প্রথমত: রাসূল ﷺ থেকে বর্নিত দলিলগুলো প্রমান করে যে, নামাযের রুকু-সিজদা অবস্থায় কুরআন তিলাওয়াত করা জায়েজ নয়। এমনকি এই বিষয়ে ইবনে আব্দুল বার্র (রাহিমাহুল্লাহ) সহ একদল আলেম ইজমা নকল করেছেন।আর হাদিসে এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। যেমন: প্রখ্যাত সাহাবী আলী রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) [মৃত: ৪০ হি.] থেকে বর্ণিত আছে। তিনি বলেন,نَهَانِي رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنْ أَقْرَأَ رَاكِعًا أَوْ سَاجِدًا”রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আমাকে রুকু’ অথবা সাজদায় কুরআন পাঠ করতে নিষেধ করেছেন”।(সহিহ মুসলিম হা/৯৬৩; ই.ফা. ৯৫৮, ই.সে. ৯৬৯) অপর বর্ননায় ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু ‘আনহু) হতে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেছেন,أَلَا إِنِّي نُهِيتُ أَنْ أَقْرَأَ رَاكِعًا أَوْ سَاجِدًا، فَأَمَّا الرُّكُوعُ فَعَظِّمُوا فِيهِ الرَّبَّ، وَأَمَّا السُّجُودُ فَاجْتَهِدُوا فِي الدُّعَاءِ قَمِنٌ أَنْ يُسْتَجَابَ لَكُمْ “তোমরা শুনে রেখ! আমাকে নিষেধ করা হয়েছে রুকু অবস্থায় কিরাত থেকে এবং সেজদা অবস্থায়। রুকুতে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের শ্রেষ্ঠত্ব ও মর্যাদা বর্ণনা কর। আর সিজদায় তোমরা দোয়া করতে চেষ্টা কর। তোমাদের জন্য দুআ কবুল হওয়ার উপযুক্ত সময় এটাই।”(সহীহ মুসলিম হা/৪৭৯; আবূদাঊদ হা/৮৭৬; ইবনু মাজাহ হা/৩৮৯৯; সুনানে নাসাঈ হ/১১২০)
.
উপরোক্ত হাদিসগুলো থেকে জানা যায় যে, রুকু-সিজদাহ অবস্থায় কুরআন তিলাওয়াত যেমন: সূরা ফাতেহা কিংবা অন্য কোন সূরা কিংবা দু’আ ব্যতীত কোন আয়াত পাঠ করা জায়েজ নাই। এই নিষেধাজ্ঞার হিকমাহ সম্পর্কে আলেমগন বলেন, নামাযের সর্বোত্তম স্তম্ভ দাঁড়িয়ে থাকা এবং সর্বোত্তম যিকির হল কুরআন তিলাওয়াত করা,তাই সর্বোত্তমটিকে সর্বোত্তম স্থানে রাখতে হবে এবং একটি অন্যটির সাথে স্থাপন করা জায়েজ নয়, আবার কেউ কেউ বলেন, কুরআন সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাব,কারণ এটি আল্লাহর বাণী,আর রুকূ’ এবং সিজদা হলো বিনয় ও নম্রতার চূড়ান্ত রূপ।সেক্ষেত্রে রুকু সিজদায় শুধুমাত্র দু‘আই বেশী মানায় অন্য কিছু নয় সুতরাং রুকু সিজদায় অধিক পরিমাণে রুকুর তাসবিহগুলো পাঠ করতে হবে। আর সেজদাহ অবস্থায় সেজদার তাসবিহগুলো পাঠ করার পাশাপাশি অধিক পরিমাণে দুআ করার চেষ্টা করতে হবে। কেননা এ অবস্থায় দুআ কবুলের সম্ভাবনা বেশি।এর দলিল হচ্ছে,আবূ হুরায়রাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন,নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: أَقْرَبُ مَا يَكُونُ الْعَبْدُ مِنْ رَبِّهِ وَهُوَ ساجد فَأَكْثرُوا الدُّعَاء”বান্দা তার প্রভুর সবচেয়ে বেশি নিকটবর্তী হয় সেজদারত অবস্থায়। অতএব, তোমরা বেশি বেশি দোয়া কর।”(সহিহ মুসলিম হা/৪৮২; আবূ দাঊদ ৮৭৫, সহীহ ইবনু হিব্বান ১৯২৮, সহীহ আল জামি হা/১১৭৫) উক্ত হাদীসের আলোকে হাফেয ইবনে হাজার (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: নামাযে দোয়া করার স্থান হচ্ছে সেজদা কিংবা তাশাহ্হুদ।(ফাতহুর বারী (১১/১৮৬) শাইখ বিন বায (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: নামাযে দোয়া করার স্থান: সিজদা ও আত্তাহিয়্যাতু শেষে সালাম ফেরানোর পূর্বে।(মাজমুউ ফাতাওয়া বিন বায; খন্ড: ৮ পৃষ্ঠা:৩১০)
.
উপরোক্ত হাদীসগুলোর আলোকে ইমাম সানআনী (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন: “الْحَدِيثُ دَلِيلٌ عَلَى تَحْرِيمِ قِرَاءَةِ الْقُرْآنِ حَالَ الرُّكُوعِ وَالسُّجُودِ ; لِأَنَّ الْأَصْلَ فِي النَّهْيِ التَّحْرِيمُ”হাদীসটি রুকু ও সিজদা অবস্থায় কুরআন পাঠ করা হারাম হওয়ার ওপর দলিল। কারণ নিষিদ্ধতার ক্ষেত্রে মূলনীতি হলো হারাম হওয়া।(সুবুলুস সালাম: খন্ড: ১, পৃষ্ঠা:২৬৬)।
.
বিগত শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফাক্বীহ, মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও উসূলবিদ, আশ-শাইখুল ‘আল্লামাহ, ইমাম মুহাম্মাদ বিন সালিহ আল-‘উসাইমীন (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ১৪২১ হি./২০০১ খ্রি.] বলেছেন, “لا يجوز للمصلي أن يقرأ القرآن وهو راكع ، ولا أن يقرأ القرآن وهو ساجد” ا”সালাত আদায়কারীর জন্য রুকু অবস্থায় কোরআন পাঠ করা বৈধ নয়। এমনকি সিজদাবস্থায়ও কুরআন তেলোয়াত করা যাবে না।(উসাইমীন;আল-লিক্বাউশ শাহরী; খন্ড: ১, পৃষ্ঠা: ১৮৬)।
.
শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭২৮ হি.] বলেছেন:
” اتَّفَقَ الْعُلَمَاءُ عَلَى كَرَاهَةِ الْقِرَاءَةِ فِي الرُّكُوعِ وَالسُّجُودِ , وَتَنَازَعُوا فِي بُطْلَانِ الصَّلَاةِ بِذَلِكَ عَلَى قَوْلَيْنِ , هُمَا وَجْهَانِ فِي مَذْهَبِ الْإِمَامِ أَحْمَدَ , وَذَلِكَ تَشْرِيفًا لِلْقُرْآنِ , وَتَعْظِيمًا لَهُ أَنْ لَا يُقْرَأَ فِي حَالِ الْخُضُوعِ وَالذُّلِّ
“আলেমগণ একমত যে রুকু এবং সিজদার মধ্যে কিরাআত পাঠ করা মাকরূহ। আর তারা এ কারণে সালাত বাতিল হওয়ার ক্ষেত্রে দুটি মতামতের ওপর মতভেদ করেছেন। ইমাম আহমদ বিন হাম্বাল (রাহিমাহুল্লাহ)-এর মাযহাবে এই দুটি মত রয়েছে। আর এটি কুরআনের মর্যাদার কারণে এবং তার সম্মানার্থে যে নত অবস্থায় তা পাঠ করা হবে না।(আল-ফাতওয়া আল-কুবরা: খন্ড: ২, পৃষ্ঠা: ৩৮৯)।
.
হাফিয যাইনুদ্দীন আবুল ফারজ ‘আব্দুর রহমান বিন শিহাব—যিনি ইবনু রজব আল-হাম্বালী আল-বাগদাদী নামে প্রসিদ্ধ—রাহিমাহুল্লাহ [জন্ম: ৭৩৬ হি.] বলেন,
“وأكثر العلماء على كراهة القراءة في الركوع والسجود ، ومنهم من حكاه إجماعاً .وهل الكراهة للتحريم ، أو للتنزيه ؟ فيه اختلاف .وحكى ابن عبد البر الإجماع على أنه لا يجوز . ومذهب الشافعي وأكثر أصحابنا : أنه مكروه وهل تبطل به الصلاة ، أو لا ؟ فيه وجهان لأصحابنا . والأكثرون على أنها لا تبطل بذلك”
“অধিকাংশ আলেম রুকু ও সিজদার মধ্যে কুরআন তেলোয়াত করা মাকরূহ বলেছেন।আবার তাদের মধ্যে থেকে কেউ কেউ এই নিষেধাজ্ঞের মর্মে ইজমা বর্ণনা করেছেন।এটি কি মাকরুহ তাহরিমি (এমন মাকরুহ যা হারাম) নাকি মাকরূহ তানযিহ (এমন মাকরূহ যা থেকে সতর্ক থাকা উচিত)? এক্ষেত্রে মতভেদ রয়েছে। ইবনে আব্দুল বার্র এর ওপর ইজমা বর্ণনা করেন যে,তা বৈধ হবে না। ইমাম শাফেঈ মাযহাব ও আমাদের (হাম্ভলী মাজহাব) অধিকাংশ আলেমগনের মত হল তা মাকরূহ।আর এ কারণে কি সালাত বাতিল হয়ে যাবে নাকি হবেনা? এক্ষেত্রে আমাদের (হাম্ভলী) মাজহাবে দুটি মত রয়েছে। অধিকাংশ এমতের পক্ষে রয়েছে যে,এ কারণে সালাত বাতিল হবে না।(ইবনে রজব: ফাতহুল-বারী: খন্ড: ৬, পৃষ্ঠা ২৮)।
.
দ্বিতীয়ত: নামাযের রুকু সিজদায় কুরআন তেলোয়াত করা নিষিদ্ধ হলেও দুআ হিসেবে কুরআনের দুআ সম্বলিত আয়াতগুলো পড়া এই নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত নয়। কেননা হাদিসে রুকু-সিজদাহ্ অবস্থায় কুরআন তেলোয়াত করতে নিষেধ করা হয়েছে দু’আ হিসেবে পড়তে নয়,মোটকথা, রুকু ও সেজদা অবস্থায় কুরআনের দুআ সম্বলিত আয়াত সমূহ দুআ হিসেবে পড়তে কোনও আপত্তি নাই। কিন্তু নফল ইবাদতের নিয়তে তিলাওয়াত হিসেবে কুরআনের আয়াত কিংবা সূরা পড়া জায়েজ নয়। তাই নামাজের সিজদায় দু‘আ করার জন্য প্রথমে অবশ্যই সিজদার তাসবিহ পড়ে নিতে হবে। সে হিসেবে ‘‘সুবহানা রাব্বিয়াল আ’লা’’ পড়ার পরই কুরআনে কিংবা হাদিসে বর্নিত দু‘আগুলো পড়া যাবে-হোক সেটি ফরজ, সুন্নাত বা নফল নামাজ। আর সিজদায় কুরআনে বর্নিত দু’আ পড়ার সময় মর্ম ঠিক রেখে সামান্য শাব্দিক পরিবর্তনে পড়া যায যেমন;رَبَّنَاۤ اٰتِنَا فِی الدُّنۡیَا حَسَنَۃً وَّ فِی الۡاٰخِرَۃِ حَسَنَۃً وَّ قِنَا عَذَابَ النَّارِ অর্থ: হে আমাদের রব! আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দিন এবং আখেরাতেও কল্যাণ দিন এবং আমাদেরকে আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন।(সূরা বাকারাহ: ২০১) এই আয়াতটি সিজদায় পড়ার সময়:اللَّهُمَّ رَبَّنَاۤ اٰتِنَا فِی الدُّنۡیَا حَسَنَۃً وَّ فِی الۡاٰخِرَۃِ حَسَنَۃً وَّ قِنَا عَذَابَ النَّارِ”হে আমাদের রব! আমাদেরকে দুনিয়াতে কল্যাণ দিন এবং আখেরাতেও কল্যাণ দিন এবং আমাদেরকে আগুনের শাস্তি থেকে রক্ষা করুন।(সূরা বাকারাহ: ২০১; মুসনাদে আহমাদ হা/১৩১৬৩; সহীহ ইবনু হিব্বান হা/ ৯৩৮)
.
ইমাম আয-যারকাশী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৯৪ হি.]
বলেন:
: ” محل الكراهة ما إذا قصد بها القراءة , فإن قصد بها الدعاء والثناء فينبغي أن يكون كما لو قنت بآية من القرآن ”
“সিজদায় কুরআন পড়া মাকরূহ তখন, যখন কিরাআতের উদ্দেশ্যে তা পড়া হবে। পক্ষান্তরে তা যদি দু’আ অথবা (আল্লাহ্র) প্রশংসা হিসেবে পড়া হয়, তাহলে তা কুরআনী আয়াত দিয়ে কুনূত পড়ার মত হওয়া। আর কুরআনের একটি আয়াত দ্বারা ক্বুনুত পাঠ করা জায়েজ এটি মাকরূহ নয়।(তুহফাতুল মুহতাজ: খন্ড: ২, পৃষ্ঠা:৬১)।
.
শাফি‘ঈ মাযহাবের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফাক্বীহ, ইমাম মুহিউদ্দীন বিন শারফ আন-নববী (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৬৭৬ হি.] বলেন:
” ولو قنت بآية أو آيات من القرآن العزيز وهي مشتملة على الدعاء حصل القنوت ، ولكن الأفضل ما جاءت به السنة ”
“যদি কুরআনের আয়াত দ্বারা কুনুত পাঠ করা হয় যেখানে দু’আ অন্তর্ভুক্ত থাকে, তাহলে কুনুত আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু সর্বোত্তম হলো সুন্নাহতে যা এসেছে তা পাঠ করা।(নববী আল-আযকার: পৃষ্ঠা:৫৯)। ইবনে আল্লান (রাহিমাহুল্লাহ) বলেন,وهذا إذا قصد بالآية الدعاء”আর কুনুত আদায় হয়ে যাবে যখন আয়াত দ্বারা দোয়া উদ্দেশ্য হবে।(বিস্তারিত জানতে দেখুন: ইবনে আল্লান: আল-ফাতুহা-তুর রাব্বানিয়্যাহ শারহুল আযকারিন-নাবাবিয়্যাহ: খন্ড: ২, পৃষ্ঠা: ৩০৮)।
.
সৌদি আরবের ‘ইলমী গবেষণা ও ফাতাওয়া প্রদানের স্থায়ী কমিটির (আল-লাজনাতুদ দাইমাহ লিল বুহূসিল ‘ইলমিয়্যাহ ওয়াল ইফতা) ‘আলিমগণ-কে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে,আমরা এ ব্যাপারে জানি যে,সিজদার মধ্যে কুরআন পাঠ করা জায়েজ নয়। তবে কিছু আয়াত রয়েছে যেখানে দু’আ অন্তর্ভুক্ত থাকে। যেমন আল্লাহ তা’আলা বলেন:ربنا لا تزغ قلوبنا بعد إذ هديتنا “হে আমাদের রব, আপনি হিদায়াত দেয়ার পর আমাদের অন্তরসমূহ বক্র করবেন না”(সূরা আলে ইমরান: ৮) সুতরাং সিজদাবস্থায় কুরআনে বর্ণিত এই দোয়াগুলোর অনুরূপ দোয়া পড়ার হুকুম কি?
জবাবে তারা বলেন,
لا بأس بذلك إذا أتى بها على وجه الدعاء لا على وجه التلاوة للقرآن
“এতে কোনও অসুবিধা নাই যদি দু’আ হিসেবে পাঠ করে; কুরআন তেলাওয়াত হিসেবে নয়।”।(ফাতাওয়া লাজনাহ দায়িমাহ; খণ্ড: ৬; পৃষ্ঠা:৪৪৩) অর্থাৎ নামাজের সিজদায় কুরআনে বর্ণিত দু‘আগুলো তিলাওয়াতের উদ্দেশ্যে পড়া যাবে না বরং দু‘আ হিসেবে পড়তে হবে। (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)।
__________________________
আপনাদের দ্বীনি ভাই:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।