প্রথমত: মূলনীতি হচ্ছে ইসলামের দৃষ্টিতে প্রত্যেক মুকাল্লাফ তথা প্রাপ্তবয়স্ক এবং সুস্থ মস্তিষ্ক সম্পন্ন (পাগল নয়) এমন নারী-পুরুষের জন্য আত্মহত্যা করা হারাম এবং কবিরা গুনাহ। কারন এটি মহান আল্লাহর কর্মে হস্তক্ষেপের শামিল। অথচ জীবন-মরণের মালিক একমাত্র আল্লাহর তাআলা। সুতরাং কেউ যদি নিজের প্রতি অবিচার ও সীমালঙ্ঘন বশত নিজেকে মৃত্যুর দিকে ঢেলে দেয় তাহলে সে আল্লাহর কর্মে হস্তক্ষেপ করল। আর যে আল্লাহর কর্মে হস্তক্ষেপ করে আল্লাহ তাআলা তাকে জাহান্নামের শাস্তি প্রদান করবেন। এই মর্মে কুরআন সুন্নাহয় অসংখ্য দলিল রয়েছে। যেমন: মহান আল্লাহ বলেন,وَلَا تَقۡتُلُوٓاْ أَنفُسَكُمۡۚ إِنَّ ٱللَّهَ كَانَ بِكُمۡ رَحِيمٗا – وَمَن يَفۡعَلۡ ذَٰلِكَ عُدۡوَٰنٗا وَظُلۡمٗا فَسَوۡفَ نُصۡلِيهِ نَارٗاۚ وَكَانَ ذَٰلِكَ عَلَى ٱللَّهِ يَسِيرًا ‘আর তোমরা নিজেদের হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়ালু। যে কেউ অবিচার ও সীমালঙ্ঘন বশত আত্মহত্যা করে অবশ্যই আমি তাকে জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করাবো। আল্লাহর পক্ষে তা সহজসাধ্য।’ (সূরা আন-নিসা: ২৯-৩০) হাদীসে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘‘যে পাহাড়ের উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করবে, সে জাহান্নামের আগুনে থাকবে এবং চিরকাল সে জাহান্নামের ভিতর সেভাবে লাফিয়ে পড়তে থাকবে। যে বিষপানে আত্মহত্যা করবে, জাহান্নামেও তার হাতে বিষ থাকবে, চিরকাল সে জাহান্নামের মধ্যে তা পান করতে থাকবে। যে লোহার আঘাতে আত্মহত্যা করবে, জাহান্নামেও সে লোহা তার হাতে থাকবে, চিরকাল সে তা দিয়ে নিজের পেটে আঘাত করতে থাকবে।’’ [ইমাম বুখারি, আস-সহিহ: ৫৭৭৮]
.
দ্বিতীয়ত: ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে শিশুদের ক্ষেত্রে শরীয়তের হুকুম আহকাম তখনই ফরজ হয় যখন শিশু মুকাল্লাফ বা শরয়ি ভারপ্রাপ্ত হবে। মুকাল্লাফ হচ্ছেন বিবেক-বুদ্ধি সম্পন্ন সাবালক ব্যক্তি। কারণ নাবালক কিংবা পাগলের উপর কোন শরয়ি ভার নেই।সুতরাং কোনও অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশু যদি আত্মহত্যা করে তাহলে আখিরাতে সে এ কারণে জাহান্নামি হবে না। কেননা আল্লাহ তাআলা প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার আগ পর্যন্ত বান্দার কোনও গুনাহ লিখেন না। যেমন আম্মিজান ‘আইশাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) [মৃত: ৫৭/৫৮ হি.] সূত্রে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, رُفِعَ الْقَلَمُ عَنْ ثَلَاثَةٍ: عَنِ النَّائِمِ حَتَّى يَسْتَيْقِظَ، وَعَنِ المُبْتَلَى حَتَّى يَبْرَأَ، وَعَنِ الصَّبِيِّ حَتَّى يَكْبُرَ “তিন ধরণের লোকের উপর থেকে কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। যথা: (১). ঘুমন্ত ব্যক্তি, যতক্ষণ না জাগ্রত হয়, (২). অসুস্থ (পাগল) ব্যক্তি, যতক্ষণ না আরোগ্য লাভ করে এবং (৩). অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালক, যতক্ষণ না প্রাপ্তবয়স্ক হয়”।(আবু দাউদ হা/৪৪০১; মিশকাত হা/৩২৮৭; সহীহুল জামে হা/৩৫১২)
.
উক্ত হাদীসের বক্তব্য: কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে এর অর্থ এসব ব্যক্তির পাপ বা গুনাহ ও অপরাধ লিপিবদ্ধ করা হয় না এবং তাদের অপরাধের জন্য শাস্তি প্রযোজ্য হয় না। সুতরাং অপ্রাপ্তবয়স্ক, উম্মাদ, পাগল ব্যক্তি কিয়ামত দিবসে দায় দায়িত্বমুক্ত। আর অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুর বয়ঃসন্ধির লক্ষণ যা পুরুষ ও মহিলা উভয়ের জন্যই প্রযোজ্য এই মতের ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে কোন মতভেদ নেই। যেমন: আল মাওযূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ আল-কুয়েতিয়াহ, কুয়েতি ফিক্বহ বিশ্বকোষে এসেছে, التَّكْلِيفُ بِالْفَرَائِضِ وَالْوَاجِبَاتِ وَتَرْكِ الْمُحَرَّمَاتِ يُشْتَرَطُ لَهُ الْبُلُوغُ ، وَلاَ تَجِبُ عَلَى غَيْرِ الْبَالِغِ … وَلاَ يَجِبُ الْقِصَاصُ وَالْحُدُودُ ، كَحَدِّ السَّرِقَةِ وَحَدِّ الْقَذْفِ وَلَكِنْ يَجُوزُ أَنْ يُؤَدَّبَ ” انتهى . ”ফরজ ও ওয়াজিব পালন এবং হারাম বর্জনের বিধিবিধান প্রযোজ্য হওয়ার জন্য প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়া শর্ত। সুতরাং তা অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশুদের উপর প্রযোজ্য হবে না। অনুরূপভাবে তার উপর কেসাস তথা হত্যাকাণ্ড অপরাধে মৃত্যুদণ্ড, চুরি, জিনার অপবাদ ইত্যাদি বিভিন্ন অপরাধের জন্য হুদুদ (শরিয়া দণ্ডবিধি) প্রয়োগ করা যাবে না। তবে তাকে আদব শেখানো বৈধ।” (আল মাউসুআতুল ফিকহিয়া (ফিকহ বিশ্বকোষ) খন্ড:৮ পৃষ্ঠা:১৯৬) তারা আরো বলেছেন, أَجْمَعَ الْفُقَهَاءُ عَلَى أَنَّ الْعَقْل هُوَ مَنَاطُ التَّكْلِيفِ فِي الإْنْسَانِ، فَلاَ تَجِبُ عِبَادَةٌ مِنْ صَلاَةٍ أَوْ صِيَامٍ أَوْ حَجٍّ أَوْ جِهَادٍ أَوْ غَيْرِهَا عَلَى مَنْ لاَ عَقْل لَهُ كَالْمَجْنُونِ، وَإِنْ كَانَ مُسْلِمًا بَالِغًا ” ফকিহগন সর্বসম্মতভাবে একমত পোষণ করেছেন যে জ্ঞানবান হওয়া মানুষের মাঝে দায়িত্বপ্রাপ্ত হওয়ার একটি অন্যতম নিদর্শন। ফলে যে ব্যক্তি জ্ঞানবান নয় সে ব্যক্তির উপর সালাত, সিয়াম, হজ, জিহাদ ইত্যাদি অন্যান্য ইবাদত আবশ্যক হবে না যেমন পাগল ব্যক্তি যদিও সে প্রাপ্তবয়স্ক মুসলিম হয়”।(আল মাউসুআতুল ফিকহিয়া (ফিকহ বিশ্বকোষ) খন্ড:১৪; পৃষ্ঠা: ৩৬)
.
এমনকি যদি কোন অপ্রাপ্তবয়স্ক নাবালক শিশু অন্য কাউকে হত্যা করে তাহলেও তাকে সেই হত্যার দায়ে কিসাস দেওয়া যাবে না। এই মর্মে ইমাম মাওয়ার্দি (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: ” كل من لم يجر عليه قلم بجنون أو صغر فلا قصاص عليه إذا جرح أو قتل ، وسواء كان الصغير مميزا أو غير مميز ، لقول النبي صلى الله عليه وسلم : رفع القلم عن ثلاث : عن الصبي حتى يحتلم ، وعن المجنون حتى يفيق ، وعن النائم حتى ينتبه “কোন ব্যক্তি যদি পাগল কিংবা ছোট (শিশু) অবস্থায় কাউকে হত্যা করে কিংবা আঘাত করে তাহলে তার ওপর কোন কিসাস নাই। শিশুটি বিচক্ষণ হোক আর না হোক। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: তিন ধরনের ব্যক্তির থেকে কলম উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে: ছোট বালক যতক্ষণ তার প্রাপ্ত বয়স না হবে, পাগল যতক্ষণ তার জ্ঞান না ফিরবে এবং ঘুমন্ত ব্যক্তি যতক্ষণ না সে জাগ্রত হবে। আল হাবিল কাবির; খন্ড:১২; পৃষ্ঠা: ১৮১)
.
হাম্বালী মাযহাবের প্রখ্যাত ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন কুদামাহ আল-মাক্বদিসী আল-হাম্বালী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬২০ হি.] বলেছেন, ” الصبي لا يُقتل ، سواء قلنا بصحة ردته أو لم نقل ؛ لأن الغلام لا يجب عليه عقوبة ، بدليل أنه لا يتعلق به حكم الزنا والسرقة في سائر الحدود ، ولا يقتل قصاصاً ” ا
“একজন নাবালক শিশুকে (ধর্মত্যাগের ক্ষেত্রে) মৃত্যুদণ্ড দেওয়া যাবে না, তার ধর্মত্যাগ বৈধ হোক বা না হোক। কেননা ছেলেটির উপর শাস্তি আবশ্যক হয় না। যেনা ও চুরি এবং অন্যান্য অপরাধ ইত্যাদি সকল হদ্দের ক্ষেত্রে সে সম্পর্কিত নয় (তাকে শাস্তি দেওয়া যাবে না) এবং তাআর উপর কিসাস (হত্যার বদলে হত্যার শাস্তি) কার্যকর করাও যাবে না। (আল মুগনী,খন্ড: ১০; পৃষ্ঠা: ৬২)
.
পরিশেষে উপরোক্ত আলোচনার ভিত্তিতে এ কথা বলা যায় যে কোন অপপ্রাপ্তবয়স্ক নাবালক শিশু আত্মহত্যা করলেও কিয়ামতের ময়দানেও কোন শাস্তি প্রয়োগ করা হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত এমন ব্যক্তি বালেগে না পৌছায়। তবে আখিরাতে এই ধরনের অপ্রাপ্তবয়স্ক নাবালক আত্মহত্যাকারী শিশুদের সরাসরি জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে নাকি পরীক্ষা করা হবে সে বিষয়ে আল্লাহই ভাল যানেন। পাশাপাশি জেনে রাখা ভাল যে ছেলে ও মেয়ে শিশুদের প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার কিছু আলামত রয়েছে (যা সুপরিচিত)। সেগুলোর কোনও একটি পরিলক্ষিত হলে তখন তাকে ‘অপ্রাপ্ত বয়স্ক বা শিশু’ হিসেবে গণ্য করা হবে না। বরং তার উপর সাধারণ প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের অনুরূপ বিধিবিধান প্রযোজ্য হবে। আর এমন ব্যক্তি আত্মহত্যা করলে প্রাথমিকভাবে জাহান্নামের অধিকারী হবে।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
_____________________
উপস্থাপনয়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ওস্তাদ ইব্রাহিম বিন হাসান (হাফি:)