প্রশ্ন: রাসূল (ﷺ) দৈনিক কতবেলা খাবার খেতেন? আহার গ্রহণের ক্ষেত্রে রাসূল (ﷺ) এর আর্দশ কি ছিল?
▬▬▬▬▬▬▬💠💠💠▬▬▬▬▬▬▬
উত্তর: সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) দৈনিক কতবার বা কতবেলা খাবার খেতেন এই মর্মে নির্দিষ্ট করে কোরআন-সুন্নাহয় কিছুই বর্ণিত হয়নি। তবে আজকালকার মানুষের মতো প্রতিদিন তিনবেলা খাবার খাওয়া মুসলিমদের আদিকালের প্রথা ছিল না। বরং রাসূল (ﷺ)-এর সময় আরবের মানুষ সর্বোচ্চ দুই বেলা খাবার গ্রহণ করতেন। একটি দিনের শুরুতে এবং আরেকটি সন্ধ্যায়। (ইসলামি সওয়াল-জবাব ফাতাওয়া নং-১৯৭১৯৩)
.
নবী করীম (ﷺ) মদীনায় আসার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর পরিবারের লোকেরা এক নাগাড়ে দুইদিন যবের রুটি পেট পুরে খাননি। (সহীহ বুখারী হা/৫৪১৬,ইবনু মাজাহ হা/ ৩৩৪৪, তিরমিযী হা/ ২৩৫৭)। বদান্যতা ও দানশীলতায় রাসূল (ﷺ) ছিলেন অতুলনীয়। স্বেচ্ছায় অভাব-অনটন গ্রহণ করে নেয়ার কারণেই তাকে এরূপ সাদাসিধা জীবন-যাপন করতে হয়েছে। রাসূলুল্লাহ দু’দিন একাধারে পেট পুরে খেতে পাননি, একদিন পেটপুরে খেলে অন্যদিনে উপোষ থাকতেন। এটা এজন্য যে, আল্লাহ তা’আলা জমিনের ধনভাণ্ডারের চাবি তার কাছে পেশ করেছিলেন এবং মক্কার একটি পাহাড়কে স্বর্ণে পরিণত করে তার নিকট পেশ করেছিলেন। কিন্তু তিনি এ কথা বলে দরিদ্রতাকেই গ্রহণ করে নিয়েছেন যে, আমি একদিন ক্ষুধার্ত থেকে সবর করব, আরেকদিন খেয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করব। কেননা ঈমান দুই অংশে বিভক্ত; এক অংশ সবরের মধ্যে, অন্য অংশ শুকরিয়ার মধ্যে। যেমন: আল্লাহ বলেছেন, “নিশ্চয় তাতে উপদেশ রয়েছে প্রত্যেক ধৈর্যশীল এবং কৃতজ্ঞ বান্দাদের জন্য।”(সূরাহ্ ইবরাহীম; ১৪/৫, সূরা লুকমান;৩১/৩১, আশ শুআরা-২৬/৩৩)। রাসূল (ﷺ)-এর এ অবস্থা মৃত্যু পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। এমনকি তিনি মৃত্যুর পূর্বে তার বর্মটি এক ইয়াহূদীর কাছে বন্ধক রেখে সামান্য কয়েক সা’ যব ধার গ্রহণ করেছিলেন। অনেকে বলে থাকেন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) শেষ জীবনে ধনী হয়ে গিয়েছিলেন। উপরোক্ত হাদীস দ্বারা তাদের এ দাবী প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। হ্যা, তাঁর হাতে অনেক সম্পদ এসেছিল কিন্তু সেগুলো তিনি নিজের জন্য সংরক্ষণ করেননি। বরং আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সব খরচ করে দিয়েছেন। অবশ্য তিনি সদা সর্বদা অন্তরের ধনী ছিলেন। (মিরকাতুল মাফাতীহ; ফাতহুল বারী ১১ খণ্ড, হা. ৬৪৫৪; আল কাশিফ ১০ম খণ্ড, ৩৩১১ পৃ.)
.
এক বর্ননায় এসেছে একমাস পর্যন্ত রাসূল (ﷺ)-এর ঘরে রুটি বানানো হয়নি। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন,একবার আবু বকর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আমাদের নিকট ভেড়ার একটি পা পাঠালেন। আমি তা ধরে রাখলাম, আর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এটি কাটলেন। অথবা আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বললেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তা ধরলেন এবং আমি তা কাটলাম। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বললেন, যিনি এটা বর্ণনা করেছেন তিনি বললেন, এই (ঘটনাটি) বাতি ছাড়ায় ছিল। অতঃপর আয়িশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) বলেন, মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর পরিবারবর্গের উপর এক মাস পর্যন্ত এমন অতিবাহিত হয়েছে, যখন তারা রুটিও বানাননি এবং হাড়িও চড়াননি। (মুসনাদে আহমাদ হা/২৪৬৭৫, সহীহ আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হা/৩২৭৬)ক্ষুধার যন্ত্রণা এতটাই কষ্ট সাধ্য ছিল যে, রাসূল (ﷺ) ক্ষুধার যন্ত্রণায় ন্যুব্জ (বাঁকা) হয়ে যেতেন। নু‘মান ইবনে বাশীর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) এক বক্তৃতায় বলেন, মানুষকে দুনিয়া কীভাবে পেয়ে বসেছে- তা উল্লেখ করে ওমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) বলেছিলেন, আমি একদিন রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে ক্ষুধার যন্ত্রণায় ন্যুব্জ হয়ে যেতে দেখেছি। পেট ভরার মত নিম্ন মানের খেজুরও তাঁর নিকট ছিল না। (সহীহ মুসলিম, হা/২৯৭৮; মুসনাদে আহমাদ, হা/৩৫৩)
.
ইমাম ইবনুল ক্বাইয়্যিম (রাহিমাহুল্লাহ) [মৃত: ৭৫১ হি.] বলেছেন,খাবারের ক্ষেত্রে রাসূল ﷺ-এর বৈশিষ্ট্য ছিল তিনি সামর্থানুযায়ী আহার করতেন। অভাবগ্রস্ত হলে সবর করতেন। এমনকি কখনো কখনো তিনি ক্ষুধার তাড়নায় পেটে পাথর পর্যন্ত বাঁধতেন। তিনি ছোট বা বড়,স্বাধীন বা দাস, আরাবী কিংবা মুহাজির কারো দাওয়াতকে অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করতেন না। (ইবনুল ক্বাইয়িম, যাদুল মা‘আদ,১ম খণ্ড, পৃ. ১৪৭)। সিমাক ইবনে হারব (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নু’মান ইবনে বাশীর (রাঃ)-কে বলতে শুনেছি। তিনি বলেছেন, তোমরা কি পানাহারের ব্যাপারে যা ইচ্ছা তা গ্রহণ কর না? (অর্থাৎ নিশ্চয় গ্রহণ করছ)। অথচ আমি দেখেছি তোমাদের নবী তৃপ্তি সহকারে পেট ভরে সাধারণ খেজুরও খেতে পাননি। (সহীহ মুসলিম হা/৭৬৫০, ইবনে হিব্বান হা/৬৩৪০, শামায়েলে তিরমিযি হা/১১)। ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) এবং তার পরিবারবর্গ একাধারে কয়েক রাত অনাহারে এমনভাবে কাটাতেন যে, তারা আহার্য বস্তুর কোন কিছুই পেতেন না। আর অধিকাংশ সময় তাদের খাবার হতো যবের রুটি। (অর্থাৎ ধারাবাহিক যবের রুটিও পেতেন না)। (ইবনে মাজাহ, হা/৩৩৪৭; মুসনাদে আহমাদ, হা/২৩০৩; মুসনাদুল বাযযার, হা/৪৮০৫; মুজামুল কাবীর, হা/১১৭৩৩)
.
রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সামনে পরিবেশন করা খাবার ও পানীয় কখন ফেরত দিতেন না আবার কোন (খাবার) না থাকলে, তার জন্য জুড়াজুড়িও করতেন না। তাঁর নিকটে পবিত্র যেকোন খাবার আসলে, তা তিনি খেতেন। তিনি কখনো খাবারের দোষ-ত্রুটি বর্ণনা করতেন না। তাঁর রুচি হলে খেতেন; না হলে ছেড়ে দিতেন। (সহীহ বুখারী, হা/৩৫৬৩; সহীহ মুসলিম, হা/২০৬৪)। আয়েশা (রাযিয়াল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত, তিনি একবার ‘উরওয়াহ (রাহিমাহুল্লাহ)-এর উদ্দেশ্যে বললেন, ভাগ্নে! আমরা নতুন চাঁদ দেখতাম, আবার নতুন চাঁদ দেখতাম। এভাবে দু’মাসে তিনটি নতুন চাঁদ দেখতাম। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর কোন ঘরেই আগুন জ্বালানো হত না।’ (সহীহ বুখারী, হা/২৫৬৭, সহীহ মুসলিম, হা/২৯৭২)। রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নয়জন স্ত্রী একত্রে ছিলেন, তাদের দিন-কাল এভাবে অতিবাহিত হত যে, কারো ঘরেই আগামীকালের জন্য এক সা’ গম কিংবা অন্য কিছু খাদ্য দানা সঞ্চয় রেখে রাত শুরু হত না। (মিরকাতুল মাফাতীহ; ফাতহুল বারী ৪র্থ খণ্ড, হা. ২০৬৯; আল কাশিফ ১০ম খণ্ড, ৩৩১১পৃ) (আল্লাহই সবচেয়ে জ্ঞানী)
_______________________
উপস্থাপনায়:
জুয়েল মাহমুদ সালাফি।