
৩. রাসুল (সাঃ) এর প্রিয় স্ত্রী, মা আয়িশা (রাঃ) এর প্রতি মুনাফেকদের কর্তৃক জঘন্য অপবাদ দেয়ার সময় তাঁকে কতটুকু পেরেশানির মধ্যে দিয়ে পার করতে হয়েছিলো? একেতো তিনি মুনাফেকদের কিছু বলতেও পারছিলেন না, আর নিজের স্ত্রীর পবিত্রতাও প্রমান করতে পারছিলেন না। কোরানের আয়াত নাযিলের মাধ্যমে মা আয়িশাহ (রাঃ) এর পবিত্রতা ঘোষণার আগে, তাকেওতো একজন স্বামী হিসেবে অমানুষিক পেরেশানির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিলো।
৪. টানা দুইবছর যখন তাঁকে একঘরে করে একটা গুহায় প্রায় বন্দী করে রাখা হয়। তৃণ ও লতা-পাতা খেয়ে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে অমানুষিক কষ্টের মধ্যে তাঁকে দিন কাটাতে হয়।
____________________________
একবার রাসুল সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম কে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, মানুষের মধ্যে কারা সবচাইতে বেশি বিপদে পড়ে? উত্তরে তিনি বলেন, নবী-রাসুলরা, আর এর পরে আল্লাহ যাকে যত বেশি ভালোবাসেন তাকে তত বেশি পরীক্ষায় ফেলেন।
____________________________
সুতরাং, বিপদে পড়লে আমাদের এই বিশ্বাস রাখা জরুরী, আমি পাপী হলেও আল্লাহ আমাকে ভালোবাসেন। আর এই জন্য আমাকে বিপদে ফেলে আমাকে সংশোধন করতে চাচ্ছেন, যাতে করে পরকালে যা আমদের আসল ঠিকানা, সেখানে আমাদেরকে অনন্ত সুখের জীবন দান করেন।
____________________________
আল্লাহ আমাকে ও আপনাদের সকলকে হক্ক পথে চলার তোওফিক দান করুন। আমাদের দুনিয়া ও আখেরাত সহজ ও সুন্দর করুন, আমীন।।

Exit mobile version