সালাত আদায়কালে নারীদের পায়ের পাতা ঢেকে রাখার বিধান কী

প্রশ্ন: সালাত আদায়কালে নারীদের পায়ের পাতা ঢেকে রাখার বিধান কী? কোন নারী যদি পায়ের পাতা ঢাকা ব্যতীত সালাত আদায় করে তাহলে কি সালাত বাতিল হবে?
▬▬▬▬▬▬▬✿◈✿▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু মহান আল্লাহর নামে শুরু করছি। যাবতীয় প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক মহান আল্লাহর জন্য। শতসহস্র দয়া ও শান্তি বর্ষিত হোক প্রাণাধিক প্রিয় নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহর প্রতি। অতঃপর
প্রত্যেক স্বাধীন শরয়ি ভারপ্রাপ্ত (মুকাল্লাফ) নারীর ওপর সালাতে সারা শরীর ঢেকে রাখা ওয়াজিব; কেবল চেহারা ও দুই হাতের কব্জিদ্বয় ছাড়া। কেননা নারীর গোটা দেহ সতর (আচ্ছাদন যোগ্য)। যদি কোন নারী এমন অবস্থায় সালাত পড়ে যে তার সতরের কোন একটি অংশ যেমন পায়ের গোছা, পায়ের পাতা, মাথা বা মাথার কিয়দাংশ প্রকাশ হয়ে গেছে তাহলে আলেমদের বড় একটি অংশের মতে তার সালাত সহিহ হবে না। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:‏”‏ لاَ تُقْبَلُ صَلاَةُ الْحَائِضِ إِلاَّ بِخِمَارٍ ‏”‏“খিমার পরিধান ছাড়া আল্লাহ্‌ কোন প্রাপ্তবয়স্ক নারীর সালাত কবুল করেন না”।(তিরমিযী হা/৩৭৭; আবু দাউদ হা/ ৬৪১; ইবন মাজাহ হা/৬৫৫)
.
সালাতের মধ্যে মহিলাদের পদদ্বয় আবৃত করা বা উন্মুক্ত রাখার ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রসিদ্ধ দুটি মত পাওয়া যায়:

(১). প্রসিদ্ধ চারটি মাযহাবের মধ্যে মালিকী, শাফেয়ী এবং হাম্বলী মাজহাবসহ অধিকাংশ আলেমদের মতানুযায়ী সালাতের মধ্যে মহিলাদের পদযুগলকে আবৃত করা ওয়াজিব। সঊদী আরবের স্থায়ী ফাতাওয়া কমিটির আলেমগণ এবং বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম ইমাম ইবনু বায (রাহিমাহুল্লাহ) এই মতটিকেই গ্রহণ করেছেন। এই মতের পক্ষে দলীল হল, মুহাম্মাদ ইবনু যায়েদ উম্মু সালামাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহা)-এর সূত্রে অনুরূপ হাদীছ বর্ণনা করেছেন। তিনি নবী (ﷺ)-কে জিজ্ঞেস করলেন যে, মহিলারা ইযার অর্থাৎ দেহের নিম্নাংশের বস্ত্র বা লুঙ্গি ছাড়া শুধু একটি জামা ও একটি ওড়না পরিধান করে ছালাত আদায় করতে পারবে কি? উত্তরে তিনি বললেন, জামাটি যদি এরূপ লম্বা হয়, যা দিয়ে পায়ের পাতা ঢেকে যায় (তাহলে সেটা পরে সালাত আদায় করতে পারবে)’ (আবূ দাঊদ, হা/৬৪০; মিশকাত, হা/৭৬৩; হাকিম, খন্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২৫০)। এ হাদীস দ্বারা নারীর দু’পায়ের পাতা পর্যন্ত আবরণীয় ঢেকে রাখা আবশ্যক প্রমাণিত হয়। কেননা রসূলের বাণী ‘‘পায়ের পিঠ ঢেকে রাখবে’’ দ্বারা পায়ের পিঠ খোলা রাখার নিষিদ্ধতা সাব্যস্ত হয়। উক্ত হাদীসের আলোকে ইমাম খত্তাবী (রা:) বলেছেন:-وفي الخبر دليل على صحة قول من لم يجز صلاتها إذا انكشف من بدنها شيء ، ألا تراه يقول : إذا كان سابغا يغطي ظهور قدميها ، فجعل من شرط جواز صلاتها ، أن لا يظهر من أعضائها شيء “এই হাদিসটি সেইসব আলেমদের মতের বৈধতাকে সমর্থন করে যারা নারীর শরীরের কোনো অংশ অনাবৃত হলে সালাত পড়াকে বৈধ বলে মনে করেননি। আপনি কি দেখতে পাচ্ছেন না যে তিনি (ﷺ) বলেছিলেন: জামাটি যদি এরূপ লম্বা হয় যা দিয়ে পায়ের পাতা ঢেকে যায় (তাহলে সেটা পরে সালাত আদায় করতে পারবে) এভাবে তিনি তার সালাত বৈধ হওয়ার শর্ত করলেন যে তার শরীরের কোন অংশ যেন দৃশ্যমান না হয়”।(মাআলিমুস সুনান খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ১৫৯ শামিলার ক্রমিক নাম্বার অনুযায়ী)

তবে উক্ত হাদীসটি সহীহ জয়ীফ হওয়ার ব্যাপারে সমালোচনা আছে। ইমাম আবূ দাঊদ (রাহিমাহুল্লাহ) নিজে হাদীসটি বর্ণনা করার পর বলেন, ‘হাদীসটি মালিক ইবনু আনাস, বাকর ইবনু মুদার, হাফস ইবনু গিয়াস, ইসমাঈল ইবনু জা‘ফর, ইবনু আবূ যি’ব এবং আবূ ইসহাক-মুহাম্মাদ ইবনু যায়িদ হতে তার মাতা থেকে উম্মু সালামাহ সূত্রে বর্ণনা করেছেন। তাদের কেউই নবী (ﷺ)-এর নাম উল্লেখ করেননি (যঈফ আবূ দাঊদ, হা/৬৪০; মিশকাত, হা/৭৬৩)। তাই বিশুদ্ধ মতে হাদিসটি মারফূ হিসেবে সহীহ নয় বরং মওকুফ তথা আম্মাজান উম্মু সালামাহ (রাদিয়াল্লাহু আনহা) থেকে প্রমানিত। মিশকাতের তাহক্বীক্বে বিগত শতদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম ইমাম আলবানী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন:”একদল একে উম্মু সালামাহর মাওকূফ বর্ণনা বলে উল্লেখ করেছেন। আর এটাই সঠিক, অর্থাৎ মাওকূফ। কিন্তু সনদটি মারফূ ও মাওকূফ কোনভাবেই সহীহ নয়।(আল্লাহই অধিক জ্ঞাত)।বিস্তারিত জানতে দেখুন, ইসলাম সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৯৩০৩৪)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন,

الواجب على المرأة الحرّة المكلفة ستر جميع بدنها في الصلاة ما عدا الوجه و الكفين لأنها عورة كلها ، فإن صلت و قد بدا شيء من عورتها كالساق والقدم والرأس أو بعضه لم تصح صلاتها لقول النبي صلى الله عليه و سلم : ” لا يقبل الله صلاة حائض إلا بخمار ” رواه أحمد وأهل السنن إلا النسائي بإسناد صحيح .و لما روى أبو داود عن أم سلمة عن النبي صلى الله عليه و سلم أنها سألت النبي عن المرأة تصلي في درع و خمار بغير إزار فقال : ” المرأة عورة “وأما الوجه فالسنّة كشفه في الصلاة ، إذا لم يكن هناك أجانب ، أما القدمان فالواجب سترهما عند جمهور أهل العلم ، وبعض أهل العلم يسامح في كشف القدمين ، ولكن الجمهور يرون المنع ، وأن الواجب سترهما ولهذا روى أبو داود عن أم سلمة – رضي الله عنها – أنها سئلت عن المرأة تصلي في خمار وقميص ، قالت ” لا بأس إذا كان الدرع يغطي قدميها ” فستر القدمين أولى وأحوط بكل حال ، أما الكفان فأمرهما أوسع إن كشفتهما فلا بأس ، وإن سترتهما فلا بأس ، وبعض أهل العلم يرى أن سترهما أولى والله ولي التوفيق

“কোন স্বাধীন শরয়ি ভারপ্রাপ্ত (মুকাল্লাফ) নারীর ওপর সালাতে তার সারা শরীর ঢেকে রাখা ওয়াজিব; কেবল চেহারা ও দুই হাতের কব্জিদ্বয় ছাড়া। কেননা নারীর গোটা দেহ সতর (আচ্ছাদন যোগ্য)। যদি কোন নারী এমন অবস্থায় সালাত পড়ে যে তার সতরের কোন একটি অংশ যেমন পায়ের গোছা, পায়ের পাতা, মাথা বা মাথার কিয়দাংশ প্রকাশ হয়ে গেছে তাহলে তার সালাত সহিহ হবে না। যেহেতু নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: “খিমার পরিধান ছাড়া আল্লাহ্‌ কোন প্রাপ্তবয়স্ক নারীর সালাত কবুল করেন না”(মুসনাদে আহমাদ ও সুনান গ্রন্থসমূহে সহিহ সনদে বর্ণিত; কেবল সুনানে নাসাঈ ছাড়া) এবং যেহেতু সুনানে আবু দাউদ-এ উম্মে সালামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে: কোন নারীর জামা ও খিমার পরে, নিম্নাংশে পরিধেয় পোশাক ছাড়া সালাত পড়া সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলেন? তখন তিনি বলেন: নারীর গোটা অংশ সতর। চেহারার ব্যাপারে সুন্নাহ হলো সালাতে চেহারা খোলা রাখা; যদি সেখানে কোন গাইরে মাহরামের উপস্থিতি না থাকে। আর পায়ের পাতাদ্বয় ঢাকা জমহুর (অধিকাংশ) আলেমের মতে ওয়াজিব। কোন কোন আলেম পায়ের পাতা খোলা রাখার অনুমতি দেন। কিন্তু জমহুর আলেম খোলা রাখাকে হারাম মনে করেন এবং ঢেকে রাখাকে ওয়াজিব বলেন। যেহেতু আবু দাউদ উম্মে সালামা (রাঃ) থেকে হাদিস সংকলন করেছেন যে, তিনি এমন নারীর ব্যাপারে জিজ্ঞাসিত হয়েছিলেন: যে নারী খিমার ও কামিজ পরে সালাত পড়ে? তখন তিনি বলেছিলেন: যদি কামিজ পায়ের পাতাদ্বয় ঢেকে রাখে তাহলে অসুবিধা নেই।” তাই সর্বাবস্থায় পায়ের পাতাদ্বয় ঢাকা উত্তম ও অধিক সতর্কতা।আর হাতের কব্জিদ্বয়ের বিষয়ে প্রশস্ততা রয়েছে। যদি হাতের কব্জিদ্বয় খোলা রাখে তাতে কোন অসুবিধা নেই। আর যদি ঢেকে রাখে তাতেও কোন অসুবিধা নেই। কোন কোন আলেমের মতে, কব্জিদ্বয় ঢেকে রাখা উত্তম। আল্লাহ্‌ই তাওফিকের মালিক।(ফাতাওয়া আল-মার’আতুল মুসলিমাহ ইবনে বায পৃষ্ঠা: ৫৭; ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১০৪৬)
.
(২). অপর একদল আলেমদের মতে সালাতের মধ্যে মহিলাদের পদযুগলকে আবৃত করা ওয়াজিব নয়। এটি হানাফীদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং এটি হিজরী ৮ম শতাব্দীর মুজাদ্দিদ শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়াহ (রাহিমাহুল্লাহ)
দ্বারা পছন্দনীয় মত ছিল। শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম ইমাম ইবনু উসাইমিন (রাহিমাহুল্লাহ) এ মতের দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন। এই মতের পক্ষে যুক্তি হচ্ছে মহিলারা সালাত আদায়ের সময় পায়ের পাতা ঢাকা অপরিহার্য হওয়ার পক্ষে রাসূল (ﷺ) থেকে বিশুদ্ধ কোন দলিল নেই। তাছাড়া দুই পায়ের পাতা মহিলার শরীরের এমন একটি অংশ যা সাধারণত সে যখন বাড়িতে থাকে তখন দৃশ্যমান হয়, তবুও পা ঢেকে রাখা বাধ্যতামূলক বলে কোন দলিল নেই। তাই শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ্,ইমাম আলবানী ও শায়খ উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) এই মত গ্রহণ করেছেন।
.
মাওযূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ আল-কুয়েতিয়াহ, কুয়েতি ফিক্বহ বিশ্বকোষে এসেছে, وأما القدمان ، فهما عورة عند المالكية والشافعية غير المزني , وهو المذهب عند الحنابلة , وهو رأي بعض الحنفية .والمعتمد عند الحنفية أنهما ليستا بعورة , وهو رأي المزني من الشافعية , والشيخ تقي الدين ابن تيمية من الحنابلة “দুই পায়ের ব্যাপারে: মালিকী এবং শাফিই (ইমাম মুযনী ব্যতিত) মাযহাবের নিকট আওরাহ তথা পর্দার অন্তর্ভুক্ত। আবার এটি হাম্বলী এবং কতিপয় হানাফি মাজহাবের মতও। আর হানাফী মাযহাবের নিকট সর্বাপেক্ষা নির্ভরযোগ্য মত হল দুই পা আওরাহ তথা লজ্জাস্থানের অন্তর্ভুক্ত নয়।আর শাফিই মাযহাবের মধ্য হতে ইমাম-মুযনী এবং হাম্বলী মাযহাবের শাইখ তাক্বিউদ্দিন শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (আওরাহ) না হওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন”।(মাওযূ‘আতুল ফিক্বহিয়াহ আল-কুয়েতিয়াহ, খন্ড: ৭; পৃষ্ঠা: ৮৬)
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি:]বলেন,শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর মতানুযায়ী স্বাধীন নারীর সমস্ত দেহই আওরাত অর্থাৎ লজ্জাস্থান, শুধু ওইটুকু ছাড়া যতটুকু সাধারণত বাড়িতে থাকাবস্থায় উন্মুক্ত থাকে। আর তা হল- মুখমণ্ডল, কব্জিদ্বয় এবং পদযুগল এবং তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ)-এর যুগে নারীরা গৃহে অবস্থানকালে কামিজ, গাউন, জামা পরিধান করতেন। প্রত্যেকের কাছে দু’জোড়া কাপড় থাকত না। সেই জন্য কাপড়ে হায়েযের রক্ত লেগে গেলে তা ধৌত করে পরিধান করতেন এবং সালাত আদায় করতেন। সাধারণত সে সময় কব্জিদ্বয় এবং পদযুগল ঢাকা থাকত না। এই বিষয়ে কোন স্পষ্ট দলীল না থাকায় আমি আমি শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর মতকেই গ্রহণ করেছি”।(আশ-শারহুল মুমতি, খন্ড: ২; পৃষ্ঠা: ১৬১)।
.
▪️সালাতের মধ্যে কোন নারীর শরীরের কিছু অংশ যদি অনাবৃত হয়ে যায় এবং তাৎক্ষণিকভাবে ঢেকে নেয় কিংবা কোন নারী যদি পায়ের পাতা ঢাকা ব্যতীত সালাত আদায় করে তাহলে কি সালাত বাতিল হবে?
.
যে ব্যক্তি (পুরুষ হোক অথবা নারী হোক) যদি সতর ঢেকে সালাত পড়ছিলেন কিন্তু অনিচ্ছাকৃতভাবে সতরের কিছু অংশ অনাবৃত হয়ে গেছে এবং সে সাথে সাথে ঢেকে নিয়েছে তাহলেও তার সালাত শুদ্ধ হবে। সতরের সে অংশ সাধারণ অঙ্গ হোক অথবা বিশেষ অঙ্গ হোক। উন্মুক্ত অংশ কম হোক অথবা বেশি হোক। পাশাপাশি কোন মহিলা যদি পায়ের পাতা না ঢেকে কিছু দিন সালাত পড়েন এবং পায়ের পাতাসহ ডেকে রাখা অপরিহার্য এই হুকুম সম্পর্কে অবগত না থাকে, তাহলে তার ঐ আগের সালাতগুলো কাযা আদায় করতে হবে না, কারণ সে হুকুম সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণে মাফ হয়ে গেছে। কিন্তু তার উচিত বর্তমানে যে সালাত আদায় করা সেগুলো পায়ের পাতাসহ ডেকে সালাত আদায় করা।
.
হাম্বলী মাজহাবের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ফিকহগ্রন্থ কাশশাফুল কিনা গ্রন্থে বলা হয়েছে:

ولا تبطل الصلاة بكشف يسير من العورة بلا قصد …ولو كان الانكشاف اليسير في زمن طويل ، وكذا لا تبطل الصلاة إن انكشف من العورة شيء كثير في زمن قصير , فلو أطارت الريح سترته عن عورته , فظهر منها ما لم يُعْفَ عنه لو طال زمنه لفُحْشه ولو كان الذي انكشف كل العورة ، فأعادها سريعاً بلا عمل كثير لم تبطل صلاته , لقصر مدته أشبه اليسير في الزمن الطويل ، فإن احتاج في أخذ سترته لعمل كثير بطلت صلاته ”

“অনিচ্ছাকৃতভাবে সতরের কিছু অংশ উন্মুক্ত হয়ে গেলে সালাত বাতিল হবে না। যদি সতরের কিছু অংশ দীর্ঘ সময়ের জন্য উন্মুক্ত থাকে তবুও। আর যদি সতরের বড় একটা অংশ স্বল্প সময়ের জন্য উন্মুক্ত হয়ে পড়ে সে ক্ষেত্রেও সালাত বাতিল হবে না। যদি বাতাসে তার সতর থেকে আচ্ছাদন সরে যায়, এমনকি এতটুকু সরে যায় দীর্ঘসময় যতটুকু উন্মুক্ত রাখা যায় না; এমনকি এতে করে যদি তার সম্পূর্ণ সতর উন্মুক্ত হয়ে পড়ে কিন্তু সে দ্রুত সময়ের মধ্যে আমলে কাছির (বেশি কাজ) না করে ঢেকে নিতে পারে তাহলেও তার সালাত বাতিল হবে না। কারণ সময়ের স্বল্পতা সামান্য সতর বেশি সময় ধরে উন্মুক্ত থাকার সাথে তুল্য। যদি সতর ঢাকতে গিয়ে আমলে কাছির (বেশি কাজ) এ লিপ্ত হতে হয় তাহলে সালাত বাতিল হয়ে যাবে।(কাশশাফুল কিনা; খণ্ড: ১; পৃষ্ঠা: ২৬৯)
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন:

“إذا انكشف كثير وستره في زمن يسير، فإن صلاته لا تبطل، ويُتَصَوَّرُ ذلك فيما لو هبَّت ريحٌ ، وهو راكع وانكشف الثَّوب ، ولكن في الحال أعاده ، فظاهر كلام المؤلِّف أن الصَّلاة تبطل ، والصَّحيح : أنها لا تبطل ؛ لأنه ستره عن قُرْب ، ولم يتعمَّد الكشف ، وقد قال تعالى : ( فَاتَّقُوا اللَّهَ مَا اسْتَطَعْتُمْ ) التغابن/

“যদি সতরের বেশি অংশ সামান্য সময়ের জন্য উন্মুক্ত হয়ে পড়ে তাহলে সালাত বাতিল হবে না। যেমন- ‘কেউ সালাতের রুকুতে ছিলেন, এর মধ্যে তীব্র বাতাসে কাপড় সরে গেল এবং তাৎক্ষণিকভাবে সে কাপড় ঠিক করে নেয়’ গ্রন্থকারের মতে এ ব্যক্তির সালাত বাতিল। কিন্তু সঠিক মতানুযায়ী সালাত বাতিল হবে না। যেহেতু তিনি অতিদ্রুত কাপড়টি পরে নিতে পেরেছেন এবং তিনি তো ইচ্ছাকৃতভাবে সতর খোলেন নি। আল্লাহ তাআলা বলেন: “তোমরা সাধ্যানুযায়ী আল্লাহকে ভয় কর।”(সূরা আত-তাগাবুন, আয়াত: ১৬: আশ শরহুল মুমতি; খণ্ড: ২; পৃষ্ঠা: ৭৫)
.
শাইখ আল্লামা শামসুল হক্ব আযীমাবাদী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, وقال مالك بن أنس : إذا صلت المرأة ، وقد انكشف شعرها ، أو ظُهُور قدميها ، تعيد ما دامت في الوقت “ইমাম মালিক ইবনু আনাস (রাহিমাহুল্লাহ) বলেছেন, ‘যদি কোন নারী মাথার চুল অথবা পায়ের গোছা খোলা অবস্থায় সালাত আদায় করে তাহলে যতক্ষণ পর্যন্ত সে ওয়াক্তের মধ্যে আছে, তাকে পুনরায় সালাত আদায় করতে হবে। (‘আওনুল মা‘বূদ, খন্ড: ২; পৃষ্ঠা: ২৪২)।
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ বলেছেন,

” يجب على المرأة أن تستر جميع بدنها في الصلاة ، بما في ذلك القدمان يجب سترهما ، وأما الوجه ، فإنها تكشفه إذا لم يكن عندها رجال غير محارم لها ، وما مضى من ظهور بعض قدميك في الصلاة ، فإنه معفو عنه إن شاء الله من أجل الجهل ، وبالله التوفيق

“নারীর উপর সালাতে তার সর্বাঙ্গ ঢেকে রাখা ওয়াজিব। অনুরূপভাবে পদযুগলকেও আবৃত করা অপরিহার্য। তবে তার আশেপাশে কোন পরপুরুষ উপস্থিত না থাকলে সালাতে মুখমণ্ডল উন্মুক্ত রাখতে হবে। সুতরাং যে নারী এর বিধান সম্পর্কে অবগত না থাকার কারণে পা উন্মুক্ত করে সালাত আদায় করেছে তাকে পুনরায় ক্বাযা তুলতে হবে না ইনশাআল্লাহ। আল্লাহই ভাল যানেন। (ফাতাওয়া আল-লাজনা আদ-দায়িমাহ, খন্ড: ৫; পৃষ্ঠা: ১৪৩)
.
বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায আন-নাজদী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন,

أما كونها تقضي ما مضى من صلاتها ، فهذا من باب أنها أخلَّت بالشرط ، فإذا كانت صلت صلوات ليست ساترة لقدميها فيها ، فإن الواجب قضاؤها ، لكن إذا كانت جاهلة بالحكم الشرعي ، فلعلَّ الله جل وعلا يعفو عنها فيما مضى ، ولا يكون عليها قضاء ، وقد صح عنه عليه الصلاة والسلام أنه لما رأى رجلاً يصلي وينقر صلاته ، فقال له عليه الصلاة : ( ارجع فصلِّ فإنك لم تصلِّ ) …. ، متفق على صحته ، فأمره النبي صلى الله عليه وسلم أن يعيد هذه الصلاة الحاضرة ، ولم يأمره أن يعيد الصلوات الماضية للجهل ، فإن ظاهر حاله أنه يصلي هذه الصلاة فيما مضى ، ولكن لما كان جاهلاً عذره صلى الله عليه وسلم في الأوقات الماضية وأمره أن يعيد الحاضر ، فدل ذلك على أن من جهل شيئاً من فرائض الصلاة ثم نبه في الوقت الحاضر فإنه يعيد الحاضر ، أما التي مضت فتجزئه من أجل الجهل ، هذا هو مقتضى هذا الحديث ، لأن الرسول صلى الله عليه وسلم لم يأمر هذا المسيء في صلاته أن يعيد صلواته الماضية ، بسبب الجهل وما في ذلك من المشقة ، فهكذا التي صلت صلوات كثيرة قبل أن تعلم وجوب ستر القدمين ، فإنها لا إعادة عليها إن شاء الله على الصحيح ؛ لأنها معذورة بالجهل ، وإنما تلتزم في المستقبل وتستقيم في المستقبل على ستر قدميها وبقية بدنها ، ما عدا الوجه والكفين ، فإنهما ليسا عورة في الصلاة ، عند أهل العلم ، ولكن إذا سترت الكفين خروجاً من خلاف بعض أهل العلم ، فهذا حسن ”

তার ইতিপূর্বের (ছুটে যাওয়া) সালাতগুলোর কাজা আদায় করার ব্যাপারে আর এটা সালাতের শর্ত ছুটে যাওয়ার বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত।যদি সে একাধিক সালাত আদায় করে যে সালাতের মধ্যে তার পা ঢাকা থাকবে না,
তাকে অবশ্যই সেই সালাতের কাযা আদায় করতে হবে। তবে যদি সে শরীয়তের বিধি-বিধান সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে তাহলে আল্লাহ তা’আলা তাকে ইতিপূর্বের বিষয়ে ক্ষমা করে দিবেন। তার ওপর কাযা আদায় করা আবশ্যক নয়। কেননা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি একজন ব্যক্তিকে অপূর্ণাঙ্গ করে সালাত আদায় করতে দেখেছেন। তখন তিনি তাকে বললেন তুমি ফিরে গিয়ে আবার সালাত আদায় কর। কেননা তুমি সালাত আদায় করনি।(সহীহ বুখারী হা/৭৫৭) এখানে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে শুধুমাত্র সেই নামাজটি পুনরায় ফিরিয়ে পড়ার কথা বললেন কিন্তু তিনি তাকে পূর্ববর্তী সালাতের পুনরাবৃত্তি করার নির্দেশ দেননি। বাহ্যিক দৃষ্টি থেকে বোঝা যাচ্ছে যে তিনি এভাবে ইতিপূর্বে আদায় করেছেন অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইতিপূর্বের বিষয়ে বললেন না কারণ ইতিপূর্বে সালাতের ব্যাপারে সে অজ্ঞ ছিল, সঠিক ভাবে জানতো না ফলে তিনি আদেশ করেননি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে শুধুমাত্র সেই সময়ের সালাতটি পুনরায় আদায় করতে বলেছেন। এটাই প্রমাণ করে যে কোন ফরজ এবাদাত ভুলক্রমে যেটা হয়ে যায় সেটা ইতিপূর্বের ইবাদত গুলোর ওপর কোন দায়ভার থাকে না অর্থাৎ পুনরায় আদায় করতে হয় না বরং যে সময়ে যেটা অবগত করা হয় সেটাকেই শুধুমাত্র আদায় করতে হয় পূর্বেরগুলো ছাড় দেওয়া হয়ে যায়। এটাই হলো হাদিসের দৃষ্টিভঙ্গি। কেননা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অজ্ঞতা ও কষ্টের কারণে সালাত আদায়কারীকে তার পূর্ববর্তী সালাতের পুনরাবৃত্তি করার আদেশ দেননি। সুতরাং একই কথা সেই মহিলার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য যে পা ঢেকে রাখা ওয়াজিব হওয়ার আগে অনেক সালাত আদায় করেছিল; সঠিক মত অনুযায়ী সেগুলোর কাযা পুনরায় আদায় করতে হবে না ইনশাআল্লাহ। কারন তার অজ্ঞতার কারণে তাকে ছাড় দেওয়া হয়েছে কিন্তু যখন জানতে পারবে তখন থেকে ভবিষ্যতে মুখ এবং হাত ব্যতীত পাসহ শরীরের অন্যান্য অংশ ঢেকে সালাত আদায় করবে। কারণ আলেমদের মতে এগুলো তথা মুখমন্ডল এবং হাত ডাকা আওরাতের (পর্দার) অন্তর্ভুক্ত নয়, এতটা সত্বেও যদি সে হাত ঢেকে সালাত আদায় করে, যাতে এমন কোনো বিষয় এড়ানো যায় যে বিষয়ে কিছু আলেম মতভেদ করেছেন তবে তা উত্তম।(বিন বায ফাতাওয়া নূরুন ‘আলাদ দারব এবং শাইখের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ফাতওয়া নং-১৪৭৯২)
.
পরিশেষে প্রিয় পাঠক উপরোক্ত আলোচনা থেকে সংক্ষেপে বলা যায় নারীদের জন্য সালাতের সময় পা ঢেকে রাখা এমন একটি বিষয় যা নিয়ে আলেমগণ মতভেদ করেছেন। তবে নিরাপদে থাকার জন্য একজন মহিলার সালাত আদায়ের সময় তার দুই পায়ের পাতা ঢেকে রাখা উচিত যাতে মতভেদ থেকে নিরাপদ থাকা যায়। তবে যদি অনিচ্ছাকৃত কিছু সময়ের জন্য উন্মুক্ত হয়ে যায় তাহলে সমস্যা নেই ইনশাআল্লাহ। পাশাপাশি অতীতে যে নারী এর বিধান সম্পর্কে অবগত না থাকার কারণে পায়ের পাতা উন্মুক্ত করে সালাত আদায় করেছে তাকে পুনরায় সেই সালাতের ক্বাযা আদায় করতে হবে না ইনশাআল্লাহ। কিন্তু ভবিষ্যতে সাবধানতা অবলম্বন করবে। আল্লাহ আমাদেরকে কুরআন সুন্নাহ’র বিধান অনুযায়ী আমল করার তৌফিক দান করুন।(আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
▬▬▬▬▬▬▬✿▬▬▬▬▬▬▬
উপস্থাপনায়: জুয়েল মাহমুদ সালাফি।
সম্পাদনায়: উস্তায ইব্রাহিম বিন হাসান হাফি.
অধ্যয়নরত, কিং খালিদ ইউনিভার্সিটি আবহা, সৌদি আরব।

Share: