জালসা-এ ইস্তিরাহাহ অর্থ সংক্ষিপ্ত বিরতি। অর্থাৎ সালাত আদায়কারী ব্যক্তি নারী-পুরুষ প্রথম ও তৃতীয় রাক‘আতে শেষ করে দ্বিতীয় ও চতুর্থ রাকআত শুরু করার পূর্বে খানিকটা সময় বসাকে জলসায়ে ইসতিরাহাত বলে। জালসা ইস্তেরাহা করার বিধান সম্পর্কে আহালুল আলেমগনের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। এক্ষেত্রে সবগুলো মোট পর্যালোচনা করলে তিনটি মত পাওয়া যায় যেমন:
(১).একদল সালাফদের মতে জালসা ইস্তেরাহা করা সবার জন্য সুন্নাহ। ইমাম শাফিঈ এবং ইমাম আহমাদ ইবনে হাম্বলের দুটি মতের একটি মত এবং আহলে হাদীস ওলামাদের মতে প্রথম ও তৃতীয় রাক্‘আতে দ্বিতীয় সাজদার পর দাঁড়াবার পূর্বে জালসা ইস্তেরাহা অর্থাৎ খানিকটা বসা সুন্নত। তারা বলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব রাসূল (ﷺ) প্রতিটি রাকআতের দুই সিজদাহ থেকে উঠার পর পুনরায় বাম পায়ের উপর সোজা হয়ে বসে যেতেন। তাদের এই মতের পক্ষে দলিল হলো: মালিক ইবনু হুওয়াইরিস হতে বর্ণিত। তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে সালাত আদায় করতে দেখেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেজোড় রাক্‘আতে সিজদাহ হতে উঠে দাঁড়াবার আগে কিছুক্ষণ সোজা হয়ে বসতেন।(সহীহ বুখারী হা/ ৮২৩, আবূ দাঊদ হা/৮৪৪, নাসায়ী ১১৫২, তিরমিযী ২৮৭, সহীহ ইবনু হিব্বান ১৯৩৪, সহীহ আল জামি‘ ৪৭৭৩) এই হাদীসটি সহীহ বুখারীসহ প্রায় অধিকাংশ হাদীসের কিতাবে রয়েছে। উক্ত হাদীসের আলোকে ইমাম খল্লাদ তাঁর কিতাব শারহে কাবীর-এর মধ্যে ইমাম আহমাদ (রহঃ) জলসায়ে ইস্তিরাহাতের ক্ষেত্রে এই হাদীসটি গ্রহণ করেছেন মর্মে স্পষ্ট বলেছেন। ইমাম আহমাদ-এর দু’ উক্তির শেষটি হলো যে, তিনি জলসায়ে ইস্তিরাহাত করেছেন।(দেখুন মিশকাতুল মাসাবিহ হা/৭৯৬ ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য:)
.
(২).অপরদিকে ইমাম আবূ হানীফাহ, ইমাম মালিক, ইমাম আহমাদ এর দ্বিতীয় মত অনুযায়ী, সুফ্ইয়ান সাওরী, আওয়াবী, ইসহাক ও অন্যান্য হানাফী বিশেষজ্ঞগণ বলেন জলসায়ে ইস্তিরাহাত সুন্নাত নয়। তাদের দলীলঃ তিরমিযীর এক রিওয়ায়াতে বর্ণিত আছে যে, আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) বলেন, মহানাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেজোড় রাক‘আতের পর সোজাসুজি পায়ের মুড়ির উপর দাঁড়িয়ে যেতেন। অর্থাৎ- সাজদার পর বসতেন না। ইমাম ত্বহাবী বলেছেন, রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন বিশেষ ওযরের দরুন বসেছেন। যেমন- তিনি হয়ত শারীরিক ক্লান্তি অনুভব করেছেন অথবা বার্ধক্যজনিত দুর্বলতার দরুন কখনো কখনো বসতেন। মুসান্নাফে আবূ শায়বাতে বর্ণিত আছে যে, ‘আবদুল্লাহ ইবনু মাস্‘ঊদ (রাঃ) না বসে সরাসরি দাঁড়িয়ে যেতেন। ইমাম শা‘বী বলেন, ‘উমার (রাঃ) ও ‘আলী (রাঃ) এবং অন্যান্য প্রথম সারীর প্রবীণ সাহাবীগণও না বসে সরাসরি দাঁড়িয়ে যেতেন।
.
(৩).উল্লেখিত দু’টি মতের মধ্যপন্থী মত। সরাসরি দাঁড়াতে যাদের কষ্ট হয় তারা জালসা ইস্তেরাহা করবে। আর যাদের কষ্ট হয় না তারা জালসা ইস্তেরাহা করবে না। এই মতটি ইমাম উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) গ্রহন করেছেন।
.
সর্বোচ্চ ‘উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন, এ মাসআলাটিতে বিদ্বানদের তিন ধরণের মতামত পাওয়া যায়।যথা: প্রথমঃ জালসা ইস্তেরাহা করা সবসময় মুস্তাহাব। দ্বিতীয়ঃ জালসা ইস্তেরাহা করা কখনই মুস্তাহাব নয়। তৃতীয়ঃ উল্লেখিত দু’টি মতের মধ্যপন্থী মত। সরাসরি দাঁড়াতে যাদের কষ্ট হয় তারা জালসা ইস্তেরাহা করবে। আর যাদের কষ্ট হয় না তারা জালসা ইস্তেরাহা করবে না। মুগনী গ্রন্থে (১/৫২৯ দারুল মানার প্রকাশনী) বলা হয়েছেঃ “এই তৃতীয় মতটি দ্বারা হাদীছ সমূহের মাঝে সামঞ্জস্য বিধান করা হয়েছে এবং তা হচ্ছে দু’টি মতের মধ্যপন্থী মত।” অতঃপর পরবর্তী পৃষ্ঠায় বলা হয়েছেঃ ‘আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ফরয নামাযে সুন্নাত হচ্ছে, কোন ব্যক্তি যখন প্রথম দু’রাকাআত শেষ করে উঠবে, তখন দু’হাত দিয়ে মাটিতে ভর করে যেন না উঠে। তবে যদি অতিবৃদ্ধ ব্যক্তি অনুরূপ করতে সক্ষম না হয়, তবে সে হাত দ্বারা মাটিতে ভর করে উঠতে পারে। (হাদীছটি আছরাম বর্ণনা করেন।) এরপর মুগনী গ্রন’কার বলেন, মালেক বিন হুওয়াইরিছ (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে বলা হয়েছে,إِذَا رَفَعَ رَأْسَهُ عَنِ السَّجْدَةِ الثَّانِيَةِ جَلَسَ وَاعْتَمَدَ عَلَى الْأَرْضِ ثُمَّ قَامَ “নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) যখন দ্বিতীয় সিজদা থেকে মাথা উঠাতেন, সোজা হয়ে বসতেন, তারপর যমীনের উপর ভর দিয়ে দাঁড়াতেন।” এ হাদীছটি হচ্ছে সেই সময়ের কথা যখন নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দুর্বল ও বৃদ্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে সরাসরি দাঁড়াতে তাঁর কষ্ট হচ্ছিল। কেননা তিনি বলেন, “আমার শরীর ভারী হয়ে গেছে। তাই তোমরা রুকূ সিজদায় আমার আগ বেড়ে কিছু করো না।” এই তৃতীয় মতকে আমি সমর্থন করি। কেননা মালেক বিন হুওয়াইরিছ (রাঃ) এমন সময় নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)এর নিকট আগমণ করেন যখন তিনি তাবুক যুদ্ধের প্রস্ততি গ্রহণ করছিলেন। আর সে সময় নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন এবং তাঁর দুর্বলতা সুস্পষ্ট হচ্ছিল। ছহীহ্ মুসলিমে বর্ণিত হয়েছে। আয়েশা (রাঃ) বলেন,لَمَّا بَدَّنَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَثَقُلَ كَانَ أَكْثَرُ صَلَاتِهِ جَالِسًا ‘নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর শরীর যখন মোটা ও ভারী হয়ে গিয়েছিল, তখন অধিকাংশ নামায তিনি বসে বসে আদায় করতেন।’ আবদুল্লাহ্ বিন শাক্বীক্ব (রাঃ) আয়েশা (রাঃ) কে প্রশ্ন করলেন, নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) কি বসে বসে নামায আদায় করতেন? তিনি বললেন, نَعَمْ بَعْدَ مَا حَطَمَهُ النَّاسُ ‘হ্যাঁ, যখন তিনি বয়োবৃদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।’ হাফছা (রাঃ) বলেন,مَا رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ صَلَّى فِي سُبْحَتِهِ قَاعِدًا حَتَّى كَانَ قَبْلَ وَفَاتِهِ بِعَامٍ فَكَانَ يُصَلِّي فِي سُبْحَتِهِ قَاعِدًا “আমি রাসূলুল্লাহ্ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)কে কখনো বসে নফল নামায আদায় করতে দেখিনি। তবে মৃত্যুর এক বছর পূর্বে থেকে তিনি বসে নফল নামায আদায় করেছেন।” অপর বর্ণনায় ‘একবছর বা দু’বছর পূর্বে থেকে।’ এ বর্ণনাগুলো সবই ছহীহ্ মুসলিমে রয়েছে। একথার সমর্থন পাওয়া যায় মালিক বিন হুওয়াইরিছ বর্ণিত হাদীছে, যাতে মাটিতে ভর করে দাঁড়ানোর কথা উল্লেখ রয়েছে। আর সাধারণতঃ প্রয়োজন ছাড়া কোন বস্তর উপর নির্ভর করার প্রশ্নই উঠে না। সম্ভবতঃ আমাদের সমর্থনে আবদুল্লাহ্ বিন বুহায়না (রাঃ) বর্ণিত হাদীছটি পেশ করা যায়। তিনি বলেন, ‘নবী (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদা তাদেরকে নিয়ে যোহর ছালাত আদায় করলেন। কিন্তু তিনি দু’রাকাআত পড়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন, বসলেন না।’ এখানে ‘বসলেন না’ শব্দটি দ্বারা সবধরণের বসা বুঝা যায়। অর্থাৎ- জালাসা ইস্তেরাহাতেও বসলেন না। কিন্তু এর জবাবে বলা যায়, এখানে ‘বসলেন না’ বলতে তাশাহুদের জন্য বসা উদ্দেশ্য করা হয়েছে। (আল্লাহ্ই অধিক জ্ঞাত)? (উসাইমীন ফাতওয়া আরকানুল ইসলাম প্রশ্ন নং-২৫৩) ____________________
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।