সালাতে ইমামতির সবচেয়ে বেশী যোগ্য হলেন তিনি, যিনি কুরআনের হাফেয; যিনি (তাজবীদ সহ্) ভালো কুরআন পড়তে পারেন। তাজবীদ ছাড়া হাফেয ইমামতির যোগ্য নয়। পূর্ণ হাফেয না হলেও যাঁর পড়া ভালো এবং বেশী কুরআন মুখস্থ আছে তিনিই ইমাম হওয়ার অধিক যোগ্যতা রাখেন। মহানবী (ﷺ) বলেন, “তিন ব্যক্তি হলে ওদের মধ্যে একজন ইমামতি করবে। আর ইমামতির বেশী হ্কদার সেই ব্যক্তি, যে তাদের মধ্যে বেশী ভালো কুরআন পড়তে পারে।” (সহীহ মুসলিম ৬৭৬; মিশকাত ১১১৮)। রাসূল (ﷺ) আরো বলেন, “লোকেদের ইমাম সেই ব্যক্তি হবে যে বেশী ভালো কুরআন পড়তে পারে। পড়াতে সকলে সমান হলে ওদের মধ্যে যে বেশী সুন্নাহ্ জানে, সুন্নাহর জ্ঞান সকলের সমান থাকলে ওদের মধ্যে যে সবার আগে হিজরত করেছে। হিজরতেও সকলে সমান হলে ওদের মধ্যে যার বয়স বেশী সে ইমাম হবে। আর কোন ব্যক্তি যেন অপর ব্যক্তির জায়গায় তার বিনা অনুমতিতে ইমামতি না করে এবং না কেউ কারো ঘরে তার বসার জায়গায় তার বিনা অনুমতিতে বসে।” (সহীহ মুসলিম হা/৬৭৩, আবু দাঊদ হা/৫৮২, তিরমিযী হা/২৩৫, নাসায়ী হা/৭৮০, ইবনু মাজাহ্ হা/৯৮০, সহীহ আল জামি হা/ ৩১০৪, মিশকাত হা/১১১৭)
.
সুতরাং যে ব্যক্তি ইমামতি করতে চায় তার মধ্যে কমপক্ষে তিনটি আবশ্যকীয় যোগ্যতা থাকা প্রয়োজন। (১). ইখলাস তথা আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়ত থাকা। (২). বিশুদ্ধ কুরআন তিলাওয়াত। (৩). কমপক্ষে সালাতের মৌলিক বিধি-বিধানগুলো জানা; যেন সঠিকভাবে সালাত পড়াতে পারে।
.
কুরআন-সুন্নাহর আলোকে বিশুদ্ধ মত অনুযায়ী
সালাতের ভিতরে হোক অথবা বাইরে হোক কুরআন তিলাওয়াতের সময় তাজবিদের যে সকল বিধিবিধান অনুসরণ না করলে শব্দের বা অর্থের পরিবর্তনের পাশাপাশি অর্থের বিকৃতি ঘটে সেগুলো অনুসরণ করা ওয়াজিব। কিন্তু যেগুলো কেবল তিলাওয়াতের সৌন্দর্য বর্ধন করে অর্থাৎ সেগুলো অনুসরণ না করলেও অর্থের বিকৃতি ঘটে না; সেগুলো অনুসরণ না করলেও কোন গুনাহ নেই ইনশাআল্লাহ। যেমন: – মাখরাজ অনুযায়ী অক্ষরের সঠিক উচ্চারণ করা আবশ্যক। কেননা অনেক ক্ষেত্রে মাখরাজের অনুসরণ না করার ফলে এক অক্ষরের পরিবর্তে অন্য অক্ষর উচ্চারিত হয়। যার কারণে অর্থেরও পরিবর্তন হয়ে যায়। যেমন: القلب (আল ক্বালবু) অর্থ: হৃদয়, অন্তর, অন্তকরণ। الكلب (আল কালবু) অর্থ: কুকুর। এখানে দেখা যাচ্ছে, ق (ক্বাফ) এর স্থানে ك (কাফ) উচ্চারণের কারণে শব্দের অর্থটা সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গেছে। আবার ه এবং ح উভয়েরই বাংলা উচ্চারনে হা বলি বা লিখি। অথচ আরবীতে উভয়ের উচ্চারণস্থল ভিন্ন ভিন্ন (ه উচ্চরণ করতে হয় হলক বা কন্ঠনালির শুরু হতে আর ح উচ্চারণ করতে হয় কন্ঠনালির মাঝখান হতে) এবং উচ্চারণের এ ভিন্নতার কারণে অর্থের মাঝেও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। যেমন: সূরা ফাতেহার প্রথম আয়াতে আমরা বলি اَلْحَمْدُ لله (আলহামদু লিল্লা-হ) অর্থ: সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর জন্য,কিন্তু যদি বলা হয়,اَلْهمْدُ لله (আলহামদুলিল্লাহ) অর্থ: সমস্ত নিভে যাওয়া আল্লাহর জন্য। এখানে দেখা যাচ্ছে ح (হাঁ) এর জায়গায় ه (হা) উচ্চারণ করার কারনে শব্দের অর্থটা সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে গেছে। পাশাপাশি মদ্দে ত্ববাঈ বা এক আলিফ পরিমাণ টেনে পড়াও অনেক সময় জরুরি। অন্যথায় শব্দের অর্থ পরিবর্তন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যেমন: يعف “তিনি মার্জনা করেন” يعفوا “তারা মার্জনা করেন।” এখানে মাদ্দে ত্ববাঈ এর উপর ভিত্তি করে অর্থগতভাবে একবচন বহু বচনে পরিবর্তন হয়ে গেছে! কিন্তু ইজহার, ইকলাব, ইদগাম, ইখফা, গুন্নাহ এবং মাদ্দে তবাঈ ছাড়া অন্যান্য মাদ্দ সমূহ (যেমন: মাদ্দে মুত্তাসিল, মুনফাসিল, লাজিম, আরেযী, লীন, বদল ইত্যাদি), হরফের সিফাত (অক্ষর উচ্চারণের ক্ষেত্রে মোটা-চিকন, কলকলা..) ইত্যাদি কেবল তিলাওয়াতের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। এগুলোর ব্যতিক্রম হলেও অর্থ পরিবর্তন হয় না। (কিছুটা নোট ওস্তাদ আব্দুল্লাহিল হাদী হাফি: থেকে)
.
সালাতে ইমামতি করার সময় বিশেষ করে সূরা ফাতিহা তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে যে ইমামের মাখরাজ অর্থাৎ উচ্চারণে, স্বরচিহ্নে অথবা অক্ষরে ভুলের কারণে যদি অর্থ পরিবর্তন হয়ে যায়, তাহলে কিন্তু তার সালাত বাতিল হিসাবে পরিগণিত হবে এবং এমন ইমামের পিছনে সালাত আদায় করাও জায়েয হবে না। এমনকি অশুদ্ধ তিলাওয়াতকারীর পিছনে শুদ্ধ তিলাওয়াতকারী ব্যক্তির সালাত হবে না। কারণ, দলিলের আলোকে এবং জমহুর ওলামাদের মতে- সূরা ফাতিহা পড়া সালাতের রোকন।এটি ছাড়া সালাত শুদ্ধ হবে না। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা পাঠ করে না তার সালাত হয় না।’ (সহীহ বুখারী হা/৭৫৬; সহীহ মুসলিম, হা/৯০০, ৯০১, ৯০২, ৯০৪, ৯০৬, ৯০৭; ই:ফা: হা/৭৫৮, ৭৫৯, ৭৬০, ৭৬২; মিশকাত, হা/৮২২ ও ৮২৩)। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরো বলেছেন, যে ব্যক্তি কোন সালাত আদায় করল অথচ সূরা ফাতিহা পাঠ করল না, তার সালাত অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। এ কথাটি তিনি তিনবার বলেন।তখন আবু হুরায়রা (রাযিয়াল্লাহু আনহু)-কে জিজ্ঞেস করা হলো, আমরা যখন ইমামের পিছনে থাকি? উত্তরে তিনি বললেন, তুমি চুপে চুপে পড়।’ (সহীহ মুসলিম, হা/৯০৪, ই:ফা: হা/৭৬২; মিশকাত, হা/৮২৩)। ইমাম বুখারী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন, প্রত্যেক সালাতে ইমাম-মুক্তাদী উভয়ের জন্য ক্বিরা‘আত (সূরা ফাতিহা) পড়া ওয়াজিব। মুক্বীম অবস্থায় হোক বা সফর অবস্থায় হোক,জেহরী সালাতে হোক বা সের্রী সালাতে হোক। (সহীহ বুখারী, হা/৭৫৬-এর অনুচ্ছেদ দ্রঃ)
.
পক্ষান্তরে ভুলের বিষয়টি যদি সূরা ফাতিহা ব্যতীত অন্য সূরাতে হয়, সেক্ষেত্রে সালাত ত্রুটিপূর্ণ হলেও কিন্তু তার এবং তার পিছনের লোকেদের সালাত হয়ে যাবে। তবে যে ইমাম সহীহ শুদ্ধ ভাবে কুরআন তেলাওয়াত করতে পারেনা এরূপ অজ্ঞ লোকদেরকে ইমামতির জন্য নিয়োগ করা জায়েয নয়।
.
শাফিঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেছেন, যে ব্যক্তির উচ্চারণ ত্রুটিপূর্ণ তা যদি তিনি সঠিকভাবে উচ্চারণ করতে বা শিখতে সক্ষম হন, তাহলে তার নামায নিজে থেকেই বাতিল হয়ে যাবে এবং তাকে ইমাম হিসেবে অনুসরণ করা জায়েয হবে না আর এ বিষয়ে আলেমদের মধ্যে কোন মতবিরোধ নেই।( ইমাম নববী আল মাজমু খন্ড: ৪, পৃষ্ঠা: ১৬৬)
.
সৌদি আরবের ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) আলিমগণ এবং বিগত শতাব্দীর সৌদি আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ শাইখুল ইসলাম ইমাম ‘আব্দুল ‘আযীয বিন ‘আব্দুল্লাহ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২০ হি./১৯৯৯ খ্রি.] বলেছেন, ‘যে ইমাম বা মুক্তাদী সূরা ফাতিহা তিলাওয়াত করতে মাখরাজে (অর্থাৎ উচ্চারণে) বা স্বরচিহ্নে অথবা অক্ষরে ভুল করে, যার ফলে অর্থ পরিবর্তন হয়ে যায়, তার সালাত অগ্রহণযোগ্য। কেননা সূরা ফাতিহা হলো সালাতের রুকন বা স্তম্ভ। তার জন্য তিলাওয়াত বিশুদ্ধ করা অপরিহার্য, বিশেষ করে সূরা ফাতিহা। এর জন্য তাকে যথাসাধ্য প্রচেষ্টা করতে হবে, কিন্তু কঠোর প্রচেষ্টা করার পরেও যদি শিখতে না পারে, সেক্ষেত্রে এটি ‘আল্লাহ কাউকেও তার সাধ্যের অতিরিক্ত দায়িত্ব অর্পণ করেন না’- তিনি এর অন্তর্ভুক্ত হবে। কিন্তু সে ব্যক্তি যদি ইমাম হয় তাহলে তার পিছনে সালাত আদায় করা যাবে না। এজন্যই যোগ্য, তীক্ষ্ম স্মৃতিশক্তি সম্পন্ন ও বিশুদ্ধ তিলাওয়াতকারী ইমাম নিযুক্ত করা অতীব জরূরী। তবে তার মতই অশুদ্ধ তিলাওয়াতকারী কিংবা তার থেকেও অধম লোকেদের সালাত হয়ে যাবে। (ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ৫২৭; ইমাম বিন বায রাহিমাহুল্লাহ; মাজমূ‘উ ফাতাওয়া ওয়া মাক্বালাতুম মুতানাওয়্যা‘আহ খন্ড: ১২, পৃষ্ঠা: ৯৮-৯৯ ইসলাম সাওয়াল ওয়া জাওয়াব, ফৎওয়া নং-৭০২৭০)।
.
সর্বোচ্চ উলামা পরিষদের সম্মানিত সদস্য, বিগত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন, যে ইমাম কুরআন তেলওয়াতে এমন ভুল পড়ে, যাতে শব্দের অর্থ পরিবর্তন হয়ে যায়,তাহলে তার ইমামতি ও তার পিছনে যে বিশুদ্ধ কুরআন পড়তে পারে তার নামায শুদ্ধ নয়। (ফাতাওয়া ইবনে উাসাইমীন খন্ড: ১, পৃষ্ঠা: ৩৬৯, মাজাল্লাতুল বুহূসিল ইসলামিয়্যাহ, ২০/১৪৮)
.
পরিশেষে, প্রিয় পাঠক! আমরা জানি, ইমাম অর্থ নেতা। সালাত আদায়ে তিনি নেতৃত্ব দেন। সকল শ্রেণীর মুসল্লী তার নেতৃত্বে সালাতে রুকু-সিজদা দেন, উঠেন ও বসেন। তার তাকবীর ধ্বনি শুনে সকলে তার অনুকরণ ও অনুসরণ করেন, কেউই তা লঙ্ঘন করে না। ইমামের এরূপ অনুসরণই হল ইকতিদা। এজন্য ইমাম সাহেব হবেন সর্বপ্রথম সুন্দর চরিত্র-মাধুর্যের অধিকারী। বিশুদ্ধ তেলাওয়াতকারী সুন্নাত সম্পর্কে অধিক জ্ঞানী। তাই গ্রাম অথবা শহরের যে সকল মসজিদে সস্তা দরে অশুদ্ধ তেলাওয়াতকারী ইমাম রাখা হয়, সেসকল মসজিদের দায়িত্বশীলদের বিষয়টি বিবেচনা করা উচিত। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
_____________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।