ভূমিকা: ইসলাম যে পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত, রামাদান মাসের ‘সাওম’ তার মধ্যে অন্যতম। সিয়াম পালনের মধ্যে মানুষের জন্য বহু কল্যাণ নিহিত রয়েছে। সুতরাং শরিয়ত সম্মত কারণ ছাড়া রোজা ভঙ্গ করা বা রোজা না রাখা কবিরা গুণাহ এবং ভয়ানক শাস্তিযোগ্য অপরাধ। আর সিয়াম অবস্থায় স্ত্রী সহবাস করা আরো বড় অপরাধ। হাদীসে বিনা কারণে সিয়াম ভঙ্গের ভয়ঙ্কর শাস্তির কথা বর্ণিত হয়েছে। (আল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করুন)
.
হাদিসে এসেছে: আবু উমামা বাহেলী (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন; একদা রাসূল (ﷺ) ফজরের সালাতের সময় আমাদের নিকটে এসে বললেন, গতরাতে আমি একটি সত্য স্বপ্ন দেখেছি। তোমরা তা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ কর। আমার নিকট দু’জন লোক এসে আমার দু’হাত ধরে এক দুর্গম পাহাড়ের কাছে নিয়ে গিয়ে বলল, এতে আরোহণ করুন! আমি বললাম, আমি পর্বতারোহণে সক্ষম নই। তারা বললেন, আমরা শীঘ্রই আপনার জন্য তা সুগম করে দিব। আমি যখনই পা উঠাচ্ছিলাম তখনই সিঁড়িতে পা রাখছিলাম। অবশেষে পর্বতের সমতল ভূমিতে পৌঁছে গেলাম। হঠাৎ বিকট শব্দ শুনে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কিসের শব্দ? তারা বললেন, এটি জাহান্নামীদের আর্তনাদ। আমরা সামনের দিকে অগ্রসর হতেই সেখানে দেখলাম, একদল নারী ও পুরুষের পায়ের গোছায় রশি বেঁধে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে, চোয়াল ফাড়া আছে এবং তা থেকে রক্ত বেরুচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? তারা বললেন, এরা ঐ সকল লোক যারা সময়ের পূর্বে ইফতার করত।…….(মু‘জামুল কাবীর হা/৭৬৬৭; সহীহ ইবনে খুযায়মাহ হা/১৯৮৬; হাকেম হা/২৮৩৭; সহীহ আত তারগীব হা/২৩৯৩; সিলসিলা সহীহাহ হা/ ৩৯৫১; সনদ সহীহ)। উক্ত হাদীসে বর্ণিত ওরা হলো তারা যারা নির্দিষ্ট সময়ের পূর্বে ইফতার করত।
.
প্রিয় পাঠক! একটু চিন্তা করুন; সিয়ান রাখার পরেও যদি এতো বড় শাস্তি হয়, তাহলে যারা সিয়াম পালন করে না বা যারা সিয়াম পালন করে বিনা কারণে ভাঙ্গে এবং নিষিদ্ধ কর্মে লিপ্ত হয় তাদের কিরূপ শাস্তি হবে তা সহজেই অনুমেয়! মুস্তাফা মুহাম্মাদ আম্মারাহ তাঁর তারগীবের টীকায় বলেন, “উক্ত হাদীসের ভাবার্থ এই যে, মহান আল্লাহ তাঁর নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-কে রোযা ভঙ্গকারীদের আযাব সম্বন্ধে ওয়াকেফহাল করেছেন। তিনি দেখেছেন, তাদের সেই দুরবস্থা; তাদের আকার-আকৃতি ছিল বড় মর্মান্তিক ও নিকৃষ্ট। কঠিন যন্ত্রণায় তারা কুকুর ও নেকড়ের মত চিৎকার করছে। তারা সাহায্য প্রার্থনা করছে অথচ কোন সাহায্যকারী নেই। তাদের পায়ের শেষ প্রান্তে (গোড়ালির উপর মোটা শিরায়) জাহান্নামের আঁকুশি দিয়ে কসাইখানার যবাই করা ছাগলের মত তাদেরকে নিম্নমুখে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আর তাদের কশ বেয়ে মুখভর্তি রক্ত ঝরছে! আশা করি নাফরমান বেরোযাদার মুসলিম সম্প্রদায় এই আযাবের কথা জেনে আল্লাহর নিকট তওবা করবে এবং তাঁর সেই আযাবকে ভয় করে যথানিয়মে রোযা পালন করবে।” (সহীহ তারগীব,টিকা ২/১০৯)।
.
ইমাম যাহাবী (রঃ) বলেন, “মুমিনদের নিকটে এ কথা স্থির-সিদ্ধান্ত যে- যে ব্যক্তি কোন রোগ ও ওজর না থাকা সত্ত্বেও রমাযানের রোযা ত্যাগ করে, সে ব্যক্তি একজন ব্যভিচারী ও মদ্যপায়ী থেকেও নিকৃষ্ট। বরং মুসলিমরা তার ইসলামে সন্দেহ পোষণ করে এবং ধারণা করে যে, সে একজন নাস্তিক ও নৈতিক শৈথিল্যপূর্ণ মানুষ। ( ইবনে তাইমিয়া মাজমূ’ ফাতাওয়া খন্ড:২৫ পৃষ্ঠা :২২৫ আল-কাবায়ের, ইমাম যাহাবী পৃষ্ঠা: ৪৯; ফিকহুস সুন্নাহ খন্ড:১ পৃষ্ঠা: ৩৮৪)। বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] উক্ত হাদিস উল্লেখ করার পর বলেন; “এই হলো যারা রোজা ভঙ্গ করত তাদের শাস্তি। তাহলে যারা আদতেই রোজা রাখে না তাদের কী পরিণতি হতে পারে?! আল্লাহর নিকট দুনিয়া ও আখিরাতের নিরাপত্তা প্রার্থনা করছি।” ( ইমাম উসাইমীন মাজমূঊ ফাতাওয়া ওয়া রাসাইল,খন্ড:১৯ পৃষ্ঠা;৮৯)
.
সুতরাং কেউ যদি শরিয়ত সম্মত ওজর ছাড়া শয়তানের প্ররোচনা বা কুপ্রবৃত্তির তাড়নায় রোজা ভঙ্গ করে বা আদতেই রোজা না রাখে তাহলে তার জন্য আবশ্যক হলো, অনতিবিলম্বে লজ্জিত অন্তরে খাঁটি ভাবে আল্লাহর কাছে তওবা করা এবং ভবিষ্যতে আর কখনো জেনে-বুঝে এমনটি না করার অঙ্গীকার করা। অত:পর শরীয়তের বিধান অনুযায়ী কাযা বা কাফফারা আদায় করা। সহবাসের মাধ্যমে রোজা ভঙ্গ করলে তওবার পাশাপাশি যে রোজাটি ভেঙ্গেছে সেটি কাজা করার পাশাপাশি কাফফারা আদায় করা আবশ্যক। স্ত্রী সহবাসের মাধ্যমে রোজা ভঙ্গ করলে তাতে অনুতপ্ত হয়ে খাঁটি অন্তরে তওবার পাশাপাশি দিনের ঐ সময় থেকে ইফতারের সময় পর্যন্ত বাকি অংশ সিয়াম পালন করা, যে রোজাটি ভেঙ্গেছে সেটি কাজা করা, তারপর তার কাফফারা আদায় করাও আবশ্যক। হাদীসে একমাত্র এই কারণে রোজা ভঙ্গ করলে কাফফারা দেয়ার কথা এসেছে। অন্য ক্ষেত্রে আসে নি। লক্ষণীয় হলো, রোজা অবস্থায় স্ত্রী সহবাস করলে-বীর্যপাত হোক বা না হোক-তাতে রোজা ভঙ্গ হয়ে যাবে। এক্ষেত্রে সহবাসে স্ত্রীর সম্মতি থাকলে স্বামী- স্ত্রী উভয়ের উপর কাযা কাফফারা ওয়াজীব হবে।(বুখারী হা/১৯৩৬; মুসলিম হা/১১১১; মিশকাত হা/২০০৪; ইমাম বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ,
খন্ড:১৫ পৃষ্ঠা:৩০৭ ফাতাওয়া লাজনা আদ-দায়েমাহ, খণ্ড:১০ পৃষ্ঠা:৩০২)। কিন্তু যদি সহবাসে স্ত্রীর সম্মতি না থাকে শুধু স্বামী জোরপূর্বক এরূপ করে তাহলে শুধু স্বামীর উপর কাযা ও কাফফারা ওয়াজিব হবে আর স্ত্রীর উপর শুধু উক্ত সিয়ামের কাযা আদায় করলেই যথেষ্ট হবে ইনশাআল্লাহ। (ইবনু মাজাহ হা/২০৪৫; মিশকাত হা/৬২৮৪; ইমাম উসামীন আশ-শারহুল মুমতি‘,খন্ড:৬ পৃষ্ঠা:৪০৪)। এখানে আরো একটি বিষয় লক্ষনীয় যে- স্বামী যদি তার স্ত্রীর সাথে রামাদানের কোন এক দিনে একবার বা একাধিক বার সহবাস করেন তবে তার উপর একবার কাফফারা আদায় করা আবশ্যক হবে; যদি তিনি প্রথমবার সহবাস করার পর কাফফারা আদায় না করে থাকেন। আর যদি তিনি কয়েকদিন দিবাভাগে সহবাস করে থাকেন তবে তাকে সম সংখ্যক দিনের কাফফারা আদায় করতে হবে। অর্থাৎ প্রতিটি দিনের জন্য কাযা কাফফারা আদায় করা ওয়াজিব হবে। এক্ষেত্রে পূর্ব কথার ন্যায় স্ত্রীর সম্মতি থাকলে উভয়ের উপর এই বিধান প্রযোজ্য হবে না থাকলে শুধুমাত্র স্বামীর জন্য প্রযোজ্য।
.
▪️রামাদানে দিনের বেলা স্ত্রীর সাথে সহবাস করলে কাফফারা বা করনীয় কি?এই সম্পর্কে সৌদি আরবের ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) আলিমগণ কে প্রশ্ন করা হলে জবাবে তারা বলেছেন,
.
(১). তিনি যদি তার স্ত্রীর সাথে রামাদানের কোন এক দিবসে একবার বা একাধিক বার সহবাস করেন তবে তার উপর একবার কাফফারা আদায় করা আবশ্যক হবে; যদি তিনি প্রথমবার সহবাস করার পর কাফফারা আদায় না করে থাকেন। আর যদি তিনি কয়েকদিন দিবাভাগে সহবাস করে থাকেন তবে তাকে সম সংখ্যক দিনের কাফফারা আদায় করতে হবে। (২). তার উপর শারীরিক মিলনের কাফফারা আদায় করা ফরয; যদিও তিনি এই ব্যাপারে অজ্ঞ থেকে থাকেন। (৩). সহবাস করার ক্ষেত্রে স্ত্রী যদি স্বামীকে সম্মতি দেয়; তাহলে স্ত্রীর উপরও কাফফারা ফরয হবে। আর যদি স্বামী জোরপূর্বক স্ত্রীর সাথে সহবাস করে তাহলে স্ত্রীর উপর কোন কিছু ফরয হবে না। (৪).খাদ্য খাওয়ানোর বদলে সমমূল্য অর্থ প্রদান করা জায়েয নয়। কারন খাওয়ানোর পরিবর্তে অর্থ প্রদান করলে এতে অর্পিত দায়িত্ব পালন হবে না। (৫). একজন মিসকীনকে তার পক্ষ থেকে অর্ধ স্বা‘ও তার স্ত্রীর পক্ষ থেকে অর্ধ স্বা‘ খাওয়ানো জায়েয। এতে তাদের দুইজনের পক্ষ থেকে ৬০ জন মিসকীনের একজনকে খাওয়ানো হয়েছে বলে গণ্য হবে। (৬). কাফফারার সবগুলো খাদ্য শুধু একজন মিসকীনকে প্রদান করা জায়েয নয়। অনুরূপভাবে অন্য কোন দাতব্য সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানকে প্রদান করাও জায়েয নয়। কারণ তারা হয়তো ৬০ জন মিসকীনের মাঝে খাদ্য বিতরণ করবে না। মুমিনের উচিত শরিয়ত কর্তৃক তার উপর আরোপিত কাফফারাসহ সকল ওয়াজিব পালনে সচেষ্ট হওয়া। আল্লাহই তাওফিক দাতা। (ফাতাওয়া লাজনা আদ-দায়েমাহ, খণ্ড:১০ পৃষ্ঠা:৩২০)
.
▪️কাফফারা আদায়ের নিয়ম কি?
_______________________________
কাফফারার বিষয়গুলোর ধারাক্রম নিম্নরূপ। [অর্থাৎ একটি আদায় করতে সক্ষম না হলে অপরটি করতে হবে। প্রথমটির সামর্থ্য থাকলে দ্বিতীয়টি গ্রহণ করা জায়েজ নেই।]
.
(১). একটি রোজার বিনিময়ে একটি দাস মুক্ত করা। [বর্তমান যুগে যেহেতু দাস-দাসীর প্রথা নেই তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়]।
(২). একটানা (বিরতি হীন ভাবে) ৬০টি রোজা রাখা।
(৩). তাও সম্ভব না হলে ৬০জন মিসকিন তথা গরিব-অসহায় মানুষকে একবেলা পেট পুরে খাবার খাওয়ানো অথবা প্রতিটি রোজার বিনিময়ে অর্ধ সা তথা সোয়া বা দেড় কিলোগ্রাম চাল দেয়া। টাকা দেয়া ঠিক সুন্নাহ পরিপন্থী; তাই টাকা দেয়া যাবেনা। একজন মিসকিনকে ৬০ বেলা খাবার খাওয়ানো যেমন জায়েজ তেমনি ৬০জন মিসকিনকে এক বেলা খাওয়ানোও জায়েজ। (কাফফারা প্রসঙ্গে একটি প্রসিদ্ধ হাদিস বুখারী হা/১৯৩৬; মুসলিম হা/১১১১; মিশকাত হা/২০০৪) জেনে রাখা ভালো যে, একটানা দু’মাস সিয়াম রাখার মধ্যে কোন বাধ্যগত শারঈ ওযর দেখা দিলে সিয়াম ভঙ্গ করতে পারবে। তাতে ধারাবাহিকতা বিনষ্ট হবে না। (ইমাম ইবনু কুদামা, মুগনী খন্ড:৮ পৃষ্ঠা:২৯)
🔰বিশেষ দৃষ্টব্য: রামাদান মাসে সিয়াম অবস্থায় যদি স্বামী-স্ত্রী উভয়ে মুসাফির হয়, সফর কষ্টকর হলে রোযা না রাখাই শ্রেয়। আর ভ্রমণ যদি খুব বেশী কষ্টের না হয় তাহলে সিয়াম পালন করাই উত্তম। এক্ষেত্রে যদি তারা সহবাস করে তবে ঐ সহবাসের কারণে তাদের কোন গুনাহ হবে না, তাদের উপর কোন কাফ্ফারাও ওয়াজিব হবে না এবং দিনের বাকি অংশ পানাহার ও যৌনমিলন থেকে বিরত থাকাও ওয়াজিব হবে না। শুধু তাদের উভয়কে ঐদিনের রোযা কাযা করতে হবে। যেহেতু মুসাফির অবস্থায় রোযা পালন করা তাদের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। (দলিল; সহীহ মুসলিম:২৫০০ আবু দাউদ: ২৪০৭)। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।