Site icon Tawheed Media

অপর মুসলিম ভাই বোনদের সম্পর্কে সর্বাবস্থায় ভাল ধারণা পোষন করুন এবং মন্দ ধারণা পরিহার করুন

ভূমিকা: দুঃখজনক হলেও সত্য, অধিকাংশ মানুষের স্বভাব হল অপর ভাই সম্পর্কে মন্দ ধারণা পোষণ করা। আর এই মন্দ বা ভুল ধারণার বশবর্তী হয়ে মানুষ একে অপরের প্রতি মিথ্যারোপ করে, গীবত করে এবং তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে, বিপরীত নিজেকে পরিশুদ্ধ মনে করে। অথচ মহান আল্লাহ বলেন,فَلاَ تُزَكُّوا أَنْفُسَكُمْ هُوَ أَعْلَمُ بِمَنِ اتَّقَى ‘তোমরা আত্মপ্রশংসা কর না, তিনিই সর্বাধিক অবগত কে বেশী পরহেযগার।(সূরা নাজম ৫৩/৩২)। ইহুদীদের আত্মপ্রশংসার নিন্দা করে আল্লাহ আয়াত নাযিল করেছেন। আল্লাহ বলেন,أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ يُزَكُّونَ أَنْفُسَهُمْ بَلِ اللهُ يُزَكِّي مَنْ يَشَاءُ وَلاَ يُظْلَمُونَ فَتِيلًا انْظُرْ كَيْفَ يَفْتَرُونَ عَلَى اللهِ الْكَذِبَ وَكَفَى بِهِ إِثْمًا مُبِينًا ‘তুমি কি তাদের প্রতি লক্ষ্য করনি, যারা স্বীয় আত্মার পবিত্রতা প্রকাশ করে? বরং আল্লাহ যাকে ইচ্ছা পবিত্র করেন এবং তারা সূতা পরিমাণও অত্যাচারিত হবে না। (সূরা নিসা ৪/৪৯)।

প্রিয় পাঠক! আমারা প্রত্যেকেই যদি কোন কথা বা কাজ ঘটার সাথে সাথেই অপর মুসলিম ভাই-বোন সম্পর্কে উত্তম ধারণা করি, তাহলে যে কোন পরিস্থিতিতে আমাদের নিজেদের অন্তরাত্মা অন্যদের সম্পর্কে সুধারণা পোষণ করতে বাধ্য থাকবে। এমনই একটি ঘটনার বৃত্তান্ত আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে উল্লেখ করেছেন। আম্মাজান আয়েশা (রাঃ)-এর উপর যখন অপবাদ আরোপ করা হয়েছিল, তখন মুমিনদের উচিত ছিল মুনাফিকদের খপ্পরে না পড়ে উক্ত অপবাদ শ্রবণের প্রথম ধাপেই তাঁদের উপর সুধারণা পোষণ করা। কিন্তু সবাই সেটা করেননি তাই মহান আল্লাহ বলেন, لَوْلَا إِذْ سَمِعْتُمُوهُ ظَنَّ الْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بِأَنْفُسِهِمْ خَيْرًا وَقَالُوا هَذَا إِفْكٌ مُبِينٌ যখন তারা এটা শুনল তখন মুমিন পুরুষ এবং মুমিন নারীগণ তাদের নিজেদের সম্পর্কে কেন ভাল ধারণা করল না এবং (কেন) বলল না, ‘এটা তো সুস্পষ্ট অপবাদ? (সূরা নূর ২৪/১২)।
.
এ আয়াতের দু’টি অনুবাদ হতে পারে।

(১). যখন তোমরা শুনেছিলে তখনই কেন মু’মিন পুরুষ ও মু’মিন নারীরা নিজেদের সম্পর্কে সুধারণা করেনি?

(২). অন্য একটি অনুবাদ এও হতে পারে, নিজেদের লোকদের অথবা নিজেদের সমাজের লোকদের ব্যাপারে ভালো ধারণা করনি কেন? আয়াতের শব্দাবলী দু’ধরনের অর্থের অবকাশ রাখে। অর্থাৎ তোমরা যখন এই অপবাদের সংবাদ শুনলে, তখন মুসলিম পুরুষ ও নারী নিজেদের মুসলিম ভাই-বোনদের সম্পর্কে সুধারণা করলে না কেন এবং একথা বললে না কেন যে, এটা প্ৰকাশ্য মিথ্যা?
.
এ আয়াতে কয়েকটি বিষয় প্রণিধানযোগ্য।

(ক). প্রথমতঃ بِاَنْجُسِهِمْ শব্দ দ্বারা কুরআনুল করীম ইঙ্গিত করেছে যে, যে মুসলিম অন্য মুসলিমের দুর্নাম রটায় ও তাকে লাঞ্ছিত করে, সে প্রকৃতপক্ষে নিজেকেই লাঞ্ছিত করে। কারণ, ইসলামের সম্পর্ক সবাইকে এক করে দিয়েছে। সর্বক্ষেত্রে কুরআন এই ইঙ্গিত ব্যবহার করেছে। যেমন এক জায়গায় বলা হয়েছে وَلَاتَلْمِزُوْٓااَنْفُسَكُمْ [সূরা আল-হুজরাতঃ ১১] অর্থাৎ তোমাদের নিজেদের প্রতি দোষারোপ করো না। উদ্দেশ্য, কোন মুসলিম পুরুষ ও নারীর প্রতি দোষারোপ করো না।
.
(খ). এ আয়াতে দ্বিতীয় প্রণিধানযোগ্য বিষয় এই যে, এখানে ظَنَّ الْمُؤُمِنُوْنَ বলা হয়েছে। এতে হাল্কা ইঙ্গিত রয়েছে যে, যাদের দ্বারা এই কাজ সংঘটিত হয়েছে, তারা এই কাজের প্রেক্ষাপটে মুমিন কথিত হওয়ার যোগ্য নয়। কেননা, এক মুসলিম অন্য মুসলিমের প্রতি সুধারণা পোষণ করবে এটাই ছিল ঈমানের দাবী।
.
(৩). এখানে তৃতীয় প্রণিধানযোগ্য বিষয় হলো, এই আয়াতের শেষ বাক্য هٰذَٓااِفْكٌ مُّبِيْنٌ এ শিক্ষা দেয়া হয়েছে যে, খবরটি শুনামাত্রই মুসলিমদের ‘এটা প্ৰকাশ্য অপবাদ’ বলে দেয়াই ছিল ঈমানের দাবী। অর্থাৎ তাদের এ সব অপবাদ তো বিবেচনার যোগ্যই ছিল না। একথা শোনার সাথে সাথেই প্রত্যেক মুসলিমের একে সুস্পষ্ট মিথ্যাচার, মিথ্যা বানোয়াট কথা ও অপবাদ আখ্যা দেয়া উচিত ছিল। [তাফসীরে বাগভী]
.
আমাদের সালাফে সালেহীনের কর্মপদ্ধতি ছিল যে, তারা কোন কথা শুনামাত্রই সেটাকে খারাপ অর্থে না নিয়ে উত্তমভাবে গ্রহণ করতেন। ওমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বলেন, وَلَا تَظُنَّنَّ بِكَلِمَةٍ خَرَجَتْ مِنِ امْرِئٍ مُسْلِمٍ شَرًّا وَأَنْتَ تَجِدُ لَهُ فِي الْخَيْرِ مَحْمَلًا ‘তোমার ভাইয়ের ভিতর থেকে যে কথা বের হয়েছে, তাকে তুমি খারাপ অর্থে নিবে না। বরং কোন কথা শুনামাত্রই উত্তমভাবে নিবে।
(বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৭৯৯২; জামেউল আহাদীছ হা/৩১৬০৪)।
.
ইমাম শাফেঈ (রহঃ) অসুস্থ হলে তার কতিপয় ভাই তাকে দেখতে এসে তাকে বলেন, ‘আল্লাহ আপনার দুর্বলতাকে শক্তিশালী করুন। ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন, আল্লাহ যদি আমার দূর্বলতাকে শক্তিশালী স্থায়িত্ব দেন, তবে তো আমার মৃত্যু হবে! তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ, আমি কল্যাণ ছাড়া কিছুই কামনা করিনি। তখন ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন, আপনি যদি আমাকে গালিগালাজও করতেন, তবুও আমি তা ভাল অর্থেই নিতাম।(বায়হাক্বী, মানাক্বিবুল ইমাম শাফেঈ ২/১১৬-১১৭; তাবাকাতুশ শাফেঈয়্যাহ আল-কুবরা পৃষ্ঠা: ১৩৫/১৩৮)।

অপর মুসলিম ভাইয়ের যে কোন কথায় বা কাজে তার ওযর-আপত্তি তালাশ করতে হবে। সালাফে সালেহীনের উত্তম ধারণার কথা স্মরণ করতে হবে। তাঁরা মানুষকে ক্ষমা করার নিমিত্তে তার ওযর-আপত্তি সমূহ তালাশ করতেন। তাঁদের কথাই ছিল: فَاطْلُبُوْا لَهُ سَبْعِيْنَ عُذْرًا ‘তোমরা তোমাদের ভাইয়ের সত্তরটি ওযর অনুসন্ধান কর’। (আবুদাঊদ হা/৫১৬৪, সনদ ছহীহ; শু‘আবুল ঈমান হা/৮৩৪৪)।
.
মুহাম্মাদ ইবনে সীরীন (রহঃ) বলেন, إِذَا بَلَغَكَ عَنْ أَخِيكَ الشَّيْءُ تُنْكِرُهُ فَالْتَمِسْ لَهُ عُذْرًا وَاحِدًا إِلَى سَبْعِينَ عُذْرًا، فَإِنْ أَصَبْتَهُ وَإِلَّا قُلْ: لَعَلَّ لَهُ عُذْرًا لاَ أَعْرِفُهُ ‘তুমি যদি তোমার মুসলিম ভাইয়ের মন্দ কিছু আঁচ করতে পার, তবে তাঁর ওযর গ্রহণ কর। যদি কোনই ওযর না পাও তবে বল, হয়তবা তার এমন ওযর আছে যা আমি জানি না। (বায়হাক্বী হা/৭৯৯১; ১০৬৮৪) আমরা যদি অপরের ওযরখাহী গ্রহণ করতে পারি তবে মন্দ ধারণা থেকে মুক্ত হয়ে আমাদের অন্তরে প্রশান্তি নেমে আসবে ইনশাআল্লাহ।
.
পরিশেষে প্রিয় পাঠক! পরিশেষে বলা যায় যে,সুধারণা পোষণ উন্নত চরিত্রের ভূষণ। অন্যের সম্পর্কে সুধারণার ফলে পারস্পরিক ভুল বুঝাবুঝির অবসান পুরোপুরিভাবে সম্ভব। অনুমান নির্ভর ও গুজবের উপর ভর করে সমাজে অঘটনের অনেক নযীর আছে। কথার সত্যতা যাচাই না করেই অন্যের বিরুদ্ধে বিষোদগার রচনার অপতৎপরতাও সমাজে কম নয়। তাই মুসলমান হিসাবে আমাদের উচিত নিজেদেরকে মন্দ ধারণা থেকে পরহেয করে ঘটনার সত্যতা যাচাই করা। ফলে পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটবে, অটুট থাকবে ইসলামী বন্ধন। দৃঢ় হবে সামাজিক মেলবন্ধনের সেতু।
.
অপর ভাই সম্পর্কে ভাল ধারণা তৈরী করার মানসে নবী করীম (ﷺ) জনৈক সাহাবীকে হাতে-কলমে শিক্ষা দিলেন। একদা এক ব্যক্তি তাঁর নিকটে অভিযোগ করল যে, আমার স্ত্রী কালো সন্তান প্রসব করেছে। তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন, তোমার কোন উট আছে কি? সে বলল, জী আছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, কি রং সেগুলোর? সে বলল, সেগুলো লাল রংয়ের। তিনি বললেন, সেগুলোর মধ্যে কোন কাল বাচ্চা আছে কি? সে বলল, অবশ্যই আছে। তিনি বললেন, কালগুলো কোথা থেকে আসল? সে বলল, সম্ভবত পূর্ব বংশের কোন রগের ছোঁয়া লেগেছে। তখন রাসূল (ﷺ) বললেন, لَعَلَّ ابْنَكَ هَذَا نَزَعَهُ عِرْقٌ ‘সম্ভবত তোমার সন্তানও পূর্ববর্তী কোন বংশের ছোঁয়া পেয়েছে।(সহীহ বুখারী হা/৬৮৪৭) এ ঘটনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মন্দ ধারণা পরিবর্তনে রাসূল (ﷺ)ছিলেন উত্তম প্রশিক্ষক। ঐ ব্যক্তির ধারণা ছিল যে, তার স্ত্রী ব্যভিচারের শিকার হয়েছে এবং এ সন্তান তার ঔরসজাত সন্তান নয়। কিন্তু রাসূল (ﷺ) বাস্তব উদাহরণের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাকে উন্নত মননের অধিকারী বানাতে সহায়তা করলেন। রাসূল (ﷺ) আরো বলেন, إِنَّ حُسْنَ الظَّنِّ مِنْ حُسْنِ الْعِبَادَةِ ‘নিশ্চয়ই সুন্দর ধারণা সুন্দর ইবাদতের অংশ’। (মুসনাদে আহমাদ হা/ ৮১৭৬; আবুদাউদ হা/ ৪৯৯৩, সনদ হাসান) আল্লাহ আমাদের সবাইকে অপর মুসলিম সম্পর্কে সুধারণা পোষণের ‘ক্বালবে সালীম’ তথা সুস্থ অন্তঃকরণ দান করুন-আমীন! (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_____________________
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।

Exit mobile version