পরম করুণাময় অসীম দয়ালু মহান আল্লাহ’র নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহ’র জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র প্রতি। অতঃপর সালাত আদায়কারী ব্যক্তি নারী-পুরুষ রুকু থেকে দাড়িয়ে ‘আল্লা-হু আকবর’ বলে প্রথমে দু’হাত ও পরে দু’হাঁটু কিংবা আগে হাটু পরে হাত মাটিতে রেখে সিজদায় যাবে এ সময় হাত দু’খানা ক্বিবলামুখী করে মাথার দু’পাশে কাঁধ বরাবর মাটিতে রাখবে।হাতের আঙ্গুলগুলো মিলিয়ে রাখবে। কনুই উঁচু রাখবে ও বগল ফাঁকা রাখবে। হাঁটু বা মাটিতে ঠেস দিবে না।সিজদা লম্বা হবে ও পিঠ সোজা থাকবে। যেন নীচ দিয়ে একটি বকরীর বাচ্চা যাওয়ার মত ফাঁকা থাকে। অতঃপর সিজদার মধ্যে দুই পায়ের মাঝে নিদিষ্ট দূরত্ব রাখা সুন্নত নাকি দু-পাঁকে একত্রিত করে মিলিয়ে দেওয়া সুন্নত? এই বিষয়ে ফিকাহবিদ আলেমগণের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ দুটি মত পাওয়া যায়।
.
প্রথম মত: সিজদায় দুই পায়ের মাঝে পৃথক রাখা মুস্তাহাব। এটি জমহুর তথা অধিকাংশ আলেমের মত। এই মতের পক্ষে আলেমগন রাসূল (ﷺ) থেকে প্রমাণিত হাদীসের মাঝে যা সাব্যস্ত হয়েছে তা দ্বারা দলিল গ্রহণ করে বলেন যে,”সিজদার সময় হাঁটু ও উরু প্রসারিত করা মুস্তাহাব” তারা বলেছেন, পা ওই দুটোর ( হাঁটু ও উরুর) অনুসরণ করে অর্থাৎ পা ঐ দুটোরই অংশ। ফলে মূলনীতি হল ওই দুটোর মাঝেও ফাঁকা করা। তাদের দলিল: ইমাম আবু দাউদ আবু হুমাইদ রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণনা করেন তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম এর নামায বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন: “যখন তিনি (ﷺ) সিজদা করতেন, তখন তিনি তার উরু আলাদা রাখতেন।”(সুনানে আবু দাউদ, হা/৭৩৫ শাইখ আলবানী হাদীসটির সনদ জয়ীফ বলেছেন আবার কেউ কেউ হাসান বলেছেন)। উক্ত হাদীসের আলোকে ইমাম শাওকানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:রাসূল (ﷺ) তার উরু আলাদা রেখেছেন” শব্দের অর্থ হল তিনি তার উরু, হাঁটু এবং পা আলাদা রেখেছেন। ইমাম শাফেঈ (রাহিমাহুল্লাহ)-[মৃত্যু: ৭৬৭ খ্রি] বলেন, দু’গোড়ালীর মাঝে এক বিঘত ফাঁক থাকবে (নায়লুল আওত্বার, ২/২৯৭; ইসলামি সাওয়াল জবাব ফাতাওয়া নং-১১৫৫৬৭)
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন,قال الشافعي والأصحاب : يستحب للساجد أن يفرج بين ركبتيه وبين قدميه . قال القاضي أبو الطيب في تعليقه : قال أصحابنا : يكون بين قدميه قدر شبر ” اইমাম শাফেঈ (রাহিমাহুল্লাহ) ও তাঁর অনুসারীরা বলেনঃ সিজদাকারীর জন্য হাঁটু ও পা আলাদা রাখা মুস্তাহাব। আল-কাদি আবুল তাইয়্যেব তার তাফসীরে বলেছেন: আমাদের সঙ্গীরা বলেছেন: তার পায়ের মধ্যে এক হাতের দূরত্ব থাকতে হবে”।(ইমাম নববী আল-মাজমু’,খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ৪০৭)
.
দ্বিতীয় মত: সিজদাহ অবস্থায় দুই পা একত্রে মিলিয়ে দেওয়া মুস্তাহাব। এই মতটি সমসাময়িক ইমামগনের মধ্যে বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] এবং বিগত শতাব্দীর অন্যতম আরেক শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ফাদ্বীলাতুশ শাইখ, ইমাম মুহাম্মাদ নাসিরুদ্দীন আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] সমর্থন করেছিলেন। যারা এই মতের পক্ষে ছিলেন তারা মুমিনদের জননী আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা কর্তৃক বর্ণিত হাদীসটি প্রমাণ হিসেবে উদ্ধৃত করেছেন,আম্মিজান ‘আইশাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) [মৃত: ৫৮ হি.] বলেন, فَقَدْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَكَانَ مَعِي عَلَى فِرَاشِي، فَوَجَدْتُهُ سَاجِدًا رَاصًّا عَقِبَيْهِ مُسْتَقْبِلًا بِأَطْرَافِ أَصَابِعِهِ الْقِبْلَةَ অর্থাৎ রাসূল ﷺ আমার সাথে আমার বিছানাতে ছিলেন। কিন্তু তাকে আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। (অন্ধকারে খুঁজতে গিয়ে) আমি সিজদারত অবস্থায় পেলাম, তখন তার দুই গোড়ালি মিলিত অবস্থায় ছিল, আর আঙ্গুলগুলো ক্বিবলার দিকে মুখ করা ছিল।…(সহীহ ইবনু খুযায়মা, হা/৬৫৪; সহীহ ইবনু হিব্বান, হা/৬৬১৪; সুনানে কুবরা, বায়হাক্বী, হা/২৭৬০ সনদ সহীহ) ইমাম বায়হাক্বী রহ এই হাদীছের পূর্বে অধ্যায় রচনা করেছেন, بابُ ما جاءَ في ضَمِّ العَقِبَينِ في السُّجودِ ‘সিজদায় দুই গোড়ালি মিলিয়ে রাখা সম্পর্কে’।(আস-সুনানুল কুবরা:২/১৬৭) ইমাম হাকেম (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, এই হাদিসটি ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম এর শর্তে সহীহ। আর এটিকে তারা দুজন এ শব্দে বর্ণনা করেননি। এই হাদীস ব্যতীত অন্য কোথাও কেউ গোড়ালী মিলানোর কথা বর্ণনা করেছেন বলে আমি জানি না (ইমাম হাকেম ১/৩৫২; হা/৮৩২)। ইমাম যাহাবী,ইমাম আলবানী হাদীসটি সহীহ বলেছেন।(আলবানী সিফাতু সালাতিন নাবী, খন্ড: ২ পৃষ্ঠা: ৭৩৬)
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:
” الذي يظهر مِن السُّنَّة أن القدمين تكونان مرصوصتين ، يعني : يرصُّ القدمين بعضهما ببعض ، كما في “الصحيح” من حديث عائشة حين فَقَدَتِ النَّبيَّ صلّى الله عليه وسلّم ، فوقعت يدُها على بطن قدميه وهما منصوبتان ، وهو ساجد .
واليد الواحدة لا تقع على القدمين إلا في حال التَّراصِّ .
وقد جاء ذلك أيضاً في “صحيح ابن خزيمة” في حديث عائشة المتقدِّم : ( أنَّ الرسولَ صلّى الله عليه وسلّم كان رَاصًّا عقبيه ) .
وعلى هذا فالسُّنَّةُ في القدمين هو التَّراصُّ ، بخلاف الرُّكبتين
“সুন্নাহ থেকে যে বিষয়টি প্রতীয়মান হয় তা হল, সিজদায় দুই পা একসাথে রাখা অর্থাৎ একে অপরকে স্পর্শ করা, যেমনটি ‘আইশাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহা) [মৃত: ৫৮ হি.] থেকে সহীহ হাদীসে বলা হয়েছে, তিনি বলেন, ‘এক রাত্রিতে আমি রাসূল (ﷺ)-কে বিছানায় না পেয়ে আমার হাত দিয়ে খুঁজতে থাকলাম। অতঃপর আমার হাত তাঁর দু’পায়ের উপর পতিত হয়। তখন তিনি সিজদারত ছিলেন এবং তাঁর পা দু’টি খাঁড়া ছিল।আর এক হাত দুই পায়ের উপর তখনই পতিত হয় যখন পা দুটো মিলানো থাকে।উল্লেখিত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর হাদীসটি সহীহ ইবনে খুযায়মাতেও তা উল্লেখ আছে যে, সিজদায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর দুই পায়ের গোড়ালি মিলিয়ে রাখতেন।এদিকে লক্ষ্য করে দুই পায়ের ক্ষেত্রে সুন্নত হল পা দুটো মিলিয়ে রাখা, দুই হাত এবং দুই হাটু যেভাবে ফাঁকা ফাঁকা করে রাখা হয় সেভাবে রাখার বিপরীত অর্থাৎ দুই পা আর দুই হাঁটু ফাঁকা রাখা হয় কিন্তু দুই পায়ের গোড়ালি ফাঁকা রাখা হবে না পাশাপাশি মিলিয়ে রাখতে হবে।(ইমাম ইবনু উসাইমীন আশ শারহুল মুমতে খন্ড: ৩ পৃষ্ঠা: ১৬৯)
.
পরিশেষে আমাদের বক্তব্য হলো সিজদায় দুই পা কিভাবে থাকবে বিষয়টি মতানৈক্য পূর্ণ তবে দলিলের আলোকে (আল্লাহু আলাম) দুটি পা একসাথে মিলিয়ে রাখাই উত্তম এই বিধান নারী পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।তবে সর্বোপরি বিষয়টি মুস্তাহাব আমল। তাই এটি নিয়ে বাড়াবাড়ি না করে একজন সালাত আদায়কারী সিজদায় তার দুই পা পাকা অথবা মিলানো যেভাবে সহজ হবে সেভাবেই রাখতে পারে। এতে কোন বাধ্যবাধকতা নেই।মহান আল্লাহ আমাদেরকে আকীদা, আমল, কথা, দাওয়াত, চরিত্র ইত্যাদিসহ জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রকৃত সালাফী বা আহলুল হাদীস হওয়ার তৌফিক দান করুন এবং এই বিজয় কাফেলাকে সার্বিকভাবে সর্বত্র নিরাপত্তা দান করুন। আমীন!(আল্লাহই ভাল জানেন)।
_________________________________
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: ওস্তাদ ইব্রাহিম বিন হাসান (হাফি:) শিক্ষক, চর বাগডাঙ্গা সেরাজুল হুদা লতিফিয়া নুরিয়া ইসলামিয়া ও হাফিজিয়া মাদরাসা চাঁপাইনবাবগঞ্জ।