ভূমিকা: সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, আমরা তাঁর প্রশংসা করি, তাঁর নিকট সাহায্য ও ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং তাঁর নিকট তাওবা করি।অতঃপর সুর দিয়ে বক্তব্য দেওয়া জায়েজ নাকি নিষিদ্ধ বিষয়টি ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। কেননা সুর দিয়ে বয়ান দেওয়া বা বক্তৃতার বিষয়টি ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে জায়েজ-নাজায়েজ হওয়া নির্ভর করে বক্তব্যের উদ্দেশ্য, পদ্ধতি, এবং প্রভাবের উপর। সূর দিয়ে বক্তব্য দেওয়া সরাসরি সুন্নাহ পরিপন্থী কি না, তা বুঝতে হলে কিছু বিষয় বিবেচনা করতে হবে: শারঈ দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তাভাবনা করলে সূর দিয়ে বক্তব্য দেওয়ার দুটি ক্ষেত্র রয়েছে। আর তা হচ্ছে; (১). কুরআন তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে সূরের ব্যবহার: এবং (২). কুরআন তিলাওয়াত ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন খুতবা বা বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রে সূরের ব্যবহার। নিম্নে বিষয়টি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হলো:
.
(১). কুরআন তিলাওয়াতের ক্ষেত্রে সূরের ব্যবহার:
কুরআন তিলাওয়াত করার সময় সুর বা তাজবীদ অনুযায়ী সুন্দরভাবে কুরআন তিলাওয়াত করা গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত এবং অত্যন্ত পছন্দনীয়। এটি আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য করা হলে এটি ইবাদতের অংশ। আল্লাহ তাআলা বলেন:”وَرَتِّلِ ٱلۡقُرۡءَانَ تَرۡتِيلًا” “তুমি কুরআন সুস্পষ্ট ও সুন্দরভাবে তিলাওয়াত কর।” (সূরা মুযযাম্মিল, ৭৩: ৪) হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, زَيِّنُوا القُرْآنَ بِأَصْوَاتِكُمْ فإِنَّ الصَّوْتَ الحَسَنَ يَزِيدُ القُرْآنَ حُسْناً “তোমাদের (সুমিষ্ট) শব্দ দ্বারা কুরআনকে সৌন্দর্যমন্ডিত কর। কারণ, মধুর শব্দ কুরআনের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।”(মুস্তাদরাক হাকেম হা/২১২৫, সহীহুল জামে’ হা/৩৫৮১) রাসূল (ﷺ) আরো বলেন, مَا أَذِنَ اللهُ لِشَىْءٍ مَا أَذِنَ لِلنَّبِىِّ أَنْ يَتَغَنَّى بِالْقُرْآنِ “মহান আল্লাহ অন্য কিছু এতো মনোযোগ দিয়ে শুনেন না, যেভাবে তিনি নবীর সুমধুর কন্ঠে স্পষ্ট উচ্চারণে কুরআন তিলাওয়াত শুনেন”।(সহীহ বুখারী হা/৫০২৪:আবু দাউদ হা/১৪৭৩) রাসূল (ﷺ) আরো বলেছেন,حُسْنُ الصَّوْتِ زِيْنَةُ القُرْآنِ، ‘সুন্দর আওয়াজ (কণ্ঠস্বর) কুরআনের সৌন্দর্য”।(সহীহুল জামে‘ হা/৩১৪৪) অন্যত্র রাসূল (ﷺ) বলেন,إِنَّ مِنْ أَحْسَنِ النَّاسِ صَوْتًا بِالْقُرْآنِ الَّذِى إِذَا سَمِعْتُمُوْهُ يَقْرَأُ حَسِبْتُمُوْهُ يَخْشَى اللهَ، ‘মানুষের মধ্যে সুকণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াতকারী সেই ব্যক্তি যার তেলাওয়াত শুনে তোমাদের ধারণা হয় যে, সে আল্লাহর ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত”।(মুওয়াত্ত্বা মালিক হ/৪৬৮; ছহীহুল জামি‘ হা/৭৭৮০; মিশকাত হা/৪৬৫) আবু মূসা আশ‘আরী বলেন, একদা রাসূল (ﷺ) তাঁকে বললেন, ‘যদি তুমি আমাকে গত রাতে তোমার তেলাওয়াত শোনা অবস্থায় দেখতে তাহ’লে তুমি কতই না খুশী হতে! ‘তোমাকে দাউদের সুললিত কণ্ঠের মতো মধুর কণ্ঠ দান করা হয়েছে”।(বুঃ মুঃ মিশকাত হা/৬১৯৪)। রাসূল ﷺ আরো বলেছেন:لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَمْ يَتَغَنَّ بِالْقُرْآنِ وَزَادَ غَيْرُهُ يَجْهَرُ بِهِ “যে ব্যক্তি কুরআন মধুর সুরে তেলাওয়াত করে না, সে আমাদের দলভুক্ত নয়”।(সহীহ বুখারী হা/৭৫২৭) এখানে মধুর সুরে তেলাওয়াতের অর্থ হচ্ছে নিজ স্বভাবজাত সুরে কুরআনকে শ্রুতিমধুর করে তোলা। (নববী, শরহ মুসলিম ৬/৭৮)
.
উপরোক্ত হাদীসগুলোর আলোকে ইমাম ইবনু কাসীর (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৭৪ হি.] বলেছেন:فدل على جواز تعاطي ذلك وتكلفه ، وقد كان أبو موسى كما قال عليه السلام قد أعطي صوتاً حسناً ، مع خشية تامة ورقة أهل اليمن الموصوفة ، فدل على أن هذا من الأمور الشرعية .
“এটি (হাদীসটি) প্রমাণ করে যে কণ্ঠস্বর সুন্দর করার জন্য অতিরিক্ত প্রচেষ্টা করা জায়েজ। আবু মূসা (রা.)-কে যেমন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, তাকে সুন্দর কণ্ঠস্বর দান করা হয়েছিল, সঙ্গে ছিল গভীর ভয় ও ইয়েমেনিদের নরম স্বভাব। এটি ইঙ্গিত করে যে এটি এমন একটি বিষয় যা শরীয়তে গ্রহণযোগ্য”।(তাফসির ইবন কাসীর, খন্ড: ১ পৃষ্ঠা: ৬৩)
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, হাফিজ ইবনু হাজার আসকালানী (রাহিমাহুল্লাহ) [জন্ম: ৭৭৩ হি: মৃত: ৮৫২ হি:] বলেছেন:
وَلَا شَكّ أَنَّ النُّفُوس تَمِيل إِلَى سَمَاع الْقِرَاءَة بِالتَّرَنُّمِ أَكْثَر مِنْ مَيْلِهَا لِمَنْ لَا يَتَرَنَّم ، لِأَنَّ لِلتَّطْرِيبِ تَأْثِيرًا فِي رِقَّة الْقَلْب وَإِجْرَاء الدَّمْع …وَالَّذِي يَتَحَصَّل مِنْ الْأَدِلَّة أَنَّ حُسْنَ الصَّوْت بِالْقُرْآنِ مَطْلُوب ، فَإِنْ لَمْ يَكُنْ حَسَنًا فَلْيُحَسِّنْهُ مَا اِسْتَطَاعَ كما قال ابن أبي مُلَيكة “.
“এতে কোনো সন্দেহ নেই যে মানুষের অন্তর প্রকৃতিগতভাবে সূর বিহীন তিলাওয়াত শোনার থেকে সুরেলা কণ্ঠে তেলাওয়াত এর প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয়। কারণ সুরেলা কণ্ঠ হৃদয়কে কোমল করতে এবং চোখের অশ্রু ঝরাতে বেশি প্রভাব ফেলে। …এবং প্রমাণাদি থেকে যা বোঝা যায় তা হলো পবিত্র কুরআনুল কারিম সুন্দর আওয়াজে তিলাওয়াত করা পছন্দনীয়। আর যদি কারও স্বর সুন্দর না হয়, তবে যতটা সম্ভব তা সুন্দর করার চেষ্টা করা উচিত, যেমনটি ইবনে আবি মুলায়কাহ বলেছেন”।(ফাতহুল বারী ফী শারহিল বুখারী, খন্ড: ৯ পৃষ্ঠা: ৬৩) এবং তিনি আরো বলেছেন: وَأَخْرَجَ اِبْن أَبِي دَاوُدَ مِنْ طَرِيق اِبْن أَبِي مُسْجِعَة قَالَ: كَانَ عُمَر يُقَدِّم الشَّابّ الْحَسَن الصَّوْت لِحُسْنِ صَوْته بَيْن يَدَيْ الْقَوْم “ইবনে আবি দাউদ বর্ননা করেন
ইবনে আবি মুসযিয়া থেকে তিনি বলেছেন: উমর (রা.) তাদের মধ্যে সেই তরুণকে (সালাতে ইমামতি করার জন্য) অগ্রাধিকার দিতেন যার কণ্ঠস্বর ছিল সুন্দর।”(ফাতহুল বারী ফী শারহিল বুখারী, খন্ড: ৯ পৃষ্ঠা: ৮০)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:
قال العلماء : وفي هذا دليل على أن الإنسان لو حسَّن صوتَه بالقرآن لأجل أن يتلذذ السامع ويسر به : فإن ذلك لا بأس به ، ولا يعدُّ من الرياء ، بل هذا مما يدعو إلى الاستماع لكلام الله عز وجل حتى يسر الناس به
“আলেমগণ বলেছেন এ থেকে প্রমাণিত হয় যে কেউ যদি কুরআন তেলাওয়াতের সময় তার কণ্ঠকে সুন্দর করে তোলে যাতে শ্রোতা তৃপ্তি পায় এবং আনন্দিত হয় তাহলে এতে কোনো সমস্যা নেই। এটি রিয়া বা আত্মপ্রদর্শনের অন্তর্ভুক্ত নয় বরং এটি এমন একটি কাজ যা মানুষকে আল্লাহ তা’আলার বাণী শোনার প্রতি উৎসাহিত করে এবং তাদের জন্য কুরআন শোনা আনন্দদায়ক করে তোলে”।(শারহু রিয়াদিস সালিহিন খণ্ড: ৪ পৃষ্ঠা: ৬৬২) সুতরাং উক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে, মধ্যমপন্থা বজায় রেখে স্বাভাবিক সুললিত কণ্ঠে কুরআন তেলাওয়াত করা বাঞ্ছনীয়।সুরের নামে ক্বারীদের তেলাওয়াতে অতি বাড়াবাড়িও নিন্দনীয়। কেননা রাসূল (ﷺ) যে কোন ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি নিষিদ্ধ করেছেন ও দুনিয়াবী খ্যাতির উদ্দেশ্যে কোন জ্ঞান অর্জন করতে নিষেধ করেছেন”।(মুসলিম হা/২৬৭০; তিরমিযী হা/২৬৫৪; সহীহ আত-তারগীব হা/১০৬)।
.
জেনে রাখা ভালো যে সুন্দর কণ্ঠে কুরআন তিলাওয়াত করা উত্তম হলেও গানের সূরে কুরআন তিলাওয়াত করা নিষিদ্ধ এবং এটি ক্বিয়ামতের অন্যতম একটি আলামত। এই মর্মে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন,بَادِرُوْا بِالْمَوْتِ سِتًّا، إمْرَةَ السُّفَهَاءِ، وَكَثْرَةَ الشَّرْطِ، وَبَيْعَ الْحُكْمِ، وَاسْتِخْفَافٌ بِالدَّمِ، وَقَطِيعَة الرَّحِم وَنَشْوًا يَتَّخِذُونَ الْقُرْآنَ مَزَامِيرَ، يُقَدِّمُونَهُ لِيُغَنِّيَهُمْ، وَإِنْ كَانَ أَقَلَّهُمْ فِقْهًا. “ছয়টি বিষয় আসার পূর্বে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ কর। (১). মূর্খদের নেতৃত্ব, (২). অধিকহারে পুলিশ নিয়োগ,(৩). বিচারের ফায়সালা বিক্রয়, (৪). রক্তপাতকে (হত্যা) হালকা মনে করা,(৫). আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা ও (৬). বাদ্যযন্ত্রের সুরে কুরআন তিলাওয়াত করা। তারা গানের সুরে তিলাওয়াতের জন্য এসকল কারীদেরকে প্রাধান্য দিবে যদিও তারা স্বল্প জ্ঞানের হয়”।(মুসনাদে আহমাদ হা/১৬০৮৩; ইমাম আলবানী সিলসিলা সহীহাহ হা/৯৭৯; সহীহুল জামে‘ হা/২৮১২ হাদীসটি বিশুদ্ধ)।
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] কে প্রশ্ন করা হয়:যে ব্যক্তি গানের সুরের সাদৃশ্য করে কুরআন তেলাওয়াত করে এবং তাদের গানের সুরটাকে নকল করার চেষ্টা করে তাদের ব্যাপারে আপনার অভিমত কি? আশাকরি সুন্দর পরামর্শ দিবেন। আল্লাহ তায়ালা আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।
উত্তরে তিনি বলেন:
الحمد لله لا يجوز للمؤمن أن يقرأ القرآن بألحان الغناء وطريقة المغنين بل يجب أن يقرأه كما قرأه سلفنا الصالح من أصحاب الرسول صلى الله عليه وسلم وأتباعهم بإحسان ،فيقرأه مرتلاً متحزناً متخشعاً حتى يؤثر في القلوب التي تسمعه وحتى يتأثر هو بذلك .أما أن يقرأه على صفة المغنين وعلى طريقتهم فهذا لا يجوز .
“আলহামদুলিল্লাহ। কোন মুমিনের জন্য গানের সুরে এবং গায়কের ঢঙে কুরআন তিলাওয়াত করা জায়েয নয়। বরং তার জন্য আবশ্যক হলো পূর্ববর্তী সাহাবী এবং তাদের পূন্যবান অনুসারীগন যেভাবে তেলাওয়াত করেছেন সেভাবে তিলাওয়াত করা। তিলাওয়াত করতে হবে চিন্তিত হয়ে ভয়-ভীতি নিয়ে যাতে করে যে কোরআন শুনবে তার হৃদয়ে এবং যে তিলাওয়াত করবে তার হৃদয়ে প্রভাব ফেলতে পারে। গায়কদের পদ্ধতিতে এটি পাঠ করা জায়েয নয়”।(মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ, খণ্ড/৯; পৃষ্ঠা:২৯০)
.
(২). ওয়াজ, খুতবা বা বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রে সূরের ব্যবহার:
.
যদি বক্তব্য বা আলোচনা ইসলামের পথে দাওয়াত, জুমার খুতবা কিংবা ধর্মীয় কোন বিষয় নিয়ে হয় এবং এর মধ্যে পবিত্র কুরআনের আয়াত তিলাওয়াত করা হয়,
যার মাধ্যমে মানুষকে আল্লাহর দিকে আহ্বান করা হয় সেটুকু অতিরঞ্জন বা বাড়াবাড়ি না করে প্রয়োজন অনুযায়ী স্বাভাবিক সুর দিয়ে দিলে কোনো আপত্তি নেই। এটি এমন হতে হবে যাতে বক্তব্যের উদ্দেশ্য শুধু সুন্দরতা নয় বরং মানুষের হৃদয়ে আল্লাহর কথার প্রভাব বিস্তার করা।কারন সাধারণত খুতবার মধ্যে খতিবের মূল উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর বানী এবং ইসলামের মূল বিষয়গুলো সাধারণ মুসল্লিদের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছে দেওয়া। আর রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এর বক্তৃতার বিষয়ও শ্রোতাদের অবস্থার উপর নির্ভরশীল হতো। তার বক্তব্য অত্যন্ত সহজ, প্রাঞ্জল, এবং হৃদয়গ্রাহী ছিল। তিনি মানুষের জ্ঞানের স্তর ও প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ্য রেখে এমনভাবে কথা বলতেন যা প্রত্যেকেই সহজে বুঝতে পারত। তিনি সাধারণত কোমল ভাষায় কথা বলতেন এবং তাঁর বক্তব্যে দয়া ও মমত্ববোধ স্পষ্ট থাকত। তিনি মানুষের মন ও পরিস্থিতি বুঝে কথা বলতেন এবং কঠিন কথা বলার প্রয়োজন হলে তিনি সুস্পষ্ট উচ্চারণে বলিষ্ঠ কণ্ঠে বক্তব্য দিতেন। মনে হতো, তিনি সেনাবাহিনীকে সতর্ক করছেন। এতে তার গলার রগগুলো ফুলে উঠত, আওয়াজ উঁচু হতো ও চক্ষুদ্বয় লাল হয়ে যেত। আবার কখনো তিনি নরম ভাষায় অন্তর বিগলিত করার মত বক্তব্য দিতেন। এতে শ্রোতাদের দু চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ত। যেমন প্রখ্যাত সাহাবি জাবের বিন আব্দুল্লাহ হতে বর্ণিত,“যখন রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভাষণ দিতেন, তখন তাঁর চক্ষুদ্বয় লাল হয়ে যেত এবং তাঁর আওয়াজ উঁচু হত ও তাঁর ক্রোধ কঠিন রূপ ধারণ করত। যেন তিনি (শত্রু) সেনা থেকে ভীতি প্রদর্শন করছেন।”(সহিহ মুসলিম, হা/৮৬৭) তিনি তাড়াহুড়ো করে বা অতিরিক্ত টেনে লম্বা করে, সুর দিয়ে হেলে দুলে বক্তব্য দিতেন না। এগুলো তার আদর্শ পরিপন্থী কাজ। মা-জননী আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন,“রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তোমাদের মত দ্রুত কথা বলতেন না (বরং তিনি ধীর স্থির ও স্পষ্টভাবে কথা বলতেন।”(সহীহ বুখারী ই: ফা: হা/২০৭৩. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর বিবরণ]। তিনি (আয়েশা রা.) আরও বলেন,তিনি এমন ভঙ্গিমায় কথা বলতেন, যদি গণনাকারী চাইত তাহলে তা গণনা করতে পারত।” (বুখারী ৩৫৬৭, মুসলিম: ৭৭০১) ইবনে হাজার আসকালানি বলেন,المراد بذلك المبالغة في الترتيل والتفهيم “এর অর্থ হলো, সুস্পষ্ট উচ্চারণ এবং বোঝানোর ক্ষেত্রে জোর দেওয়া।”(ইসলাম ওয়েব ফাতওয়া নং-১১১৩৬৬) অর্থাৎ আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কথা বলার ক্ষেত্রে ধীর স্থিরতা অবলম্বন করতেন এবং প্রতিটি শব্দকে সুস্পষ্টভাবে উচ্চারণের ক্ষেত্রে জোর দিতেন।
.
পক্ষান্তরে দ্বীনের দাওয়াত প্রদানের ক্ষেত্রে কুরআনের আয়াত বাদ দিয়ে নরমালি ওয়াজ মাহফিলে, জুমার খুতবা বা অন্য কোন ধর্মীয় বক্তৃতার ক্ষেত্রে গান বা কবিতার মতো করে সুর দিয়ে বক্তব্য দেওয়া শরীয়ত সম্মত নয়। কারণ তা একদিকে যেমন শ্রেষ্ঠ মানব প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাহ পরিপন্থী। তেমনি প্রসিদ্ধ ইমামগন গানের মত সুর করে অধিক টেনে বক্তব্য দেওয়াকে পছন্দ করতেন না। অন্যদিকে সাধারণ মানুষ এসব শ্রুতি মধুর ও আকর্ষণীয় বক্তৃতা তৃপ্তি লাভের উদ্দেশ্যে শ্রবণ করে থাকে; হেদায়েত বা উপদেশ গ্রহণের উদ্দেশ্যে নয়। তাছাড়া এ ধরনের বক্তাদের মনে মানুষকে তার দিকে আকৃষ্ট করার মাধ্যমে জনপ্রিয়তা অর্জনের মনোভাব বা রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। যা বক্তার আমল বিনষ্ট করার পাশাপাশি দাওয়াতের এ মর্যাদাপূর্ণ অঙ্গনকে কুলুষিত করে। সূর দিয়ে বক্তব্য দেওয়া স্বাভাবিকভাবে অপছন্দনীয় এবং দ্বীনের মধ্যে নতুন আবিষ্কার।কেননা ইসলামের ইতিহাসে সূর দিয়ে বক্তব্য দেওয়ার পক্ষে বিশুদ্ধ দলিল পাওয়া যায় না। সুতরাং ইহা থেকে বিরত থাকাই উত্তম।
.
সুর দিয়ে বক্তব্য দেওয়া সুন্নাহ সম্মত নয় মর্মে ইতিহাস বিখ্যাত প্রসিদ্ধ কয়েকজন ইমামের ফাতওয়া।
◆ ইমাম বাগাভী বলেন,মাত্রাধিক শব্দকে টেনে এবং গানের সুরে শব্দকে তরঙ্গায়িত করে বক্তব্য দেওয়া নিষেধ’।(আত-তাহযীব, খন্ড: ২ পৃষ্ঠা:৩৪২)। মিসরের সিনিয়র স্কলার শাইখ আলী মাহফুজ [মৃত্যু: ১৯৪২]
বলেন,الترنم في الخطيب من البدع المحدثة”বক্তাদের সুর দিয়ে বক্তব্য দেওয়া নব আবিষ্কৃত বিদআতের অন্তর্ভুক্ত।” [আল ইবদা ফি মাযাররিল ইবতিদা, পৃষ্ঠা নম্বর ৪৫], অনুরূপভাবে শাইখ বকর আবু জায়েদ একই কথা বলেছেন। [তাসহীহুদ দুআ, পৃষ্ঠা নাম্বর: ৪৫৫]
.
ইমাম ইবনুল জাওযি (রাহিমাহুল্লাহ)-সুর করে বক্তব্য দেয়ার প্রসঙ্গে চিন্তা ব্যক্ত করে বলেছেন,
تأملت أشياء تجري في مجالس الوعظ ، يعتقدها العوام وجهال العلماء قربة ، وهي منكر وبعد . وذاك أن المقرئ يطرب ويخرج الألحان إلى الغناء ، والوعظ ينشد بتطريب أشعار المجنون وليلى ، فيصفق هذا ، ويخرق ثوبه هذا .. ومعلوم أن هذه الألحان كالموسيقى ، توجب طرباً للنفوس ونشوة ، والتعرض لما يوجب الفساد غلط عظيم .. ألا إن الواعظ مأمور بأن لا يتعدى الصواب ، ولا يتعرض لما يفسدهم
“আমি লক্ষ্য করেছি যে, অনেক ওয়াজ মাহফিলে এমন কিছু ঘটনা ঘটে যাকে সাধারণ মানুষ এবং স্বল্প জ্ঞানী বিদ্বানরা ভুল করে আল্লাহর কাছে নৈকট্য লাভের উপায় মনে করে।অথচ সেগুলো অস্বীকৃত, প্রত্যাখ্যাত ও মন্দ কাজ। এটি কতটা আশ্চর্যের বিষয়! যে একজন আবৃত্তিকারী উৎফুল্ল হয়ে গানের সুর বের করে, একজন ধর্ম প্রচারক মাহফিলে লায়লী মাজনুর প্রেমের গান গায় আর শ্রোতাদের মধ্যে কেউ আবেগে উম্মাদ হয়ে হাততালি দেয়, আবার কেউ পোশাক ছিড়ে ফেলে। এটা স্পষ্ট যে, এই ধরনের সুর ও গান মিউজিকের মত মনের মধ্যে আনন্দ ও উচ্ছ্বাস সৃষ্টি করে। অথচ এমন কিছু করা যা মানুষকে পথভ্রষ্ট করতে পারে তা বিশাল ভুল। স্মরণ রাখতে হবে যে একজন বক্তা বা উপদেশ দাতার কাজ হল নিজে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত না হওয়া এবং এমন কিছু না করা যা মানুষকে ভ্রষ্ট করে দেয়।”(সাইদুল খাতের, পৃষ্ঠা নং ১০৭)
.
শাইখ মুহাম্মাদ রশিদ রেজা (রাহিমাহুল্লাহ) সুর দিয়ে বক্তব্য দেওয়ার বিধান উল্লেখ করে বলেছেন:
روى مسلم وابن ماجه عن جابر رضي الله عنه أنه قال : (( كان رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا خطب احمرت عيناه وعلا صوته واشتد غضبه حتى كأنه منذر جيش يقول صبحكم ومساكم )) الحديث . فهذه هي السنة في كيفية أداء الخطبة ، وهذا ما يرجى به التأثير والاتعاظ بها التي شرع لأجله ، وكل أداء يخالفه فهو مكروه ، وأشده كراهة تكلف الألحان والنغمات فيها كما يفعله بعض الترك وغيرهم ، وإذا قيل بحرمة هذه الألحان والنغمات الموسيقية في الخطبة لم يكن بعيداً ؛ لأنه على مخالفته للسنة الصحيحة تشبه بالكفار في خطبهم الدينية وعبادتهم ولو من بعض الوجوه ، فإن لم يكن تشبهاً لاشتراط القصد في معنى التشبه كان تركاً لما أمرنا به من مخالفتهم في أمثال هذه الأمور ، ولما أمر النبي صلى الله عليه وسلم بصيام عاشوراء وقيل له إن اليهود تصومه أمر بمخالفتهم بصيام يوم قبله أو بعده ، ولأنه مفوت لحكمة الدين في الخطبة وهو الزجر المؤثر في القلوب ، والوعظ الذي يزع النفوس ، وهذه النغمات من اللهو الذي ترتاح إليه النفوس وتستلذه ، وترويح النفوس بالمباح غير محظور ، ولكن الخطبة لم تشرع له ، والمساجد لم تبن لأجله . وقد صارت الخطبة في أكثر البلاد الإسلامية رسوماً تقليدية مؤلفة من أسجاع متكلفة كسجع الكهان ، وتؤدى بنغمات موقعة كنغمات القسوس والرهبان
“ইমাম মুসলিম, ইমাম ইবনু মাজাহ প্রখ্যাত সাহাবি জাবের বিন আব্দুল্লাহ হতে বর্ণিত,“যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ভাষণ দিতেন তখন তাঁর চক্ষুদ্বয় লাল হয়ে যেত এবং তাঁর আওয়াজ উঁচু হত ও তাঁর ক্রোধ কঠিন রূপ ধারণ করত। যেন তিনি (শত্রু) সেনা থেকে ভীতি প্রদর্শন করছেন।”(সহিহ মুসলিম, হা/৮৬৭) খুতবা দেওয়ার পদ্ধতি সম্পর্কে এটাই হলো সুন্নতী পদ্ধতি এবং প্রভাব ও উপদেশের ক্ষেত্রে এর মাধ্যমে সফলতা আশা করা যায় এটাই শরয়ী পদ্ধতি।এর বিপরীত সব কিছুই মাকরূহ (অপছন্দনীয়) এবং এর মধ্যে সবচেয়ে ঘৃণিত (মাকরুহ ) হল এতে সুর করা যেমন কিছু তুর্কি এবং অন্যরা করে। যদি বলা হয় যে খুতবায় এসব সুর করা হারাম তবে এটা উদ্ভট কথা নয়। কেননা তা বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমানিত সুন্নাহর বিপরীত হওয়ার পাশাপাশি কিছু ক্ষেত্রে হলেও কাফেরদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ তাদের ধর্মীয় বক্তব্য এবং ইবাদত বন্দিনীর ক্ষেত্রে। যদিও তা উদ্দেশ্যগত ভাবে কাফেরদের সাদৃশ্যপূন্য নয়, তার পরেও এসব ক্ষেত্রে তাদের বিরোধিতা করার স্বার্থে এগুলো পরিত্যাগ করাই কর্তব্য। যেমন যখন নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আশুরার রোজা রাখার নির্দেশ দিলেন তখন তাঁকে বলা হল যে, ইহুদীরাও এই দিনে রোজা পালন করে, এ কথা শুনে তিনি আমাদেরকে নির্দেশ দিলেন যে, আশুরার রোজা একদিন আগে অথবা একদিন পরে মিলিয়ে পালন কর। আর একটি কারন হল যে,বক্তব্যের উদ্দেশ্য হল মানুষের মনে ভয়-ভীতি এবং প্রভাব সৃষ্টি করা কিন্তু সূর দিয় বক্তব্য দেওয়ার ক্ষেত্রে এই উদ্দেশ্যটাই ব্যহত হয়। যদিও সূর মানুষের মনে প্রশান্তি সৃষ্টি করে এবং হালাল পন্থায় মনে বিনোদন সৃষ্টি করে যা হারাম নয়, কিন্তু এসকল খুতবা বা আলোচনা বিনোদনের উদ্দেশ্যে শরীয়ত সম্মত করা হয়নি এবং মাসজিদগুলো এজন্য তৈরি করা হয়নি। অধিকাংশ ইসলামী দেশে এই সকল ওয়াজ বা বক্তৃতা প্রচলিত সামাজিক রশম রেওয়াজে পরিনত হয়েছে যা গনক ও কবিরাজদের ছন্দময় কথার মত সাজিয়ে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে এবং পুরহিত ও সন্ন্যাসীদের সূরে পরিবেশন করা হয়ে থাকে। (মাজাল্লাতুল মিনার: খন্ড: ১৫; পৃষ্ঠা: ২৮)
.
পরিশেষে উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথা পরিস্কার যে গানের সূরে বক্তব্য দেয়া ঠিক নয়। বক্তব্যের উদ্দেশ্য হবে মানুষকে জান্নাতের পথ প্রদর্শন করা ও জাহান্নাম থেকে ভয় দেখানো।যেমন মহান আল্লাহ বলেন “তুমি তোমার রবের পথে হিকমত ও সুন্দর উপদেশের মাধ্যমে আহবান কর.. (সূরা নাহল: ১৬/১২৫)। তাছাড়া সালাফগণ গানের মত সুর করে বক্তব্য দেওয়াকে পসন্দ করতেন না। ইমাম নববী (রাহিমাহুল্লাহ) ও শায়খ আর-রামলী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,”সর্বাধিক উত্তম এটাই যে, বক্তব্যটি যেন সুস্পষ্ট, বিশুদ্ধ, তত্ত্বসমৃদ্ধ, অলঙ্কারপূর্ণ, সাজানো-গোছানো ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়। যেন তা চিৎকার করে ও দীর্ঘ করে টেনে না দেয়া হয়। কেননা এমনটি করা অনুচিত। তার মধ্যে যেন অশ্লীল, অশ্রাব্য, উদ্ভাবিত, মিথ্যা ও প্রয়োগ না করা হয়। কারণ এগুলো সম্পূর্ণরূপে মানুষের অন্তরে অবতরণ করতে ও অবস্থান করতে সক্ষম হয় না এবং আত্মার মধ্যে ভীতি সঞ্চার করতে পারে না। ফলে বক্তৃতার আসল উদ্দেশ্য ব্যহত হয়’ (কিতাবুল মাজমূঊ, খন্ড: ৪ পৃষ্ঠা: ৩৫৬-৩৫৮ ও ৪০০; নিহায়াতুল মুহতাজ, খন্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৩২৬)।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: আব্দুল্লাহিল হাদি বিন আব্দুল জলিল আল মাদানী (হাফিজাহুল্লাহ)।
লিসান্স, মদীনা ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়। দাঈ, জুবাইল দাওয়াহ এন্ড গাইডেন্স সেন্টার, সউদী আরব।